২২ বছরে নিহত ২৫১৯
রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ বছরে দুই হাজার ৫১৯ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দানবীয় রূপ নিয়েছে। এর মুখ্য দায় নাগরিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর চাপালে চলবে না। এর মুখ্য দায় শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বকেই নিতে হবে। কিন্তু পরিহাস হচ্ছে, তাঁরা একে অন্যের ওপর দায় স্থানান্তর করেই পার পেতে চাইছেন। এটা আর চলতে পারে না। ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে দুর্বার সামাজিক প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। দেশে ক্ষতিপূরণ (টর্ট) আইনের কার্যকারিতা সৃষ্টি ও তার প্রসার ঘটাতে হবে। রাজনীতিতে আকস্মিক উগ্রবাদ ও অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। এর মূলে রয়েছে দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রকৃত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করার বাস্তবতা সমাজ থেকে লোপ পেতে চলেছে। সহিংসতার বিষবৃক্ষ সমাজ থেকে উপড়াতে হলে সর্বাগ্রে দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ব্যাপকভিত্তিক চর্চা দরকার। এ জন্য প্রয়োজন বৈরী ও বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির পরিবর্তন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিস্তৃতি ঘটেছিল সামরিক শাসনামলে। ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর আমরা আশা করেছিলাম, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল ও সক্রিয় করে তোলার পাশাপাশি দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা জোরদার হবে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। এর কুফল নানাবিধ উপায়ে সমাজে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
শাসকগোষ্ঠী জাতির সামনে বৈষয়িক উন্নতির যে চিত্র তুলে ধরে আসছে, তার আড়ালে বহু মানুষের লাশ চাপা আছে। দল ও শাসনব্যবস্থায় যেকোনো মূল্যে ব্যক্তিকে ধরে রাখার সর্বনাশা চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এই লাশের মিছিল চলতেই থাকবে। নির্বাচনী বছরগুলো ক্রমেই রক্তগঙ্গার বছর হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ গঠনের বছরে মাত্র ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটলেও ২০০১ সালে তা ৫০০ জনে উন্নীত হয়েছে। এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩০৪ জন মারা গেছে। মানুষ শঙ্কিত, এবার কী হবে? স্বজনহারাদের পরিবারগুলো বলছে, ক্ষমতার রাজনীতির কারণে এসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। অথচ ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিভূরা এ নিয়ে আলোচনায় বিমুখ থাকেন। ২২ বছরে আড়াই হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি নিয়ে সংসদে একটিবারও আলোচনা হয়নি। সাম্প্রতিক হরতালে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের বিষয়ে দুই প্রধান দলের মধ্যে প্রথাগত দায় স্থানান্তরের খেলা চলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরতালজনিত সহিংসতায় প্রাণহানির দায়ে এমন ভাষায় মামলা দায়ের করার হুমকি দিচ্ছেন, যাতে মনে হতে পারে, তিনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে কেবলই রাজনৈতিক কারণে করুণা ভিক্ষা দিচ্ছেন; যেন এটা তাদের অধিকার নয়। এই রাষ্ট্র এবং তার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সঙ্গে এভাবেই পরিহাস করে চলেছে। এই ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ আমরা চাই না। সহিংস ক্ষমতার রাজনীতির অবসান হোক। আর এ জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নেতৃত্বে অবশ্যই গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে।
No comments