১৬ কোটি মানুষের মনের ভাষা পড়বেন কি মোদি? by সোহরাব হাসান
নরেন্দ্র
দামোদর দাস মোদি, নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা মানুষটি ভারতের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতিতে কতটা পরিবর্তন এনেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু
বৈদেশিক নীতিতে যে বাঁক বদল করেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। শপথ গ্রহণ
অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী সাত দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের (শেখ হাসিনা জাপান
সফরে ছিলেন বলে বাংলাদেশ থেকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রতিনিধিত্ব
করেন) হাজির করার ঘটনাকে কেবল ব্যক্তি মহিমা প্রচারের সোপান ভাবা ঠিক হবে
না। ৬৫ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা প্রতিদ্বন্দ্বী
মহাশক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। গুজরাটের দাঙ্গার
কারণে একদা তারা মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানালেও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক
দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে
পয়লা সফরেই মাত করে দিয়েছিলেন মোদি। রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ
কোরিয়া—মোদি যেখানেই গিয়েছেন, নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তিই তুলে ধরেছেন। সেই
তুলনায় চীনে তাঁর সাম্প্রতিক সফরের অর্জন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশাল অঙ্কের
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি সত্ত্বেও সীমান্ত বিরোধ ও পাকিস্তান অধিকৃত
কাশ্মীরে চীনের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে রেষারেষি রয়েই গেছে।
নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’ হিসেবে অভিহিত করলেও দেশটি তাঁর সফর তালিকায় এল ১৯ নম্বরে। বাংলাদেশ সফরের আগেই তিনি নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসেছেন। বাংলাদেশ কি তাঁর সফর তালিকার শীর্ষে থাকতে পারত না? হ্যাঁ, পারত, যদি না ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্থলসীমান্ত চুক্তি ও তিস্তার পানি বণ্টনে বাদ সাধতেন; যদি না মোদির নিজের দল বিজেপিও সীমান্ত চুক্তিটিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। মোদির বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যতই বলুন না কেন, তাঁরা ‘দাদাগিরি’ ছেড়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ ভাই হিসেবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান, ভেতরে ভেতরে দাদাগিরিটা পুরো ছাড়তে পারেননি দেশটির কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা।
ঢাকা সফরের আগমুহূর্তে নরেন্দ্র মোদি টুইটারে জানিয়ে দিয়েছেন: ‘আমি অত্যন্ত উৎসাহ ও আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই, আমি এমন এক দেশ সফরে যাচ্ছি, যার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত জোরদার।’ তাঁর সফর দুই দেশের জনগণের কল্যাণের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অামরাও চাই, অতীতের সব সংশয়-সন্দেহ পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হোক, প্রসারিত হোক বন্ধুত্বের হাত। কিন্তু দুই দেশেই অতি উগ্র রাজনীতি সেই পথ আগলে থাকে। ৪৪ বছর ধরে আমরা এক পা এগোই, দুই পা পিছিয়ে যাই।
মোদি বাংলাদেশ ও ভারতের স্থলসীমান্ত চুক্তিকে বার্লিন ওয়ালের পতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, বার্লিন দেয়াল দিয়ে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের জনগণের যাতায়াত বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন পূর্ব জার্মানি। সেই দেয়াল পেরিয়ে যাঁরাই সীমান্ত পার হতেন, তাঁদেরই গুলি খেয়ে মরতে হতো। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তেও একই ঘটনা ঘটছে। বার্লিনে দেয়াল ছিল, এখানে আছে কাঁটাতারের বেড়া।
ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি কমাতে যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ভারতীয় জনগণের প্রশংসা কুড়িয়ে থাকেন; স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুমোদন করিয়ে নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশের মানুষের সমীহ পাওয়ার দাবিদার। নিজ দলের বিরোধিতাকেও আমলে নেননি তিনি। ট্র্যাজেডি হলো, কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তি সই করলেও তিনি বা তাঁর উত্তরসূরি কোনো কংগ্রেস সরকার এটি পার্লামেন্টে অনুমোদন করাতে পারেনি। করলেন কংগ্রেসের কট্টর বিরোধী বলে পরিচিত মোদির সরকার। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও সদিচ্ছার কারণেই ৬৭ বছরের পুরোনো ছিটমহল ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। কেউ আর ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক’ থাকবেন না।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনাগুলোকে খাটো করে দেখেছিল, মোদির এই সফর সেই ভ্রান্তি সংশোধন করবে
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়; ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলাকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করলেও আত্মিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভাগ করতে পারেনি; ওপারে গঙ্গা, এপারে পদ্মার তীরের মানুষগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি, রুচি, খাদ্যাভ্যাস প্রায় অভিন্ন। পয়লা বৈশাখে, ঈদ কিংবা দুর্গোৎসবে দুই দেশের মানুষ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে স্বজনদের কাছে ছুটে যায়; যদি সশস্ত্র সান্ত্রিরা বাধা দেয়; কাঁটাতারের ভেতর থেকে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানায়। এই আবেগ ও ভালোবাসা রাষ্ট্রীয় কোনো আচার দিয়ে রুদ্ধ করা যায় না। মোদির ঢাকা সফর অতীতের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন পেছনে ফেলে সময়ের দাবি মেটাতে সক্ষম হবে বলে বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
আমরা যদি আরেকটু পেছনে ফিরে তাকাই দেখব, ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশে বিভক্ত হলেও দুই দেশের মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাবের ও মনের আদান-প্রদান যথারীতি চলছিল ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ’৬৫-তে ১৭ দিনের যুদ্ধ কেবল দুটি দেশকে দূরে সরিয়ে দেয়নি; দেশের ভেতরের মানুষগুলোকেও পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করেছে। জারি হয়েছিল শত্রু সম্পত্তি আইন, যা ভিন্ন নামে এখনো রয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়ার ৪৪ বছর পরও অনেকে সেই মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি—না ভারতে, না বাংলাদেশে। তাই রাজনীতি চিহ্নিত হয় ভারতপন্থী কিংবা পাকিস্তানপন্থী হিসেবে। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইসলামি মৌলবাদীদের মদদদাতা আখ্যায়িত করে তাঁকে যেন মোদির সফরসঙ্গী করা না হয়, সেই ফতোয়া দেন কেউ কেউ। সাম্প্রদায়িকতা দুই তরফেই আছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলের খবর অনুযায়ী এবার মোদির সফরে নিরাপত্তা ও কানেকটিভিটি বা সংযোগ গুরুত্ব পাবে। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। দুই প্রতিবেশী দেশ নিরাপত্তা বিধানে একযোগে কাজ করবে, নিরাপত্তার বাধাগুলো সরিয়ে দিতে একে অপরকে সহায়তা করবে, এটাই প্রত্যাশিত। তারা কেউ কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। মোদি দুই দেশের জনগণের কল্যাণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন সত্য; কিন্তু সহযোগিতার বর্তমান চিত্রটি মোটেই উজ্জ্বল নয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে সুখের সময়ে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণ। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি যেখানে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৪–১৪ অর্থবছরে বেড়েছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ভারতীয় সাংবাদিক অগ্নি রায়ের ভাষায়, এই অবস্থায় বাংলাদেশের চাহিদার তালিকা স্থলসীমান্ত চুক্তির মধ্যে আটকে থাকবে না। তিস্তার জল থেকে বাণিজ্যবৈষম্য, রপ্তানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চাহিদাটিও মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে ভারতের সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ যুক্তরাজ্য ও জাপান তো বটেই, এমনকি পাকিস্তানের চেয়ে কম হওয়াটাকে কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সৈয়দ মুনির খসরু প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি কমাতে যেখানে বাংলাদেশ সম্ভাব্য সবকিছু করেছে, সেখানে সীমান্তে হত্যা বন্ধে তাদের দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না।
ভারতের প্রখ্যাত গবেষক সি রাজা মোহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ লিখেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনাগুলোকে খাটো করে দেখেছিল, মোদির এই সফর সেই ভ্রান্তি সংশোধন করবে। আশা করি, সাউথ ব্লকের কর্তাব্যক্তিরা তাঁর বার্তাটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবেন না।
আমরা মনে করি, মোদির প্রস্তাবিত কানেকটিভিটি কেবল বাসযাত্রায় সীমিত থাকবে না, এই অঞ্চলের যেকোনো দেশের নাগরিকদের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যেকোনো পথে অন্য দেশে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ট্রেন যোগাযোগ চালু ছিল, সেটিকে আমরা কেন ফের পুনরুজ্জীবিত করব না? ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দিল্লিতে প্রাতরাশ করে লাহোরে মধ্যাহ্নভোজের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
আমরাও চাই, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র অক্ষুণ্ন থাকবে, স্বার্থ নিয়ে দর–কষাকষিও চলবে। কিন্তু সেটি শত্রুতায় রূপ নেবে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করবে না। বাংলাদেশ বা ভারত থেকে কেউ পাকিস্তানে গেলে কাছাকাছি থানায় নিজের অবস্থান জানাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক ভারতে কিংবা ভারতের নাগরিক বাংলাদেশে এলেও একই ব্যবস্থা কেন চালু থাকবে? হোক সেটি ভ্রমণ বা চিকিৎসার জন্য যাওয়া। মনে সন্দেহ রেখে বন্ধুত্ব হয় না।
মোদির সফরটি সংক্ষিপ্ত হলেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এমন এক সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন, যখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে, যখন কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং ঢাকা-গুয়াহাটি-শিলং বাস সার্ভিস চালু হওয়ার পথে, তখন বাংলাদেশ তিস্তার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার পেতে চাইবে। তাঁর সফরকালে যোগােযাগ, নিরাপত্তা, জ্বালানিসহ দ্বিপক্ষীয় বহু বিষয়ে আলোচনা ও চুক্তি সই হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। কূটনীতিকেরা সহযোগিতার নানা দিক তুলে ধরবেন। কিন্তু এসব আনুষ্ঠানিকতার মোড়ক থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে হৃদয়ের গভীরে কী করে স্থান দেওয়া যায়, সেই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকায় অবস্থানকালে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, নাগরিক ও তরুণ সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করবেন, কথা বলবেন, তাঁদের কথা শুনবেন। এমনকি সেলফিও তুলতে পারেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে রাজধানী শহরকে নানা রঙের ব্যানারে-ফেস্টুনে সাজানো হয়েছে। এসবের মাধ্যমে তাঁর প্রতি সরকার ও জনগণের আন্তরিকতাই
প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারবেন কি? তাদের চাওয়া সামান্যই—সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব। তাঁরা চায় ভিসা পাওয়ার পথটি যেন সহজ হয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’ হিসেবে অভিহিত করলেও দেশটি তাঁর সফর তালিকায় এল ১৯ নম্বরে। বাংলাদেশ সফরের আগেই তিনি নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসেছেন। বাংলাদেশ কি তাঁর সফর তালিকার শীর্ষে থাকতে পারত না? হ্যাঁ, পারত, যদি না ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্থলসীমান্ত চুক্তি ও তিস্তার পানি বণ্টনে বাদ সাধতেন; যদি না মোদির নিজের দল বিজেপিও সীমান্ত চুক্তিটিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। মোদির বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যতই বলুন না কেন, তাঁরা ‘দাদাগিরি’ ছেড়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ ভাই হিসেবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান, ভেতরে ভেতরে দাদাগিরিটা পুরো ছাড়তে পারেননি দেশটির কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেরা।
ঢাকা সফরের আগমুহূর্তে নরেন্দ্র মোদি টুইটারে জানিয়ে দিয়েছেন: ‘আমি অত্যন্ত উৎসাহ ও আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই, আমি এমন এক দেশ সফরে যাচ্ছি, যার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত জোরদার।’ তাঁর সফর দুই দেশের জনগণের কল্যাণের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অামরাও চাই, অতীতের সব সংশয়-সন্দেহ পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হোক, প্রসারিত হোক বন্ধুত্বের হাত। কিন্তু দুই দেশেই অতি উগ্র রাজনীতি সেই পথ আগলে থাকে। ৪৪ বছর ধরে আমরা এক পা এগোই, দুই পা পিছিয়ে যাই।
মোদি বাংলাদেশ ও ভারতের স্থলসীমান্ত চুক্তিকে বার্লিন ওয়ালের পতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, বার্লিন দেয়াল দিয়ে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের জনগণের যাতায়াত বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন পূর্ব জার্মানি। সেই দেয়াল পেরিয়ে যাঁরাই সীমান্ত পার হতেন, তাঁদেরই গুলি খেয়ে মরতে হতো। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তেও একই ঘটনা ঘটছে। বার্লিনে দেয়াল ছিল, এখানে আছে কাঁটাতারের বেড়া।
ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি কমাতে যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ভারতীয় জনগণের প্রশংসা কুড়িয়ে থাকেন; স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুমোদন করিয়ে নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশের মানুষের সমীহ পাওয়ার দাবিদার। নিজ দলের বিরোধিতাকেও আমলে নেননি তিনি। ট্র্যাজেডি হলো, কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তি সই করলেও তিনি বা তাঁর উত্তরসূরি কোনো কংগ্রেস সরকার এটি পার্লামেন্টে অনুমোদন করাতে পারেনি। করলেন কংগ্রেসের কট্টর বিরোধী বলে পরিচিত মোদির সরকার। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও সদিচ্ছার কারণেই ৬৭ বছরের পুরোনো ছিটমহল ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। কেউ আর ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক’ থাকবেন না।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনাগুলোকে খাটো করে দেখেছিল, মোদির এই সফর সেই ভ্রান্তি সংশোধন করবে
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়; ঔপনিবেশিক শক্তি বাংলাকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করলেও আত্মিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভাগ করতে পারেনি; ওপারে গঙ্গা, এপারে পদ্মার তীরের মানুষগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি, রুচি, খাদ্যাভ্যাস প্রায় অভিন্ন। পয়লা বৈশাখে, ঈদ কিংবা দুর্গোৎসবে দুই দেশের মানুষ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে স্বজনদের কাছে ছুটে যায়; যদি সশস্ত্র সান্ত্রিরা বাধা দেয়; কাঁটাতারের ভেতর থেকে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানায়। এই আবেগ ও ভালোবাসা রাষ্ট্রীয় কোনো আচার দিয়ে রুদ্ধ করা যায় না। মোদির ঢাকা সফর অতীতের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন পেছনে ফেলে সময়ের দাবি মেটাতে সক্ষম হবে বলে বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
আমরা যদি আরেকটু পেছনে ফিরে তাকাই দেখব, ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশে বিভক্ত হলেও দুই দেশের মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাবের ও মনের আদান-প্রদান যথারীতি চলছিল ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ’৬৫-তে ১৭ দিনের যুদ্ধ কেবল দুটি দেশকে দূরে সরিয়ে দেয়নি; দেশের ভেতরের মানুষগুলোকেও পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করেছে। জারি হয়েছিল শত্রু সম্পত্তি আইন, যা ভিন্ন নামে এখনো রয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়ার ৪৪ বছর পরও অনেকে সেই মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি—না ভারতে, না বাংলাদেশে। তাই রাজনীতি চিহ্নিত হয় ভারতপন্থী কিংবা পাকিস্তানপন্থী হিসেবে। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইসলামি মৌলবাদীদের মদদদাতা আখ্যায়িত করে তাঁকে যেন মোদির সফরসঙ্গী করা না হয়, সেই ফতোয়া দেন কেউ কেউ। সাম্প্রদায়িকতা দুই তরফেই আছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলের খবর অনুযায়ী এবার মোদির সফরে নিরাপত্তা ও কানেকটিভিটি বা সংযোগ গুরুত্ব পাবে। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। দুই প্রতিবেশী দেশ নিরাপত্তা বিধানে একযোগে কাজ করবে, নিরাপত্তার বাধাগুলো সরিয়ে দিতে একে অপরকে সহায়তা করবে, এটাই প্রত্যাশিত। তারা কেউ কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। মোদি দুই দেশের জনগণের কল্যাণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন সত্য; কিন্তু সহযোগিতার বর্তমান চিত্রটি মোটেই উজ্জ্বল নয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে সুখের সময়ে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণ। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি যেখানে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৪–১৪ অর্থবছরে বেড়েছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ভারতীয় সাংবাদিক অগ্নি রায়ের ভাষায়, এই অবস্থায় বাংলাদেশের চাহিদার তালিকা স্থলসীমান্ত চুক্তির মধ্যে আটকে থাকবে না। তিস্তার জল থেকে বাণিজ্যবৈষম্য, রপ্তানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চাহিদাটিও মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে ভারতের সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ যুক্তরাজ্য ও জাপান তো বটেই, এমনকি পাকিস্তানের চেয়ে কম হওয়াটাকে কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সৈয়দ মুনির খসরু প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি কমাতে যেখানে বাংলাদেশ সম্ভাব্য সবকিছু করেছে, সেখানে সীমান্তে হত্যা বন্ধে তাদের দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না।
ভারতের প্রখ্যাত গবেষক সি রাজা মোহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ লিখেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনাগুলোকে খাটো করে দেখেছিল, মোদির এই সফর সেই ভ্রান্তি সংশোধন করবে। আশা করি, সাউথ ব্লকের কর্তাব্যক্তিরা তাঁর বার্তাটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবেন না।
আমরা মনে করি, মোদির প্রস্তাবিত কানেকটিভিটি কেবল বাসযাত্রায় সীমিত থাকবে না, এই অঞ্চলের যেকোনো দেশের নাগরিকদের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যেকোনো পথে অন্য দেশে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ট্রেন যোগাযোগ চালু ছিল, সেটিকে আমরা কেন ফের পুনরুজ্জীবিত করব না? ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দিল্লিতে প্রাতরাশ করে লাহোরে মধ্যাহ্নভোজের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
আমরাও চাই, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র অক্ষুণ্ন থাকবে, স্বার্থ নিয়ে দর–কষাকষিও চলবে। কিন্তু সেটি শত্রুতায় রূপ নেবে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করবে না। বাংলাদেশ বা ভারত থেকে কেউ পাকিস্তানে গেলে কাছাকাছি থানায় নিজের অবস্থান জানাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক ভারতে কিংবা ভারতের নাগরিক বাংলাদেশে এলেও একই ব্যবস্থা কেন চালু থাকবে? হোক সেটি ভ্রমণ বা চিকিৎসার জন্য যাওয়া। মনে সন্দেহ রেখে বন্ধুত্ব হয় না।
মোদির সফরটি সংক্ষিপ্ত হলেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এমন এক সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন, যখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে, যখন কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং ঢাকা-গুয়াহাটি-শিলং বাস সার্ভিস চালু হওয়ার পথে, তখন বাংলাদেশ তিস্তার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার পেতে চাইবে। তাঁর সফরকালে যোগােযাগ, নিরাপত্তা, জ্বালানিসহ দ্বিপক্ষীয় বহু বিষয়ে আলোচনা ও চুক্তি সই হবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। কূটনীতিকেরা সহযোগিতার নানা দিক তুলে ধরবেন। কিন্তু এসব আনুষ্ঠানিকতার মোড়ক থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে হৃদয়ের গভীরে কী করে স্থান দেওয়া যায়, সেই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকায় অবস্থানকালে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, নাগরিক ও তরুণ সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করবেন, কথা বলবেন, তাঁদের কথা শুনবেন। এমনকি সেলফিও তুলতে পারেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে রাজধানী শহরকে নানা রঙের ব্যানারে-ফেস্টুনে সাজানো হয়েছে। এসবের মাধ্যমে তাঁর প্রতি সরকার ও জনগণের আন্তরিকতাই
প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারবেন কি? তাদের চাওয়া সামান্যই—সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব। তাঁরা চায় ভিসা পাওয়ার পথটি যেন সহজ হয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments