ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর by ড. মাহবুব উল্লাহ্
আজ
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষ এই দিনটি পালন করে জাতীয়
বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর
সিপাহি-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। সিপাহি-জনতার এই অভ্যুত্থান
ছিল আধিপত্যবাদের করালগ্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার এক তেজোদীপ্ত
জাগরণ। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপরিচয় নির্ধারণে এ অভ্যুত্থানের
ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানি
শাসন ও শোষণের নিগড় থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার মাটিতে
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। বাংলাদেশের
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ কমান্ড গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের
সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল এমএজি ওসমানী। বাংলাদেশের জনগণ এবং
সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যাশা করেছিল, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে একদিকে
যেমন থাকবেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরা, অন্যদিকে
তারই পাশে অবস্থান করবেন জেনারেল এমএজি ওসমানী। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ
হয়নি। যে কোনো কারণেই হোক বা কোনো ষড়যন্ত্রের ফলেই হোক, জেনারেল ওসমানী
আত্মসমর্পণ স্থল থেকে বহু দূরে অবস্থান করেছিলেন। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা এবং
সাধারণ বাংলাদেশীদের অহংবোধ মারাত্মকভাবে আহত হয়। মানুষ ভাবতে শুরু করল,
আমরা কি সত্যই একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি?
বাংলাদেশের অতুলনীয় সাহসের অধিকারী মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস ধরে খণ্ড খণ্ড লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিল। এ লড়াই আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলাদেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের মিত্র ভারতের ছিল ভিন্ন চিন্তা। তারা চাইল এ যুদ্ধের ত্বরিত সমাধান। তারা ভেবেছিল, যুদ্ধ-জয়ের একক গৌরব যদি মুক্তিযোদ্ধারা অর্জন করে, তাহলে বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের রণনীতিগত আকাক্সক্ষার সাফল্য আসবে না। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি আÍগর্ভে বলীয়ান দৃঢ়চেতা জাতি। এদের কাছ থেকে কোনো অন্যায় সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে না।
পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যুদ্ধের ময়দানে মিত্র শক্তিরা নিছক নিঃস্বার্থভাবে মানবিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় না। যে কোনো ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থনের ক্ষেত্রে- হোক তা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অথবা হতে পারে সামরিক- সাহায্য লাভের জন্য মূল্য দিতে হয়। এমনি ধরনের মূল্য দিয়েছিল নাৎসি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। তারা যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য পেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অন্তরে অন্তরে গুমরে মরছিল।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ সামরিক বাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার পদ থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। একই সময় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাধারণ সৈনিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। সাধারণ সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা এবং খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। তারা ভাবল, বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদের কব্জা আরও দৃঢ় হল। এ অবস্থা সৈনিকরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৬ নভেম্বরের মধ্যরাতের পর কামানের গোলাবর্ষণ করে সর্বাত্মক বিদ্রোহের সূচনা ঘটাল। তারা জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করল। খালেদ মোশারফ এবং তার সহযোগীরা পালাতে গিয়ে বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হলেন। এভাবে খালেদ মোশারফের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের প্রতি বেঈমানি করার কালিমা নিয়ে দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এরকম মৃত্যুও কাম্য ছিল না। কিন্তু ইতিহাসের ঘটনা অনেক সময় আমাদের স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধিকে হার মানায়।
অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে পড়ল। তাদের কণ্ঠে স্লোগান ছিল- ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহি-জনতা ভাই-ভাই’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। জনগণ ফুলের মালা দিয়ে হর্ষধ্বনি তুলে বিপ্লবী সৈনিকদের অভিনন্দন জানাল। অনেকে ট্যাংকের ওপরে চড়ে বসল। এভাবে রচিত হল সৈনিক ও জনতার মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রত্যয়ে এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। একটি দেশের সামরিক বাহিনী যতই প্রশিক্ষিত হোক, তাদের অস্ত্র সম্ভার যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা না থাকলে তারা কখনোই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জয়ী হতে পারে না। ৭ নভেম্বরের শিক্ষা হল, সামরিক বাহিনী ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সৌভ্রাতৃত্বই বাংলাদেশকে যে কোনো আগ্রাসী শক্তির ভ্রুকুটি থেকে রক্ষা করতে পারে।
৩ থেকে ৭ নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানী ঢাকার মানুষদের অনুভূতি ও অভিব্যক্তি অনুভব করার সুযোগ আমার হয়েছিল। মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এক অজানা শংকা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তারা ভাবছিল, আবার কি গোলামি জিঞ্জির পরতে হবে? ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এ দেশের মানুষকে নবতর জীবন চেতনায় প্রাণিত করল। জাতি তার পরিচয় ও ঠিকানা পুনরুদ্ধার করল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান সরকারের আমলে দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে না। এ দিবসের তাৎপর্য মুছে ফেলার প্রয়াস বাংলাদেশকে সবল করবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বাংলাদেশের অতুলনীয় সাহসের অধিকারী মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস ধরে খণ্ড খণ্ড লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিল। এ লড়াই আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলাদেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের মিত্র ভারতের ছিল ভিন্ন চিন্তা। তারা চাইল এ যুদ্ধের ত্বরিত সমাধান। তারা ভেবেছিল, যুদ্ধ-জয়ের একক গৌরব যদি মুক্তিযোদ্ধারা অর্জন করে, তাহলে বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের রণনীতিগত আকাক্সক্ষার সাফল্য আসবে না। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি আÍগর্ভে বলীয়ান দৃঢ়চেতা জাতি। এদের কাছ থেকে কোনো অন্যায় সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে না।
পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যুদ্ধের ময়দানে মিত্র শক্তিরা নিছক নিঃস্বার্থভাবে মানবিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় না। যে কোনো ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থনের ক্ষেত্রে- হোক তা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অথবা হতে পারে সামরিক- সাহায্য লাভের জন্য মূল্য দিতে হয়। এমনি ধরনের মূল্য দিয়েছিল নাৎসি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। তারা যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য পেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অন্তরে অন্তরে গুমরে মরছিল।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ সামরিক বাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার পদ থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। একই সময় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাধারণ সৈনিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। সাধারণ সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা এবং খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। তারা ভাবল, বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদের কব্জা আরও দৃঢ় হল। এ অবস্থা সৈনিকরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৬ নভেম্বরের মধ্যরাতের পর কামানের গোলাবর্ষণ করে সর্বাত্মক বিদ্রোহের সূচনা ঘটাল। তারা জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করল। খালেদ মোশারফ এবং তার সহযোগীরা পালাতে গিয়ে বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হলেন। এভাবে খালেদ মোশারফের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের প্রতি বেঈমানি করার কালিমা নিয়ে দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এরকম মৃত্যুও কাম্য ছিল না। কিন্তু ইতিহাসের ঘটনা অনেক সময় আমাদের স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধিকে হার মানায়।
অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে পড়ল। তাদের কণ্ঠে স্লোগান ছিল- ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ’, ‘সিপাহি-জনতা ভাই-ভাই’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। জনগণ ফুলের মালা দিয়ে হর্ষধ্বনি তুলে বিপ্লবী সৈনিকদের অভিনন্দন জানাল। অনেকে ট্যাংকের ওপরে চড়ে বসল। এভাবে রচিত হল সৈনিক ও জনতার মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রত্যয়ে এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। একটি দেশের সামরিক বাহিনী যতই প্রশিক্ষিত হোক, তাদের অস্ত্র সম্ভার যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা না থাকলে তারা কখনোই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জয়ী হতে পারে না। ৭ নভেম্বরের শিক্ষা হল, সামরিক বাহিনী ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সৌভ্রাতৃত্বই বাংলাদেশকে যে কোনো আগ্রাসী শক্তির ভ্রুকুটি থেকে রক্ষা করতে পারে।
৩ থেকে ৭ নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানী ঢাকার মানুষদের অনুভূতি ও অভিব্যক্তি অনুভব করার সুযোগ আমার হয়েছিল। মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এক অজানা শংকা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তারা ভাবছিল, আবার কি গোলামি জিঞ্জির পরতে হবে? ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এ দেশের মানুষকে নবতর জীবন চেতনায় প্রাণিত করল। জাতি তার পরিচয় ও ঠিকানা পুনরুদ্ধার করল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান সরকারের আমলে দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে না। এ দিবসের তাৎপর্য মুছে ফেলার প্রয়াস বাংলাদেশকে সবল করবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments