জনগণের নির্বাচিত নেতাদের কাছেই জনগণ অসহায় by মইনুল হোসেন
আমরা
সবাই রাস্তার সহিংসতা এবং হরতালের রাজনীতির নিন্দা জানাই। সাধারণ মানুষরাই
জানমালের ক্ষতি স্বীকার করে এর চরম মূল্য দিয়ে থাকে। সহিংসতার পরিমাণ
ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরেই বেশি এবং জীবনহানির ঘটনা ঢাকার বাইরেই বেশি ঘটছে।
সব জায়গার সব ঘটনার তথ্যাদি আমরা পাইও না। যারা হরতাল আহ্বান করেন, তারা
কখনও চান না হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হোক। আমরা যদি সত্যি সত্যি
জনসাধারণকে বিরোধীদলীয় সহিংস হরতালের রাজনীতি থেকে বাঁচাতে চাই তাহলে
আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে এবং সমস্যাকে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে
হবে। আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহি করতে শিখতে হবে। জনগণের
নির্বাচিত নেতাদের কাছেই জনগণ অসহায় থাকবে, তা গ্রহণীয় হতে পারে না। আর
বিচার করার সময় নির্বাচনী রাজনীতির ছদ্মাবরণে আমরা যে দীর্ঘকাল ধরে
অগণতান্ত্রিক সহিংস রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন করে আসছি, সে ব্যাপারে অমনোযোগী
হলে চলবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিচার বিভাগসহ সব গণতান্ত্রিক
প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে। যখন আমি বলি আমরা তখন আমি
আরও সুনির্দিষ্টভাবে সংবাদপত্রকে বুঝিয়ে থাকি। দুঃখের বিষয়, নির্বাচন নিয়ে
আজ যে সংকট, তা তৈরির সঙ্গে বিচার বিভাগের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
হরতালের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রাস্তার সহিংসতায় প্রাণহানি ও মানুষের ভোগান্তি নিয়ে অন্যদের মতো আমরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। প্রতিদিন হরতালকেন্দ্রিক নৃশংস কর্মকাণ্ড বাড়তে দেখে হৃদয় বেদনাভারাক্রান্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিকে নানাভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে গিয়ে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছে। এ নিয়ে নেতাদের কোনো দুর্ভাবনা নেই। মনে হয়, কে কিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করবেন সেটাই তাদের একমাত্র চিন্তা।
আমরা অসহায় বোধ করার কারণে বিবেকের তাড়নায় লজ্জার মাথা খেয়ে বাইরের বন্ধুদের কাছে আবেদন করছি আমাদের উদ্ধার করতে আসার জন্য। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আমাদের নির্বাচন ক্ষমতালোভী রাজনীতির কারণে কিভাবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে, সেটা আমরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এ রাজনীতিকে টেঙ্গো নাচের সঙ্গেই তুলনা করা যায়, যেখানে মাত্র দু’জনেই নৃত্য পরিবেশন করতে পারে। সরকার এবং বিরোধী দলকে ঠিকভাবে খেলতে হবে- আইনহীনতা ও সহিংসতায় যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। তারা সেভাবে খেলতে ব্যর্থ হলে দোষ বা দায়-দায়িত্ব তো উভয়ের ওপর সমানভাবে বর্তাবে। পুলিশ কেবল রাস্তার সহিংস রাজনীতিকে অধিকতর নৃশংস করতে পারে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান সংকট হচ্ছে গণবিরোধী লোভী রাজনীতির ঘনীভূত রূপ। জনগণের ইচ্ছানুসারে জনগণের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই তো গণতন্ত্রের কথা। সবাই সমঅবস্থানে থেকে নির্বাচন করতে না পারলে কিংবা সবার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সেটা কেবল গণতন্ত্রবিরোধী নয়, কাণ্ডজ্ঞানেরও বিরোধী। আমাদের দেশে যে ধরনের দলীয় রাজনীতি বিরাজ করছে, তাতে দলীয় নেতৃত্বের জবাবদিহির বা যুক্তিপূর্ণ হওয়ার দরকার করে না। জবাবদিহি বলতে আদতে কী বোঝায়, সেটা উপলব্ধির তোয়াক্কা না করেই রাজনৈতিক নেতারা জনগণের কাছে জবাবদিহির কথা বলে থাকেন। জবাবদিহি বলতে জনমতকে উপেক্ষা করা বোঝায় না। জনমত জরিপ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নেতাদের জানা আছে, তারা ভালো করেই জানেন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। নেতারা নিজেদের যতটা জনসমর্থিত মনে করেন, ততটা জনসমর্থিত নন।
এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে, যেখানে গণতন্ত্র কাজ করে সেখানে হরতালের রাজনীতি কিংবা হিংসার রাজনীতির দেখা মেলে না। হরতালের জন্য সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি হচ্ছে, রাস্তায় ভাংচুর ও আগুন জ্বালানোর ঘটনায় জনমনে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাকে উপেক্ষা করে তো বিরোধী দল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার চিন্তা করতে পারত না। সব ধরনের অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতি করেও নির্বাচনে কিভাবে জয়ী হতে হয় তার কলাকৌশল আমাদের রাজনীতিকদের জানা আছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন এখন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে। এ নিয়েই সবার দুশ্চিন্তা। দেশে নির্বাচন আছে, গণতন্ত্র নেই। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল যে, সরকারের সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব বিরোধী জোটের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। বিএনপি এখন সুস্পষ্টভাবে সর্বদলীয় সরকারের অংশীদার হতে অস্বীকার করেছে।
সরকার, অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি উপদেষ্টাদের পরামর্শে, এ প্রস্তাব উত্থাপন করে মনে করেছে, এটা একটা চাতুর্যপূর্ণ চাল হয়েছে। আর এটা এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, এটা একটা আপসমূলক ফর্মুলা। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে তার বিপরীতে সরকার এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। সরকার সমর্থকরা সবাইকে বিশ্বাস করাতে চান যে, তারা একটা বড় ধরনের ছাড় দিচ্ছেন বিরোধী দলকে তাদের সরকারে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানিয়ে। এটাই হচ্ছে আত্মস্বার্থান্ধ রাজনীতি, যা রাজনীতিকে এতটা একরোখা, অন্ধ, হিংস্র করে তুলেছে- সরকার ও বিরোধী উভয়ের জন্য।
নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগোচ্ছে না, সরকার চাচ্ছে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন আর কোয়ালিশন সরকার এক হতে পারে না। সর্বদলীয় সরকারের নামে বিএনপির লোকদেরও চাকরি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যাতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত করা যায়। ১৯৭৫ সালেও একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল অন্যদের চাকরি দিয়ে। বহুদলীয় গণতন্ত্র ধ্বংস করে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা হয়েছিল, এভাবে অনেকে ব্যাপারটাকে চিত্রিত করে থাকেন। ওই সময়ে জনপ্রিয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও প্রয়োজন অনুভব করা হয়নি।
সেই সময়টাতে যে কর্মকাণ্ডের অনুশীলন হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক ভূমিকা রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। সব সংবাদপত্রকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকরাও প্রতিবাদ করার বদলে দলে দলে অসহায়ভাবে হলেও বাহ্যিকভাবে উৎসাহভরে সেই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল। দু-চারজন শামিল না হলেও তাদের সবার আড়ালে চলে যেতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিমান স্তম্ভ প্রেস সহজেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সাংবাদিকদের জন্য আবারও কঠিন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সাংবাদিক সমাজ আজ বিভক্ত এবং তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির সক্রিয় দলীয় কর্মী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দলীয়করণের বিভক্তি জনপ্রশাসন, পুলিশ, সরকারি কার্যালয়ের সর্বত্র বিদ্যমান। এটা দুঃখজনক যে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির স্বার্থে বিচার বিভাগকেও রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত করা হয়েছে।
স্বাধীন ভূমিকার বদলে সাংবাদিকরা যখন সক্রিয় দলীয় কর্মীর চেহারা নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হন, তখন সাংবাদিক হিসেবে তার সম্মানজনক অবস্থানটি সবচেয়ে বিব্রতকর রূপ ধারণ করে। সর্বত্র সাংবাদিকদের যে সম্মানের আসন দেয়া হয়, দলীয় রাজনীতির অ্যাক্টিভিস্টের ভাবমূর্তি সেই আসন পাওয়ার অনুকূল হতে পারে না। প্রবীণ সাংবাদিকদের স্মরণ রাখা উচিত, প্রখ্যাত সাংবাদিক মানিক মিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে পেশাগত স্বাধীনতা বজায় রাখার স্বার্থে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
বাকশালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তি ঘটেছিল কয়েক মাসের মধ্যে। আমাদের অনেকেরই চিন্তা ছিল, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতিকে নিরাপদ করা হবে ভবিষ্যতে। রাজনীতি এক ধরনের বিজ্ঞান, এ বিজ্ঞানের ব্যবহার অগ্রাহ্য করা হলে তার ফল মারাত্মক পরিণতি বহন করে আনতে পারে। কারণ, তখন রাজনীতি আর রাজনীতি থাকে না। গণতন্ত্রের চর্চা ভিন্ন গণতন্ত্র টিকে না। ক্ষমতার লোভ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যেটা স্মরণ রাখা দরকার, এ ক্ষমতার লোভ কখনও একতরফা হয় না। বিজ্ঞ লোকেরা গণতন্ত্র সমর্থন করে, কারণ নিরাপদ রাজনীতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা রয়েছে এ ব্যবস্থায়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
হরতালের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রাস্তার সহিংসতায় প্রাণহানি ও মানুষের ভোগান্তি নিয়ে অন্যদের মতো আমরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। প্রতিদিন হরতালকেন্দ্রিক নৃশংস কর্মকাণ্ড বাড়তে দেখে হৃদয় বেদনাভারাক্রান্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিকে নানাভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে গিয়ে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছে। এ নিয়ে নেতাদের কোনো দুর্ভাবনা নেই। মনে হয়, কে কিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করবেন সেটাই তাদের একমাত্র চিন্তা।
আমরা অসহায় বোধ করার কারণে বিবেকের তাড়নায় লজ্জার মাথা খেয়ে বাইরের বন্ধুদের কাছে আবেদন করছি আমাদের উদ্ধার করতে আসার জন্য। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আমাদের নির্বাচন ক্ষমতালোভী রাজনীতির কারণে কিভাবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে, সেটা আমরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এ রাজনীতিকে টেঙ্গো নাচের সঙ্গেই তুলনা করা যায়, যেখানে মাত্র দু’জনেই নৃত্য পরিবেশন করতে পারে। সরকার এবং বিরোধী দলকে ঠিকভাবে খেলতে হবে- আইনহীনতা ও সহিংসতায় যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। তারা সেভাবে খেলতে ব্যর্থ হলে দোষ বা দায়-দায়িত্ব তো উভয়ের ওপর সমানভাবে বর্তাবে। পুলিশ কেবল রাস্তার সহিংস রাজনীতিকে অধিকতর নৃশংস করতে পারে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান সংকট হচ্ছে গণবিরোধী লোভী রাজনীতির ঘনীভূত রূপ। জনগণের ইচ্ছানুসারে জনগণের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই তো গণতন্ত্রের কথা। সবাই সমঅবস্থানে থেকে নির্বাচন করতে না পারলে কিংবা সবার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সেটা কেবল গণতন্ত্রবিরোধী নয়, কাণ্ডজ্ঞানেরও বিরোধী। আমাদের দেশে যে ধরনের দলীয় রাজনীতি বিরাজ করছে, তাতে দলীয় নেতৃত্বের জবাবদিহির বা যুক্তিপূর্ণ হওয়ার দরকার করে না। জবাবদিহি বলতে আদতে কী বোঝায়, সেটা উপলব্ধির তোয়াক্কা না করেই রাজনৈতিক নেতারা জনগণের কাছে জবাবদিহির কথা বলে থাকেন। জবাবদিহি বলতে জনমতকে উপেক্ষা করা বোঝায় না। জনমত জরিপ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নেতাদের জানা আছে, তারা ভালো করেই জানেন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। নেতারা নিজেদের যতটা জনসমর্থিত মনে করেন, ততটা জনসমর্থিত নন।
এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে, যেখানে গণতন্ত্র কাজ করে সেখানে হরতালের রাজনীতি কিংবা হিংসার রাজনীতির দেখা মেলে না। হরতালের জন্য সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি হচ্ছে, রাস্তায় ভাংচুর ও আগুন জ্বালানোর ঘটনায় জনমনে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তাকে উপেক্ষা করে তো বিরোধী দল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার চিন্তা করতে পারত না। সব ধরনের অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতি করেও নির্বাচনে কিভাবে জয়ী হতে হয় তার কলাকৌশল আমাদের রাজনীতিকদের জানা আছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন এখন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে। এ নিয়েই সবার দুশ্চিন্তা। দেশে নির্বাচন আছে, গণতন্ত্র নেই। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল যে, সরকারের সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব বিরোধী জোটের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। বিএনপি এখন সুস্পষ্টভাবে সর্বদলীয় সরকারের অংশীদার হতে অস্বীকার করেছে।
সরকার, অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি উপদেষ্টাদের পরামর্শে, এ প্রস্তাব উত্থাপন করে মনে করেছে, এটা একটা চাতুর্যপূর্ণ চাল হয়েছে। আর এটা এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, এটা একটা আপসমূলক ফর্মুলা। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে তার বিপরীতে সরকার এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। সরকার সমর্থকরা সবাইকে বিশ্বাস করাতে চান যে, তারা একটা বড় ধরনের ছাড় দিচ্ছেন বিরোধী দলকে তাদের সরকারে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানিয়ে। এটাই হচ্ছে আত্মস্বার্থান্ধ রাজনীতি, যা রাজনীতিকে এতটা একরোখা, অন্ধ, হিংস্র করে তুলেছে- সরকার ও বিরোধী উভয়ের জন্য।
নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগোচ্ছে না, সরকার চাচ্ছে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন আর কোয়ালিশন সরকার এক হতে পারে না। সর্বদলীয় সরকারের নামে বিএনপির লোকদেরও চাকরি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যাতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত করা যায়। ১৯৭৫ সালেও একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল অন্যদের চাকরি দিয়ে। বহুদলীয় গণতন্ত্র ধ্বংস করে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা হয়েছিল, এভাবে অনেকে ব্যাপারটাকে চিত্রিত করে থাকেন। ওই সময়ে জনপ্রিয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও প্রয়োজন অনুভব করা হয়নি।
সেই সময়টাতে যে কর্মকাণ্ডের অনুশীলন হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক ভূমিকা রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। সব সংবাদপত্রকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকরাও প্রতিবাদ করার বদলে দলে দলে অসহায়ভাবে হলেও বাহ্যিকভাবে উৎসাহভরে সেই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল। দু-চারজন শামিল না হলেও তাদের সবার আড়ালে চলে যেতে হয়েছিল। গণতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিমান স্তম্ভ প্রেস সহজেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সাংবাদিকদের জন্য আবারও কঠিন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সাংবাদিক সমাজ আজ বিভক্ত এবং তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির সক্রিয় দলীয় কর্মী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দলীয়করণের বিভক্তি জনপ্রশাসন, পুলিশ, সরকারি কার্যালয়ের সর্বত্র বিদ্যমান। এটা দুঃখজনক যে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির স্বার্থে বিচার বিভাগকেও রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত করা হয়েছে।
স্বাধীন ভূমিকার বদলে সাংবাদিকরা যখন সক্রিয় দলীয় কর্মীর চেহারা নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হন, তখন সাংবাদিক হিসেবে তার সম্মানজনক অবস্থানটি সবচেয়ে বিব্রতকর রূপ ধারণ করে। সর্বত্র সাংবাদিকদের যে সম্মানের আসন দেয়া হয়, দলীয় রাজনীতির অ্যাক্টিভিস্টের ভাবমূর্তি সেই আসন পাওয়ার অনুকূল হতে পারে না। প্রবীণ সাংবাদিকদের স্মরণ রাখা উচিত, প্রখ্যাত সাংবাদিক মানিক মিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে পেশাগত স্বাধীনতা বজায় রাখার স্বার্থে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
বাকশালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তি ঘটেছিল কয়েক মাসের মধ্যে। আমাদের অনেকেরই চিন্তা ছিল, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতিকে নিরাপদ করা হবে ভবিষ্যতে। রাজনীতি এক ধরনের বিজ্ঞান, এ বিজ্ঞানের ব্যবহার অগ্রাহ্য করা হলে তার ফল মারাত্মক পরিণতি বহন করে আনতে পারে। কারণ, তখন রাজনীতি আর রাজনীতি থাকে না। গণতন্ত্রের চর্চা ভিন্ন গণতন্ত্র টিকে না। ক্ষমতার লোভ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যেটা স্মরণ রাখা দরকার, এ ক্ষমতার লোভ কখনও একতরফা হয় না। বিজ্ঞ লোকেরা গণতন্ত্র সমর্থন করে, কারণ নিরাপদ রাজনীতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা রয়েছে এ ব্যবস্থায়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments