আদালতের রায় উপেক্ষা করে ভিসিবিরোধী আন্দোলন! by ফরিদ আহমদ রবি
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একাংশের চলমান আন্দোলনের প্রথমদিকে একজন অভিভাবক
হিসেবে আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। যুগান্তরের পাতায়
তা স্থান পেয়েছিল। এরপর অনেক বিদগ্ধজন বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় লিখেছেন।
আনুপূর্বিক বিশ্লেষণ পেয়েছি। পত্রিকায় অনেক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। সব
বক্তব্য একজন সচেতন পাঠক পড়ে থাকলে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমানে দেশের
রাজনীতির সঙ্গে খুব মিলে যায় আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের রাজনীতি।
দু’ক্ষেত্রেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা কোনো
যৌক্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে চাইছেন না। শুরু থেকে তাদের একটিই উদ্দেশ্য
ছিল, আর তা হচ্ছে একটি নির্বাচিত সরকারের পদত্যাগ। বিরোধী রাজনীতির
নিয়ন্ত্রকরা এখন একের পর এক হরতালের খড়গ চাপিয়ে দিচ্ছেন দেশবাসীর ঘাড়ে।
বোমাবাজি হচ্ছে, আগুন জ্বলছে, মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের
পরীক্ষার ঘরে তালা ঝুলছে। এ ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে জনগণকে সবকিছু মাথা পেতে
নিতে হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকরাও একজন নির্বাচিত ভিসির পেছনে লেগে আছেন শুরু থেকেই। শুরুতে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের অপরাধ চিহ্নিত হয়েছে। তা হচ্ছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক রাজনীতিক শিক্ষকের ভিসি হওয়ার আকাক্সক্ষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি ভিসি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক ধারণাকে তোয়াক্কা না করে সংকীর্ণ স্থানিক ধারণা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে তারা গ্রহণ করতে পারেননি। এরপর অধ্যাপক আনোয়ার নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে মহামান্য চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তার অবস্থান শক্ত হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা তখন কৌশল পাল্টান। নানা ইস্যু তুলে তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন, যাতে বিরক্ত হয়ে ভিসি মহোদয় পদত্যাগ করেন। কিন্তু এ মুক্তিযোদ্ধা ভিসির মনোবল শক্ত থাকায় তিনি অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন, কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। আন্দোলনকারীরা ১২ থেকে ১৮ দফা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ভিসিকে পদত্যাগ করানোর মতো একটিও উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে নানা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়। শেষ পর্যন্ত বলপ্রয়োগের চেষ্টাও করেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। নিজেদের লাভক্ষতির আন্দোলনে জিম্মি করে ফেলেন শিক্ষার্থীদেরও। ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে সেশনজটের মুখে ফেলে দেন। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিপন্ন করে তোলেন শিক্ষক নামধারী কিছুসংখ্যক রাজনীতি করা শিক্ষক। একপর্যায় অত্যন্ত অমার্জিতভাবে ভিসি মহোদয়কে প্রায় চারদিন অবরুদ্ধ করে রাখেন তার অফিস কক্ষে। এ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও একজন ছাত্র শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য হাইকোর্টে রিট করেন। মহামান্য আদালত রায় দেন রিটকারীদের পক্ষে। সব ধরনের অবরোধ অবস্থা তুলে দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নির্বিঘœ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশ কার্যকর করার জন্য আদেশ দেয়া হয় পুলিশের আইজিপি, শিক্ষা সচিব, সাভার অঞ্চলের পুলিশ প্রশাসন, ভিসি মহোদয় প্রমুখের ওপর। এবার দেশবাসী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। অবরুদ্ধ অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন মুক্ত হন। ভিসি মহোদয় সরকারের কাছে দাবি জানান সবকিছু তদন্ত করে দেখার। তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে তার জন্য সব শাস্তি মেনে নেয়ার অঙ্গীকারও করেন। এমন উদাহরণ এদেশে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কি-না আমার জানা নেই।
বিস্ময়কর হচ্ছে, আদালতের আদেশের একটি বায়বীয় কার্যকারিতা কয়েকদিন কার্যকর থাকে। তারপর আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ভর করে। তারা আদালতকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। তারা অবরুদ্ধ করেন প্রশাসন ভবন। ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেন। আটকে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন কার্যক্রম। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, আদালত অবমাননাকে যেন উৎসাহ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাও। ভিসি বারবার তাগাদা দেয়ার পরও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে না। দু-একটি সংবাদপত্রের রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়, তদন্তে নাকি ভিসিকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো উপাদান নেই। আন্দোলনকারীদের রক্ষার জন্য এ নীরবতা! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক শিক্ষক বন্ধুর অনুমান, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের কারও সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাশীল কারও সখ্য আছে। তাই পাথর চাপা দেয়া হয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট। পত্রিকা সূত্রে জানতে পারি, এর মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটি ভিসি এবং আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতাদের ডেকেছিলেন মিটমাট করার জন্য। কিন্তু এতে গৃহীত সিদ্ধান্তে আন্দোলনকারীরাই লাভবান হয়েছেন। অনেকটা জোর খাটিয়েই অনেক অন্যায় আবদার মেনে নিতে অনুরোধ করা হয়েছে ভিসিকে। আন্দোলনকারীদের কাছেও অনুরোধ রাখা হয়েছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। শোনা যায়, সরকার তার শেষ অবস্থায় বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে বলে নতুন ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চাইছে না। ফলে একজন নির্বাচিত ভিসিকেই অন্যায় অনুরোধ মেনে নিতে হচ্ছে। তাই নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে ছাড় দিয়ে ভিসি ঘোষণা দিয়েছেন, সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ভিসির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে তিনি অচিরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবেন। তবে আমাদের মনে হয়, এমন প্রক্রিয়ায় গিয়ে সংসদীয় কমিটি ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ায় না থেকে একটি বাজে উদাহরণ তৈরি করল। এর নেতিবাচক ব্যবহার শুরু হবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জানা যায়, ভিসি তার কথা রক্ষা করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। তবে কথা রাখেননি আন্দোলনকারীরা। তারা ভিসিকে সময় দিতে চান না। বলপূর্বক পদত্যাগ করিয়েই ছাড়বেন। শিক্ষক রাজনীতির আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক গ্র“পের এক দারুণ মিলনের রসায়নে চাপ বৃদ্ধি চলছে ক্রমাগত। আমাদের ধারণা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি বিশেষ ব্যতিক্রম। সেখানে দুটি শিক্ষক গ্র“প ছাড়া আন্দোলনে অন্য কেউ নেই। কোনো ধারার ছাত্ররা এ আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করেনি, বরঞ্চ শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য মিছিল করেছে। ব্যানার টানিয়েছে। লিফলেট বিতরণ করেছে। শিক্ষক মঞ্চ নামে বাকি শিক্ষকরা এ অযৌক্তিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবুও আন্দোলনকারীরা নির্দ্বিধায় শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার মতো অনাচার করে যাচ্ছেন। আর তা সম্ভব হচ্ছে সম্ভবত অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের একাকীত্বে। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি দলীয় শিক্ষক রাজনীতির বলয় তৈরি করতে চাননি। সেই অর্থে তার কোনো শিক্ষক গ্র“প নেই। যারা এ আন্দোলন সমর্থন করছেন না, তারা নৈতিকভাবে নিজেদের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, কিন্তু যৌক্তিক কারণে ভিসিকে রক্ষায় সংঘবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন না। সম্ভবত এ সুযোগটিই গ্রহণ করছেন আন্দোলনকারীরা।
এরই মধ্যে আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবার সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছেন আন্দোলনকারীরা। ক্লাস, পরীক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম সবকিছু অচল করে দেয়া হয়েছে। ভিসির ওপর চূড়ান্ত চাপ প্রয়োগের জন্য গভীর রাতে তার বাসভবনে ঢুকে ঘুমন্ত ভিসিকে ডেকে নামানো হয়েছে। নানাভাবে অসদাচরণ করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। ভিসিকে এবার নিজ বাসভবনে পরিবার-পরিজনসহ অবরুদ্ধ করে সেখানেই অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষাগুরুরা।
এসব দেখেশুনে ও পত্রিকায় পড়ে আমরা ভীষণভাবে হতাশ ও আতংকিত। অভিভাবক হিসেবে আমরা ঘোর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। এমন অনাচারের দায় আমরা শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকদেরই দিতে চাই না, এ দায় নিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব অংশকেই। প্রশ্ন থাকে, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করে কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংকট ঘোলাটে করায় ভূমিকা রাখছে না? সংসদীয় কমিটির অসম ফয়সালাও শেষ পর্যন্ত মান্য না করে যে অপরাধ করলেন আন্দোলনকারীরা, তার জন্য কোনো প্রতিক্রিয়া কি দেখিয়েছে সংসদীয় কমিটি? আর আদালতের রায় অব্যাহতভাবে অমান্য করে যাওয়ার পর রায় কার্যকর করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক কোনো ভূমিকা না রাখায় তারা কি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন না?
আমি আমার শিক্ষক বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম, রায় থাকার পরও আন্দোলনকারীরা আদালত অবমাননা করে যাচ্ছেন কীভাবে? তিনি বললেন, এসব রায়ে শিক্ষকরা ভীত নন। তাদের বিশ্বাস, শেষ সময়ে এসবে মনোযোগ দেবে না সরকারপক্ষ। আর শিক্ষকদের ঘাঁটাতে আদালতের রায় কার্যকর করতেও এগিয়ে আসবে না সংশ্লিষ্ট পক্ষ। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে আইনের শাসনের প্রতি কারও আস্থা থাকবে কি? আর এভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর যদি জোড়াতালি দিয়ে সংকট এড়াতে চায়, তবে তা ভয়ংকরভাবে চেপে বসবে ঘাড়ে। এরপর স্বাভাবিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। নষ্ট রাজনীতির কাছে এমন আত্মসমর্পণ শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশকে স্থায়ী সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে, যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা মনে করি, মহামান্য আদালতের নিজ দায়িত্বে বিষয়টি নজরে আনা প্রয়োজন। কারণ আদালতের রায় এভাবে অকার্যকর হতে থাকলে আদালতের মর্যাদা প্রশ্নের মুখে পড়বে।
ফরিদ আহমদ রবি : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকরাও একজন নির্বাচিত ভিসির পেছনে লেগে আছেন শুরু থেকেই। শুরুতে ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের অপরাধ চিহ্নিত হয়েছে। তা হচ্ছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক রাজনীতিক শিক্ষকের ভিসি হওয়ার আকাক্সক্ষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি ভিসি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক ধারণাকে তোয়াক্কা না করে সংকীর্ণ স্থানিক ধারণা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে তারা গ্রহণ করতে পারেননি। এরপর অধ্যাপক আনোয়ার নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে মহামান্য চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তার অবস্থান শক্ত হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা তখন কৌশল পাল্টান। নানা ইস্যু তুলে তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন, যাতে বিরক্ত হয়ে ভিসি মহোদয় পদত্যাগ করেন। কিন্তু এ মুক্তিযোদ্ধা ভিসির মনোবল শক্ত থাকায় তিনি অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন, কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। আন্দোলনকারীরা ১২ থেকে ১৮ দফা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ভিসিকে পদত্যাগ করানোর মতো একটিও উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে নানা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়। শেষ পর্যন্ত বলপ্রয়োগের চেষ্টাও করেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। নিজেদের লাভক্ষতির আন্দোলনে জিম্মি করে ফেলেন শিক্ষার্থীদেরও। ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে সেশনজটের মুখে ফেলে দেন। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিপন্ন করে তোলেন শিক্ষক নামধারী কিছুসংখ্যক রাজনীতি করা শিক্ষক। একপর্যায় অত্যন্ত অমার্জিতভাবে ভিসি মহোদয়কে প্রায় চারদিন অবরুদ্ধ করে রাখেন তার অফিস কক্ষে। এ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও একজন ছাত্র শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য হাইকোর্টে রিট করেন। মহামান্য আদালত রায় দেন রিটকারীদের পক্ষে। সব ধরনের অবরোধ অবস্থা তুলে দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নির্বিঘœ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশ কার্যকর করার জন্য আদেশ দেয়া হয় পুলিশের আইজিপি, শিক্ষা সচিব, সাভার অঞ্চলের পুলিশ প্রশাসন, ভিসি মহোদয় প্রমুখের ওপর। এবার দেশবাসী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। অবরুদ্ধ অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন মুক্ত হন। ভিসি মহোদয় সরকারের কাছে দাবি জানান সবকিছু তদন্ত করে দেখার। তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে তার জন্য সব শাস্তি মেনে নেয়ার অঙ্গীকারও করেন। এমন উদাহরণ এদেশে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কি-না আমার জানা নেই।
বিস্ময়কর হচ্ছে, আদালতের আদেশের একটি বায়বীয় কার্যকারিতা কয়েকদিন কার্যকর থাকে। তারপর আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ভর করে। তারা আদালতকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। তারা অবরুদ্ধ করেন প্রশাসন ভবন। ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেন। আটকে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন কার্যক্রম। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, আদালত অবমাননাকে যেন উৎসাহ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাও। ভিসি বারবার তাগাদা দেয়ার পরও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে না। দু-একটি সংবাদপত্রের রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়, তদন্তে নাকি ভিসিকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো উপাদান নেই। আন্দোলনকারীদের রক্ষার জন্য এ নীরবতা! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক শিক্ষক বন্ধুর অনুমান, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের কারও সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাশীল কারও সখ্য আছে। তাই পাথর চাপা দেয়া হয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট। পত্রিকা সূত্রে জানতে পারি, এর মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটি ভিসি এবং আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতাদের ডেকেছিলেন মিটমাট করার জন্য। কিন্তু এতে গৃহীত সিদ্ধান্তে আন্দোলনকারীরাই লাভবান হয়েছেন। অনেকটা জোর খাটিয়েই অনেক অন্যায় আবদার মেনে নিতে অনুরোধ করা হয়েছে ভিসিকে। আন্দোলনকারীদের কাছেও অনুরোধ রাখা হয়েছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। শোনা যায়, সরকার তার শেষ অবস্থায় বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে বলে নতুন ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চাইছে না। ফলে একজন নির্বাচিত ভিসিকেই অন্যায় অনুরোধ মেনে নিতে হচ্ছে। তাই নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে ছাড় দিয়ে ভিসি ঘোষণা দিয়েছেন, সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ভিসির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে তিনি অচিরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবেন। তবে আমাদের মনে হয়, এমন প্রক্রিয়ায় গিয়ে সংসদীয় কমিটি ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ায় না থেকে একটি বাজে উদাহরণ তৈরি করল। এর নেতিবাচক ব্যবহার শুরু হবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জানা যায়, ভিসি তার কথা রক্ষা করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। তবে কথা রাখেননি আন্দোলনকারীরা। তারা ভিসিকে সময় দিতে চান না। বলপূর্বক পদত্যাগ করিয়েই ছাড়বেন। শিক্ষক রাজনীতির আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক গ্র“পের এক দারুণ মিলনের রসায়নে চাপ বৃদ্ধি চলছে ক্রমাগত। আমাদের ধারণা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি বিশেষ ব্যতিক্রম। সেখানে দুটি শিক্ষক গ্র“প ছাড়া আন্দোলনে অন্য কেউ নেই। কোনো ধারার ছাত্ররা এ আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত করেনি, বরঞ্চ শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য মিছিল করেছে। ব্যানার টানিয়েছে। লিফলেট বিতরণ করেছে। শিক্ষক মঞ্চ নামে বাকি শিক্ষকরা এ অযৌক্তিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবুও আন্দোলনকারীরা নির্দ্বিধায় শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার মতো অনাচার করে যাচ্ছেন। আর তা সম্ভব হচ্ছে সম্ভবত অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের একাকীত্বে। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি দলীয় শিক্ষক রাজনীতির বলয় তৈরি করতে চাননি। সেই অর্থে তার কোনো শিক্ষক গ্র“প নেই। যারা এ আন্দোলন সমর্থন করছেন না, তারা নৈতিকভাবে নিজেদের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, কিন্তু যৌক্তিক কারণে ভিসিকে রক্ষায় সংঘবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন না। সম্ভবত এ সুযোগটিই গ্রহণ করছেন আন্দোলনকারীরা।
এরই মধ্যে আদালতের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবার সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছেন আন্দোলনকারীরা। ক্লাস, পরীক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম সবকিছু অচল করে দেয়া হয়েছে। ভিসির ওপর চূড়ান্ত চাপ প্রয়োগের জন্য গভীর রাতে তার বাসভবনে ঢুকে ঘুমন্ত ভিসিকে ডেকে নামানো হয়েছে। নানাভাবে অসদাচরণ করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। ভিসিকে এবার নিজ বাসভবনে পরিবার-পরিজনসহ অবরুদ্ধ করে সেখানেই অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষাগুরুরা।
এসব দেখেশুনে ও পত্রিকায় পড়ে আমরা ভীষণভাবে হতাশ ও আতংকিত। অভিভাবক হিসেবে আমরা ঘোর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। এমন অনাচারের দায় আমরা শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষকদেরই দিতে চাই না, এ দায় নিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব অংশকেই। প্রশ্ন থাকে, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করে কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংকট ঘোলাটে করায় ভূমিকা রাখছে না? সংসদীয় কমিটির অসম ফয়সালাও শেষ পর্যন্ত মান্য না করে যে অপরাধ করলেন আন্দোলনকারীরা, তার জন্য কোনো প্রতিক্রিয়া কি দেখিয়েছে সংসদীয় কমিটি? আর আদালতের রায় অব্যাহতভাবে অমান্য করে যাওয়ার পর রায় কার্যকর করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক কোনো ভূমিকা না রাখায় তারা কি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন না?
আমি আমার শিক্ষক বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম, রায় থাকার পরও আন্দোলনকারীরা আদালত অবমাননা করে যাচ্ছেন কীভাবে? তিনি বললেন, এসব রায়ে শিক্ষকরা ভীত নন। তাদের বিশ্বাস, শেষ সময়ে এসবে মনোযোগ দেবে না সরকারপক্ষ। আর শিক্ষকদের ঘাঁটাতে আদালতের রায় কার্যকর করতেও এগিয়ে আসবে না সংশ্লিষ্ট পক্ষ। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে আইনের শাসনের প্রতি কারও আস্থা থাকবে কি? আর এভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর যদি জোড়াতালি দিয়ে সংকট এড়াতে চায়, তবে তা ভয়ংকরভাবে চেপে বসবে ঘাড়ে। এরপর স্বাভাবিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। নষ্ট রাজনীতির কাছে এমন আত্মসমর্পণ শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশকে স্থায়ী সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে, যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা মনে করি, মহামান্য আদালতের নিজ দায়িত্বে বিষয়টি নজরে আনা প্রয়োজন। কারণ আদালতের রায় এভাবে অকার্যকর হতে থাকলে আদালতের মর্যাদা প্রশ্নের মুখে পড়বে।
ফরিদ আহমদ রবি : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা
No comments