হরতালে শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনায় রাখতে হবে by নজরুল ইসলাম
যুগান্তর
: রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হয়।
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি হ্রাসে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে করণীয় কী?
প্রফেসর নজরুল ইসলাম : আমাদের দেশে এটা একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে যে, বিভিন্ন সমস্যার কারণে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিরোধী দলে যারা থাকেন, তারা তাদের কর্মসূচি হিসেবে হরতালকে বেছে নেন। হরতাল যদি করতেই হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের যাতে সমস্যা না হয়, সেটা বিবেচনায় রেখেই করতে হবে। অর্থাৎ বড় যেসব পরীক্ষা হয়, সেগুলোর নির্ধারিত তারিখ আগেই জানা থাকে। সেই তারিখগুলো যেন হরতালের মধ্যে না পড়ে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। হরতালের মতো কর্মসূচি আহ্বান না করলেই সবচেয়ে ভালো হয়। হরতাল যদি হয়ই সেটা যেন কোনো অবস্থাতেই সহিংস ঘটনায় পরিণত না হয়। এতে কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ তো অবশ্যই পড়ে এবং অন্যদের ওপরও এর নানারকম প্রভাব পড়ে। সে জন্য হরতাল পরিহার করার চিন্তা করা উচিত। হরতাল পরিহার করতে না পারলে পরীক্ষার সময়গুলো বাদ দিয়ে যেন হরতাল হয়, সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
যুগান্তর : বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
নজরুল ইসলাম : দেশে পাবলিক পরীক্ষায় বিশেষত বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় অথবা কলেজ পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। আমাদের দেশে একটা ঐতিহ্য বা ধারা ছিল- অস্বাভাবিক উঁচু হারে পরীক্ষায় পাস- এটা ছিল না। গত কয়েক বছরে এসব পরীক্ষায় পাসের হার অনেক বেড়েছে। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাসের হার বাড়তেই পারে। কিন্তু সেটা যেন অতি উচ্চ হারে না হয় এবং অস্বাভাবিক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। পরীক্ষা একটা মান যাচাইয়ের কাজ। সেই মান যদি সঠিকভাবে যাচাই করতে না পারা যায়, তাহলে তো পাস দেখিয়ে খুব একটা লাভ নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের আরেকটু সচেতন হতে হবে- পাসের হার যেন মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
যুগান্তর : শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশে বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?
নজরুল ইসলাম : স্কুল শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বা চিন্তা শক্তির বিকাশে বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতি অতীতের রচনামূলক পদ্ধতির তুলনায় কিছুটা কার্যকর বলা যেতে পারে। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা হতে পারে। বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতি চলতে দেয়া উচিত। বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতি যেন আরও গ্রহণযোগ্যতা পায় সে জন্য গবেষণা হওয়া উচিত।
যুগান্তর : দীর্ঘ সময় পর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার প্রক্রিয়া চালু হলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম ঠিকমতো চলছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে মনিটরিং কমিটির কার্যক্রমে কী ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার, যাতে নিয়ম অমান্য করার অল্প সময়ের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায়?
নজরুল ইসলাম : ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিপুলভাবে প্রসার লাভ করেছে। এখন তো প্রায় ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংখ্যার বিবেচনায় এটি একটি বৈপ্লবিক অগ্রগতি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর যে সংখ্যা- এটিও একটি বিশাল অর্জন। এ ক্ষেত্রে এবং সর্বক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মান যেন ক্ষুণ্ন না হয় এবং শিক্ষার মান যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এবং শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পাশাপাশি যখন শিক্ষার মান অর্জিত না হয় বা মান প্রতিষ্ঠিত না হয় তখন আমরা খুবই শংকিত হই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যে দ্রুত হারে বেড়েছে, সেটার সঙ্গে তাল রেখে সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না এবং মনিটরিং যদি না হয় তাহলে মান সংরক্ষণ বা মান অর্জন সম্ভব হবে না। কতগুলো নিয়মনীতির আওতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়ার কথা। সেই নিয়মনীতি-শৃংখলা যদি ভঙ্গ করা হয় সেক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তও সরকার নিতে পারে- এরকম সিদ্ধান্ত নেয়াও হয়েছে দু-এক ক্ষেত্রে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম মনিটরিং ব্যবস্থা এবং নিয়ম ভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ- এটি আরও সুদৃঢ় হওয়া উচিত- সরকারের পক্ষ থেকে এবং ইউজিসির পক্ষ থেকে। কারণ মনিটরিং যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানের ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন। তবে এখানে বলা সঙ্গত হবে, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক ও যতœবান থাকে। সেটা একটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু আমরা শংকিত হই যখন দেখি অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে হয়, দুর্নিবারভাবে মানকে উপেক্ষা করে এবং তা শুধুই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এটাও মনে হচ্ছে যে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে মুনাফা সৃষ্টির লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। সেটা হওয়া উচিত নয় এবং হতে দেয়া উচিত নয়।
যুগান্তর : রাজধানীর পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু নদীগুলোই দূষণের শিকার। নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য করণীয় কী?
নজরুল ইসলাম : আমরা জানি, ঢাকা একটি ভাগ্যবান শহর। কারণ এর চারপাশে নদী আছে। দক্ষিণে তো বুড়িগঙ্গা যথেষ্ট চওড়া নদী ছিল। বুড়িগঙ্গার প্রশস্ততা কিছুটা কমেছে, কিন্তু এর নাব্য অনেক কমে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এর পানিতে অতিমাত্রায় দূষণ পাওয়া যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে এই অর্থে নদী বলা যায়- এর মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল করে। কিন্তু এর পানি এতই দূষিত যে, নদীর যে অন্যান্য ব্যবহার আছে সেগুলো আর এখানে হয় না। ঢাকা ওয়াসা বুড়িগঙ্গা থেকে কিছু পানি সংগ্রহ করে। এত দূষিত পানি সংগ্রহ না করাই ভালো। এ নদীর পানি দূষণের কারণে এর আশপাশের জনগণের (যারা এর পানি কোনো না কোনোভাবে ব্যবহার করে) জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। যারা দূষিত জেনেও বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার করে, তাদের নানারকম ঝুঁকি থেকে যায়।
বুড়িগঙ্গার দূষণের অন্যতম কারণ ট্যানারির বর্জ্য। এসব বর্জ্যরে কারণে বুড়িগঙ্গার পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। এ ছাড়া বস্তি এবং অন্যান্য আবাসিক এলাকার নানারকম বর্জ্যরে মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হয়। ঢাকা ওয়াসার অপরিশোধিত তরল বর্জ্যও বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। এগুলোকে প্রবহমান রাখতে হবে, এদের নাব্য বাড়াতে হবে, যাতে নদীগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ অন্যান্য নাগরিক সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ের সব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হবে।
যুগান্তর : যানজটের কারণে রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী হতে পারে?
নজরুল ইসলাম : যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকার জনগণের দুর্ভোগ কী করে বেড়ে যায়, এটি আমরা সবাই জানি। এ সমস্যা নিয়ে বহুদিন ধরে আলোচনা চলছে। এ সমস্যার সমাধানে নানারকম পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা হয়। রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা ও যানজট নিয়ে সবচেয়ে বড়, ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটির নাম হল এসটিপি বা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান। এটি ছিল বৃহত্তর ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে। কিন্তু তখন তা অনুমোদন পায়নি বা তৎকালীন সরকার এটি অনুমোদনের ব্যবস্থা করেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এটির অনুমোদন দিলেও এর বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তাদের সময়ও ছিল না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উল্লিখিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা পুনঃঅনুমোদন দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসটিপিতে উল্লিখিত কিছু বিষয়কে আরও অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। এর মধ্যে গণপরিবহন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির অংশ হিসেবে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে। এ ট্রেন সার্ভিস আংশিক চালু হলেও তা কার্যকরভাবে সফল হয়নি। বৃত্তাকার নৌপথ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। এসটিপির আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হল বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি- যার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত। এ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। গণপরিবহনবিষয়ক আরেকটি বড় প্রকল্প হল মেট্রোরেল। এটি হতে পারে আন্ডারগ্রাউন্ড রেল বা ওভারগ্রাউন্ড রেল অর্থাৎ পাতাল দিয়ে হতে পারে; মাথার ওপর দিয়েও হতে পারে। এটি বিভিন্ন দেশের শহরে আছে। ঢাকায় ইতিমধ্যে এক কোটি মানুষ বসবাস করছে, বৃহত্তর ঢাকা দেড় কোটিরও বেশি মানুষের শহরাঞ্চল। এরকম একটি শহরে মেট্রোরেল, কমিউটার ট্রেন সার্ভিস, বাস র্যাপিড ট্রানজিট- অর্থাৎ ব্যাপক রকমের গণপরিবহন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে যানজট বা পরিবহন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এর পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবহন ব্যবস্থাপনার (ট্রাফিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট) দিকেও জোর দিতে হবে। ফুটপাতগুলোকে চলাচলের উপযোগী রাখতে হবে। ফুটপাতের কোনো অংশ যাতে বেদখলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনুষ্যচালিত রিকশা ও সাইকেল ধরনের যানবাহনের জন্য আলাদা লেন থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের এ শহরে প্রায় ছয়-সাত লাখ রিকশা আছে। তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবহন পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়িকে যে অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে, তা কমিয়ে গণপরিবহন ও মনুষ্যচালিত পরিবহনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা উচিত। সার্বিকভাবে পরিবহন ব্যবস্থাপনাটি কার্যকর করা উচিত।
যুগান্তর : অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট জটিলতা দূরীকরণে কী করতে হবে?
নজরুল ইসলাম : নগরায়ণ অবশ্যই হতে হবে পরিকল্পিতভাবে। রাজধানীর ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সার্বিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে- এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু রাজউকের সেই ক্ষমতাও বোধহয় নেই। তাদের জনবলও নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে রাজউকের আর্থিক কোনো সংকট আছে বলে মনে হয় না। কারণ রাজউক যেভাবে জমি ও হাউজিংয়ের ব্যবসা করছে সেখানে তাদের অর্থ সমাগম খুব ভালো। কিন্তু যা হচ্ছে না তা হল, সঠিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। রাজউক যেহেতু পরিকল্পনা করতে পারে না, তাই তারা অন্যকে দিয়ে পরিকল্পনা করায়। রাজউক অন্যকে দিয়ে যে পরিকল্পনাটা করায় তা সঠিক হতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, রাজধানীর সঠিক উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সব ধরনের পরিকল্পনাই করতে হবে। পরিকল্পনার বিকল্প কিছুই হতে পারে না। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে।
যুগান্তর : সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার ফলে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়ে যায়। এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন?
নজরুল ইসলাম : রাজধানীর অধিবাসীদের সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের জন্য একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংস্থা থাকা উচিত। সেটি আমাদের নেই। আমি বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছি সব সেবাদানকারী সংস্থার সমন্বয়ে করতে পারবে- এ রকম একটি ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা নতুন করে তৈরি করতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন উচ্চ মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি নির্বাচিত হয়ে আসবেন- হয়তো এমপিদের মধ্য থেকে একজন অথবা একজন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারী হতে পারেন। অবশ্য এ রকম ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে নেই। সে ক্ষেত্রে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া উচিত। একই সঙ্গে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা ও সুযোগ দিতে হবে। ম্যানিলা, ব্যাংকক, টরেন্টো- এসব শহরের আদলে মেট্রো গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা চালু করা যায়। যেহেতু আমাদের দেশের সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে, সে জন্য অন্য দেশে না থাকলেও আমাদের দেশের উপযোগী নতুন সংস্থা চালু করতে হবে। এ সংস্থা সরাসরি কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে না। বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে নির্দেশ দিয়ে কাজটির সমন্বয় সাধন করবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব যাতে বেশি থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
যুগান্তর : প্লট-ফ্ল্যাট নিয়ে রাজউক যেভাবে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, এতে রাজউকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার আশংকা আছে কি?
নজরুল ইসলাম : রাজউকের ম্যান্ডেটের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন অনুমোদন ও তদারকি করা। শুরু থেকেই অবশ্য রাজউক (বা তৎকালীন ডিআইটি) নাগরিকদের আবাসনের জন্য প্লট প্রস্তুতকরণ, প্লট বরাদ্দকরণ, মৌলিক সেবা সংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। এ কার্যক্রমের অধীনে তারা গুলশান, বনানী, উত্তরা, বারিধারা উন্নয়ন করেছে। বর্তমানে পূর্বাচল, ঝিলমিল ইত্যাদি মডেল টাউনশিপ উন্নয়ন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজউকের পাশাপাশি বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন সংস্থাগুলোও একই ধরনের কাজ করছে। সে বিবেচনায় প্লট ও ফ্ল্যাট সরবরাহে রাজউকের দায়িত্ব অনেকটা হ্রাস পেতে পারে। তবে একেবারে বন্ধ করা সমীচীন হবে না। এ ক্ষেত্রে রাজউকের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও বেসরকারি কোম্পানির তুলনায় বেশি। অবশ্যই রাজউকের মূল কাজ হওয়া উচিত নগর পরিকল্পনায় মনোযোগী হওয়া এবং সে জন্য তার দক্ষতা ও জনবল বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, রাজউকের দায়িত্ব হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে নগর উন্নয়ন, আবাসন উন্নয়ন ইত্যাদি যথাযথভাবে তদারক করা এবং উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন করা।
যুগান্তর : বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা যাতে ওপরের দিকে থাকে তার জন্য সামগ্রিকভাবে কী করণীয়?
নজরুল ইসলাম : বাসযোগ্য শহরের আন্তর্জাতিক তালিকায় ঢাকার অবস্থান সর্বনিুে। তালিকার নিচের অবস্থানের উন্নতি করতে হলে অন্যান্য (বাকি ১৩৯) নগরীর তুলনায় উন্নয়ন প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিযোগিতায় সব ক’টি সূচকেই উন্নয়ন আবশ্যক। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সুশাসন ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর। সামগ্রিক নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার মান বাড়াতে হবে, পরিকল্পনা সংস্থা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে। নগর উন্নয়নের জন্য অর্থ-সম্পদও বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি হ্রাস ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন হবে না। ঢাকার জন্য একটি শক্তিশালী সমন্বয়কারী সংস্থা গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এই সংস্থা যেমন হবে সব সম্পৃক্ত মহলের প্রতিনিধিত্বমূলক, তেমনি এর নেতৃত্বে থাকবেন একজন দক্ষ ও ধীমান নেতা। আগেই উল্লেখ করেছি, এরকম ব্যক্তির পদমর্যাদাও উচ্চতম পর্যায়ের হতে হবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।
প্রফেসর নজরুল ইসলাম : আমাদের দেশে এটা একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে যে, বিভিন্ন সমস্যার কারণে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিরোধী দলে যারা থাকেন, তারা তাদের কর্মসূচি হিসেবে হরতালকে বেছে নেন। হরতাল যদি করতেই হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের যাতে সমস্যা না হয়, সেটা বিবেচনায় রেখেই করতে হবে। অর্থাৎ বড় যেসব পরীক্ষা হয়, সেগুলোর নির্ধারিত তারিখ আগেই জানা থাকে। সেই তারিখগুলো যেন হরতালের মধ্যে না পড়ে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। হরতালের মতো কর্মসূচি আহ্বান না করলেই সবচেয়ে ভালো হয়। হরতাল যদি হয়ই সেটা যেন কোনো অবস্থাতেই সহিংস ঘটনায় পরিণত না হয়। এতে কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ তো অবশ্যই পড়ে এবং অন্যদের ওপরও এর নানারকম প্রভাব পড়ে। সে জন্য হরতাল পরিহার করার চিন্তা করা উচিত। হরতাল পরিহার করতে না পারলে পরীক্ষার সময়গুলো বাদ দিয়ে যেন হরতাল হয়, সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
যুগান্তর : বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
নজরুল ইসলাম : দেশে পাবলিক পরীক্ষায় বিশেষত বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় অথবা কলেজ পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। আমাদের দেশে একটা ঐতিহ্য বা ধারা ছিল- অস্বাভাবিক উঁচু হারে পরীক্ষায় পাস- এটা ছিল না। গত কয়েক বছরে এসব পরীক্ষায় পাসের হার অনেক বেড়েছে। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাসের হার বাড়তেই পারে। কিন্তু সেটা যেন অতি উচ্চ হারে না হয় এবং অস্বাভাবিক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। পরীক্ষা একটা মান যাচাইয়ের কাজ। সেই মান যদি সঠিকভাবে যাচাই করতে না পারা যায়, তাহলে তো পাস দেখিয়ে খুব একটা লাভ নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের আরেকটু সচেতন হতে হবে- পাসের হার যেন মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
যুগান্তর : শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশে বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?
নজরুল ইসলাম : স্কুল শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বা চিন্তা শক্তির বিকাশে বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতি অতীতের রচনামূলক পদ্ধতির তুলনায় কিছুটা কার্যকর বলা যেতে পারে। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা হতে পারে। বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতি চলতে দেয়া উচিত। বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতি যেন আরও গ্রহণযোগ্যতা পায় সে জন্য গবেষণা হওয়া উচিত।
যুগান্তর : দীর্ঘ সময় পর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার প্রক্রিয়া চালু হলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম ঠিকমতো চলছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে মনিটরিং কমিটির কার্যক্রমে কী ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার, যাতে নিয়ম অমান্য করার অল্প সময়ের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায়?
নজরুল ইসলাম : ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিপুলভাবে প্রসার লাভ করেছে। এখন তো প্রায় ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংখ্যার বিবেচনায় এটি একটি বৈপ্লবিক অগ্রগতি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর যে সংখ্যা- এটিও একটি বিশাল অর্জন। এ ক্ষেত্রে এবং সর্বক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মান যেন ক্ষুণ্ন না হয় এবং শিক্ষার মান যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এবং শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পাশাপাশি যখন শিক্ষার মান অর্জিত না হয় বা মান প্রতিষ্ঠিত না হয় তখন আমরা খুবই শংকিত হই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যে দ্রুত হারে বেড়েছে, সেটার সঙ্গে তাল রেখে সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না এবং মনিটরিং যদি না হয় তাহলে মান সংরক্ষণ বা মান অর্জন সম্ভব হবে না। কতগুলো নিয়মনীতির আওতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়ার কথা। সেই নিয়মনীতি-শৃংখলা যদি ভঙ্গ করা হয় সেক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তও সরকার নিতে পারে- এরকম সিদ্ধান্ত নেয়াও হয়েছে দু-এক ক্ষেত্রে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম মনিটরিং ব্যবস্থা এবং নিয়ম ভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ- এটি আরও সুদৃঢ় হওয়া উচিত- সরকারের পক্ষ থেকে এবং ইউজিসির পক্ষ থেকে। কারণ মনিটরিং যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানের ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন। তবে এখানে বলা সঙ্গত হবে, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক ও যতœবান থাকে। সেটা একটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু আমরা শংকিত হই যখন দেখি অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে হয়, দুর্নিবারভাবে মানকে উপেক্ষা করে এবং তা শুধুই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এটাও মনে হচ্ছে যে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে মুনাফা সৃষ্টির লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। সেটা হওয়া উচিত নয় এবং হতে দেয়া উচিত নয়।
যুগান্তর : রাজধানীর পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু নদীগুলোই দূষণের শিকার। নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য করণীয় কী?
নজরুল ইসলাম : আমরা জানি, ঢাকা একটি ভাগ্যবান শহর। কারণ এর চারপাশে নদী আছে। দক্ষিণে তো বুড়িগঙ্গা যথেষ্ট চওড়া নদী ছিল। বুড়িগঙ্গার প্রশস্ততা কিছুটা কমেছে, কিন্তু এর নাব্য অনেক কমে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এর পানিতে অতিমাত্রায় দূষণ পাওয়া যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে এই অর্থে নদী বলা যায়- এর মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল করে। কিন্তু এর পানি এতই দূষিত যে, নদীর যে অন্যান্য ব্যবহার আছে সেগুলো আর এখানে হয় না। ঢাকা ওয়াসা বুড়িগঙ্গা থেকে কিছু পানি সংগ্রহ করে। এত দূষিত পানি সংগ্রহ না করাই ভালো। এ নদীর পানি দূষণের কারণে এর আশপাশের জনগণের (যারা এর পানি কোনো না কোনোভাবে ব্যবহার করে) জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। যারা দূষিত জেনেও বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার করে, তাদের নানারকম ঝুঁকি থেকে যায়।
বুড়িগঙ্গার দূষণের অন্যতম কারণ ট্যানারির বর্জ্য। এসব বর্জ্যরে কারণে বুড়িগঙ্গার পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। এ ছাড়া বস্তি এবং অন্যান্য আবাসিক এলাকার নানারকম বর্জ্যরে মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হয়। ঢাকা ওয়াসার অপরিশোধিত তরল বর্জ্যও বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। এগুলোকে প্রবহমান রাখতে হবে, এদের নাব্য বাড়াতে হবে, যাতে নদীগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ অন্যান্য নাগরিক সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ের সব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হবে।
যুগান্তর : যানজটের কারণে রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। যানজট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী হতে পারে?
নজরুল ইসলাম : যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকার জনগণের দুর্ভোগ কী করে বেড়ে যায়, এটি আমরা সবাই জানি। এ সমস্যা নিয়ে বহুদিন ধরে আলোচনা চলছে। এ সমস্যার সমাধানে নানারকম পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা হয়। রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা ও যানজট নিয়ে সবচেয়ে বড়, ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটির নাম হল এসটিপি বা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান। এটি ছিল বৃহত্তর ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে। কিন্তু তখন তা অনুমোদন পায়নি বা তৎকালীন সরকার এটি অনুমোদনের ব্যবস্থা করেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এটির অনুমোদন দিলেও এর বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তাদের সময়ও ছিল না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উল্লিখিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা পুনঃঅনুমোদন দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসটিপিতে উল্লিখিত কিছু বিষয়কে আরও অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। এর মধ্যে গণপরিবহন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির অংশ হিসেবে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে। এ ট্রেন সার্ভিস আংশিক চালু হলেও তা কার্যকরভাবে সফল হয়নি। বৃত্তাকার নৌপথ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। এসটিপির আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হল বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি- যার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত। এ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। গণপরিবহনবিষয়ক আরেকটি বড় প্রকল্প হল মেট্রোরেল। এটি হতে পারে আন্ডারগ্রাউন্ড রেল বা ওভারগ্রাউন্ড রেল অর্থাৎ পাতাল দিয়ে হতে পারে; মাথার ওপর দিয়েও হতে পারে। এটি বিভিন্ন দেশের শহরে আছে। ঢাকায় ইতিমধ্যে এক কোটি মানুষ বসবাস করছে, বৃহত্তর ঢাকা দেড় কোটিরও বেশি মানুষের শহরাঞ্চল। এরকম একটি শহরে মেট্রোরেল, কমিউটার ট্রেন সার্ভিস, বাস র্যাপিড ট্রানজিট- অর্থাৎ ব্যাপক রকমের গণপরিবহন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে যানজট বা পরিবহন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এর পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবহন ব্যবস্থাপনার (ট্রাফিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট) দিকেও জোর দিতে হবে। ফুটপাতগুলোকে চলাচলের উপযোগী রাখতে হবে। ফুটপাতের কোনো অংশ যাতে বেদখলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনুষ্যচালিত রিকশা ও সাইকেল ধরনের যানবাহনের জন্য আলাদা লেন থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের এ শহরে প্রায় ছয়-সাত লাখ রিকশা আছে। তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবহন পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়িকে যে অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে, তা কমিয়ে গণপরিবহন ও মনুষ্যচালিত পরিবহনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা উচিত। সার্বিকভাবে পরিবহন ব্যবস্থাপনাটি কার্যকর করা উচিত।
যুগান্তর : অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট জটিলতা দূরীকরণে কী করতে হবে?
নজরুল ইসলাম : নগরায়ণ অবশ্যই হতে হবে পরিকল্পিতভাবে। রাজধানীর ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সার্বিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে- এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু রাজউকের সেই ক্ষমতাও বোধহয় নেই। তাদের জনবলও নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে রাজউকের আর্থিক কোনো সংকট আছে বলে মনে হয় না। কারণ রাজউক যেভাবে জমি ও হাউজিংয়ের ব্যবসা করছে সেখানে তাদের অর্থ সমাগম খুব ভালো। কিন্তু যা হচ্ছে না তা হল, সঠিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। রাজউক যেহেতু পরিকল্পনা করতে পারে না, তাই তারা অন্যকে দিয়ে পরিকল্পনা করায়। রাজউক অন্যকে দিয়ে যে পরিকল্পনাটা করায় তা সঠিক হতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, রাজধানীর সঠিক উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সব ধরনের পরিকল্পনাই করতে হবে। পরিকল্পনার বিকল্প কিছুই হতে পারে না। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে।
যুগান্তর : সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার ফলে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়ে যায়। এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন?
নজরুল ইসলাম : রাজধানীর অধিবাসীদের সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের জন্য একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংস্থা থাকা উচিত। সেটি আমাদের নেই। আমি বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছি সব সেবাদানকারী সংস্থার সমন্বয়ে করতে পারবে- এ রকম একটি ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা নতুন করে তৈরি করতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন উচ্চ মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি নির্বাচিত হয়ে আসবেন- হয়তো এমপিদের মধ্য থেকে একজন অথবা একজন সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারী হতে পারেন। অবশ্য এ রকম ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে নেই। সে ক্ষেত্রে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া উচিত। একই সঙ্গে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা ও সুযোগ দিতে হবে। ম্যানিলা, ব্যাংকক, টরেন্টো- এসব শহরের আদলে মেট্রো গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা চালু করা যায়। যেহেতু আমাদের দেশের সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে, সে জন্য অন্য দেশে না থাকলেও আমাদের দেশের উপযোগী নতুন সংস্থা চালু করতে হবে। এ সংস্থা সরাসরি কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে না। বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে নির্দেশ দিয়ে কাজটির সমন্বয় সাধন করবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব যাতে বেশি থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
যুগান্তর : প্লট-ফ্ল্যাট নিয়ে রাজউক যেভাবে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, এতে রাজউকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার আশংকা আছে কি?
নজরুল ইসলাম : রাজউকের ম্যান্ডেটের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন অনুমোদন ও তদারকি করা। শুরু থেকেই অবশ্য রাজউক (বা তৎকালীন ডিআইটি) নাগরিকদের আবাসনের জন্য প্লট প্রস্তুতকরণ, প্লট বরাদ্দকরণ, মৌলিক সেবা সংযোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। এ কার্যক্রমের অধীনে তারা গুলশান, বনানী, উত্তরা, বারিধারা উন্নয়ন করেছে। বর্তমানে পূর্বাচল, ঝিলমিল ইত্যাদি মডেল টাউনশিপ উন্নয়ন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজউকের পাশাপাশি বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন সংস্থাগুলোও একই ধরনের কাজ করছে। সে বিবেচনায় প্লট ও ফ্ল্যাট সরবরাহে রাজউকের দায়িত্ব অনেকটা হ্রাস পেতে পারে। তবে একেবারে বন্ধ করা সমীচীন হবে না। এ ক্ষেত্রে রাজউকের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও বেসরকারি কোম্পানির তুলনায় বেশি। অবশ্যই রাজউকের মূল কাজ হওয়া উচিত নগর পরিকল্পনায় মনোযোগী হওয়া এবং সে জন্য তার দক্ষতা ও জনবল বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, রাজউকের দায়িত্ব হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে নগর উন্নয়ন, আবাসন উন্নয়ন ইত্যাদি যথাযথভাবে তদারক করা এবং উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন করা।
যুগান্তর : বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা যাতে ওপরের দিকে থাকে তার জন্য সামগ্রিকভাবে কী করণীয়?
নজরুল ইসলাম : বাসযোগ্য শহরের আন্তর্জাতিক তালিকায় ঢাকার অবস্থান সর্বনিুে। তালিকার নিচের অবস্থানের উন্নতি করতে হলে অন্যান্য (বাকি ১৩৯) নগরীর তুলনায় উন্নয়ন প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিযোগিতায় সব ক’টি সূচকেই উন্নয়ন আবশ্যক। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সুশাসন ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর। সামগ্রিক নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার মান বাড়াতে হবে, পরিকল্পনা সংস্থা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে। নগর উন্নয়নের জন্য অর্থ-সম্পদও বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি হ্রাস ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন হবে না। ঢাকার জন্য একটি শক্তিশালী সমন্বয়কারী সংস্থা গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এই সংস্থা যেমন হবে সব সম্পৃক্ত মহলের প্রতিনিধিত্বমূলক, তেমনি এর নেতৃত্বে থাকবেন একজন দক্ষ ও ধীমান নেতা। আগেই উল্লেখ করেছি, এরকম ব্যক্তির পদমর্যাদাও উচ্চতম পর্যায়ের হতে হবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।
No comments