বিসিএসের ভাইভা ও কোটা দুর্নীতির সুযোগ বাড়িয়েছে by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
গণতান্ত্রিক
সরকারের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে দক্ষ, প্রশিক্ষিত, কল্যাণকামী,
নিরপেক্ষ ও সুযোগ্য আমলাতন্ত্রের ওপর। কারণ, প্রশাসনে নিয়োজিত আমলারাই একটি
সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। আধুনিক
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আমলাদের কেবল দক্ষ ও যোগ্য হলেই হয় না, তাদের মানবিক ও
জনকল্যাণকামীও হতে হয়। সে কারণে এদের ‘সিভিল সার্ভেন্ট’ বলা হয়। আমলাদের
কেবল ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসক হলে হয় না, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে তাদের জনগণের
সেবকও হতে হয়। দেশের সাধারণ মানুষের সেবা না করে কেবল ঔপনিবেশিক আমলের
আমলার মতো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মুনাফা নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে
সফল আমলা হওয়া যায় না। যে জনগণের করের অর্থে আমলারা সরকারি চাকরি করেন,
তাদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও আমলাদের প্রশাসকের পরিবর্তে সেবকের ভূমিকা
পালন করতে হয়। আর ওই সেবাও দিতে হয় জনগণের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে,
তাদের সামান্যতম হয়রান না করে শান্তভাবে। সেজন্য ‘সিভিল সার্ভেন্টে’র বাংলা
অনুবাদ করা হয়েছে ‘সুশীল সেবক’। তারা জনগণকে কষ্ট না দিয়ে দক্ষতা ও
পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে সেবা প্রদান করেন। প্রশাসনে এ রকম দক্ষ,
যোগ্য, নিরপেক্ষ ও পেশাদার কর্মকর্তা নিয়োগে সব দেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা
আরোপ করা হয়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে লোক নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে স্বাধীনতা
দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশে দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের ওপর স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা হলেও বাস্তবে এর কর্মকাণ্ডে সে চরিত্র ও পেশাদারিত্বের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। এ কমিশনের সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকায় সরকার যাকে খুশি পিএসসির সদস্য নিয়োগ করতে পারে। এ সুযোগে সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের আÍীয়স্বজনরাই এ পদে অধিক হারে নিয়োগ পান। পিএসসির চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি-বিধান লংঘিত হয়। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পিএসসিতে প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয় প্রফেসর একিউএম বজলুল করিমকে। কর্মচারী প্রশাসনের বিশেষ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে এ নিয়োগ দেয়া হয়। সৈয়দ গিয়াসউদ্দীন আহমেদ তার ‘পাবলিক পারসনেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এ নিয়োগের পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই সময়ের রাজনৈতিক সচিবের সক্রিয়তার কথা উল্লেখ করেন। তখন থেকে পিএসসিতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের যে সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় তা ৪২ বছরে ক্রমান্বয়ে কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে। এর মধ্যে যুগপৎ সামরিক ও বেসামরিক শাসনামলে পিএসসিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আÍীয়করণ, দলীয়করণ এবং প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। এর ফলে পিএসসি তার পেশাদারিত্ব যেমন হারিয়েছে, তেমনি প্রশাসনও ক্রমান্বয়ে হয়েছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। পিএসসিতে নিরপেক্ষভাবে যোগ্য ও দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে না পারায় সংস্থাটি বস্তুনিষ্ঠভাবে মেধাবী প্রশাসক নির্বাচন করতে পারছেÑ বলা যায় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ দেশের ছাত্রসমাজের সরকারি চাকরি পাওয়ার প্রধান ভরসাস্থল হল পিএসসি আয়োজিত প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করে ক্যাডারভুক্ত চাকরি লাভ করা যায়। কাজেই বিসিএস পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই এ দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজের কর্মজীবন গড়ে তোলার স্বপ্ন আবর্তিত হয়। অথচ এই স্বপ্নের জায়গাটিতে সব সরকারই প্রত্যাশিত শৃংখলা, পেশাদারিত্ব ও নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। দিন বদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারও এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। এ সরকার চাইলে সংবিধান সংশোধনের সময় সহজেই পিএসসিকে আরও দক্ষ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনতে পারত। পিএসসির সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব এড়াবার লক্ষ্যে কিছু যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারত। কিন্তু তা না করে এ সরকার প্রথম থেকেই পিএসসিকে একটি দলীয়করণ ও আÍীয়করণের আখড়ায় পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করায় পিএসসির স্বাধীন ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়। পিএসসির সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মহাজোট সরকার ১৫ জন সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যাদের বেছে নিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই হয় সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের আÍীয় হিসেবে, না হয় দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করেছেন।
উল্লেখ্য, মহাজোট সরকারের সময় পিএসসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই ও আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর চাচাতো ভাই মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত, প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানকের বড় বোন অধ্যাপক রাশিদা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও যুবলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক এমরান কবীর চৌধুরী, জনতার মঞ্চের কথিত রূপকার হিসেবে পরিচিত এটি আহমেদুল হক চৌধুরী (বর্তমানে চেয়ারম্যান, ২০১০-এর এপ্রিলে সাবেক পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সাদত হোসেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে রাষ্ট্রপতির কাছে ‘কর্মকমিশনে স্থবিরতা’ শীর্ষক চিঠি প্রদানকারী হিসেবে সমালোচিত), প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ভাগ্নে সৈয়দ হাসিনুর রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ভাগ্নি অধ্যাপক ডা. ফরিদা আদিব খানম, সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি তারানা হালিমের ভগ্নিপতি ইকরাম আহমেদ প্রভৃতি। আরও যেসব সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের শানে নজুল খোঁজ করলেও হয়তো একই রকম তথ্য পাওয়া যাবে। কাজেই এই যদি হয় পিএসসির সদস্য নিয়োগের চিত্র, তাহলে সে সংগঠনের পক্ষে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কতটা সম্ভব, তা অনুমান করা যায়। এরকম দলীয় পরিচয়ে নিয়োজিতরা যখন পিএসসির মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সভাপতিত্ব করবেন, তখন তারা যে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হবেন না সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এসব কারণে সরকারি কমকর্তা নিয়োগে পিএসসি তার সুনাম প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে এবং সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা পিএসসির ওপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না। এর ওপর কোটা সুবিধা বাড়াতে বাড়াতে শতকরা ৫৫ ভাগে নিয়ে যাওয়ায় সাধারণ গ্রামগঞ্জের মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী পাওয়া না গেলেও ওই কোটা বহাল রাখা হয়েছে এবং ওই কোটা পূরণে যে সবসময় স্বচ্ছভাবে সবকিছু হচ্ছে, তাও বলা যায় না। অনেক সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবনযাপন করছেন, অনেকে রিকশা চালাচ্ছেন। সরকার তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা না দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে কেবল তাদের সম্মানিত করতে চাইছেন কেন, সে বিষয়টি বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ কোটা কতদিন পর্যন্ত বহাল থাকবে, সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করে চাকরি ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া সমর্থনযোগ্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও না হয় কিছুটা ছাড় দেয়া যেতে পারে, কিন্তু বংশ পরম্পরায় এ কোটা আজীবন চলমান রাখা যৌক্তিক হবে কি-না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। একজন সৎ লোকের সন্তান সবাই যে সৎ হবেন সে নিশ্চয়তা যেমন দেয়া যায় না, তেমনি একজন সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্মর সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন হবেন, সে নিশ্চয়তা দেয়াও অযৌক্তিক। একজন মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্মর কেউ কি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চিন্তাভাবনার ধারক হতে পারেন না? তেমন হলে সেক্ষেত্রে তাকে কেন কোটা সুবিধা দেয়া হবে? এ ছাড়া উপজাতীয় ও নারী কোটার যৌক্তিকতা কি আগের মতো আছে? তারা তো এমনিতেই এখন লেখাপড়া ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা এগিয়ে এসেছেন এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতেও তারা প্রশাসনসহ সবক্ষেত্রে যে একেবারেই সুযোগ পাচ্ছেন না এমন নয়। সেক্ষেত্রে এমন কোটা যদি রাখতেও হয়, তাহলে তা আরও কমিয়ে আনা উচিত কি-না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেবল প্রতিবন্ধীদের কোটা ঠিক রেখে আর সব কোটা কমিয়ে সব মিলিয়ে শতকরা ১০ বা ১৫ ভাগের বেশি সরকারি ক্যাডারভুক্ত পদে কোটায় চাকরি দেয়াকে সুবিবেচনাপ্রসূত বলা যায় না। এমনটা হলে গ্রামের মেধাবী ছেলেমেয়েরা আরও অধিক হারে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হয়ে দেশসেবার সুযোগ পাবেন। শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা রাখায় ইতিমধ্যেই প্রশাসনের মানের যে ক্ষতি হয়েছে, আগামী অনেক বছর তার ফল ভোগ করতে হবে। কোটার হার উল্লেখযোগ্যভাবে না কমালে যে প্রশাসনের মান আরও ধসে পড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মহাজোট সরকার বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে চলমান মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করে আরেকটি মারাত্মক ক্ষতিকর কাজ করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতা, প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সুপারিশ ও তদবির সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের কেউই এ কাজটি সমর্থন করেননি। এর ফলে বিসিএসে দুর্নীতি করার সুযোগ অধিক প্রসারিত হয়েছে। এজন্য নানা-মামা বা খুঁটির জোর নেই এমন লাখ লাখ সাধারণ চাকরিপ্রার্থী সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০০ করায় তাদের বিসিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন অনেকটাই ধূসর হয়ে গেছে। চাকরিপ্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সিদ্ধান্তগ্রহণ যোগ্যতা এবং বুদ্ধি যাচাই করার জন্য মৌখিক পরীক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে বলা যায়, দেশের চলমান বাস্তবতা বিচার করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে কমিয়ে ৫০ নম্বরে আনতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু তা না করে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা এ ক্ষেত্রে তদবির ও সুপারিশ কালচারের মাধ্যমে দুর্নীতি করার সুযোগ প্রসারিত করেছে। যেহেতু পিএসসির মোখিক পরীক্ষার বোর্ডগুলো সাধারণত একজন পিএসসি সদস্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু পিএসসি সদস্যরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়স্বজন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে, কাজেই তারা যে মৌখিক পরীক্ষায় সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবেন, এমন নিশ্চয়তা দেয়া কঠিন।
কোটা, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর, পরীক্ষা ক্ষেত্রের অনিয়মানুবর্তিতা ও বিশৃংখলা- সব মিলিয়ে বিসিএস পরীক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্যে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় তারা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন, তখন তাদের বক্তব্য না শুনে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করেছে। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের বক্তব্যের যৌক্তিকতা যাচাই না করে প্রধানমন্ত্রী কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যারা ‘ভাংচুর করেছে’ তাদের ছবি সংরক্ষণ করে পরবর্তীকালে তাদের সব রকম চাকরিতে ডিসকোয়ালিফাই করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত ছিল যে, এ আন্দোলনটি একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং এতে সবাই রাজপথে না নামলেও লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত বেকার এ আন্দোলনে জড়িত। আন্দোলনটি যেমন দলীয় পরিচয়ভিত্তিক নয়, তেমনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করা বা সরকারকে বিপদে ফেলা নয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে চাকরি না দেয়ার ভয় দেখিয়ে কি তাদের ন্যায্য দাবি আদায় থেকে সরিয়ে রাখা যাবে? নির্বাচনের আগে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে এভাবে আহত করলে তার কী পরিণাম হতে পারে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ভেবে দেখা উচিত ছিল। তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের না ক্ষেপিয়ে সরকারের উচিত অচিরেই পিএসসির সদস্য নিয়োগে আত্মীয়করণ, কোটা ব্যবস্থা, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর এবং বিসিএস পরীক্ষার অন্যান্য অনিয়ম চিহ্নিত করে ওইসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এভাবে সরকারি চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে শৃংখলা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় বর্ধিত মনোযোগ দিয়ে প্রশাসনসহ সব সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শতভাগ নিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে মেধাবীদের নিয়োগ সুনিশ্চিত করাই হওয়া উচিত সরকারের লক্ষ্য।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের ওপর স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা হলেও বাস্তবে এর কর্মকাণ্ডে সে চরিত্র ও পেশাদারিত্বের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। এ কমিশনের সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকায় সরকার যাকে খুশি পিএসসির সদস্য নিয়োগ করতে পারে। এ সুযোগে সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের আÍীয়স্বজনরাই এ পদে অধিক হারে নিয়োগ পান। পিএসসির চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি-বিধান লংঘিত হয়। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পিএসসিতে প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয় প্রফেসর একিউএম বজলুল করিমকে। কর্মচারী প্রশাসনের বিশেষ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে এ নিয়োগ দেয়া হয়। সৈয়দ গিয়াসউদ্দীন আহমেদ তার ‘পাবলিক পারসনেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এ নিয়োগের পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই সময়ের রাজনৈতিক সচিবের সক্রিয়তার কথা উল্লেখ করেন। তখন থেকে পিএসসিতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের যে সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় তা ৪২ বছরে ক্রমান্বয়ে কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে। এর মধ্যে যুগপৎ সামরিক ও বেসামরিক শাসনামলে পিএসসিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আÍীয়করণ, দলীয়করণ এবং প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। এর ফলে পিএসসি তার পেশাদারিত্ব যেমন হারিয়েছে, তেমনি প্রশাসনও ক্রমান্বয়ে হয়েছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। পিএসসিতে নিরপেক্ষভাবে যোগ্য ও দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে না পারায় সংস্থাটি বস্তুনিষ্ঠভাবে মেধাবী প্রশাসক নির্বাচন করতে পারছেÑ বলা যায় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ দেশের ছাত্রসমাজের সরকারি চাকরি পাওয়ার প্রধান ভরসাস্থল হল পিএসসি আয়োজিত প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করে ক্যাডারভুক্ত চাকরি লাভ করা যায়। কাজেই বিসিএস পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই এ দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজের কর্মজীবন গড়ে তোলার স্বপ্ন আবর্তিত হয়। অথচ এই স্বপ্নের জায়গাটিতে সব সরকারই প্রত্যাশিত শৃংখলা, পেশাদারিত্ব ও নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। দিন বদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারও এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। এ সরকার চাইলে সংবিধান সংশোধনের সময় সহজেই পিএসসিকে আরও দক্ষ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনতে পারত। পিএসসির সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব এড়াবার লক্ষ্যে কিছু যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারত। কিন্তু তা না করে এ সরকার প্রথম থেকেই পিএসসিকে একটি দলীয়করণ ও আÍীয়করণের আখড়ায় পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করায় পিএসসির স্বাধীন ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়। পিএসসির সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মহাজোট সরকার ১৫ জন সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যাদের বেছে নিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই হয় সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের আÍীয় হিসেবে, না হয় দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করেছেন।
উল্লেখ্য, মহাজোট সরকারের সময় পিএসসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই ও আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর চাচাতো ভাই মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত, প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানকের বড় বোন অধ্যাপক রাশিদা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও যুবলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক এমরান কবীর চৌধুরী, জনতার মঞ্চের কথিত রূপকার হিসেবে পরিচিত এটি আহমেদুল হক চৌধুরী (বর্তমানে চেয়ারম্যান, ২০১০-এর এপ্রিলে সাবেক পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সাদত হোসেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে রাষ্ট্রপতির কাছে ‘কর্মকমিশনে স্থবিরতা’ শীর্ষক চিঠি প্রদানকারী হিসেবে সমালোচিত), প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ভাগ্নে সৈয়দ হাসিনুর রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ভাগ্নি অধ্যাপক ডা. ফরিদা আদিব খানম, সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি তারানা হালিমের ভগ্নিপতি ইকরাম আহমেদ প্রভৃতি। আরও যেসব সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের শানে নজুল খোঁজ করলেও হয়তো একই রকম তথ্য পাওয়া যাবে। কাজেই এই যদি হয় পিএসসির সদস্য নিয়োগের চিত্র, তাহলে সে সংগঠনের পক্ষে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কতটা সম্ভব, তা অনুমান করা যায়। এরকম দলীয় পরিচয়ে নিয়োজিতরা যখন পিএসসির মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সভাপতিত্ব করবেন, তখন তারা যে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হবেন না সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এসব কারণে সরকারি কমকর্তা নিয়োগে পিএসসি তার সুনাম প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে এবং সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা পিএসসির ওপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না। এর ওপর কোটা সুবিধা বাড়াতে বাড়াতে শতকরা ৫৫ ভাগে নিয়ে যাওয়ায় সাধারণ গ্রামগঞ্জের মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী পাওয়া না গেলেও ওই কোটা বহাল রাখা হয়েছে এবং ওই কোটা পূরণে যে সবসময় স্বচ্ছভাবে সবকিছু হচ্ছে, তাও বলা যায় না। অনেক সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবনযাপন করছেন, অনেকে রিকশা চালাচ্ছেন। সরকার তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা না দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে কেবল তাদের সম্মানিত করতে চাইছেন কেন, সে বিষয়টি বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ কোটা কতদিন পর্যন্ত বহাল থাকবে, সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করে চাকরি ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া সমর্থনযোগ্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও না হয় কিছুটা ছাড় দেয়া যেতে পারে, কিন্তু বংশ পরম্পরায় এ কোটা আজীবন চলমান রাখা যৌক্তিক হবে কি-না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। একজন সৎ লোকের সন্তান সবাই যে সৎ হবেন সে নিশ্চয়তা যেমন দেয়া যায় না, তেমনি একজন সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্মর সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন হবেন, সে নিশ্চয়তা দেয়াও অযৌক্তিক। একজন মুক্তিযোদ্ধার পরবর্তী প্রজন্মর কেউ কি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চিন্তাভাবনার ধারক হতে পারেন না? তেমন হলে সেক্ষেত্রে তাকে কেন কোটা সুবিধা দেয়া হবে? এ ছাড়া উপজাতীয় ও নারী কোটার যৌক্তিকতা কি আগের মতো আছে? তারা তো এমনিতেই এখন লেখাপড়া ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা এগিয়ে এসেছেন এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতেও তারা প্রশাসনসহ সবক্ষেত্রে যে একেবারেই সুযোগ পাচ্ছেন না এমন নয়। সেক্ষেত্রে এমন কোটা যদি রাখতেও হয়, তাহলে তা আরও কমিয়ে আনা উচিত কি-না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেবল প্রতিবন্ধীদের কোটা ঠিক রেখে আর সব কোটা কমিয়ে সব মিলিয়ে শতকরা ১০ বা ১৫ ভাগের বেশি সরকারি ক্যাডারভুক্ত পদে কোটায় চাকরি দেয়াকে সুবিবেচনাপ্রসূত বলা যায় না। এমনটা হলে গ্রামের মেধাবী ছেলেমেয়েরা আরও অধিক হারে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হয়ে দেশসেবার সুযোগ পাবেন। শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা রাখায় ইতিমধ্যেই প্রশাসনের মানের যে ক্ষতি হয়েছে, আগামী অনেক বছর তার ফল ভোগ করতে হবে। কোটার হার উল্লেখযোগ্যভাবে না কমালে যে প্রশাসনের মান আরও ধসে পড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মহাজোট সরকার বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে চলমান মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করে আরেকটি মারাত্মক ক্ষতিকর কাজ করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতা, প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সুপারিশ ও তদবির সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের কেউই এ কাজটি সমর্থন করেননি। এর ফলে বিসিএসে দুর্নীতি করার সুযোগ অধিক প্রসারিত হয়েছে। এজন্য নানা-মামা বা খুঁটির জোর নেই এমন লাখ লাখ সাধারণ চাকরিপ্রার্থী সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০০ করায় তাদের বিসিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন অনেকটাই ধূসর হয়ে গেছে। চাকরিপ্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সিদ্ধান্তগ্রহণ যোগ্যতা এবং বুদ্ধি যাচাই করার জন্য মৌখিক পরীক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে বলা যায়, দেশের চলমান বাস্তবতা বিচার করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে কমিয়ে ৫০ নম্বরে আনতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু তা না করে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা এ ক্ষেত্রে তদবির ও সুপারিশ কালচারের মাধ্যমে দুর্নীতি করার সুযোগ প্রসারিত করেছে। যেহেতু পিএসসির মোখিক পরীক্ষার বোর্ডগুলো সাধারণত একজন পিএসসি সদস্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু পিএসসি সদস্যরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়স্বজন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ে, কাজেই তারা যে মৌখিক পরীক্ষায় সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবেন, এমন নিশ্চয়তা দেয়া কঠিন।
কোটা, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর, পরীক্ষা ক্ষেত্রের অনিয়মানুবর্তিতা ও বিশৃংখলা- সব মিলিয়ে বিসিএস পরীক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্যে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় তারা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন, তখন তাদের বক্তব্য না শুনে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করেছে। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের বক্তব্যের যৌক্তিকতা যাচাই না করে প্রধানমন্ত্রী কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যারা ‘ভাংচুর করেছে’ তাদের ছবি সংরক্ষণ করে পরবর্তীকালে তাদের সব রকম চাকরিতে ডিসকোয়ালিফাই করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মনে রাখা উচিত ছিল যে, এ আন্দোলনটি একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং এতে সবাই রাজপথে না নামলেও লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত বেকার এ আন্দোলনে জড়িত। আন্দোলনটি যেমন দলীয় পরিচয়ভিত্তিক নয়, তেমনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করা বা সরকারকে বিপদে ফেলা নয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে চাকরি না দেয়ার ভয় দেখিয়ে কি তাদের ন্যায্য দাবি আদায় থেকে সরিয়ে রাখা যাবে? নির্বাচনের আগে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে এভাবে আহত করলে তার কী পরিণাম হতে পারে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ভেবে দেখা উচিত ছিল। তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের না ক্ষেপিয়ে সরকারের উচিত অচিরেই পিএসসির সদস্য নিয়োগে আত্মীয়করণ, কোটা ব্যবস্থা, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর এবং বিসিএস পরীক্ষার অন্যান্য অনিয়ম চিহ্নিত করে ওইসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এভাবে সরকারি চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে শৃংখলা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় বর্ধিত মনোযোগ দিয়ে প্রশাসনসহ সব সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শতভাগ নিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে মেধাবীদের নিয়োগ সুনিশ্চিত করাই হওয়া উচিত সরকারের লক্ষ্য।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments