নির্বাচন যদি হয় এবং না হয়- by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সাউথ
লন্ডনে এক বন্ধুপুত্রের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ভোজে গিয়েছিলাম। আমন্ত্রিতদের
মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশী এবং অনেকে আমার পরিচিত। তারা শিক্ষিত, পেশাজীবী
এবং দীর্ঘকাল বিলাতে বসবাসের ফলে নাসিকা একটু উচ্চ। দেশে এবং বিদেশেও
বাঙালিরা কোথাও একত্রিত হলে যা হয়; সব আলাপের শেষ আলাপ রাজনীতি এবং তা নিয়ে
জোর বিতর্ক। সেদিনও এর অন্যথা হল না। ভোজ শেষে আলাপ শুরু হল। বর্তমানে
বিবাহ পদ্ধতির ব্যর্থতা, ডিভোর্সের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে খুচরা
আলাপের পরই তা চলে গেল বাংলাদেশে নির্বাচন হবে কি হবে না সেই প্রসঙ্গে।
একদল বললেন, নির্বাচন হতেই পারে না। দুটি বড় দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
প্রশ্নে বিপরীতমুখী গোঁ ধরে বসে আছে। এ গোঁ তারা ছাড়বে না এবং নির্বাচনও
হবে না। শেষ পর্যন্ত আর্মিকে এগিয়ে আসতে হবে এবং হয় তারা সাময়িকভাবে ক্ষমতা
নেবে অথবা তাদের সমর্থিত কোনো সিভিল সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা আবার কয়েক
বছর পর একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এ ব্যাপারে পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর,
এমনকি ভারত ও আমেরিকারও সম্মতি ও সমর্থন থাকবে। আরেকদল বললেন, না, নির্বাচন
হবেই। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী এবং আওয়ামী লীগ সরকারও এখন মুখে
যাই বলুক, বিরোধী দলকে কোনো এক ধরনের ছাড় দিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে
টানবে। এ নির্বাচনে বিএনপির জয় হবে। বেগম জিয়া এবার জামায়াতকে ঘোষিত বা
অঘোষিতভাবে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে ২০০১ সালের মতো চণ্ডমূর্তি ধারণ করবেন
না। গতবারের ভুল থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছেন। তাই বারবার বলছেন, তিনি
প্রতিহিংসার রাজনীতিতে যাবেন না। তিনি এবার একটি মডারেট সরকার গঠন করবেন।
আওয়ামী লীগকে আবার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য বিরোধী দলের অবস্থানে চলে যেতে
হবে। সংসদেও তাদের সদস্য সংখ্যা জোর বড় একটা থাকবে না
এই বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ভোজে সংখ্যাল্প হলেও একটি তৃতীয় গ্র“প ছিল। তারা বললেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তাদের ধারণা, এবার নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপি জয়ী হবে। কিন্তু বিএনপির এ জয় হবে নামে; কাজে জামায়াত ভোল পাল্টে (স্বনামে আসত না পারলে) ক্ষমতায় আসবে। খালেদা জিয়া নামে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার ছেলে তারেক রহমানও দেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন। কিন্তু এবার আসল ক্ষমতা যাবে জামায়াতের হাতে। ওই সরকারের আসল চালিকাশক্তি হবে জামায়াত ও হেফাজত।
তারা ক্ষমতায় গিয়েই ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড বাতিল করবে। প্রশাসন থেকে ‘আওয়ামী লীগের ছাপমারা লোক’ এই ধুয়া তুলে অসাম্প্রদায়িক সব লোকের বিতাড়ন ও নিধন শুরু হবে। দেশের আধুনিক সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আঘাত আসবে। মুক্তমনা মুদ্ধিজীবী, এমনকি হাফ মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদেরও দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। আফগানিস্তানের মতো নারী শিক্ষাবর্জিত হবে। নারীরা অবরোধবাসিনী হবে। পুরোপুরি তালেবান রাষ্ট্র না হলেও বাংলাদেশ হাফ তালেবান রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে। শেখ হাসিনা এবং দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ছোট বড় বহু নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ অথবা দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে। দেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এক বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে। দেশে গুপ্ত রাজনৈতিক হত্যার সূচনা হবে। নতুন চেহারায় বাংলা ভাইদের আবির্ভাব হবে।
আবার তৃতীয় গ্র“পের একজনের এই বিশ্লেষণটি শেষ না হতেই একজন তাকে বললেন, আপনার আশংকার কথাটি যুক্তির খাতিরে মেনে নিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের ভোটদাতাদের একটা বড় অংশ না হয় ভুল করে বিএনপিকে ভোট দিতে গিয়ে জামায়াতকে ক্ষমতা দখলের সুযোগ দিল। জামায়াতও ক্ষমতায় গিয়ে মিসরের পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির মতো সামরিক-অসামরিক প্রশাসন জামায়াতিকরণ শুরু করল এবং সেকুলার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি ভাঙার কাজে নিয়োজিত হল। তা কি বাংলাদেশের সাহায্যদাতা বৃহৎ শক্তিগুলো, বিশেষ করে ভারত ও আমেরিকা মেনে নেবে?
তার প্রশ্নের জবাব কেউ দেয়নি। তিনি নিজেই তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে বললেন, মেনে নেবে না। ভারত এবং আমেরিকা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রকৃত মিত্র না হতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিসরের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গি এবং মধ্যযুগীয় মৌলবাদের উল্লাসের আশংকায় তারা ভীত। মিসরের মুরসি প্রশাসন যেমন আমেরিকা বেশিদিন বরদাস্ত করেনি, সেনাবাহিনীকে দিয়ে তার পতন ঘটিয়েছে এবং জঙ্গি মৌলবাদীদের ক্ষমতা থেকে হটানোর কাজে মিসরের বহুধাবিভক্ত সেকুলার, গণতান্ত্রিক দল ও সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে, তেমন ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে।
আজ আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকাসহ বড় প্রভাবশালী দেশগুলো বিরক্ত হতে পারে। দেশের সুশীলসমাজের মাথাওয়ালা একটি অংশ এ সরকারকে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে উদগ্রীব হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যদি ঘটে এবং দেখা যায় বিএনপির আলখেল্লার আড়ালে মধ্যযুগীয় উগ্র মৌলবাদ ক্ষমতা দখল করেছে, তখন প্রতিবেশী ভারত তার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্ক হবে এবং আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর টনক নড়বে। ভদ্রলোক বললেন, আমার মনে হয়, তখন দেশের ভেতরের এবং বাইরের কোনো কোনো শক্তির সমর্থন ও উৎসাহেই সামরিক বাহিনীকে একটা উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির একটি আশা, ক্যান্টনমেন্ট সব সময় তাদের অনুকূলে থাকবে। এক/এগারোর সময় তাদের এই আশা পূর্ণ হয়নি, বর্তমানেও হবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে এখন পাকিস্তানপন্থী ও জামায়াতপন্থীদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। নতুন জেনারেশনের আবির্ভাব হয়েছে; তারা আধুনিকমনা, শিক্ষিত এবং এনলাইটেন্ড। সেনাবাহিনীতে পেশাদারিত্ব বহুগুণ বেড়েছে। জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে দলে দলে কাজ করে তাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেছে।
এই সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিএনপি বা জামায়াতের পক্ষপাত আশা করা হবে বোকার স্বর্গে বাস করা। বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদীদের ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র সফল হলে এবং সেনাবাহিনী তা ঠেকাতে চাইলে দেশে সেনাশাসন সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো যতই অনিচ্ছুক হোক, মিসরের মতো সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সমর্থন দিতে বাধ্য হবে। বর্তমানে তাদের মধ্যে রয়েছে অনৈক্য এবং আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই তাদের কাছে অনেক বড়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তখন দেশের বাস্তব পরিস্থিতি তারা সম্যক উপলব্ধি করবেন এবং মৌলবাদের দশানন রাবণকে হটানোর জন্য তখন যে কোনো শক্তি এগিয়ে আসুক তাকে সমর্থন দিতে বাধ্য হবেন। মৌলবাদী গোষ্ঠী এখন এতই শক্তিশালী, বিভক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ কেবল একার শক্তিতে তাকে হটাতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশেও মিসরের মতো অবস্থার উদ্ভব ঘটতে পারে।
আসরের আরেকজন বলে উঠলেন (তিনি কোন গ্র“পের তা লক্ষ্য করিনি), বাংলাদেশে যদি মিসরের মতো অবস্থার উদ্ভব হয়, তাহলে এ দেশেও আর্মি সরাসরি ক্ষমতা নেবে না, একজন পশ্চিমা অনুগত সিভিলিয়ানকেই সরকার প্রধানের পদে বসাবে। এখানেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জেনারেল এরশাদ প্রমুখদের আশা এবং প্রতীক্ষা। নিজেদের শক্তির জোরে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবেন না জেনে তারা এখন রাজনৈতিক স্টেজের পর্দার পাশে অবস্থান নিয়েছেন। যদি কেউ তাদের হাত ধরে স্টেজে টেনে নিয়ে সিংহাসনে বসায়। এ জন্য ড. ইউনূস ও ড. কামাল হোসেন আবার নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতায় নেমেছেন এবং জেনারেল এরশাদ তো বলেই ফেলেছেন তিনি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হতে চান।
এ আসরে আমার পরিচিত বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সাবেক কূটনীতিক হাজির ছিলেন। তিনি অনেকেরই পরিচিত এবং আলোচনার এক সময় অনেকে তার দিকে তাকালেন তার মতামত জানার জন্য। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে আজ আমার এক সাংবাদিক বন্ধু হাজির আছেন। আমি এ আসরে কিছু বললে তিনি হয় তো তার লেখায় তা প্রকাশ করবেন। তিনি আমার বক্তব্য প্রকাশ করুন আপত্তি নেই; কিন্তু আমার নামটা যেন প্রকাশ না করেন। আমি রিটায়ার্ড মানুষ। দেশের রাজনীতির কোনো বিতর্কে জড়াতে চাই না। তাছাড়া আমি যা বলব, তা যে ধ্র“ব সত্য হবে তারও নিশ্চয়তা দিতে পারি না। প্রবীণ কূটনীতিককে আশ্বাস দিলাম। আপনার অভিমত ইন্টারেস্টিং হলে তা নিয়ে আমার লেখায় আলোচনা করতে পারি। কিন্তু আপনার নাম প্রকাশ করব না; তবে আপনাকে আমি বহুকাল ধরে চিনি এবং আপনার মতামতকে গুরুত্ব দেই।
প্রবীণ সাবেক কূটনীতিক বললেন, আমি আজকাল শহরে বেশি থাকি না। গ্রামের বাড়িতেই বেশি সময় থাকি এবং কৃষিকাজ করে অবসর সময় কাটাই। ফলে সাধারণ মানুষের মনোভাব অনেকটা বুঝতে পারি। ৫ মে রাতে ঢাকার শাপলা চত্বরে হাজার হাজার হেফাজতি হত্যা সম্পর্কে বিএনপি ও জামায়াত সারাদেশে একটা মিথ্যার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে দেশের অধিকাংশ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ঠিক এ সময় পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ঠিক হয়নি। এ নির্বাচনের ফল দ্বারা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে এটাও ভাবা ঠিক হবে না।
বর্তমানে ৫ মের তথাকথিত হত্যাকাণ্ডের মিথ্যা প্রচারের কুয়াশা কেটে গেছে। শেখ হাসিনা যদি কঠোরভাবে তার দলে ও সংগঠনে পার্জিং চালান এবং সংগঠনকে পুনর্গঠন দ্বারা তুলনামূলকভাবে সৎ ও যোগ্য লোক নির্বাচনে মনোনয়ন দেন, সরকারের ভালো কাজগুলো ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে পারেন, তাহলে বড় ভয়ের কোনো কারণ নেই। নির্বাচনে বিএনপিকে টানার জন্য নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে তাকে কিছুটা ছাড় দিতেই হবে। নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশে মিসরের অবস্থার উদ্ভবের কোনো আশংকা নেই। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচনে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো জামায়াতের একক ও বিরাট বিজয়ের সম্ভাবনা নেই। তিনি বললেন, তবে আমি যে আশংকাটা করি, তা হল, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক বিজয়ের সম্ভাবনাও কম। হাং পার্লামেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের জন্য স্বতন্ত্র ও ছোট ছোট দলের সদস্যদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে বেশি। জেনারেল এরশাদ দোদিল বান্দা। এবার নির্বাচনে তার দল কতটা সাফল্য অর্জন করবে, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। এ জন্যই শেখ হাসিনার উচিত মহাজোটকে শক্তিশালী করা এবং মহাজোটের শরিক দলগুলোকে গুরুত্ব ও শক্তি অর্জনে সাহায্য করা।
দেশের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোর ওপর থেকে জামায়াত ও হেফাজতের অশুভ প্রভাব দূর করার জন্য আওয়ামী লীগের উচিত মৌলবাদী ও জঙ্গি নয় এমন ইসলামী দলগুলোর সাহায্য নেওয়া। এ জন্য আটরশির পীর, ইসলামী ঐক্যজোটের জামায়াতবিরোধী অংশ এবং এ ধরনের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে আওয়ামী লীগের কাছে টানা উচিত। শেখ হাসিনার উচিত দলের নিষ্ক্রিয় অংশ ও নেতাদের সক্রিয় করা এবং পেশাজীবী সব মানুষ এবং তাদের সংগঠনকে গুরুত্ব দেয়া। সাবেক কূটনীতিক বললেন, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য এটা খুবই সংকট মুহূর্ত। তবে আমি আশাবাদী। আমার ধারণা, বাংলাদেশ এ সংকট কাটিয়ে উঠবে। আগামী নির্বাচন হবে না, বাংলাদেশের অবস্থা হবে মিসরের মতো, এসব আশংকা তো আছেই। কিন্তু এ আশংকার পাশাপাশি রয়েছে নির্বাচন হওয়া এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই সব সংকট উত্তরণের এবং গণতন্ত্রের বিপদমুক্ত হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা। আমরা এখন মনের বাঘের ভয়েই অস্থির। তবে সত্যি বাঘ আছে কিনা তা খুঁজে দেখছি না। সেদিনের বিবাহোত্তর ভোজ সভায় কথা বলার সুযোগ আমার হয়নি। মনে হয় কথা না বলে ভালোই করেছি। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেকেই আসরে মন খুলে কথা বলেছেন। তা শুনে নিজের মনের ভয় অনেকটা দূর হয়েছে। এ বিশ্বাস ফিরে এসেছে যে, বাংলাদেশের এ সংকটমুক্তি ঘটবেই।
এই বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ভোজে সংখ্যাল্প হলেও একটি তৃতীয় গ্র“প ছিল। তারা বললেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তাদের ধারণা, এবার নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপি জয়ী হবে। কিন্তু বিএনপির এ জয় হবে নামে; কাজে জামায়াত ভোল পাল্টে (স্বনামে আসত না পারলে) ক্ষমতায় আসবে। খালেদা জিয়া নামে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার ছেলে তারেক রহমানও দেশে ফিরে দলের হাল ধরবেন। কিন্তু এবার আসল ক্ষমতা যাবে জামায়াতের হাতে। ওই সরকারের আসল চালিকাশক্তি হবে জামায়াত ও হেফাজত।
তারা ক্ষমতায় গিয়েই ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড বাতিল করবে। প্রশাসন থেকে ‘আওয়ামী লীগের ছাপমারা লোক’ এই ধুয়া তুলে অসাম্প্রদায়িক সব লোকের বিতাড়ন ও নিধন শুরু হবে। দেশের আধুনিক সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আঘাত আসবে। মুক্তমনা মুদ্ধিজীবী, এমনকি হাফ মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদেরও দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। আফগানিস্তানের মতো নারী শিক্ষাবর্জিত হবে। নারীরা অবরোধবাসিনী হবে। পুরোপুরি তালেবান রাষ্ট্র না হলেও বাংলাদেশ হাফ তালেবান রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে। শেখ হাসিনা এবং দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ছোট বড় বহু নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ অথবা দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে। দেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এক বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে। দেশে গুপ্ত রাজনৈতিক হত্যার সূচনা হবে। নতুন চেহারায় বাংলা ভাইদের আবির্ভাব হবে।
আবার তৃতীয় গ্র“পের একজনের এই বিশ্লেষণটি শেষ না হতেই একজন তাকে বললেন, আপনার আশংকার কথাটি যুক্তির খাতিরে মেনে নিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের ভোটদাতাদের একটা বড় অংশ না হয় ভুল করে বিএনপিকে ভোট দিতে গিয়ে জামায়াতকে ক্ষমতা দখলের সুযোগ দিল। জামায়াতও ক্ষমতায় গিয়ে মিসরের পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির মতো সামরিক-অসামরিক প্রশাসন জামায়াতিকরণ শুরু করল এবং সেকুলার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি ভাঙার কাজে নিয়োজিত হল। তা কি বাংলাদেশের সাহায্যদাতা বৃহৎ শক্তিগুলো, বিশেষ করে ভারত ও আমেরিকা মেনে নেবে?
তার প্রশ্নের জবাব কেউ দেয়নি। তিনি নিজেই তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে বললেন, মেনে নেবে না। ভারত এবং আমেরিকা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রকৃত মিত্র না হতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিসরের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গি এবং মধ্যযুগীয় মৌলবাদের উল্লাসের আশংকায় তারা ভীত। মিসরের মুরসি প্রশাসন যেমন আমেরিকা বেশিদিন বরদাস্ত করেনি, সেনাবাহিনীকে দিয়ে তার পতন ঘটিয়েছে এবং জঙ্গি মৌলবাদীদের ক্ষমতা থেকে হটানোর কাজে মিসরের বহুধাবিভক্ত সেকুলার, গণতান্ত্রিক দল ও সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছে, তেমন ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে।
আজ আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকাসহ বড় প্রভাবশালী দেশগুলো বিরক্ত হতে পারে। দেশের সুশীলসমাজের মাথাওয়ালা একটি অংশ এ সরকারকে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে উদগ্রীব হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যদি ঘটে এবং দেখা যায় বিএনপির আলখেল্লার আড়ালে মধ্যযুগীয় উগ্র মৌলবাদ ক্ষমতা দখল করেছে, তখন প্রতিবেশী ভারত তার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্ক হবে এবং আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর টনক নড়বে। ভদ্রলোক বললেন, আমার মনে হয়, তখন দেশের ভেতরের এবং বাইরের কোনো কোনো শক্তির সমর্থন ও উৎসাহেই সামরিক বাহিনীকে একটা উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির একটি আশা, ক্যান্টনমেন্ট সব সময় তাদের অনুকূলে থাকবে। এক/এগারোর সময় তাদের এই আশা পূর্ণ হয়নি, বর্তমানেও হবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে এখন পাকিস্তানপন্থী ও জামায়াতপন্থীদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। নতুন জেনারেশনের আবির্ভাব হয়েছে; তারা আধুনিকমনা, শিক্ষিত এবং এনলাইটেন্ড। সেনাবাহিনীতে পেশাদারিত্ব বহুগুণ বেড়েছে। জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে দলে দলে কাজ করে তাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেছে।
এই সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিএনপি বা জামায়াতের পক্ষপাত আশা করা হবে বোকার স্বর্গে বাস করা। বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদীদের ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র সফল হলে এবং সেনাবাহিনী তা ঠেকাতে চাইলে দেশে সেনাশাসন সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো যতই অনিচ্ছুক হোক, মিসরের মতো সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সমর্থন দিতে বাধ্য হবে। বর্তমানে তাদের মধ্যে রয়েছে অনৈক্য এবং আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই তাদের কাছে অনেক বড়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তখন দেশের বাস্তব পরিস্থিতি তারা সম্যক উপলব্ধি করবেন এবং মৌলবাদের দশানন রাবণকে হটানোর জন্য তখন যে কোনো শক্তি এগিয়ে আসুক তাকে সমর্থন দিতে বাধ্য হবেন। মৌলবাদী গোষ্ঠী এখন এতই শক্তিশালী, বিভক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ কেবল একার শক্তিতে তাকে হটাতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশেও মিসরের মতো অবস্থার উদ্ভব ঘটতে পারে।
আসরের আরেকজন বলে উঠলেন (তিনি কোন গ্র“পের তা লক্ষ্য করিনি), বাংলাদেশে যদি মিসরের মতো অবস্থার উদ্ভব হয়, তাহলে এ দেশেও আর্মি সরাসরি ক্ষমতা নেবে না, একজন পশ্চিমা অনুগত সিভিলিয়ানকেই সরকার প্রধানের পদে বসাবে। এখানেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জেনারেল এরশাদ প্রমুখদের আশা এবং প্রতীক্ষা। নিজেদের শক্তির জোরে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবেন না জেনে তারা এখন রাজনৈতিক স্টেজের পর্দার পাশে অবস্থান নিয়েছেন। যদি কেউ তাদের হাত ধরে স্টেজে টেনে নিয়ে সিংহাসনে বসায়। এ জন্য ড. ইউনূস ও ড. কামাল হোসেন আবার নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতায় নেমেছেন এবং জেনারেল এরশাদ তো বলেই ফেলেছেন তিনি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হতে চান।
এ আসরে আমার পরিচিত বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সাবেক কূটনীতিক হাজির ছিলেন। তিনি অনেকেরই পরিচিত এবং আলোচনার এক সময় অনেকে তার দিকে তাকালেন তার মতামত জানার জন্য। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে আজ আমার এক সাংবাদিক বন্ধু হাজির আছেন। আমি এ আসরে কিছু বললে তিনি হয় তো তার লেখায় তা প্রকাশ করবেন। তিনি আমার বক্তব্য প্রকাশ করুন আপত্তি নেই; কিন্তু আমার নামটা যেন প্রকাশ না করেন। আমি রিটায়ার্ড মানুষ। দেশের রাজনীতির কোনো বিতর্কে জড়াতে চাই না। তাছাড়া আমি যা বলব, তা যে ধ্র“ব সত্য হবে তারও নিশ্চয়তা দিতে পারি না। প্রবীণ কূটনীতিককে আশ্বাস দিলাম। আপনার অভিমত ইন্টারেস্টিং হলে তা নিয়ে আমার লেখায় আলোচনা করতে পারি। কিন্তু আপনার নাম প্রকাশ করব না; তবে আপনাকে আমি বহুকাল ধরে চিনি এবং আপনার মতামতকে গুরুত্ব দেই।
প্রবীণ সাবেক কূটনীতিক বললেন, আমি আজকাল শহরে বেশি থাকি না। গ্রামের বাড়িতেই বেশি সময় থাকি এবং কৃষিকাজ করে অবসর সময় কাটাই। ফলে সাধারণ মানুষের মনোভাব অনেকটা বুঝতে পারি। ৫ মে রাতে ঢাকার শাপলা চত্বরে হাজার হাজার হেফাজতি হত্যা সম্পর্কে বিএনপি ও জামায়াত সারাদেশে একটা মিথ্যার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে দেশের অধিকাংশ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ঠিক এ সময় পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ঠিক হয়নি। এ নির্বাচনের ফল দ্বারা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে এটাও ভাবা ঠিক হবে না।
বর্তমানে ৫ মের তথাকথিত হত্যাকাণ্ডের মিথ্যা প্রচারের কুয়াশা কেটে গেছে। শেখ হাসিনা যদি কঠোরভাবে তার দলে ও সংগঠনে পার্জিং চালান এবং সংগঠনকে পুনর্গঠন দ্বারা তুলনামূলকভাবে সৎ ও যোগ্য লোক নির্বাচনে মনোনয়ন দেন, সরকারের ভালো কাজগুলো ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে পারেন, তাহলে বড় ভয়ের কোনো কারণ নেই। নির্বাচনে বিএনপিকে টানার জন্য নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে তাকে কিছুটা ছাড় দিতেই হবে। নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশে মিসরের অবস্থার উদ্ভবের কোনো আশংকা নেই। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচনে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো জামায়াতের একক ও বিরাট বিজয়ের সম্ভাবনা নেই। তিনি বললেন, তবে আমি যে আশংকাটা করি, তা হল, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক বিজয়ের সম্ভাবনাও কম। হাং পার্লামেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের জন্য স্বতন্ত্র ও ছোট ছোট দলের সদস্যদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে বেশি। জেনারেল এরশাদ দোদিল বান্দা। এবার নির্বাচনে তার দল কতটা সাফল্য অর্জন করবে, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। এ জন্যই শেখ হাসিনার উচিত মহাজোটকে শক্তিশালী করা এবং মহাজোটের শরিক দলগুলোকে গুরুত্ব ও শক্তি অর্জনে সাহায্য করা।
দেশের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোর ওপর থেকে জামায়াত ও হেফাজতের অশুভ প্রভাব দূর করার জন্য আওয়ামী লীগের উচিত মৌলবাদী ও জঙ্গি নয় এমন ইসলামী দলগুলোর সাহায্য নেওয়া। এ জন্য আটরশির পীর, ইসলামী ঐক্যজোটের জামায়াতবিরোধী অংশ এবং এ ধরনের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে আওয়ামী লীগের কাছে টানা উচিত। শেখ হাসিনার উচিত দলের নিষ্ক্রিয় অংশ ও নেতাদের সক্রিয় করা এবং পেশাজীবী সব মানুষ এবং তাদের সংগঠনকে গুরুত্ব দেয়া। সাবেক কূটনীতিক বললেন, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য এটা খুবই সংকট মুহূর্ত। তবে আমি আশাবাদী। আমার ধারণা, বাংলাদেশ এ সংকট কাটিয়ে উঠবে। আগামী নির্বাচন হবে না, বাংলাদেশের অবস্থা হবে মিসরের মতো, এসব আশংকা তো আছেই। কিন্তু এ আশংকার পাশাপাশি রয়েছে নির্বাচন হওয়া এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই সব সংকট উত্তরণের এবং গণতন্ত্রের বিপদমুক্ত হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা। আমরা এখন মনের বাঘের ভয়েই অস্থির। তবে সত্যি বাঘ আছে কিনা তা খুঁজে দেখছি না। সেদিনের বিবাহোত্তর ভোজ সভায় কথা বলার সুযোগ আমার হয়নি। মনে হয় কথা না বলে ভালোই করেছি। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেকেই আসরে মন খুলে কথা বলেছেন। তা শুনে নিজের মনের ভয় অনেকটা দূর হয়েছে। এ বিশ্বাস ফিরে এসেছে যে, বাংলাদেশের এ সংকটমুক্তি ঘটবেই।
No comments