প্রয়োজন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি by সুনীল শুভ রায়
রাজধানী
ঢাকা শহরে একটি বিশেষ চত্ব¡র ও একটি স্কয়ার রয়েছে। একটির নাম ‘শহীদ নূর
হোসেন স্কয়ার’ আর একটির নাম ‘শহীদ ডা. মিলন চত্বর’। শহীদ হওয়া, নিহত হওয়া,
মারা যাওয়া কিংবা মেরে ফেলা, মৃত্যুবরণ করা, গুম হওয়া, খুন হওয়া অথবা
আত্মহত্যা করা- ভিন্নার্থক এ শব্দগুলোর যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন, মৌলিক
বিষয়টি হচ্ছে ইহলোক থেকে বিদায় নেয়া। যে কোনো মৃত্যুই এ লৌকিক জগতের সবচেয়ে
শোকের ও বেদনার। তাই কোনো মৃত মানুষের প্রতি অসম্মান করা যায় না এবং সেটা
করা চরম অন্যায় ও অনৈতিক। তাই যাদের নামে ঢাকায় স্কয়ার বা চত্ব¡র হয়েছে-
তারা শহীদের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত কি-না সে প্রশ্নে যাব না। তাদের ইহজগৎ
থেকে অকালে বিদায় নিতে হয়েছে- এটাই বড় শোকের ও বেদনার- সে কথাই মেনে নেব।
তাই তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাব, সম্মান নিবেদন করব। তবে তারা
প্রাণ হারালেন কীভাবে, কেন তাদের জীবন বিসর্জন দিতে হল- এর জন্য তারা যদি
শহীদের মর্যাদা পেতে পারেন, তাহলে নূর হোসেন বা ডা. মিলন পরবর্তী সময়ে
আমাদের দেশে শহীদের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাদের শহীদের মর্যাদা দিয়ে
স্কয়ার কিংবা চত্বর বানানো হবে কোথায়? তাদের জন্য এলাকা বরাদ্দ করতে কত
জায়গার প্রয়োজন হবে?
পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে নূর হোসেনের পিঠে গুলি লাগার কথাই বলা হয়েছে। সে তখন মিছিলের সামনে ছিল। পেছনে তো পুলিশ ছিল না। ছিল তার সহযোদ্ধারা। তাহলে কে গুলি করল তাকে। দোষ দেয়া হল রাষ্ট্রপতি এরশাদের সরকারকে। তারপর যারা তাকে শহীদ বানিয়ে ফায়দা লুটল, তাদের কাউকে নূর হোসেনের পরিবারের পাশে দেখা যায়নি। দেখা গেছে তাকে, যার কাঁধে নূর হোসেনের হত্যার দায় চাপানো হয়েছিল। সেই রাষ্ট্রপতি এরশাদ কারামুক্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন নূর হোসেনের পরিবারের কাছে। প্রতি মাসে তার বাবাকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। এখন প্রতি বছর ১০ নভেম্বর ‘নূর হোসেন দিবস’ পালন করা হয়। এইচএম এরশাদের বানানো চত্বরের নাম ‘নূর হোসেন স্কয়ার’ বানিয়ে সেখানে ফুল দেয়া হয়। অলক্ষ্যে নূর হোসেনের বিদেহী আত্মা কী বলে জানি না। হয়তো বলে- ‘তুমি মহারাজ, সাধু সেজে আজ, আমারে শহীদ বানালে বটে/তোমাদের কথা, তোমাদের কাজ- জেগে আছে আমার স্মৃতিপটে’।
আসা যাক শহীদ ডা. মিলনের কথায়। যিনি আন্দোলনের মাঠে-ময়দানে নেই, সংগ্রামে নেই, ধর্মযুদ্ধেও নেই যে তিনি বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ হবেন, তিনি পিজি হাসপাতাল থেকে রিকশাযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। তিনি ঢাকা ভার্সিটি এলাকায় দু’দল ছাত্রের ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়লেন। আচমকা গুলি তার বুকে লাগল। তার নামে চত্ব¡র হয়ে গেছে। কিন্তু তারপর যা ঘটেছে- তার মূল্যায়ন কীভাবে হবে? তারপর যারা আন্দোলনের মাঠে, সংগ্রামের ময়দানে জীবন দিয়েছে, তাদের নামে চত্বর বা স্কয়ার হয় না কেন? ‘স্বৈরতন্ত্র’ নিপাত করে তো ‘গণতন্ত্র’ আনা হয়েছে। কিন্তু সেটা কোন গণতন্ত্র? এ গণতন্ত্রে কি হাজার হাজার নূর হোসেন কিংবা ডা. মিলন প্রাণ দেয়নি? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নামে চত্বর বা স্কয়ার হচ্ছে না কেন?
অতি সম্প্র্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ব্যানার হেডিং হয়েছে- ‘হত্যার রাজনীতি, লাশের মিছিল’। তথ্যে ভরা প্রতিবেদন ছিল সেটি। সেখানে বলা হয়েছে, ২২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি হয়েছে ২ হাজার ৩৮৮ জনের। তার মধ্যে বিএনপির ১৯৯১-৯৬ সময়ের শাসনামলে ১৭৪ জন, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-০১ আমলে ৭৬৭ জন, বিএনপির ২০০১-০৬ আমলে ৮৭২ জন, তত্ত্বাবধায়কের ২০০৭-০৮ আমলে ১১ জন এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের ২০০৯-১৩ আমলে এ পর্যন্ত ৫৬৪ জন মানুষ রাজনৈতিক আন্দোলনে ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের শহীদ বলা হয় না, তাদের নামে স্কয়ার, চত্ব¡র কিংবা কোনো স্মৃতিসৌধ হয় না। নূর হোসেন বা ডা. মিলনকে শহীদ বলা হলে তারাও নিশ্চয়ই শহীদ। আর এ শহীদের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে- সেই অজানা আতংক গোটা দেশবাসীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সঠিক গণতন্ত্র আবার কবে মুক্তি পাবে- তার প্রতীক্ষায় নীরবে গোটা জাতিকে প্রহর গুনতে হচ্ছে। সামনের রাজনীতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের পুরো ৯ বছর সময়ের মধ্যে মোট যতজন মানুষ মারা গেছে, পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলের মধ্যে যে কোনো একদিনে তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মারা গেছে ও যাচ্ছে। সামনে এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে কথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। তারপরও আমাদের ভাগ্যকে পালাক্রমে ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত চুলার মধ্যে সমর্পণ করতে হচ্ছে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দাবি হচ্ছে দুই নেত্রীর সংলাপ। মনে হচ্ছে, দুই নেত্রী সংলাপে বসলেই সারা বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে মিলন মঙ্গলিকের সুর বেজে উঠবে, নহবত বাজবে, দুই দলের মানুষ হানাহানি-মারামারি-কাটাকাটি ভুলে প্রেমালিঙ্গনে মেতে উঠবে! সংলাপ হলে কী হবে তা তো ৩৭ মিনিটের ফোনালাপে বোঝা গেছে। নৈতিক হোক আর অনৈতিকই হোক- ফোনালাপটি প্রচার হওয়ায় ভালোই হয়েছে। জাতি প্রকৃত রূপটা দেখেছে। প্রেস সচিব সাহেবরা মোলায়েম সুরে জাতিকে যা জানিয়েছিলেন সেটা যে আসল চেহারা নয়, মানুষ তো তা জানতে ও বুঝতে পেরেছে। ৩৭ মিনিটের ঝগড়া ও আলোচনার মধ্যে দেশের কথা, জনগণের কথা কত সেকেন্ড ছিল? গোটা জাতির মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, সম্ভাব্য টেলি সংলাপের মধ্য দিয়ে সংকট উত্তোরণের একট পথ উন্মোচন হবে। কিন্তু সেই স্যাম্পলে যা দেখা গেল, তাতে গোডাউনের মধ্যে কী আছে বা থাকতে পারে, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। বলতে খারাপ লাগলেও বলতে হয় যে, সংলাপে বসার অসম্ভব কাজটি যদি সম্ভব হয়ও তাহলে সেই সংলাপ মঞ্চের মাঝখানে লোহার জালের একটা বেড়া থাকবে তো?
পাদটিকা : সম্ভাব্য সংলাপ এখন এক অর্থহীন সান্ত্বনা। সংলাপ হলেও কোনো লাভ হবে না। এরা কী দিয়েছেন এ জাতিকে? নিয়েছেন তো অনেক। আড়াই হাজার মানুষের রক্তের মূল্য কী দিয়ে পরিশোধ হবে? কেন এ রক্ত ঝরল? বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যাদের স্বাধীনতা অর্জনে এত রক্ত ঢালতে হয়নি। এ রক্ত নেয়া হয়েছে শুধু একটি লোভের বশে। আর তা হচ্ছে ক্ষমতা। এখন লড়াই চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য। কেন এ চাওয়া- নিশ্চয় জনগণের কল্যাণের জন্য নয়। চাওয়া হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। আর একপক্ষ সংবিধানের অজুহাত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক দিতে চায় না। এই না চাওয়া কি শুধুই সংবিধানকে ভালোবেসে? নিশ্চয় এর পেছনে আছে ক্ষমতা আগলে রাখার মানসিকতা। এর আগে ১৯৯৬ সালে যখন এ তত্ত্বাবধায়কের জন্য আন্দোলন হয়েছিল, সেটাও দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য ছিল না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যা করেছে, এখন বিএনপি তাই করছে। ওই সময় বিএনপি যেভাবে সংবিধানের অজুহাত দিয়েছে, এখন আওয়ামী লীগ তাই করছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকবে? এখন মুক্তির উপায় খোঁজার সময় এসে গেছে। এখনই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত না নিলে সামনের ঘোর অমানিষার অবসান ঘটবে না। অবিলম্বে প্রয়োজন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। সেই শক্তি এখনও আছে, তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অতীতের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মত-পার্থক্য ভুলতে হবে। চক্ষু লজ্জা মুছতে হবে।
গোটা জাতি আজ সংকটাপন্ন। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ, ইসলামী মূল্যবোধ, স্বাধীনতার চেতনা, অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সম্মিলিত ধারার সঙ্গে সচেতন নাগরিক সমাজের ঐক্যের মাধ্যমে যদি বিকল্প রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে ওঠে- গোটা জাতি সেই মঞ্চে একত্রিত হবেই। আজকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আসছে দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থানই একমাত্র পথ। নতুন করে শহীদের তালিকা আর প্রত্যাশিত নয়। শহীদের নামে কোনো চত্ব¡র-স্কয়ার-স্মৃতিসৌধও আর প্রত্যাশিত নয়। যারা যা করেছেন, এখন তার জন্য ক্ষমা চেয়ে বিদায় হোন- জাতিকে মুক্তি দিন।
সুনীল শুভ রায় : লেখক ও সাংবাদিক
পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে নূর হোসেনের পিঠে গুলি লাগার কথাই বলা হয়েছে। সে তখন মিছিলের সামনে ছিল। পেছনে তো পুলিশ ছিল না। ছিল তার সহযোদ্ধারা। তাহলে কে গুলি করল তাকে। দোষ দেয়া হল রাষ্ট্রপতি এরশাদের সরকারকে। তারপর যারা তাকে শহীদ বানিয়ে ফায়দা লুটল, তাদের কাউকে নূর হোসেনের পরিবারের পাশে দেখা যায়নি। দেখা গেছে তাকে, যার কাঁধে নূর হোসেনের হত্যার দায় চাপানো হয়েছিল। সেই রাষ্ট্রপতি এরশাদ কারামুক্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন নূর হোসেনের পরিবারের কাছে। প্রতি মাসে তার বাবাকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। এখন প্রতি বছর ১০ নভেম্বর ‘নূর হোসেন দিবস’ পালন করা হয়। এইচএম এরশাদের বানানো চত্বরের নাম ‘নূর হোসেন স্কয়ার’ বানিয়ে সেখানে ফুল দেয়া হয়। অলক্ষ্যে নূর হোসেনের বিদেহী আত্মা কী বলে জানি না। হয়তো বলে- ‘তুমি মহারাজ, সাধু সেজে আজ, আমারে শহীদ বানালে বটে/তোমাদের কথা, তোমাদের কাজ- জেগে আছে আমার স্মৃতিপটে’।
আসা যাক শহীদ ডা. মিলনের কথায়। যিনি আন্দোলনের মাঠে-ময়দানে নেই, সংগ্রামে নেই, ধর্মযুদ্ধেও নেই যে তিনি বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ হবেন, তিনি পিজি হাসপাতাল থেকে রিকশাযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। তিনি ঢাকা ভার্সিটি এলাকায় দু’দল ছাত্রের ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়লেন। আচমকা গুলি তার বুকে লাগল। তার নামে চত্ব¡র হয়ে গেছে। কিন্তু তারপর যা ঘটেছে- তার মূল্যায়ন কীভাবে হবে? তারপর যারা আন্দোলনের মাঠে, সংগ্রামের ময়দানে জীবন দিয়েছে, তাদের নামে চত্বর বা স্কয়ার হয় না কেন? ‘স্বৈরতন্ত্র’ নিপাত করে তো ‘গণতন্ত্র’ আনা হয়েছে। কিন্তু সেটা কোন গণতন্ত্র? এ গণতন্ত্রে কি হাজার হাজার নূর হোসেন কিংবা ডা. মিলন প্রাণ দেয়নি? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নামে চত্বর বা স্কয়ার হচ্ছে না কেন?
অতি সম্প্র্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ব্যানার হেডিং হয়েছে- ‘হত্যার রাজনীতি, লাশের মিছিল’। তথ্যে ভরা প্রতিবেদন ছিল সেটি। সেখানে বলা হয়েছে, ২২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানি হয়েছে ২ হাজার ৩৮৮ জনের। তার মধ্যে বিএনপির ১৯৯১-৯৬ সময়ের শাসনামলে ১৭৪ জন, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-০১ আমলে ৭৬৭ জন, বিএনপির ২০০১-০৬ আমলে ৮৭২ জন, তত্ত্বাবধায়কের ২০০৭-০৮ আমলে ১১ জন এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের ২০০৯-১৩ আমলে এ পর্যন্ত ৫৬৪ জন মানুষ রাজনৈতিক আন্দোলনে ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের শহীদ বলা হয় না, তাদের নামে স্কয়ার, চত্ব¡র কিংবা কোনো স্মৃতিসৌধ হয় না। নূর হোসেন বা ডা. মিলনকে শহীদ বলা হলে তারাও নিশ্চয়ই শহীদ। আর এ শহীদের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে- সেই অজানা আতংক গোটা দেশবাসীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সঠিক গণতন্ত্র আবার কবে মুক্তি পাবে- তার প্রতীক্ষায় নীরবে গোটা জাতিকে প্রহর গুনতে হচ্ছে। সামনের রাজনীতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের পুরো ৯ বছর সময়ের মধ্যে মোট যতজন মানুষ মারা গেছে, পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলের মধ্যে যে কোনো একদিনে তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মারা গেছে ও যাচ্ছে। সামনে এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে কথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। তারপরও আমাদের ভাগ্যকে পালাক্রমে ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত চুলার মধ্যে সমর্পণ করতে হচ্ছে।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দাবি হচ্ছে দুই নেত্রীর সংলাপ। মনে হচ্ছে, দুই নেত্রী সংলাপে বসলেই সারা বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে মিলন মঙ্গলিকের সুর বেজে উঠবে, নহবত বাজবে, দুই দলের মানুষ হানাহানি-মারামারি-কাটাকাটি ভুলে প্রেমালিঙ্গনে মেতে উঠবে! সংলাপ হলে কী হবে তা তো ৩৭ মিনিটের ফোনালাপে বোঝা গেছে। নৈতিক হোক আর অনৈতিকই হোক- ফোনালাপটি প্রচার হওয়ায় ভালোই হয়েছে। জাতি প্রকৃত রূপটা দেখেছে। প্রেস সচিব সাহেবরা মোলায়েম সুরে জাতিকে যা জানিয়েছিলেন সেটা যে আসল চেহারা নয়, মানুষ তো তা জানতে ও বুঝতে পেরেছে। ৩৭ মিনিটের ঝগড়া ও আলোচনার মধ্যে দেশের কথা, জনগণের কথা কত সেকেন্ড ছিল? গোটা জাতির মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, সম্ভাব্য টেলি সংলাপের মধ্য দিয়ে সংকট উত্তোরণের একট পথ উন্মোচন হবে। কিন্তু সেই স্যাম্পলে যা দেখা গেল, তাতে গোডাউনের মধ্যে কী আছে বা থাকতে পারে, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। বলতে খারাপ লাগলেও বলতে হয় যে, সংলাপে বসার অসম্ভব কাজটি যদি সম্ভব হয়ও তাহলে সেই সংলাপ মঞ্চের মাঝখানে লোহার জালের একটা বেড়া থাকবে তো?
পাদটিকা : সম্ভাব্য সংলাপ এখন এক অর্থহীন সান্ত্বনা। সংলাপ হলেও কোনো লাভ হবে না। এরা কী দিয়েছেন এ জাতিকে? নিয়েছেন তো অনেক। আড়াই হাজার মানুষের রক্তের মূল্য কী দিয়ে পরিশোধ হবে? কেন এ রক্ত ঝরল? বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যাদের স্বাধীনতা অর্জনে এত রক্ত ঢালতে হয়নি। এ রক্ত নেয়া হয়েছে শুধু একটি লোভের বশে। আর তা হচ্ছে ক্ষমতা। এখন লড়াই চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য। কেন এ চাওয়া- নিশ্চয় জনগণের কল্যাণের জন্য নয়। চাওয়া হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। আর একপক্ষ সংবিধানের অজুহাত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক দিতে চায় না। এই না চাওয়া কি শুধুই সংবিধানকে ভালোবেসে? নিশ্চয় এর পেছনে আছে ক্ষমতা আগলে রাখার মানসিকতা। এর আগে ১৯৯৬ সালে যখন এ তত্ত্বাবধায়কের জন্য আন্দোলন হয়েছিল, সেটাও দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য ছিল না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যা করেছে, এখন বিএনপি তাই করছে। ওই সময় বিএনপি যেভাবে সংবিধানের অজুহাত দিয়েছে, এখন আওয়ামী লীগ তাই করছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকবে? এখন মুক্তির উপায় খোঁজার সময় এসে গেছে। এখনই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত না নিলে সামনের ঘোর অমানিষার অবসান ঘটবে না। অবিলম্বে প্রয়োজন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। সেই শক্তি এখনও আছে, তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে। তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অতীতের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মত-পার্থক্য ভুলতে হবে। চক্ষু লজ্জা মুছতে হবে।
গোটা জাতি আজ সংকটাপন্ন। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ, ইসলামী মূল্যবোধ, স্বাধীনতার চেতনা, অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সম্মিলিত ধারার সঙ্গে সচেতন নাগরিক সমাজের ঐক্যের মাধ্যমে যদি বিকল্প রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে ওঠে- গোটা জাতি সেই মঞ্চে একত্রিত হবেই। আজকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আসছে দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থানই একমাত্র পথ। নতুন করে শহীদের তালিকা আর প্রত্যাশিত নয়। শহীদের নামে কোনো চত্ব¡র-স্কয়ার-স্মৃতিসৌধও আর প্রত্যাশিত নয়। যারা যা করেছেন, এখন তার জন্য ক্ষমা চেয়ে বিদায় হোন- জাতিকে মুক্তি দিন।
সুনীল শুভ রায় : লেখক ও সাংবাদিক
No comments