ফলের রস আর কোমল পানীয়ের প্রতারণায় ক্রেতারা ঠকছে by আবম ফারুক

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে বা যে কোনো টিভি চ্যানেলের সামনে বসলে বিভিন্ন খাদ্য ও পানীয়ের বিজ্ঞাপন আমাদের দেখতে হয়। ব্যবসায়ী তার উৎপাদিত পণ্যকে ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরবেন, তার গুণাগুণ বর্ণনা করবেন তাতে দোষের কিছু নেই। বরং এতে ক্রেতাদেরই সুবিধা। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাজারে যাওয়ার আগে ঘরে বসেই তো কোন পণ্যটি কিনবেন তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বাজারে গিয়ে সহজেই পণ্যটি কিনে ফেলা যায় বলে সময় ও ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। বিজ্ঞাপন তাই পণ্যটির গুণাগুণ সম্পর্কে নানা তথ্য সরবরাহ করে তাকে আকর্ষণ করে, তার মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং পণ্যটি কিনতে তার মনে ইচ্ছা জাগায়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রচারিত খাদ্য ও পানীয়ের বিজ্ঞাপনে আমরা কী দেখছি? আমাদের দেখা অধিকাংশ বিজ্ঞাপনই মিথ্যায় ঠাসা, ক্রেতাকে সঠিক তথ্য সরবরাহের বদলে এগুলো ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে, যে লক্ষ্য বা চাহিদা নিয়ে পণ্যটি ক্রেতা কিনেছিল, তা না পেয়ে প্রতারিত হয়। উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিজ্ঞাপিত খাদ্য ও পানীয় তার স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে।
‘তাজা আমের রস’, ‘তাজা কমলার রস’, ‘আসল আমের মজা’ ইত্যাদি বলে যেসব বিজ্ঞাপন দেয়া হয়, সেগুলোর অধিকাংশতেই শুধু তাজা আমের বা কমলার ছবিটাই থাকে, তাজা বা আসল ফলের কিছুই থাকে না। পানির সঙ্গে কিছু সিএমসির দ্রবণ, সরবিটল, ম্যানিটল, কৃত্রিম মিষ্টিকারক, প্রিজারভেটিভ, কৃত্রিম রং এবং আম বা কমলার কৃত্রিম সুগন্ধ- এই হল এসব ‘তাজা’ ও ‘আসল’ রসের ফর্মুলা। ‘কোনো কৃত্রিম রং নেই’ বলে যারা বিজ্ঞাপন দেন, তারা কিন্তু ক্রেতাকে জানাচ্ছেন না তারা শতকরা কতভাগ আসল আমের বা কমলার রস দিচ্ছেন। ‘হাতের স্পর্শ নেই বলে কোনো প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় না’ এ কথাটার মানে কি? প্রিজারভেটিভ কি হাত লাগলে ব্যবহার করতে হয়, নাকি জীবাণুর গ্রোথ ঠেকানোর জন্য? বিজ্ঞান বিষয়ে যাদের সাধারণ জ্ঞান আছে, তারাও এসব বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবেন। এসব বিজ্ঞাপনের কারণে মনে হয় ক্রেতাকে বিজ্ঞানও এখন আবার নতুন করে পড়তে হবে।
এসব বিজ্ঞাপিত ফলের রসে আসল ফলের রস না থাকায় আপনি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এসব কৃত্রিম ফলের রসে ওপরে বর্ণিত যেসব উপাদান দেয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে প্রধান ক্ষতিকারকগুলো হল কৃত্রিম রং, কৃত্রিম মিষ্টিকারক ও প্রিজারভেটিভ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে কৃত্রিম রং। কৃত্রিম মিষ্টিকারক খেলে মূত্রথলিতে ক্যান্সার, মায়োকার্ডিয়াল ক্যালসিফিকেশন অর্থাৎ সহজ কথায় হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, করোনারি ভেসেলসের স্কে¬রোসিস অর্থাৎ হৃৎপিণ্ডের ধমনি-শিরাগুলো চর্বি জমে শক্ত হয়ে যাওয়া, রিনাল হাইপারপ্লেসিয়া অর্থাৎ কিডনি বড় হয়ে যাওয়া, ফুসফুস, লিভার এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের টিউমার, ফটোসেনসিটাইজেশন তৈরি অর্থাৎ এটি খেয়ে রোদে বের হলে গায়ের রং কালো হয়ে যাওয়া, কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের বিশোষণে বাধা দেয় বলে কোনো কোনো জীবাণুজনিত অসুখ জটিল আকার ধারণ করা, ক্রোমোজমের ক্ষতি অর্থাৎ বাবা-মা এটি খেলে তাদের বিকলাঙ্গ বা অস্বাভাবিক বাচ্চা জন্ম নেয়া, গর্ভবতী মায়েরা এটি খেলে বাচ্চা ডাউনস সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রভাবের বৈজ্ঞানিক অভিযোগ রয়েছে।
দুই
আজকাল পত্রিকা ও টিভিতে দেশী-বিদেশী হরেক নামের কোলা পানীয়ের বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, কোলাজাতীয় পানীয়গুলো শিশুদের ক্ষতি করে। অথচ এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে শিশু-কিশোররা প্রলুব্ধ হয়। কোলাজাতীয় পানীয়ে এদের কোনো উপকার না হয়ে বরং স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়ে থাকে। এ ধরনের পানীয়ে অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের কথা বাদ দিয়ে শুধু ক্যাফেইনের কথাই ধরা যাক। এক কাপ চায়ে প্রায় ২০-২৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে, এক কাপ/মগ কফিতে থাকতে পারে ৫০ মিগ্রা পর্যন্ত ক্যাফেইন। অথচ কোনো কোনো কোল্ড ড্রিংকসের এক বোতল/ক্যানে থাকে ১০০ মিগ্রা পর্যন্ত ক্যাফেইন। আপনি আপনার বাচ্চাকে চা খেতে দেন না তার ক্ষতি হবে ভেবে। অথচ এই বাচ্চাকেই তার আবদারে বা আপনি নিজে থেকে অনায়াসে একটি কোল্ড ড্রিংকস কিনে দিচ্ছেন। তার মানে ক্যাফেইনের হিসেবে আপনি তাকে একেকবারে প্রায় ৪-৫ কাপ চা খেতে দিচ্ছেন। কোলা জাতীয় ড্রিংকস বাচ্চাকে কিনে দেয়ার চেয়ে বাচ্চাকে চা খেতে দিলে ক্ষতি কম হতো না কি?
বিজ্ঞাপনগুলো না দেখলে আপনি হয়তো বাচ্চাকে এসব কোলা ড্রিংকস্ কিনে দিতেন না, কিংবা আপনার বাচ্চাও হয়তো এগুলো খেতে চাইত না। বিজ্ঞাপনে ভুল মেসেজ দেয়া হচ্ছে। এগুলো যে শিশু-কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর (এবং বেশি খেলে বড়দের জন্যও), বিজ্ঞাপনে তা লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবিশ্বাস্য ও নাটুকে সব কাণ্ডকারখানার চমকে পানীয়টি সম্পর্কে তার মনে একধরনের মোহময়তা তৈরি হয়। ফলে ক্রেতা অবচেতনভাবে এর দিকে হাত বাড়ায়, অবচেতনভাবে সে সেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো নিজেকে ভেবে এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করে, বিজ্ঞাপনের প্রতারণাকে সে আমলে নিতে চায় না।
অল্প ক্যাফেইন নিমিষে শরীরকে চাঙ্গা করে। নিয়মিত কোলাজাতীয় ড্রিংকস অর্থাৎ বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন খেলে মেজাজ খিট্খিটে হয়ে যাওয়া, ঘুম কম হওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, প্রাত্যহিক খাবার ভালো না লাগা, কিডনিতে চাপ পড়ার কারণে ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া, নেশা হওয়ার কারণে বারবার কোলাজাতীয় ড্রিংকস খেতে চাওয়া- এসব জটিলতা দেখা দেয়। তাছাড়া গভীর মনোযোগ প্রয়োজন হয় এমন কাজে অনীহা ও অক্ষমতা দেখা দেয়ার ফলে আপনার বাচ্চার লেখাপড়া কম করা, পরীক্ষায় খারাপ করা, বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজিতে গভীর মনঃসংযোগ প্রয়োজন হয় বলে এগুলোতে অনীহা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞাপনের মোহে পড়ে কোলাজাতীয় ড্রিংকস খুব অল্প বয়স থেকেই নিয়মিত ও ‘বেশি বেশি’ পছন্দ করার কারণে তার যে মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটি আসলে এক ধরনের নেশাই। বড় হলে সে যে আরও বড় কোনো নেশা করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ এসব কিছুই হয়তো ঘটত না যদি কোলাজাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন তাকে প্রলুব্ধ না করত। আমরা তাই দাবি করছি, কোলাজাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে শিশুদের ব্যবহার বা তাদের প্রলুব্ধ করা অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।
আমরা বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে বলছি না। আমরা শুধু বলছি, যা সত্য নয়, বিজ্ঞাপনে তা বলা বন্ধ হোক। মানুষকে বিভ্রান্ত করে নয়, বরং তাদের সঠিক তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হোক। সঠিক তথ্য জানা ভোক্তার একটি আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘ স্বীকৃত অধিকার। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যা কিছু ক্ষতিকর, তা প্রচারে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে এবং মানুষকে বিজ্ঞাপনের কোনো অসত্য প্রচারণা থেকে রক্ষা করতে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে একটি বিজ্ঞাপন নীতিমালা তৈরি করা। বিজ্ঞাপন নীতিমালা থাকলে পত্রিকাগুলো এবং টিভি চ্যানেলগুলো কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করবে আর কোনটা করবে না, তা নিজেরাই বাছাই করে নিতে পারবে। বিজ্ঞাপনে নীতিমালাবহির্ভূত কিছু থাকলে বিজ্ঞাপনদাতাকে তা সংশোধনের জন্য বলতে পারবে। প্রতারিত না হওয়ার ফলে বা স্বাস্থ্যহানি না ঘটায় মানুষের মধ্যেও একদিকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল, অন্যদিকে পণ্য উৎপাদকের প্রতি আস্থা বাড়বে। এর ফলে পণ্যের প্রতি বর্তমানের অনাস্থা ও অবিশ্বাস কেটে গেলে পণ্যের বাজারও বিকশিত হবে। সরকার এ রকম একটি কাজ করলে মানুষ নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানাবে।
তাই আসুন, বিজ্ঞাপনে ভুল মেসেজ দেয়া বন্ধের জন্য ভোক্তা হিসেবে জনস্বার্থে আমরা সবাই অবিলম্বে একটি কার্যকর বিজ্ঞাপন নীতিমালার জন্য সরকারের কাছে বলিষ্ঠ দাবি জানাই। ভোক্তা হিসেবে আমরা আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের উৎপাদকদের ভুল ও স্বাস্থ্যহানিকর বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ঠেলে দিতে পারি না। যেসব দেশে খাদ্যে নকল-ভেজাল মেশানো হয় না, সেসব দেশে খাদ্যপণ্যের অসত্য বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর কঠোর বিধিনেষধ থাকে। কারণ অসত্য বিজ্ঞাপনের ফলে ক্রেতা-ভোক্তা বিভ্রান্ত হয়, অসত্যকে সত্য বলে সরল মনে গ্রহণ করে। ইংল্যান্ডে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে ‘অ্যাডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি’। এটি সেখানে অসত্য বিজ্ঞাপনের হাত থেকে ক্রেতা-ভোক্তাদের রক্ষা করে থাকে। ইংল্যান্ডে তাই খাদ্য ও পানীয়ের বিজ্ঞাপনের মান অত্যন্ত উঁচু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞাপনে অসত্য তথ্য দেয়ার ব্যাপারে সেখানকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ অত্যন্ত সতর্ক। আমাদের দেশে এরকম একটি এফডিএ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সেই ১৯৯৮ সাল থেকে দাবি জানিয়ে আসছি। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব এটি হওয়া উচিত।
আ ব ম ফারুক : অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.