আমি তার চোখে একই কামনা দেখেছি -‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে
মাকসুদা
আক্তার প্রিয়তী। বাংলাদেশী মেয়ে। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনার জন্য পাড়ি
জমান আয়ারল্যান্ডে। পড়াশোনার সঙ্গে জড়ান মডেলিং-এ। নিজের চেষ্টা আর সাধনায়
অর্জন করেন মিস আয়ারল্যান্ড হওয়ার গৌরব। নিজের চেষ্টায়ই বিমান চালনা
শিখেছেন। ঘর সংসার পেতেছেন আয়ারল্যান্ডেই।
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজন্যে। আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব-
আমরা সবাই বলি, অতীতকে ভোলা যায় না। আসলে অতীতকে হয়তো কোনো এক স্মৃতির ভাঁজে তুলে রেখে ভোলা যায় তা ঠিক, শুধুমাত্র অতীত থেকে যেই অভিজ্ঞতা নেয়া হয়েছে তা ভোলা যায় না। এখন দেখবার বিষয়, ওই অভিজ্ঞতাকে আসলে কোনো ভাবে কাজে লাগাচ্ছে তার গতানুগতিক জীবনে। ওই অভিজ্ঞতা অনেক শক্তিশালীও হতে পারে, অনেক শক্তিশালী।
আমি ধীরে ধীরে জীবন থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছি।
আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি আমার আরেক জীবন অভিজ্ঞতা।
মানুষ নাকি একা থাকতে পারে না। হ্যাঁ, তাতো পারেই না। আমি পুরো একটা বছর সম্পূর্ণ একা কাটিয়েছি, কিছুটা জনমন শূন্য। ফ্লাইং স্কুল এবং বাসা, এর মধ্যবর্তী আর কিছুই নেই, কোনো কথাও নেই। কথা বা মিশব কার সাথে নিজ দেশের কমিউনিটির কাছে তো আমি পরিত্যক্ত খারাপ নারী। আয়ারল্যান্ডে আশার পর থেকেই ছিলাম বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে, উঠা-বসা ছিল ওইখানেই। কখনোই আইরিশ কালচার বা আইরিশদের সাথে মিশিনি বা মিশার আগ্রহ জন্মায়নি, যার কারণে কোনো আইরিশ আমার পরিচিত বা বন্ধু ছিল না। আর পড়াশোনা বা কাজের খাতিরে যাদের সাথে কথা হতো, খুবই ফরমাল ছিল, ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রেখেছি। তাদের সাথে কখনো সখ্যতা বা বন্ধুত্ব তৈরি করার চেষ্টা করিনি।
আমার জীবন খুব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সমাজ ছাড়া, পরিবার ছাড়া, বন্ধু ছাড়া। বাংলাদেশেও তেমন আর ফোনে যোগাযোগ হতো না। বাংলাদেশে তখন ইন্টারনেট সবার ঘরে ঘরে ছিল না, এমনকি আয়ারল্যান্ড আমার বাসায়ও না, কারণ তার ব্যয় সুলভমূল্যে না থাকায় এফোর্ড করা সম্ভব ছিল না। আর সরাসরি ফোন করা তো আকাশের চাঁদ হাতে নেয়ার মতো। আর তাছাড়া পরিবার আমার এই পরিস্থিতির কথা জানলেও বা কী? ওদের কিছু করার নেই। ওরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
এই ভাবেই কেটে যাচ্ছে দুই বাচ্চা নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন। অভিযোগ নেই কারোর ওপর, এটি তো আমারই পছন্দ করা অপশন ছিল, যেই অপশনের আর কোনো অপশন আমার জন্য এভেইলেবেল ছিল না। ঘর থেকে বাইরে গিয়ে যে তিন ইউরো দিয়ে একটা কফি কিনে খাব, সেটি ভাবতো হতো একশ’বার। এই তিন ইউরো খরচ করা তো আমার জন্য বিলাসিতা, এই তিন ইউরো দিয়ে আমি একটা পাউরুটি এবং একটা গরুর দুধ কিনতে পারব।
এমনি সময়, আবরাজ হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এর মধ্যে মৌনীরা ও অসুস্থ হয়ে পড়ল, তারও অবস্থা খারাপ, দু’জনই হাসপাতালে। দু’জনকে দুই রুমে রাখা হয়েছে। আর আমি একা। বাচ্চাদের বাবার সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে যেহেতু সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না, যত রকম সুযোগ বিবেক পেত আমাকে আঘাত করার, আপ্রাণ চেষ্টা করত আমাকে ভাঙার। আমার প্রতি তার এতটাই ঘৃণা বা হিংসা। বাইরের মানুষ তার বাইরের প্রচ- ভদ্ররূপটা দেখেছে, কিন্তু সে ততটাই হিংস্র তার মনে, অপর সাইডে যার দেখা সবাই পায় না। হিউম্যান সাইকোলজি যারা পড়ে, তারা বিষয়টি জানে। আমাদের মানুষের মনে এক হিংস্র পশু বাস করে, যা আমরা জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচার, বিবেক দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখি। কিন্তু অনেক সময়ই ওই হিংসা পশু তালা ভেঙে বের হয়ে আসে, অনেকে পারে তা নিয়ন্ত্রণ করতে, অনেকেই পারে না। নির্ভর করছে যার যার ব্যক্তিত্বের ওপর। সুতরাং আমিই জানি বিবেকের অপর পাশের চেহারা, যেই চেহারা তার পরিবারও দেখেনি, আর আশপাশের মানুষ তো দূরের কথা। বাইরের মানুষের কাছে সে অনেক ঠা-া, ভদ্র-নম্র একজন মানুষ, যা আসলেই সে এমন। কিন্তু এটি বাহ্যিক রূপ বা চরিত্র ব্যক্তিত্ব। বাহ্যিক বা চরিত্র বলতে যা বোঝায় তা হলো, আমি বা আপনি মানুষের সামনে আমাদের বিশিষ্ট, ব্যবহার, উপস্থাপন করি। যেটা দিয়ে আমাদের বাইরের মানুষ বিচার করে আমরা মানুষটা কেমন। কিন্তু ভিতরে মানুষটিকে খুব কম মানুষই চিনতে পারে। আমার বয়স তখন কম, জীবন দেখেছি কম, বুঝিও কম। এত কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার তখন হয়নি।
যা বলছিলাম, আবরাজ ও মৌনীরা অসুস্থ, হাসপাতালে। দুই বাচ্চার পাশে দু’জন এডাল্ট বা অভিভাবক থাকতে হবে। আমি একা, তো একবার এই রুমে আরেকবার ওই রুমে। পাবলিক হাসপাতাল তাই আমার বিশ্রাম নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, আছে শুধু একটা চেয়ার। সারারাত চেয়ারে বসে বসে কাটিয়েছি। বাচ্চাকে ফেলে রেখে হাসপাতালে থেকে বের হয়ে গিয়ে খাওয়ার পর্যন্ত অনুমতি নেই। হাসপাতাল তো আর আমাকে খাওয়াবে না। সুতরাং, বাচ্চাদের বাবা এই মোক্ষম সময়টি বেছে নিয়েছেন আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। তিনি আসেননি বাচ্চাদের দেখতে এবং আমাকে সহযোগিতা করতে। সারাদিন না খেয়ে আছি। গোসল নেই, ঘুম নেই। দু’টি কোলের বাচ্চা অসুস্থ, দু’জনই মায়ের সান্নিধ্য চায়। আমি হিমশিম খাচ্ছি। দুই বাচ্চার শরীরে স্যালাইন লাগানো, যার মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টা এন্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সুই একটা এই মাসুম বাচ্চার ছোট হাতে লাগানো। একটু নাড়াচাড়া করলে হয়তো গুতা লাগে, তাতে ব্যথা লাগে, কান্না করে ওঠে। আমরা বড়রাই একটু অসুস্থ হলে কেমন লাগে, আপনারাই বলেন? তো, আমি সারারাত সজাগ থেকে যখন চেয়ারে বসে থাকি তখন হাসপাতালের ইন্টারনেট ব্যবহার করি। খুবই ধীরগতির ইন্টারনেট, যেহেতু শেয়ারিং এবং ফ্রি। রাত তখন ১২টা বাজবে, হঠাৎ করেই ফেসবুকে একটা মেসেজ আসলো। খুব অবাক হলাম, সাথে মৃদু হাসি। এতদিন, এত বছর পর বার্তা আসলো তার কাছ থেকে? আমি খুব আগ্রহের সাথে প্রতিউত্তর দিতে লাগলাম। বার্তাটি ছিল আয়ারল্যান্ডে আসার পর আমার প্রথম যার প্রতি ক্রাশ হয়েছিল। সিওর আমার প্রতিও তার ক্রাশ হয়েছিল, আমি সেই সিগন্যাল পেয়েছিলাম। যেহেতু বাংলাদেশ হাই, হ্যালো শুভেচ্ছা বিনিময় হতো প্রায়ই। কিন্তু ব্যাপারটি তেমন গভীরভাবে কাছাকাছি গড়ায়নি। কারণ তার বাংলাদেশে এক প্রেমিকা ছিল। পরবর্তীতে আমিও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যাই এবং তার প্রেমিকাকে সে বিয়ে করে ফেলে। সবকিছু ছিমছাম। ভালো লাগার ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়। সুদর্শন, ভদ্র ছেলে। পড়াশোনার প্রতি খুবই আগ্রহী, আয়ারল্যান্ডে খুব ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পড়াশোনা করে যাচ্ছে। কোন ধরনের বাজে অভ্যাস নেই, কোথাও দেখা হলে দেখতাম চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকত। কারো আগে-পিছে নাই, সে তার পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত। যে কেউ দেখলে বলবে অসাধারণ ছেলে।
সেই ছেলে হঠাৎ ফেসবুকে বার্তা পাঠানোর পর, বুক ধক করে উঠল। জানালাম আমি শিশু হাসপাতালে। আমাকে সে বলল, সে কাজ করে কাছেই, সে কাজ শেষে যাওয়ার সময় দেখা করে যাবে। আমিও হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। সে আসলো, কিছু খাবার নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তার বিয়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। আমার ব্রেকআপের কথা শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করল। আমি যে খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেটা তার বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। আমিও অনেকদিন পরে কথা বলার মানুষ পেয়ে বড় বড় করে অনেক কথা বললাম। ধরে নিলাম তার নাম নিশো। হাসপাতালে আমি পাঁচ দিন ধরে এক কাপড়ে কোনো গোসল নাই, কাপড় পরিবর্তন হয়নি। অনুধাবন করতে পারছেন আমার অবস্থা কেমন ছিল। হাসপাতাল থেকে আমার বাসা অনেক দূরে, যার কারণে বাচ্চাদের রেখে বাসায় যাওয়া হয়নি। নিশো এর মধ্যে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছে, খবর নিচ্ছে। ব্যাপারটি আমার কাছে খুব ভালো লাগছে। মনের কোনো এক কোণায় যেন শক্তি উৎপাদন হচ্ছে, নুয়ে থাকা মাথা উঠাচ্ছি আস্তে আস্তে।
নিশো পরের রাতে কাজ শেষে রাত একটার দিকে আবারও আসে। এসে বলল চলো তোমাকে বাসায় নিয়ে যাই, তোমার ফ্রেশ হওয়ার দরকার, কাপড় পরিবর্তন করার দরকার।
আমি মনে মনে বললাম, ‘হায় খোদা আমার শরীর থেকে আবার দুর্গন্ধ বের হচ্ছে না তো?’
আমি নার্সকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলাম আমাকে দুই তিন ঘণ্টার জন্য যাওয়ার অনুমতি দিতে। বললাম, আমি ভোর পাঁচটার মধ্যে চলে আসব। নার্স আমার অবস্থা বিবেচনা করে বুঝতে পারলেন এবং দয়া করে যেতে দিলেন। আমি বাসায় গেলাম দ্রুত গোসল আর কিছু জিনিস আনতে।
বাসা থেকে হাসপাতালে ফেরার পথে ঘটল যত সব পাগলামি ঘটনা।
আমি তো তার পাশে বসে আছি গাড়িতে, নিশো কথা বলছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কেমন যেন ধুুকুর ধুকুর করছে, আমি জানি না তার মধ্যেও তেমন করছিল কিনা। নিশোও আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল, তার চাহনি আমার ভেতরটা ওলটপালট করে দিচ্ছিল। আমি বারবার তার হাতের দিকে তাকাচ্ছি। সে যখন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলে, আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথা বলে মনে হচ্ছে সেই যে, আট/দশ বছর আগে তার প্রতি ক্রাশ খেয়েছিলাম, সেই তখনকার মুহূর্ত। তখনকার আকাক্সক্ষাগুলো এক সাথে জড়ো হচ্ছে। শরীরের রক্তনালীগুলোতে নিঃসৃত হরমোনগুলো ছুটোছুটি করছে। শরীরের অঙ্গের কোনো কিছুই যেন স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। আজ অনেক বছর পর কোথায় যেন হারিয়ে যেতে মন চাইছে। হঠাৎ করেই উপলব্দি করলাম আমরা হাসপাতালের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। এতখানি পথ এত দ্রুত কীভাবে চলে আসলাম? আশ্চর্য! আমার মনে তার (নিশো) হাত ধরার কামনা জাগছে। মন বলছে, ‘এই তুমি কি আমার হাত ধরবে? তোমার আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁট স্পর্শ করবে? প্রথমে উপরের ঠোঁটে, তারপর নিচের ঠোঁটে, তারপর দুই ঠোঁটে?’ কিন্তু সে তো এই কথাগুলো শুনতে পারছে না। আমার ধুক ধুক করে যে হৃদয়ের স্পন্দন হচ্ছে, তা তো শোনার কথা, সে কি শুনতে পারছে? আমি স্পষ্ট তার চোখে দেখতে পারছি তার জড়তা তাকে বধির করে রাখার চেষ্টা করছে। আমার বায়োলজিক্যাল শরীর আমাকে জানান দিল, এই দেহে বিপরীত লিঙ্গের কোনো স্পর্শ পায়নি প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে আমরা মাত্র তিন/চার মিনিটের দূরত্বে। আমি শেষমেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রেখে, লাজ লজ্জা ভুলে, গাড়ির গিয়ার স্টিকের ওপরে রাখা তার হাতের ওপর আমার হাত রেখে নিশোকে আজকের উপকারের জন্য ধন্যবাদ জানালাম। ভাবলাম, সবকিছু বাদ, অন্তত তাকে তো একটা ধন্যবাদ জানাতে হবে। হ্যাঁ অস্বীকার করব না, তাকে আমার ছুঁয়ে দেখতে মন চাচ্ছিল অবচেতন মন থেকে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখন, সে এটাকে যেভাবে নেয় নেবে। তার ব্যাপার। আমি তার চোখে ওই একই কামনা দেখেছি, অনুভব করেছি না ছুঁয়েই। আমি তার হাতের ওপরে আমার হাত আলতেভাবে রাখলাম, রাখার সাথে সাথে সারা শরীরে বিদ্যুতের মতো কিছু প্রবাহ হলো। আমি নিশ্চিত, আপনি জীবনের কোনো না কোনো সময় ওই রকম স্পর্শে শরীরে তড়িৎ প্রবাহের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হয়েছে। নিজের শরীর এতদিন নিজের কাছেই অপরিচিত, প্রাণহীন ছিল। অদ্ভুত! নিশো আমার হাতে স্পর্শ পেয়ে এমনভাবে তাকাল, যেন সে কয়েক হার্টবিট স্কিপ করেছে, যেন সে কল্পনাই করেনি আমি কখনো এমনভাবে নিজ থেকে তার হাত ধরব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নিশো আমার হাতটি চেপে ধরল। এ এমন ছোঁয়া যে শিরায় শিরায় তার প্রবাহ হচ্ছে, যেন এমন স্পর্শের জন্য মরতে পারি বারবার। মুহূর্তেই আমি আমার বিষাদ, কষ্ট, স্ট্রাগল সবকিছু যেন ভুলে গেলাম। গাড়ি থামল হাসপাতালের পিছনের গেটে। মুহূর্তগুলো যেন ওই জায়গায় ফ্রিজ হয়ে আছে। নিশো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার দিকে মানে আমার ঠোঁকের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি তার চোখের দিকে। দু’জনই খুব তৃষ্ণার্ত, ঢুক গিলছি বারবার। এ তো নিশ্চয় পানির জন্য তৃষ্ণার্ত নয়। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে আসছে। দু’জন দু’জনের হৃদয়ের ধুক ধুক স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ নিশোর একটা হাত আমার ঘাড়ের চুলের পিছনে রাখতেই আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। ছেলেরা মনে হয় জানেই যে তাদের হাতে সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের শরীর কাবু করার জন্য জাদু দিয়ে দিয়েছেন। অটোম্যাটিকভাবে আমার চোখ বন্ধ হতেই নিশো তার ঠোঁট আমার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল। উফফ কী অদ্ভুত সুখ বয়ে যাচ্ছে আমার শরীরের ভিতর দিয়ে। সে তার ঠোঁট আর জিভ দিয়ে আমার দুই ঠোঁট চুষল, একবার উপরের ঠোঁট, একবার নিচের ঠোঁট। ঠিক যেমনটি আমি মনে মনে আকাক্সক্ষা করছিলাম প্রথম দিকে। আমার শরীর তখনও নিস্তেজ। তার দুই হাত দিয়ে আমার মুখখানা আলতো করে ছুঁয়ে সারা মুখে চুমু খেতে লাগল। আমার বাধা দেয়ার কোনো স্নায়ু কাজ করেনি তখন, ব্রেইনের নিয়ন্ত্রণ ছিল সম্পূর্ণ তার হাতে। আর আমি সাধারণ এক বায়োলজিক্যাল প্রাণীর মতো উপভোগ করছি, যার কামনা মনের কোনো এক কোণায় হয়তো পোষণ করছিলাম। চুম্বনের শেষটুকু সে শেষ করেছে, তার এক হাত দিয়ে আমার কোমরে হাত দিয়ে তার শরীরের আরও কাছে সে আনতে চাইল, যেন সে আরও বেশি কাছে আমাকে পেতে চায়। কয়েকবার আমার কোমরে হাত দিয়ে তার শরীরের সন্নিকটে আনার প্রচেষ্টা আমাকে আরও উত্তেজিত করে ফেলছিল। এই পুরো ব্যাপারটির সময়ের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ৪/৫ মিনিট। হঠাৎ করেই অনুধাবন করলাম, ওহ হ্যাঁ আমরা তো হাসপাতালের বাইরে, রাস্তার ওপর পার্কিং করে আছি। আমার যেতে হবে। চলে আসলাম, সুখের স্বর্গ থেকে বাস্তবতায়। বিদায়ের সময় লজ্জা পাচ্ছিলাম নিশোর চোখের দিকে তাকাতে, কি থেকে কি হয়ে গেল। আফসোস হচ্ছিল না, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এক ঝলক তার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বিদায় নিয়ে চলে আসলাম হাসপাতালের ভিতরে।
এরপর থেকে আমার প্রতি নিশোর যতœ, খোঁজ-খবর, কেয়ার করা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আর আমি এইদিকে ভাবতে লাগলাম, আমার একঘরা নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হিসেবে কাউকে পেলাম, কোথায় যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হলো স্বপ্নের রাজকুমার বুঝি এতে বছর পর এলো আমার জীবনে। ঘোড়ায় চড়ে এসে আমার জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, বেদনা সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর আমাকে জীবনের সব সুখগুলো দিয়ে ভরিয়ে রাখবে। আমি শুধু তার হয়ে থাকব সারাজীবন।
আমার শুরু হলো নিশোকে নিয়ে কল্পনার জগৎ। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাবনাগুলো আচ্ছন্ন করে রাখত। আর এই আচ্ছন্নতা ছিল সুখের। প্রেমে পড়লে আপনার মন যেমন স্বতঃফূর্ত থাকে, আমি সেই প্রেমের নৌকায় ভাসছি। কিছুক্ষণ পর পর নিশো আমার খবর নিচ্ছে, আমার প্রচ- ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমার বোবার জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে। আগেও আপনাদের বলেছি, ফ্লাইং স্কুলের বাইরে আমার কোথাও যাওয়া হতো না, আর সেখানে পড়াশোনার বিষয় ছাড়া কথা হতো না। আমি তখনও আইরিশদের সাথে ইন্ট্রিগ্রেইট করতে পারতাম না, সত্যি কথা বলতে কখনো সাদা চামড়ার পুরুষদের প্রতি আকর্ষণও বোধ করতাম না তখন। কোন ক্রাশ জাতীয় অনুভূতি হয়নি তাদের প্রতি। কেন, কে জানে? এটি আমার ব্যক্তিত্বের একটি বাধা বলব। নিজ কালচারের বাইরে কারোর সাথে মিশতে না পারার কারণে আমি যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম ‘নিশো তার মাঝে এক জাদুর কাঠি।’ আমার সাথে সে কাজ শেষে ২/১ দিন পর পর দেখা করতে আসত। তার সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময় কাটানো আমি খুব উপভোগ করতাম। যদিও সে আমাকে আরও গভীরভাবে পেতে চাইত, বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইত। ওই পর্যন্ত না যেতে পারলে যে, সে কিছুটা নিরাশ হতো বুঝতে পারতাম। কিন্তু তখন ব্যাপারটি আমার কাছে মিষ্টি লাগত। আমাদের মধ্যে সুখ-দুঃখগুলো বিনিময় হতো। মনে মনে বিশ্বাস বেড়েছিল দু’জন দু’জনকে মনে হয় খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। খুব তাড়াতাড়ি দু’জনের কাছাকাছি চলে এসেছি। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের খোলা-খুলি কিছু কথাবার্তা আদান-প্রদান করার কারণে খুব তাড়াতাড়ি মানুষজন জেনে গেলে আমাদের সম্পর্কের কথা। আসলে নিশো চাচ্ছিল সবাই জানুক আর আমারও বাধা দিতে মন চায়নি। কারণ লুকোচুরি করার তো কিছু নেই, তাই না? নিশোর ছায়াতে আমি সিকিউর অনুভব করতাম। এরই মধ্যে নিশো আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রপোজ করে। সে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়। সেই মুহূর্তে পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মেয়ে মনে হয় আর কেউ নেই।
বাচ্চাদের সাথে তার সখ্যতা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। আর কি লাগে সুখের সাগরে ভাসার জন্য। আমি যখন লিখছি তখন হা হা করে হাসছি, কতটা বোকা ছিলাম আমি, তাই না? কঠিন পৃথিবী তখনও আমার কাছে অনেকটা অপরিচিত। আমাকে নিশো জানাল সে তার পরিবারের সাথে ইতিমধ্যে আমার বিষয়ে কথা বলেছে, তার বাবার সাথেও আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিল। ভদ্রলোক বেশ ভদ্র মানুষ, মা মা বলে সম্বোধন করলেন। যেন আমি তার কত আপন। আমার বিশ্বাস করতে হচ্ছিল যে, আসলেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে আমার জীবনে। বাংলাদেশে গিয়ে আমাদের বিয়ে হবে, আমি তার প্রেমে আরও পাগল হতে লাগলাম। আমি নিশোর প্রতি খুব ডিভোটেড এবং আমি অনুভব করছি সে নিজেও। আমাকে সত্যি সত্যি কেউ এত ভালোবাসতে পারে? এত!
বেশিদিন টেকেনি আমার সেই অবিশ্বাস্য কল্পনার জগৎ। আমি কিছু দিন পর থেকেই লক্ষ্য করছি একটু ভিন্ন কিছু। প্রথম প্রথম ভাবতাম এ বুঝি আমার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে আমার শ্বাসরুদ্ধ মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে কেউ মনে হয় আমাকে আস্তে আস্তে বোতলের ভিতর ভরার চেষ্টা করছে, আর আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। নির্বাক হয়ে যেতাম যখন দেখতাম, সোশ্যাল মিডিয়ার আমার কোনো পোস্টে কারও কোনো কমেন্টে তেলে বেগুনে রেগে যেত। তার সাথে সম্পর্কতে জড়ানোর আগের টেক্সটগুলো পড়ত আমাকে না জানিয়ে। এইগুলো নিয়ে নিশো আমার সাথে তুমুল ঝগড়া করা শুরু করল, যা আমার কাছে সম্পূর্ণভিত্তিহীন মনে হতো। কিন্তু তখনও আমি ভেবে যাচ্ছি ও এইরকম প্রতিক্রিয়া করছে সব অভিমান, অনুযোগ থেকে। ভালোবাসা তো নিষ্পাপ, অন্ধ।
নিশোর ব্যাপারে প্রথমবারের মতো বাকরুদ্ধ হয়ে যাই এক সন্ধ্যার ঘটনাতে। সেই সন্ধ্যা যা অনেক কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিল আমাকে কিন্তু আংশিক ধরেছি। খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটছে আমাদের, আদর করছে সে আমাকে। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত বলতে আমি চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা এগুলোই বুঝি। স্পর্শের উষ্ণতায় দু’জনেই হারিয়ে যাচ্ছি। কারও রূপে যে কেউ পাগল হতে পারে, তা এই প্রথম দেখছি নিশোর চোখে। তবে পুরুষ ও নারীর যে মনের ভিন্নতা, কামনার ভিন্নতা, চাওয়ার ভিন্নতা রয়েছে তার বিশ্লেষণ করার বয়স এবং অভিজ্ঞতা আমার তখনও হয়নি, আমি বুঝিনি। সে আমাকে আদর করতে করতে বিছানায় নিয়ে যেতে চাইল। আমাকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, আমার সাথে এই মুহূর্ত শারীরিক মিলনের কামনায় সে পাগল হয়ে আছে। আমার উত্তর তখন বাধা সূচক ‘না’ আসে। তখন নিশো ভেবে পাচ্ছে না যে, দু’দিন পর আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে, এতটা কাছাকাছি আসার পর শারীরিক সম্পর্কে বাধা কোথায়? আমি বললাম, ‘আমি শারীরিক সম্পর্কের জন্য এখনো তৈরি নই। ‘আমার এই কথা শোনার পর মনে হয় নিশোর মাথায় বাপ পড়ল। প্রচ- রেগে গেল। তার চেহারা আর মুখের ভাষা মুহূর্তেই পালটে গেল। আমাকে নিশো বলে উঠল, ‘তুই কেমন প্রেমিকা যে, তুই তোর প্রেমিকের শারীরিক চাহিদা মিটাতে পারিস না?’ তার এই কথা শুনে আমি স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমার মাথার মধ্যে কি কি যেন ইলেকট্রিক শক-এর মতো স্পার্ক হচ্ছে। আমি নির্বোধের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর দু’দিন পরই তো বাংলাদেশে যাচ্ছি বিয়ে করতে। কি এমন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তার জন্য? কি এমন তাড়াহুড়া তার? এই উত্তরগুলো তখন আমার জানা না থাকলেও এখন আমি জানি। সাইকোলজিক্যাল নারী ও পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ভিন্নভাবে ফর্ম করা। কামনার বিষয়গুলো মাথায় কাজ করে ভিন্নভাবে।
ছোট একটা উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, একটা মেয়ে যখন সুন্দর করে সেজেগুঁজে, আবেদনময়ী হয়ে তার প্রেমিকের সামনে উপস্থিত হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য থাকে তার রূপে যেন তার প্রেমিক প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। প্রেমিকের চোখে যেন সে রানি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী। আর ওই একই মুহূর্তে পুরুষদের চিন্তা-ভাবনায়, কামনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন পুরুষ ভেবে নেয় যে, তার প্রেমিকা তার সাথে বিছানায় যাওয়ার জন্যই হয়তো এতসব আয়োজন করেছে, এত আবেদনময়ীভাবে সেজেছে। নারীরা টিজ করতে পছন্দ করে তা বেশিরভাগ পুরুষরা বোঝে না, বিশেষ করে রক্ষণশীল পুরুষরা।
ওড়াল সেক্স হওয়ার পর বা করার মুহূর্তে অনেক পুরুষ ভেবে নেয়, পুরোপুরিভাবে শারীরিক মিলনে সমস্যা কোথায়? যেখানে এক নারী যেকোনো মুহূর্তে মনে করতে পারে, আমি একটা পর্যায়ের বেশি এগুবে না। সম্মতির ব্যাপারটা তাই এখানে খুব জরুরি।
আমি নিশোর সাথে ওই মুহূর্তে শারীরিক সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জড়ানোর জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। হয়তো সেই সময় তখনও আসেনি তাই আমার মন সায় দেয়নি। আমি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে খুব প্রাধান্য দেই। আমি শুনি তার কথা। নিশো রেগে চলে গেলেও, পরের দিন সরি বলে ক্ষমা চেয়ে নিল। নিশোর সাথে এই প্রথম ঘটেছে এমন ঘটনা, তাই আমিমাফ করে বিষয়টি স্বাভাবিক করে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভিতরে কোথায় যেন একটা তার ছিঁড়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারছি, সুরটা মিলছে না। যাই হোক, দুদিন পরই বাংলাদেশে যাব, হয়তো তখন আমার এই উদ্বিগ্ন হওয়াটা চলে যাবে। দুই পক্ষ কথা বলবে, মুরব্বিরা যদি ভালো মনে করে তাহলেই বিয়ে ব্যাপারটা এগুবে। এখন আপাতত এই বিষয়গুলো কম্প্রোমাইজ করে ফেলাটাই ভালো।
এক্সাইটেট তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, ভুলে যেতে চাইলাম কষ্টের সব অভিজ্ঞতার কথা। এই অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিশোর যে পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম, তাও এড়ানোর চেষ্টা করলাম। এক সাথে চলতে গেলে এমন টুকটাক বিষয় ঘটতেই পারে, বিষয়গুলো মাথায় এভাবে ঢুকানোর চেষ্টা করলেও আসলে বিষয়গুলো টুকটাক ছিল না। এইগুলো ছিল সিগন্যাল, একটা মানুষকে বোঝার সিগন্যাল, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত বোঝার সিগন্যাল। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, অনভিজ্ঞতার কারণে। ওইটুকু বয়সে কত কিছুই বুঝতে পারার কথা? নাকি মানুষের ওপর ঘৃণা আর অবিশ্বাসের দেয়াল উঠাব? মানুষ যে বলে দুনিয়া অনেক কঠিন, সেটি বুঝতে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, বাধার মুখোমুখি হতে হয়, তা ড্রিল করতে হয়।
তেমনি, আরেক আঘাত আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাংলাদেশে গিয়ে দেখি নিশোর বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানলেও নিশোর পুরো পরিবার জানে না, অর্থাৎ তার মা এবং অন্যান্যরা। নিশোর বাবা-মা’র বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে তাও আমি জানি না। যদিও সেটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাবা জানলে মা জানবে না কেন এই প্রশ্ন আপনার মনে আসবে বলে কথাটি জানানো। নিশোর বাবা পরিবারে কারোর সাথে কোনো আলাপ করেনি এবং নিশো পুরো ব্যাপারটি গোপন রেখেছে। নিশোর মা একদিন লুকিয়ে আমাদের বাসায় আসে। এসে আমাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করে, আমি যেন উনার ছেলের জীবন থেকে সরে যাই। আমি দুুই বাচ্চার মা আর দুই বাচ্চার মা’কে ছেলের বৌ হিসেবে মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজে তারা মুখ দেখাতে পারবে না। আমার আবরাজের দোহাই দিয়ে বলল, ‘তোমারও ছেলে আছে, তুমি আমার ছেলেকে এসব কথা বলো না। বললে সে পাগলামি করবে, আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।’ উনার কান্না থামছিল না।
আমি উত্তরে বললাম, ‘আমি এসেছিলাম আপনাদের পরিবারের সদস্য হতে, আমার বাবা-মা নেই, আপনাদের মাধ্যমে বাবা-মা খুঁজে পেতে। আপনারা যদি আমাকে না-ই চান, তাহলে সেই পরিবারের সদস্য আমার হয়ে কি লাভ? আপনার ছেলে কোনোদিনই জানবে না, আমি এই সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
আমি নিশোর সাথে কঠোরভাবে ব্রেকাপ করলাম। নিশো কখনোই জানতে পারল না আমাদের সম্পর্ক ভাঙার মূল কারণ। সে শুধু জানল আমি খুব নির্দয়ী, অহঙ্কারী, স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ মানুষ, যে শুধু ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে।
কঠিন এক প্রিয়তী হয়ে গেলাম আমি।
এরপর থেকে দু’জন দু’জনের চেহারা আজ অব্দি দেখা হয়নি। দেখা যাতে কোনদিন না হয় সেই প্রার্থনা করি।
‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে নেয়া
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটিতে খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজন্যে। আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব-
আমরা সবাই বলি, অতীতকে ভোলা যায় না। আসলে অতীতকে হয়তো কোনো এক স্মৃতির ভাঁজে তুলে রেখে ভোলা যায় তা ঠিক, শুধুমাত্র অতীত থেকে যেই অভিজ্ঞতা নেয়া হয়েছে তা ভোলা যায় না। এখন দেখবার বিষয়, ওই অভিজ্ঞতাকে আসলে কোনো ভাবে কাজে লাগাচ্ছে তার গতানুগতিক জীবনে। ওই অভিজ্ঞতা অনেক শক্তিশালীও হতে পারে, অনেক শক্তিশালী।
আমি ধীরে ধীরে জীবন থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছি।
আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি আমার আরেক জীবন অভিজ্ঞতা।
মানুষ নাকি একা থাকতে পারে না। হ্যাঁ, তাতো পারেই না। আমি পুরো একটা বছর সম্পূর্ণ একা কাটিয়েছি, কিছুটা জনমন শূন্য। ফ্লাইং স্কুল এবং বাসা, এর মধ্যবর্তী আর কিছুই নেই, কোনো কথাও নেই। কথা বা মিশব কার সাথে নিজ দেশের কমিউনিটির কাছে তো আমি পরিত্যক্ত খারাপ নারী। আয়ারল্যান্ডে আশার পর থেকেই ছিলাম বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে, উঠা-বসা ছিল ওইখানেই। কখনোই আইরিশ কালচার বা আইরিশদের সাথে মিশিনি বা মিশার আগ্রহ জন্মায়নি, যার কারণে কোনো আইরিশ আমার পরিচিত বা বন্ধু ছিল না। আর পড়াশোনা বা কাজের খাতিরে যাদের সাথে কথা হতো, খুবই ফরমাল ছিল, ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রেখেছি। তাদের সাথে কখনো সখ্যতা বা বন্ধুত্ব তৈরি করার চেষ্টা করিনি।
আমার জীবন খুব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সমাজ ছাড়া, পরিবার ছাড়া, বন্ধু ছাড়া। বাংলাদেশেও তেমন আর ফোনে যোগাযোগ হতো না। বাংলাদেশে তখন ইন্টারনেট সবার ঘরে ঘরে ছিল না, এমনকি আয়ারল্যান্ড আমার বাসায়ও না, কারণ তার ব্যয় সুলভমূল্যে না থাকায় এফোর্ড করা সম্ভব ছিল না। আর সরাসরি ফোন করা তো আকাশের চাঁদ হাতে নেয়ার মতো। আর তাছাড়া পরিবার আমার এই পরিস্থিতির কথা জানলেও বা কী? ওদের কিছু করার নেই। ওরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
এই ভাবেই কেটে যাচ্ছে দুই বাচ্চা নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন। অভিযোগ নেই কারোর ওপর, এটি তো আমারই পছন্দ করা অপশন ছিল, যেই অপশনের আর কোনো অপশন আমার জন্য এভেইলেবেল ছিল না। ঘর থেকে বাইরে গিয়ে যে তিন ইউরো দিয়ে একটা কফি কিনে খাব, সেটি ভাবতো হতো একশ’বার। এই তিন ইউরো খরচ করা তো আমার জন্য বিলাসিতা, এই তিন ইউরো দিয়ে আমি একটা পাউরুটি এবং একটা গরুর দুধ কিনতে পারব।
এমনি সময়, আবরাজ হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এর মধ্যে মৌনীরা ও অসুস্থ হয়ে পড়ল, তারও অবস্থা খারাপ, দু’জনই হাসপাতালে। দু’জনকে দুই রুমে রাখা হয়েছে। আর আমি একা। বাচ্চাদের বাবার সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে যেহেতু সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না, যত রকম সুযোগ বিবেক পেত আমাকে আঘাত করার, আপ্রাণ চেষ্টা করত আমাকে ভাঙার। আমার প্রতি তার এতটাই ঘৃণা বা হিংসা। বাইরের মানুষ তার বাইরের প্রচ- ভদ্ররূপটা দেখেছে, কিন্তু সে ততটাই হিংস্র তার মনে, অপর সাইডে যার দেখা সবাই পায় না। হিউম্যান সাইকোলজি যারা পড়ে, তারা বিষয়টি জানে। আমাদের মানুষের মনে এক হিংস্র পশু বাস করে, যা আমরা জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচার, বিবেক দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখি। কিন্তু অনেক সময়ই ওই হিংসা পশু তালা ভেঙে বের হয়ে আসে, অনেকে পারে তা নিয়ন্ত্রণ করতে, অনেকেই পারে না। নির্ভর করছে যার যার ব্যক্তিত্বের ওপর। সুতরাং আমিই জানি বিবেকের অপর পাশের চেহারা, যেই চেহারা তার পরিবারও দেখেনি, আর আশপাশের মানুষ তো দূরের কথা। বাইরের মানুষের কাছে সে অনেক ঠা-া, ভদ্র-নম্র একজন মানুষ, যা আসলেই সে এমন। কিন্তু এটি বাহ্যিক রূপ বা চরিত্র ব্যক্তিত্ব। বাহ্যিক বা চরিত্র বলতে যা বোঝায় তা হলো, আমি বা আপনি মানুষের সামনে আমাদের বিশিষ্ট, ব্যবহার, উপস্থাপন করি। যেটা দিয়ে আমাদের বাইরের মানুষ বিচার করে আমরা মানুষটা কেমন। কিন্তু ভিতরে মানুষটিকে খুব কম মানুষই চিনতে পারে। আমার বয়স তখন কম, জীবন দেখেছি কম, বুঝিও কম। এত কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার তখন হয়নি।
যা বলছিলাম, আবরাজ ও মৌনীরা অসুস্থ, হাসপাতালে। দুই বাচ্চার পাশে দু’জন এডাল্ট বা অভিভাবক থাকতে হবে। আমি একা, তো একবার এই রুমে আরেকবার ওই রুমে। পাবলিক হাসপাতাল তাই আমার বিশ্রাম নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, আছে শুধু একটা চেয়ার। সারারাত চেয়ারে বসে বসে কাটিয়েছি। বাচ্চাকে ফেলে রেখে হাসপাতালে থেকে বের হয়ে গিয়ে খাওয়ার পর্যন্ত অনুমতি নেই। হাসপাতাল তো আর আমাকে খাওয়াবে না। সুতরাং, বাচ্চাদের বাবা এই মোক্ষম সময়টি বেছে নিয়েছেন আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। তিনি আসেননি বাচ্চাদের দেখতে এবং আমাকে সহযোগিতা করতে। সারাদিন না খেয়ে আছি। গোসল নেই, ঘুম নেই। দু’টি কোলের বাচ্চা অসুস্থ, দু’জনই মায়ের সান্নিধ্য চায়। আমি হিমশিম খাচ্ছি। দুই বাচ্চার শরীরে স্যালাইন লাগানো, যার মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টা এন্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সুই একটা এই মাসুম বাচ্চার ছোট হাতে লাগানো। একটু নাড়াচাড়া করলে হয়তো গুতা লাগে, তাতে ব্যথা লাগে, কান্না করে ওঠে। আমরা বড়রাই একটু অসুস্থ হলে কেমন লাগে, আপনারাই বলেন? তো, আমি সারারাত সজাগ থেকে যখন চেয়ারে বসে থাকি তখন হাসপাতালের ইন্টারনেট ব্যবহার করি। খুবই ধীরগতির ইন্টারনেট, যেহেতু শেয়ারিং এবং ফ্রি। রাত তখন ১২টা বাজবে, হঠাৎ করেই ফেসবুকে একটা মেসেজ আসলো। খুব অবাক হলাম, সাথে মৃদু হাসি। এতদিন, এত বছর পর বার্তা আসলো তার কাছ থেকে? আমি খুব আগ্রহের সাথে প্রতিউত্তর দিতে লাগলাম। বার্তাটি ছিল আয়ারল্যান্ডে আসার পর আমার প্রথম যার প্রতি ক্রাশ হয়েছিল। সিওর আমার প্রতিও তার ক্রাশ হয়েছিল, আমি সেই সিগন্যাল পেয়েছিলাম। যেহেতু বাংলাদেশ হাই, হ্যালো শুভেচ্ছা বিনিময় হতো প্রায়ই। কিন্তু ব্যাপারটি তেমন গভীরভাবে কাছাকাছি গড়ায়নি। কারণ তার বাংলাদেশে এক প্রেমিকা ছিল। পরবর্তীতে আমিও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যাই এবং তার প্রেমিকাকে সে বিয়ে করে ফেলে। সবকিছু ছিমছাম। ভালো লাগার ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়। সুদর্শন, ভদ্র ছেলে। পড়াশোনার প্রতি খুবই আগ্রহী, আয়ারল্যান্ডে খুব ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পড়াশোনা করে যাচ্ছে। কোন ধরনের বাজে অভ্যাস নেই, কোথাও দেখা হলে দেখতাম চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকত। কারো আগে-পিছে নাই, সে তার পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত। যে কেউ দেখলে বলবে অসাধারণ ছেলে।
সেই ছেলে হঠাৎ ফেসবুকে বার্তা পাঠানোর পর, বুক ধক করে উঠল। জানালাম আমি শিশু হাসপাতালে। আমাকে সে বলল, সে কাজ করে কাছেই, সে কাজ শেষে যাওয়ার সময় দেখা করে যাবে। আমিও হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। সে আসলো, কিছু খাবার নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তার বিয়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। আমার ব্রেকআপের কথা শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করল। আমি যে খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেটা তার বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। আমিও অনেকদিন পরে কথা বলার মানুষ পেয়ে বড় বড় করে অনেক কথা বললাম। ধরে নিলাম তার নাম নিশো। হাসপাতালে আমি পাঁচ দিন ধরে এক কাপড়ে কোনো গোসল নাই, কাপড় পরিবর্তন হয়নি। অনুধাবন করতে পারছেন আমার অবস্থা কেমন ছিল। হাসপাতাল থেকে আমার বাসা অনেক দূরে, যার কারণে বাচ্চাদের রেখে বাসায় যাওয়া হয়নি। নিশো এর মধ্যে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছে, খবর নিচ্ছে। ব্যাপারটি আমার কাছে খুব ভালো লাগছে। মনের কোনো এক কোণায় যেন শক্তি উৎপাদন হচ্ছে, নুয়ে থাকা মাথা উঠাচ্ছি আস্তে আস্তে।
নিশো পরের রাতে কাজ শেষে রাত একটার দিকে আবারও আসে। এসে বলল চলো তোমাকে বাসায় নিয়ে যাই, তোমার ফ্রেশ হওয়ার দরকার, কাপড় পরিবর্তন করার দরকার।
আমি মনে মনে বললাম, ‘হায় খোদা আমার শরীর থেকে আবার দুর্গন্ধ বের হচ্ছে না তো?’
আমি নার্সকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলাম আমাকে দুই তিন ঘণ্টার জন্য যাওয়ার অনুমতি দিতে। বললাম, আমি ভোর পাঁচটার মধ্যে চলে আসব। নার্স আমার অবস্থা বিবেচনা করে বুঝতে পারলেন এবং দয়া করে যেতে দিলেন। আমি বাসায় গেলাম দ্রুত গোসল আর কিছু জিনিস আনতে।
বাসা থেকে হাসপাতালে ফেরার পথে ঘটল যত সব পাগলামি ঘটনা।
আমি তো তার পাশে বসে আছি গাড়িতে, নিশো কথা বলছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কেমন যেন ধুুকুর ধুকুর করছে, আমি জানি না তার মধ্যেও তেমন করছিল কিনা। নিশোও আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল, তার চাহনি আমার ভেতরটা ওলটপালট করে দিচ্ছিল। আমি বারবার তার হাতের দিকে তাকাচ্ছি। সে যখন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলে, আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথা বলে মনে হচ্ছে সেই যে, আট/দশ বছর আগে তার প্রতি ক্রাশ খেয়েছিলাম, সেই তখনকার মুহূর্ত। তখনকার আকাক্সক্ষাগুলো এক সাথে জড়ো হচ্ছে। শরীরের রক্তনালীগুলোতে নিঃসৃত হরমোনগুলো ছুটোছুটি করছে। শরীরের অঙ্গের কোনো কিছুই যেন স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না। আজ অনেক বছর পর কোথায় যেন হারিয়ে যেতে মন চাইছে। হঠাৎ করেই উপলব্দি করলাম আমরা হাসপাতালের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। এতখানি পথ এত দ্রুত কীভাবে চলে আসলাম? আশ্চর্য! আমার মনে তার (নিশো) হাত ধরার কামনা জাগছে। মন বলছে, ‘এই তুমি কি আমার হাত ধরবে? তোমার আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁট স্পর্শ করবে? প্রথমে উপরের ঠোঁটে, তারপর নিচের ঠোঁটে, তারপর দুই ঠোঁটে?’ কিন্তু সে তো এই কথাগুলো শুনতে পারছে না। আমার ধুক ধুক করে যে হৃদয়ের স্পন্দন হচ্ছে, তা তো শোনার কথা, সে কি শুনতে পারছে? আমি স্পষ্ট তার চোখে দেখতে পারছি তার জড়তা তাকে বধির করে রাখার চেষ্টা করছে। আমার বায়োলজিক্যাল শরীর আমাকে জানান দিল, এই দেহে বিপরীত লিঙ্গের কোনো স্পর্শ পায়নি প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে আমরা মাত্র তিন/চার মিনিটের দূরত্বে। আমি শেষমেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রেখে, লাজ লজ্জা ভুলে, গাড়ির গিয়ার স্টিকের ওপরে রাখা তার হাতের ওপর আমার হাত রেখে নিশোকে আজকের উপকারের জন্য ধন্যবাদ জানালাম। ভাবলাম, সবকিছু বাদ, অন্তত তাকে তো একটা ধন্যবাদ জানাতে হবে। হ্যাঁ অস্বীকার করব না, তাকে আমার ছুঁয়ে দেখতে মন চাচ্ছিল অবচেতন মন থেকে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখন, সে এটাকে যেভাবে নেয় নেবে। তার ব্যাপার। আমি তার চোখে ওই একই কামনা দেখেছি, অনুভব করেছি না ছুঁয়েই। আমি তার হাতের ওপরে আমার হাত আলতেভাবে রাখলাম, রাখার সাথে সাথে সারা শরীরে বিদ্যুতের মতো কিছু প্রবাহ হলো। আমি নিশ্চিত, আপনি জীবনের কোনো না কোনো সময় ওই রকম স্পর্শে শরীরে তড়িৎ প্রবাহের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হয়েছে। নিজের শরীর এতদিন নিজের কাছেই অপরিচিত, প্রাণহীন ছিল। অদ্ভুত! নিশো আমার হাতে স্পর্শ পেয়ে এমনভাবে তাকাল, যেন সে কয়েক হার্টবিট স্কিপ করেছে, যেন সে কল্পনাই করেনি আমি কখনো এমনভাবে নিজ থেকে তার হাত ধরব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নিশো আমার হাতটি চেপে ধরল। এ এমন ছোঁয়া যে শিরায় শিরায় তার প্রবাহ হচ্ছে, যেন এমন স্পর্শের জন্য মরতে পারি বারবার। মুহূর্তেই আমি আমার বিষাদ, কষ্ট, স্ট্রাগল সবকিছু যেন ভুলে গেলাম। গাড়ি থামল হাসপাতালের পিছনের গেটে। মুহূর্তগুলো যেন ওই জায়গায় ফ্রিজ হয়ে আছে। নিশো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার দিকে মানে আমার ঠোঁকের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি তার চোখের দিকে। দু’জনই খুব তৃষ্ণার্ত, ঢুক গিলছি বারবার। এ তো নিশ্চয় পানির জন্য তৃষ্ণার্ত নয়। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে আসছে। দু’জন দু’জনের হৃদয়ের ধুক ধুক স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ নিশোর একটা হাত আমার ঘাড়ের চুলের পিছনে রাখতেই আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। ছেলেরা মনে হয় জানেই যে তাদের হাতে সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের শরীর কাবু করার জন্য জাদু দিয়ে দিয়েছেন। অটোম্যাটিকভাবে আমার চোখ বন্ধ হতেই নিশো তার ঠোঁট আমার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল। উফফ কী অদ্ভুত সুখ বয়ে যাচ্ছে আমার শরীরের ভিতর দিয়ে। সে তার ঠোঁট আর জিভ দিয়ে আমার দুই ঠোঁট চুষল, একবার উপরের ঠোঁট, একবার নিচের ঠোঁট। ঠিক যেমনটি আমি মনে মনে আকাক্সক্ষা করছিলাম প্রথম দিকে। আমার শরীর তখনও নিস্তেজ। তার দুই হাত দিয়ে আমার মুখখানা আলতো করে ছুঁয়ে সারা মুখে চুমু খেতে লাগল। আমার বাধা দেয়ার কোনো স্নায়ু কাজ করেনি তখন, ব্রেইনের নিয়ন্ত্রণ ছিল সম্পূর্ণ তার হাতে। আর আমি সাধারণ এক বায়োলজিক্যাল প্রাণীর মতো উপভোগ করছি, যার কামনা মনের কোনো এক কোণায় হয়তো পোষণ করছিলাম। চুম্বনের শেষটুকু সে শেষ করেছে, তার এক হাত দিয়ে আমার কোমরে হাত দিয়ে তার শরীরের আরও কাছে সে আনতে চাইল, যেন সে আরও বেশি কাছে আমাকে পেতে চায়। কয়েকবার আমার কোমরে হাত দিয়ে তার শরীরের সন্নিকটে আনার প্রচেষ্টা আমাকে আরও উত্তেজিত করে ফেলছিল। এই পুরো ব্যাপারটির সময়ের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ৪/৫ মিনিট। হঠাৎ করেই অনুধাবন করলাম, ওহ হ্যাঁ আমরা তো হাসপাতালের বাইরে, রাস্তার ওপর পার্কিং করে আছি। আমার যেতে হবে। চলে আসলাম, সুখের স্বর্গ থেকে বাস্তবতায়। বিদায়ের সময় লজ্জা পাচ্ছিলাম নিশোর চোখের দিকে তাকাতে, কি থেকে কি হয়ে গেল। আফসোস হচ্ছিল না, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এক ঝলক তার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বিদায় নিয়ে চলে আসলাম হাসপাতালের ভিতরে।
এরপর থেকে আমার প্রতি নিশোর যতœ, খোঁজ-খবর, কেয়ার করা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আর আমি এইদিকে ভাবতে লাগলাম, আমার একঘরা নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হিসেবে কাউকে পেলাম, কোথায় যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হলো স্বপ্নের রাজকুমার বুঝি এতে বছর পর এলো আমার জীবনে। ঘোড়ায় চড়ে এসে আমার জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, বেদনা সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর আমাকে জীবনের সব সুখগুলো দিয়ে ভরিয়ে রাখবে। আমি শুধু তার হয়ে থাকব সারাজীবন।
আমার শুরু হলো নিশোকে নিয়ে কল্পনার জগৎ। সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাবনাগুলো আচ্ছন্ন করে রাখত। আর এই আচ্ছন্নতা ছিল সুখের। প্রেমে পড়লে আপনার মন যেমন স্বতঃফূর্ত থাকে, আমি সেই প্রেমের নৌকায় ভাসছি। কিছুক্ষণ পর পর নিশো আমার খবর নিচ্ছে, আমার প্রচ- ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমার বোবার জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে। আগেও আপনাদের বলেছি, ফ্লাইং স্কুলের বাইরে আমার কোথাও যাওয়া হতো না, আর সেখানে পড়াশোনার বিষয় ছাড়া কথা হতো না। আমি তখনও আইরিশদের সাথে ইন্ট্রিগ্রেইট করতে পারতাম না, সত্যি কথা বলতে কখনো সাদা চামড়ার পুরুষদের প্রতি আকর্ষণও বোধ করতাম না তখন। কোন ক্রাশ জাতীয় অনুভূতি হয়নি তাদের প্রতি। কেন, কে জানে? এটি আমার ব্যক্তিত্বের একটি বাধা বলব। নিজ কালচারের বাইরে কারোর সাথে মিশতে না পারার কারণে আমি যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম ‘নিশো তার মাঝে এক জাদুর কাঠি।’ আমার সাথে সে কাজ শেষে ২/১ দিন পর পর দেখা করতে আসত। তার সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময় কাটানো আমি খুব উপভোগ করতাম। যদিও সে আমাকে আরও গভীরভাবে পেতে চাইত, বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইত। ওই পর্যন্ত না যেতে পারলে যে, সে কিছুটা নিরাশ হতো বুঝতে পারতাম। কিন্তু তখন ব্যাপারটি আমার কাছে মিষ্টি লাগত। আমাদের মধ্যে সুখ-দুঃখগুলো বিনিময় হতো। মনে মনে বিশ্বাস বেড়েছিল দু’জন দু’জনকে মনে হয় খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। খুব তাড়াতাড়ি দু’জনের কাছাকাছি চলে এসেছি। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের খোলা-খুলি কিছু কথাবার্তা আদান-প্রদান করার কারণে খুব তাড়াতাড়ি মানুষজন জেনে গেলে আমাদের সম্পর্কের কথা। আসলে নিশো চাচ্ছিল সবাই জানুক আর আমারও বাধা দিতে মন চায়নি। কারণ লুকোচুরি করার তো কিছু নেই, তাই না? নিশোর ছায়াতে আমি সিকিউর অনুভব করতাম। এরই মধ্যে নিশো আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রপোজ করে। সে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়। সেই মুহূর্তে পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মেয়ে মনে হয় আর কেউ নেই।
বাচ্চাদের সাথে তার সখ্যতা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। আর কি লাগে সুখের সাগরে ভাসার জন্য। আমি যখন লিখছি তখন হা হা করে হাসছি, কতটা বোকা ছিলাম আমি, তাই না? কঠিন পৃথিবী তখনও আমার কাছে অনেকটা অপরিচিত। আমাকে নিশো জানাল সে তার পরিবারের সাথে ইতিমধ্যে আমার বিষয়ে কথা বলেছে, তার বাবার সাথেও আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিল। ভদ্রলোক বেশ ভদ্র মানুষ, মা মা বলে সম্বোধন করলেন। যেন আমি তার কত আপন। আমার বিশ্বাস করতে হচ্ছিল যে, আসলেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে আমার জীবনে। বাংলাদেশে গিয়ে আমাদের বিয়ে হবে, আমি তার প্রেমে আরও পাগল হতে লাগলাম। আমি নিশোর প্রতি খুব ডিভোটেড এবং আমি অনুভব করছি সে নিজেও। আমাকে সত্যি সত্যি কেউ এত ভালোবাসতে পারে? এত!
বেশিদিন টেকেনি আমার সেই অবিশ্বাস্য কল্পনার জগৎ। আমি কিছু দিন পর থেকেই লক্ষ্য করছি একটু ভিন্ন কিছু। প্রথম প্রথম ভাবতাম এ বুঝি আমার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে আমার শ্বাসরুদ্ধ মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে কেউ মনে হয় আমাকে আস্তে আস্তে বোতলের ভিতর ভরার চেষ্টা করছে, আর আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। নির্বাক হয়ে যেতাম যখন দেখতাম, সোশ্যাল মিডিয়ার আমার কোনো পোস্টে কারও কোনো কমেন্টে তেলে বেগুনে রেগে যেত। তার সাথে সম্পর্কতে জড়ানোর আগের টেক্সটগুলো পড়ত আমাকে না জানিয়ে। এইগুলো নিয়ে নিশো আমার সাথে তুমুল ঝগড়া করা শুরু করল, যা আমার কাছে সম্পূর্ণভিত্তিহীন মনে হতো। কিন্তু তখনও আমি ভেবে যাচ্ছি ও এইরকম প্রতিক্রিয়া করছে সব অভিমান, অনুযোগ থেকে। ভালোবাসা তো নিষ্পাপ, অন্ধ।
নিশোর ব্যাপারে প্রথমবারের মতো বাকরুদ্ধ হয়ে যাই এক সন্ধ্যার ঘটনাতে। সেই সন্ধ্যা যা অনেক কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিল আমাকে কিন্তু আংশিক ধরেছি। খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটছে আমাদের, আদর করছে সে আমাকে। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত বলতে আমি চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা এগুলোই বুঝি। স্পর্শের উষ্ণতায় দু’জনেই হারিয়ে যাচ্ছি। কারও রূপে যে কেউ পাগল হতে পারে, তা এই প্রথম দেখছি নিশোর চোখে। তবে পুরুষ ও নারীর যে মনের ভিন্নতা, কামনার ভিন্নতা, চাওয়ার ভিন্নতা রয়েছে তার বিশ্লেষণ করার বয়স এবং অভিজ্ঞতা আমার তখনও হয়নি, আমি বুঝিনি। সে আমাকে আদর করতে করতে বিছানায় নিয়ে যেতে চাইল। আমাকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, আমার সাথে এই মুহূর্ত শারীরিক মিলনের কামনায় সে পাগল হয়ে আছে। আমার উত্তর তখন বাধা সূচক ‘না’ আসে। তখন নিশো ভেবে পাচ্ছে না যে, দু’দিন পর আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে, এতটা কাছাকাছি আসার পর শারীরিক সম্পর্কে বাধা কোথায়? আমি বললাম, ‘আমি শারীরিক সম্পর্কের জন্য এখনো তৈরি নই। ‘আমার এই কথা শোনার পর মনে হয় নিশোর মাথায় বাপ পড়ল। প্রচ- রেগে গেল। তার চেহারা আর মুখের ভাষা মুহূর্তেই পালটে গেল। আমাকে নিশো বলে উঠল, ‘তুই কেমন প্রেমিকা যে, তুই তোর প্রেমিকের শারীরিক চাহিদা মিটাতে পারিস না?’ তার এই কথা শুনে আমি স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমার মাথার মধ্যে কি কি যেন ইলেকট্রিক শক-এর মতো স্পার্ক হচ্ছে। আমি নির্বোধের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর দু’দিন পরই তো বাংলাদেশে যাচ্ছি বিয়ে করতে। কি এমন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তার জন্য? কি এমন তাড়াহুড়া তার? এই উত্তরগুলো তখন আমার জানা না থাকলেও এখন আমি জানি। সাইকোলজিক্যাল নারী ও পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ভিন্নভাবে ফর্ম করা। কামনার বিষয়গুলো মাথায় কাজ করে ভিন্নভাবে।
ছোট একটা উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, একটা মেয়ে যখন সুন্দর করে সেজেগুঁজে, আবেদনময়ী হয়ে তার প্রেমিকের সামনে উপস্থিত হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য থাকে তার রূপে যেন তার প্রেমিক প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে। প্রেমিকের চোখে যেন সে রানি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী। আর ওই একই মুহূর্তে পুরুষদের চিন্তা-ভাবনায়, কামনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন পুরুষ ভেবে নেয় যে, তার প্রেমিকা তার সাথে বিছানায় যাওয়ার জন্যই হয়তো এতসব আয়োজন করেছে, এত আবেদনময়ীভাবে সেজেছে। নারীরা টিজ করতে পছন্দ করে তা বেশিরভাগ পুরুষরা বোঝে না, বিশেষ করে রক্ষণশীল পুরুষরা।
ওড়াল সেক্স হওয়ার পর বা করার মুহূর্তে অনেক পুরুষ ভেবে নেয়, পুরোপুরিভাবে শারীরিক মিলনে সমস্যা কোথায়? যেখানে এক নারী যেকোনো মুহূর্তে মনে করতে পারে, আমি একটা পর্যায়ের বেশি এগুবে না। সম্মতির ব্যাপারটা তাই এখানে খুব জরুরি।
আমি নিশোর সাথে ওই মুহূর্তে শারীরিক সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জড়ানোর জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। হয়তো সেই সময় তখনও আসেনি তাই আমার মন সায় দেয়নি। আমি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে খুব প্রাধান্য দেই। আমি শুনি তার কথা। নিশো রেগে চলে গেলেও, পরের দিন সরি বলে ক্ষমা চেয়ে নিল। নিশোর সাথে এই প্রথম ঘটেছে এমন ঘটনা, তাই আমিমাফ করে বিষয়টি স্বাভাবিক করে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভিতরে কোথায় যেন একটা তার ছিঁড়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারছি, সুরটা মিলছে না। যাই হোক, দুদিন পরই বাংলাদেশে যাব, হয়তো তখন আমার এই উদ্বিগ্ন হওয়াটা চলে যাবে। দুই পক্ষ কথা বলবে, মুরব্বিরা যদি ভালো মনে করে তাহলেই বিয়ে ব্যাপারটা এগুবে। এখন আপাতত এই বিষয়গুলো কম্প্রোমাইজ করে ফেলাটাই ভালো।
এক্সাইটেট তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, ভুলে যেতে চাইলাম কষ্টের সব অভিজ্ঞতার কথা। এই অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিশোর যে পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম, তাও এড়ানোর চেষ্টা করলাম। এক সাথে চলতে গেলে এমন টুকটাক বিষয় ঘটতেই পারে, বিষয়গুলো মাথায় এভাবে ঢুকানোর চেষ্টা করলেও আসলে বিষয়গুলো টুকটাক ছিল না। এইগুলো ছিল সিগন্যাল, একটা মানুষকে বোঝার সিগন্যাল, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত বোঝার সিগন্যাল। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, অনভিজ্ঞতার কারণে। ওইটুকু বয়সে কত কিছুই বুঝতে পারার কথা? নাকি মানুষের ওপর ঘৃণা আর অবিশ্বাসের দেয়াল উঠাব? মানুষ যে বলে দুনিয়া অনেক কঠিন, সেটি বুঝতে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, বাধার মুখোমুখি হতে হয়, তা ড্রিল করতে হয়।
তেমনি, আরেক আঘাত আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাংলাদেশে গিয়ে দেখি নিশোর বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানলেও নিশোর পুরো পরিবার জানে না, অর্থাৎ তার মা এবং অন্যান্যরা। নিশোর বাবা-মা’র বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে তাও আমি জানি না। যদিও সেটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাবা জানলে মা জানবে না কেন এই প্রশ্ন আপনার মনে আসবে বলে কথাটি জানানো। নিশোর বাবা পরিবারে কারোর সাথে কোনো আলাপ করেনি এবং নিশো পুরো ব্যাপারটি গোপন রেখেছে। নিশোর মা একদিন লুকিয়ে আমাদের বাসায় আসে। এসে আমাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করে, আমি যেন উনার ছেলের জীবন থেকে সরে যাই। আমি দুুই বাচ্চার মা আর দুই বাচ্চার মা’কে ছেলের বৌ হিসেবে মেনে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজে তারা মুখ দেখাতে পারবে না। আমার আবরাজের দোহাই দিয়ে বলল, ‘তোমারও ছেলে আছে, তুমি আমার ছেলেকে এসব কথা বলো না। বললে সে পাগলামি করবে, আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।’ উনার কান্না থামছিল না।
আমি উত্তরে বললাম, ‘আমি এসেছিলাম আপনাদের পরিবারের সদস্য হতে, আমার বাবা-মা নেই, আপনাদের মাধ্যমে বাবা-মা খুঁজে পেতে। আপনারা যদি আমাকে না-ই চান, তাহলে সেই পরিবারের সদস্য আমার হয়ে কি লাভ? আপনার ছেলে কোনোদিনই জানবে না, আমি এই সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
আমি নিশোর সাথে কঠোরভাবে ব্রেকাপ করলাম। নিশো কখনোই জানতে পারল না আমাদের সম্পর্ক ভাঙার মূল কারণ। সে শুধু জানল আমি খুব নির্দয়ী, অহঙ্কারী, স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ মানুষ, যে শুধু ভালোবাসা নিয়ে খেলেছে।
কঠিন এক প্রিয়তী হয়ে গেলাম আমি।
এরপর থেকে দু’জন দু’জনের চেহারা আজ অব্দি দেখা হয়নি। দেখা যাতে কোনদিন না হয় সেই প্রার্থনা করি।
‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে নেয়া
No comments