শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন by মোঃ মুজিবুর রহমান
২৮
জুলাই এক অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন
অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার মান সবচেয়ে খারাপ।
শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও দুর্বল মাধ্যমিক শিক্ষা।’
তিনি শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রীর
উপস্থিতিতেই। অনুষ্ঠানে সরকারের শিক্ষা বিভাগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের
কর্মকর্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা সচিব এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা
অধিদফতরের মহাপরিচালকও। মাধ্যমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন শুধু
অর্থমন্ত্রীর একার নয়। আমার ধারণা, সাধারণ মানুষের মনেও মাধ্যমিক শিক্ষার
মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যেমন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস না
হওয়া, স্কুলগুলোয় মানসম্মত পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা, শিক্ষা উপকরণের অভাব,
সরকারের দেয়া বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তে নোট-গাইডের ওপর
শিক্ষার্থীদের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়া, স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের প্রতি
বেশি আকর্ষণ অনুভব করা ইত্যাদি। এত কিছুর পরও দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর
এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ছে। এমনকি আগে যেসব স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে
একজন শিক্ষার্থীও পাস করত না, এখন সেসব প্রতিষ্ঠান থেকেও জিপিএ-৫ পেয়ে পাস
করার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। পরীক্ষায় পাসের হার বেড়ে যাওয়ায় আমরা আশান্বিত।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সবাই পাস করবে, এটা সব অভিভাবকই চান। তবে
পরীক্ষায় কতজন জিপিএ-৫ পেয়েছে, তা দিয়ে যেমন পরীক্ষার ফলাফলের পরিমাণগত দিক
বোঝায়, তেমনি যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করছে তারা শিক্ষাক্রমে বর্ণিত
শিখন অভিজ্ঞতা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে কিংবা আদৌ অর্জন করতে পারছে কি-না,
সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার
স্বার্থেই। পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেই যে গুণগত মান বাড়বে, এমনটি সব সময়
সত্য বলে ধরে নেয়া যায় না। এ পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক শিক্ষার মান নিয়ে
অর্থমন্ত্রীর অভিমত বিবেচনা করতে হবে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে।
মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানের সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাতে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ অনেক সময় সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সম্পন্ন হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নানামুখী চাপে পড়ে কখনও কখনও অযোগ্য ব্যক্তিকেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়। এভাবে শিক্ষক নিয়োগ হলে পরে একসময় চাপ আসে ওই শিক্ষকদের সরকারি বেতনের আওতায় (এমপিওভুক্তি) নিয়ে আসার জন্য। অর্থমন্ত্রী এমপিওভুক্তির বিষয়টিও সেদিনের আলোচনায় তুলে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদিও সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয় এ খাতে, কিন্তু এমপিও পদ্ধতি মাধ্যমিক শিক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আগামী ৫ বছর এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’ (সমকাল, ২৯.০৭.১৩)। অর্থমন্ত্রীর অভিমত মেনে নিয়ে আমরা বলব, বর্তমানে যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হয়, তার পরিবর্তন জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ দেখা যায়, অযোগ্য ব্যক্তি একবার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলে পরে কোনো না কোনো সময় এমপিওভুক্ত হয়ে যান। আবার সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমেও অনেক সময় অযোগ্য ও দুর্বল ব্যক্তিরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। ফলে শিক্ষার মানের আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটে না। দুর্বল শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন আশা করা যায় না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করলেও এ প্রক্রিয়াটি মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। কারণ এটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয় মাত্র। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে যাদের নিবন্ধন রয়েছে তারা আবেদন করতে পারেন। কিন্তু নিয়োগের বিষয়টি অনেক সময় চাপ প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করার আশংকা বেড়ে যায়। এভাবে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত হয় না। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বলই থেকে যাচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় যখন দেখা যায়, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অর্ধেকেরও বেশি পরীক্ষার্থী ন্যূনতম নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়। পড়ালেখার মান কী পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের অনার্স পার্ট-১ পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে। ওই পরীক্ষায় শতকরা ৪৬ ভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে এবং বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী পাঁচটিরও বেশি কোর্সে ফেল করেছে। একপর্যায়ে ফেল করা শিক্ষার্থীরা প্রমোশনের জন্য আন্দোলন শুরু করলে পরীক্ষায় অবতীর্ণদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ ৫টি কোর্সে শতকরা ৪০ নম্বরের নিচে অর্থাৎ ‘এফ’ গ্রেড পেয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিশেষ বিবেচনায় শর্ত সাপেক্ষে ২য় বর্ষে প্রমোশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনার্স পরীক্ষায় এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কেন ফেল করল, এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ পরীক্ষায় ফেল করা এবং পরবর্তীকালে প্রমোশন দেয়ার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার মানের প্রশ্নটি জড়িয়ে রয়েছে গভীরভাবে। এখন খুঁজে দেখতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত গ্রেডিং পদ্ধতিতে কোনো ত্র“টি রয়েছে কি-না। কারণ ফেল করার দায় এককভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। শিক্ষার্থীরা যাতে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারে, সে পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া এবং নিয়মিত ক্লাস অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এখন আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য কী কী উপায় অনুসরণ করা যায়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বলব, আগস্টে ওই সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সমিতি ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে। এটি পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের সংগঠন হওয়ায় দেশ ও জাতি গঠনে এ সমিতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ সংগঠনের কাছে জাতির প্রত্যাশাও অনেক বেশি। আমরা আশ্চর্য হই যখন দেখি, এ ধরনের সংগঠন নির্বাচন উপলক্ষে দেশজুড়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে কিংবা কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজিত সমস্যা নিরসন করা যায়, সেসব বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের কোনো উদ্যোগ নিতে সচরাচর দেখা যায় না। এমনকি নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে মাঠপর্যায়ে তাদের কোনো তৎপরতাও তেমন একটা দেখা যায় না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি মাঝে মাঝে শুধু শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন করত, তাহলে শিক্ষার মান নিয়ে আজ এত বড় প্রশ্ন উঠত না।
বর্তমান সরকার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোটি কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করছে, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে, জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে একটি দুরূহ কাজ হিসেবে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১৭ বছরের পুরনো শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে, নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমের আওতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত রয়েছে। তারপরও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে কী করা দরকার, সে বিষয়টি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সদস্যরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। প্রয়োজনে এসব বিষয় নিয়ে দেশজুড়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে।
শেষ করার আগে শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। কারণ ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টিও সেদিন আলোচিত হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ১৩শ বিসিএস পর্যন্ত অধ্যাপক, ১৮শ বিসিএস পর্যন্তদের সহযোগী অধ্যাপক এবং ২৪তম বিসিএসপ্রাপ্তদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে (দৈনিক যায়যায়দিন)। এখানে বলা দরকার, শুধু ১৩শ বিসিএস পর্যন্তদের অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হলেও পদোন্নতির বাইরে থেকে যাবে পরবর্তী বিসিএসের আরও বহুসংখ্যক যোগ্য শিক্ষক। এর মধ্যে দেখা যায়, ১৪শ বিসিএস পর্যন্ত অনেকেই সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পর বর্তমানে প্রায় ৭ বছর ধরে একই পদে কর্মরত রয়েছেন। এমনকি অনেক শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন বহু বছর ধরে। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক পদে ২ বছরের এবং সহকারী অধ্যাপক পদে ৩ বছরের কর্মকাল পূর্ণ হওয়ার পর যথাক্রমে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শুধু ৭ বছর নয়, বরং আরও বেশি সময় ধরে অনেক শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক পদে এবং ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন। বিশেষ করে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোয় কর্মরত অনেক শিক্ষক ৭-৮ বছর ধরে সহযোগী অধ্যাপক এবং সমমর্যাদার উপাধ্যক্ষ পদে কাজ করছেন। এসব শিক্ষক অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তির নির্ধারিত সময় অনেক আগেই পার করলেও তাদের অবসর গ্রহণের আগে চাকরিজীবনের শেষ পদোন্নতি পাবেন কি-না তা নিশ্চিত নয়। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের স্বার্থেই এসব বিষয় ভেবে দেখতে হবে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানের সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে যে পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাতে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ অনেক সময় সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সম্পন্ন হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নানামুখী চাপে পড়ে কখনও কখনও অযোগ্য ব্যক্তিকেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়। এভাবে শিক্ষক নিয়োগ হলে পরে একসময় চাপ আসে ওই শিক্ষকদের সরকারি বেতনের আওতায় (এমপিওভুক্তি) নিয়ে আসার জন্য। অর্থমন্ত্রী এমপিওভুক্তির বিষয়টিও সেদিনের আলোচনায় তুলে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদিও সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয় এ খাতে, কিন্তু এমপিও পদ্ধতি মাধ্যমিক শিক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আগামী ৫ বছর এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’ (সমকাল, ২৯.০৭.১৩)। অর্থমন্ত্রীর অভিমত মেনে নিয়ে আমরা বলব, বর্তমানে যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হয়, তার পরিবর্তন জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ দেখা যায়, অযোগ্য ব্যক্তি একবার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলে পরে কোনো না কোনো সময় এমপিওভুক্ত হয়ে যান। আবার সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমেও অনেক সময় অযোগ্য ও দুর্বল ব্যক্তিরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। ফলে শিক্ষার মানের আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটে না। দুর্বল শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন আশা করা যায় না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করলেও এ প্রক্রিয়াটি মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। কারণ এটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয় মাত্র। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে যাদের নিবন্ধন রয়েছে তারা আবেদন করতে পারেন। কিন্তু নিয়োগের বিষয়টি অনেক সময় চাপ প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করার আশংকা বেড়ে যায়। এভাবে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত হয় না। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বলই থেকে যাচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় যখন দেখা যায়, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অর্ধেকেরও বেশি পরীক্ষার্থী ন্যূনতম নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়। পড়ালেখার মান কী পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের অনার্স পার্ট-১ পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে। ওই পরীক্ষায় শতকরা ৪৬ ভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে এবং বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী পাঁচটিরও বেশি কোর্সে ফেল করেছে। একপর্যায়ে ফেল করা শিক্ষার্থীরা প্রমোশনের জন্য আন্দোলন শুরু করলে পরীক্ষায় অবতীর্ণদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ ৫টি কোর্সে শতকরা ৪০ নম্বরের নিচে অর্থাৎ ‘এফ’ গ্রেড পেয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিশেষ বিবেচনায় শর্ত সাপেক্ষে ২য় বর্ষে প্রমোশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনার্স পরীক্ষায় এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কেন ফেল করল, এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ পরীক্ষায় ফেল করা এবং পরবর্তীকালে প্রমোশন দেয়ার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার মানের প্রশ্নটি জড়িয়ে রয়েছে গভীরভাবে। এখন খুঁজে দেখতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত গ্রেডিং পদ্ধতিতে কোনো ত্র“টি রয়েছে কি-না। কারণ ফেল করার দায় এককভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। শিক্ষার্থীরা যাতে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারে, সে পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া এবং নিয়মিত ক্লাস অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এখন আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য কী কী উপায় অনুসরণ করা যায়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বলব, আগস্টে ওই সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সমিতি ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে। এটি পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদের সংগঠন হওয়ায় দেশ ও জাতি গঠনে এ সমিতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ সংগঠনের কাছে জাতির প্রত্যাশাও অনেক বেশি। আমরা আশ্চর্য হই যখন দেখি, এ ধরনের সংগঠন নির্বাচন উপলক্ষে দেশজুড়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে কিংবা কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজিত সমস্যা নিরসন করা যায়, সেসব বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের কোনো উদ্যোগ নিতে সচরাচর দেখা যায় না। এমনকি নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে মাঠপর্যায়ে তাদের কোনো তৎপরতাও তেমন একটা দেখা যায় না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি মাঝে মাঝে শুধু শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে মতবিনিময়ের আয়োজন করত, তাহলে শিক্ষার মান নিয়ে আজ এত বড় প্রশ্ন উঠত না।
বর্তমান সরকার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোটি কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করছে, একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে, জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে একটি দুরূহ কাজ হিসেবে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১৭ বছরের পুরনো শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে, নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমের আওতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত রয়েছে। তারপরও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে কী করা দরকার, সে বিষয়টি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সদস্যরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। প্রয়োজনে এসব বিষয় নিয়ে দেশজুড়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে।
শেষ করার আগে শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের পদোন্নতি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। কারণ ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টিও সেদিন আলোচিত হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ১৩শ বিসিএস পর্যন্ত অধ্যাপক, ১৮শ বিসিএস পর্যন্তদের সহযোগী অধ্যাপক এবং ২৪তম বিসিএসপ্রাপ্তদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে (দৈনিক যায়যায়দিন)। এখানে বলা দরকার, শুধু ১৩শ বিসিএস পর্যন্তদের অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হলেও পদোন্নতির বাইরে থেকে যাবে পরবর্তী বিসিএসের আরও বহুসংখ্যক যোগ্য শিক্ষক। এর মধ্যে দেখা যায়, ১৪শ বিসিএস পর্যন্ত অনেকেই সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পর বর্তমানে প্রায় ৭ বছর ধরে একই পদে কর্মরত রয়েছেন। এমনকি অনেক শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন বহু বছর ধরে। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক পদে ২ বছরের এবং সহকারী অধ্যাপক পদে ৩ বছরের কর্মকাল পূর্ণ হওয়ার পর যথাক্রমে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে শুধু ৭ বছর নয়, বরং আরও বেশি সময় ধরে অনেক শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক পদে এবং ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন। বিশেষ করে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোয় কর্মরত অনেক শিক্ষক ৭-৮ বছর ধরে সহযোগী অধ্যাপক এবং সমমর্যাদার উপাধ্যক্ষ পদে কাজ করছেন। এসব শিক্ষক অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তির নির্ধারিত সময় অনেক আগেই পার করলেও তাদের অবসর গ্রহণের আগে চাকরিজীবনের শেষ পদোন্নতি পাবেন কি-না তা নিশ্চিত নয়। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের স্বার্থেই এসব বিষয় ভেবে দেখতে হবে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
No comments