এক বিচারপতির প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ by আসিফ নজরুল

বিচারপতি খায়রুল হক নানা কারণে আলোচিত ছিলেন। প্রথা ভেঙে প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিচারপতি থাকা অবস্থায় তিনিসহ অন্য কয়েকজন বিচারপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। তাঁর আচরণের চেয়েও বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল তাঁর কয়েকটি রায়। তিনি অনেকাংশে রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন। এই রায় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর একটি অংশকে যেমন প্রীত করেছিল, অন্য অংশকে তেমনি ক্ষুব্ধ করেছিল।

পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমী রায় প্রদান করে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন, অথচ একই মামলায় সামরিক ফরমানবলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য প্রদত্ত কিছু সুবিধা বহাল রেখেছেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েক দিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করায় দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। এই মামলায় নিজেরই দেওয়া সংক্ষিপ্ত আদেশ থেকে বিতর্কিতভাবে সরে এসে তিনি যে রায় দেন, তা ছিল আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পাসকৃত পঞ্চদশ সংশোধনীর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
তাঁর অনেক রায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য সুবিধাজনক বা এর সমর্থনসূচক। এসব রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়েও। তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রতি সরকারের বিশেষ সুদৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অস্বস্তিকর সন্দেহ ছিল। এই সন্দেহ তিনি সম্প্রতি আবারও উসকে দিলেন তাঁর অবসর গ্রহণের প্রায় দুই বছর পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করে।
বিচারপতি হকের আগে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আরও কয়েকজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু তাঁরা বিচারপতি হকের মতো আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন না। তাঁদের কেউ নিজের বিভিন্ন রায়ে এমন অবস্থানও গ্রহণ করেননি, যার পরিপ্রেক্ষিতে অবসর-পরবর্তী কোনো সরকারি নিয়োগ অনৈতিক মনে হতে পারে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বিচারপতি হকের নিয়োগ গ্রহণ তাই প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর নিয়োগ ভবিষ্যতে আইন কমিশন কর্তৃক কোনো সাংবিধানিক বা আইনি প্রশ্নে সুপারিশ দেওয়া হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করবে। এটি উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের অবসর-পরবর্তী সময়ে নিয়োগ-সুবিধাদির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার নতুন তাগিদও সৃষ্টি করেছে।
দুই
উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের অবসর গ্রহণের পর পুনরায় সরকারি চাকরিতে তাঁর নিয়োগকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। গণপরিষদ বিতর্কে চাকরিকালীন বিচারকদের নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য এটি প্রয়োজন বলে অভিমত দেওয়া হয়। আবদুল বারী শিকদার বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয় যে যদি অবসরের পর বিচারকদের সরকারি কোনো পদে নিয়োগের বিধান থাকে, তাহলে বিচারকেরা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের দিকে চোখ রেখে কর্তৃপক্ষগুলোর পক্ষে রায় দিতে প্রভাবিত হতে পারেন (২০০৫ সালে মানবজমিন বনাম বাংলাদেশ মামলায় অনুরূপ পর্যবেক্ষণ করা হয়)। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৭ সালের এক সামরিক ফরমানবলে সম্ভবত এই সম্ভাবনাকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের অবসর-পরবর্তী সময়ে বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় (জুডিশিয়াল অর কোয়াসি-জুডিশিয়াল) পদে সরকারি চাকরিতে (প্রজাতন্ত্রের কর্মে) নিয়োগদানের বিধান করা হয়। ১৯৯৬ সালে বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগদানের বিধানও করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে বিচারপতিদের নিয়োগ রাজনৈতিক সমঝোতাপ্রসূত একটি বিষয় ছিল এবং এই পদটি প্রচলিত অর্থে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত পদের মতো নয়। তবু বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় এই পদে বিচারকদের অবসর-পরবর্তী সময়ে নিয়োগ উচ্চ আদালতের নিরপেক্ষতার জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁরই নির্দেশক্রমে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বিচারকদের অবসর গ্রহণ করার পর প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের কর্মে নিয়োগকে অবৈধ করা হয়, যদিও এ-সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট উল্লেখ তাঁর রায়ে ছিল না।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির সমান মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে তাঁর নিয়োগ গ্রহণ স্ববিরোধিতামূলক। তিনি পঞ্চম সংশোধনী মামলায় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সালের সব সামরিক আদেশ ও ফরমানকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেন। অবৈধ ঘোষিত ফরমানবলে প্রতিষ্ঠিত অবসর-পরবর্তী নিয়োগ-সুবিধা তিনি অন্তত নিজে গ্রহণ করতে পারেন কি না, এই প্রশ্ন তাই করা যেতে পারে। তা ছাড়া যে বিবেচনায় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের নিয়োগ অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন, সেই একই বিবেচনায় তাঁর কর্তৃক একটি লাভজনক নিয়োগ গ্রহণ নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমাকে দেওয়া মিজানুর রহমান খানের তথ্যানুযায়ী বিচারপতি হক তাঁকে একবার বলেছিলেন যে তাঁর কোনো একটি রায়ে তিনি অবসর গ্রহণের দুই বছরের মধ্যে কোনো সরকারি নিয়োগ গ্রহণ অনুচিত বলেছিলেন। তাহলে কি দুই বছর সময়কাল পূরণের জন্য ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর থেকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদটি খালি রাখা হয়েছিল তাঁকে নিয়োগদানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে?
তিন
পঞ্চদশ সংশোধনী অনুসারে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের প্রজাতন্ত্রের বিচারিক বা আধা বিচারিক কর্মে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যপদে নিয়োগ বিচারিক বা আধা বিচারিক পদে নিয়োগ কি না, এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা যায়।
বাংলাদেশ আইন কমিশন আইন, ১৯৯৬ অনুসারে আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় অচল আইনগুলো বাতিল, প্রচলিত অন্যান্য আইন সংস্কার এবং ক্ষেত্রবিশেষে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করার জন্য। এসব কাজের কোনোটিই সরাসরিভাবে বিচারিক বা আধা বিচারিক নয়। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যপদে নিয়োগ ও অপসারণ-প্রক্রিয়ার মধ্যেও এমন কোনো প্রতিফলন নেই। নির্বাচন কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি বা অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণের মতো আধা বিচারিক কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত এবং এসব পদে অপসারণ-প্রক্রিয়াও উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ-প্রক্রিয়ার অনুরূপ। অন্যদিকে, আইন কমিশনের নিয়োগ বা অপসারণ এককভাবে সরকারের নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছাধীন। কমিশনের কার্যাবলি এবং এতে নিয়োগ বা এ থেকে অপসারণ—কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে বিচারিক বা আধা বিচারিক বৈশিষ্ট্যগুলো নেই। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যপদে বিচারপতিদের নিয়োগ নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে বিচারপতি খায়রুল হকের মতো পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে কিছু মহল থেকে সমালোচিত কোনো বিচারপতিকে স্পষ্টভাবে বিচারিক বা আধা বিচারিকও নয়, এমন পদে নিয়োগ তাঁর প্রতি সরকারের বিশেষ সুদৃষ্টি কি না, এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা যেতে পারে। এমনকি এই ‘সুদৃষ্টি’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলায় বর্তমান সরকারের পছন্দ মোতাবেক রায় প্রদানের স্বার্থে তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের (নিজের সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদানে অস্বাভাবিক সময় গ্রহণ, পূর্ণাঙ্গ রায় একবার ফেরত নিয়ে তাতে আবারও পরিবর্তন আনা) পুরস্কার কি না, এ প্রশ্নেরও উদ্রেক করতে পারে।
চার
বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের ৩১১ ও ৩১২ নম্বর পৃষ্ঠায় তাঁর একটি সন্দেহের কথা লিখে গেছেন। ২০০১ সালের ১১ জানুয়ারির এই ঘটনায় আপিল বিভাগে একজন বিচারকের নিয়োগের প্রতিবাদে একদল আইনজীবী (সম্ভবত বিএনপিপন্থী) করিডরে শুয়ে পড়ে তাঁদের ক্ষোভ জানাতে থাকেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি লতিফুর রহমান) তাঁদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করতে অনীহা প্রকাশ করলে জাজেস লাউঞ্জে প্রায় ৫০ জন বিচারককে অন্তত দুই ঘণ্টা আটক থাকতে হয়। উল্লিখিত প্রধান বিচারপতি পরে নিয়মানুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ লাভ করেন। খায়রুল হক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাঁহার অবচেতন মনে প্রধান উপদেষ্টা হইবার আকাঙ্ক্ষাই কি তাঁহাকে প্রয়োজনীয় দৃঢ় পদক্ষেপ লইতে বাধা সৃষ্টি করিয়াছিল? তাঁহার মানসিক অবস্থান জানা সম্ভব নয়, কিন্তু ইহা একটি সম্ভাবনা বটে। নিশ্চিত হইবার প্রয়োজন নাই, এইরূপ সম্ভাবনাই বিচার বিভাগের জন্য সম্মানহানিকর এবং স্বাধীনতার পরিপন্থী।’
বিচারপতি লতিফুর রহমান শুধু বিক্ষোভরত আইনজীবীদের সরে যেতে বলেননি বলে বিচারপতি খায়রুল হকের এমন সন্দেহ হয়েছিল এবং তিনি তা তাঁর রায়ে লিখিতভাবে দেশবাসীকে জানিয়েছেন। তাঁর কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন, সিনিয়রদের ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি পদে তাঁকে নিয়োগের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল প্রশ্নে তিনি যেভাবে নিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বর্তমান সরকারের পঞ্চদশ সংশোধনীর অনুরূপ রায় দিয়েছেন, তাতে তাঁর ক্ষেত্রেও কি অনুরূপ সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ নেই? বিশেষ করে অবসর গ্রহণের পর তিনি বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রধান বিচারপতির মর্যাদা ও সুবিধা নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে ‘পুরস্কৃত’ হওয়ার পর এই সন্দেহ কি আরও প্রগাঢ় হওয়া স্বাভাবিক নয়?
আইন কমিশনের একটি কাজ হচ্ছে সরকার কর্তৃক প্রেরিত আইনি বিষয়ে সুপারিশ করা। ফলে ভবিষ্যতে নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনি জটিলতা নিয়েও সরকার কমিশনের কাছে কোনো সুপারিশ চাইতে পারে। আমার আশঙ্কা, কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বিচারপতি খায়রুল হকের নিয়োগের কারণে কমিশনের কোনো সুপারিশ নতুন রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। তাঁর নিয়োগ রাজনৈতিক বিষয়গুলোয় তাঁর রায়গুলোর গ্রহণযোগ্যতাকেও নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিচারপতি খায়রুল হক শুধু একা নন। সরকারের সুদৃষ্টি পেয়েছেন এবং সরকারের অনুকূলে রায় দিয়েছেন এমন বিচারক আরও কেউ কেউ ছিলেন এবং আছেন বিচার বিভাগে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.