মূল্যবোধ গঠনে যৌথ পরিবারের ভূমিকা by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
উন্নত
মূলবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠনে সংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। সুস্থ সংস্কৃতির
চর্চা ছাড়া মূলবোধসম্পন্ন জাতি আশা করা অবান্তর। কথায় আছে, ‘একটি রাষ্ট্রকে
ধ্বংস করতে চাইলে আগে তার সংস্কৃতিকে ধ্বংস কর।’ বাংলাদেশের অবস্থা সেরকমই
হয়েছে। মাদক আর অপসংস্কৃতির ছোবলে আমাদের হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল
সংস্কৃতি আজ ধ্বংস হতে বসেছে। যার জন্য স্বাধীনতার ৪২ বছর অতিবাহিত হওয়ার
পরও আমরা উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠন করতে সমর্থ হয়নি। উপরন্তু
কোন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিতে আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তা আমরা নিজেরাই
জানি না। তবে এটুকু জানি, একটা হ-য-ব-র-ল জাতি হিসেবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি
অন্ধকার গহ্বরের দিকে। অথচ স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে
হলে আগে প্রয়োজন উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠন আর এর জন্য দরকার সৎ,
দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শক্তিশালী সামাজিক নেতৃত্ব। কেননা সংস্কৃতির
সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ওতপ্রোত, রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতি
চর্চা আশা করা যায় না। বিদেশী অপসংস্কৃতি, হেরোইন, ফেনসিডিল ও ইয়াবা জায়গা
করে নিয়েছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে। তৈরি করছে ঐশীর মতো মূল্যবোধহীন
হাজারও সন্তান। তারা না চেনে নিজের দেশকে, না চেনে ধর্মকে, না চেনে নিজের
ভাষা ও সংস্কৃতিকে; সর্বোপরি না চেনে নিজের বাবা-মাকে। এ সন্তানদের হাতে
নৃশংসভাবে জীবন দিতে হয়েছে বাবা-মাকে। আবার বাবা-মায়ের হাতেও জীবন দিতে
হচ্ছে সন্তানকে। আপন মমতাময়ী মাও আদরের সন্তানকে হত্যা করছেন নির্দয়,
নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে। অপরূপা রূপসীরাও তাদের ভালোবাসার স্বামীদের হাতে
প্রাণ দিচ্ছেন। এমনকি শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ নয় শিক্ষার্থী। মানুষ গড়ার
কারিগর শিক্ষকরা লালসা চরিতার্থ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন শিশু ছাত্রীর ওপর। নেশা
ও অপসংস্কৃতির জালে জড়িয়ে এমনই মূল্যবোধহীন একটি জাতি নিয়ে বাংলাদেশ সামনে
এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে; বাংলাদেশকে ডিজিটাল ও মধ্যআয়ের দেশ করার
স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রাজনীতিকরা। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে, যদি
মূল্যবোধসম্পন্ন একটি জাতি গঠন করা না যায়। যদি না অপসংস্কৃতির বেড়াজাল
থেকে জাতিকে বের করে আনা না যায়। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের নৈতিক অধঃপতন
যখন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছে, তখন বোঝার আর বাকি থাকে না জাতি হিসেবে আমরা
কোথায় দাঁড়িয়ে। একজন শিক্ষকের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ আর কে গ্রহণ করে? জাতি
গঠনের লক্ষ্যে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে গড়ে তুলতে যে অপরিসীম জীবনীশক্তি
লাগে, তা তো কেবল একজন শিক্ষকেরই থাকে। সে শিক্ষক কীভাবে পারেন ছাত্রীকে
ধর্ষণ করতে? কীভাবে ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন?
দেশে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার এবং বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে গাঁজা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ অন্যান্য নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতাও। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি পরিবারে জীবনসঙ্গীর মতো জায়গা করে নিয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত মেগা সিরিয়াল। খাওয়া-নাওয়া ও সংসারের কাজকর্ম ফেলে রেখে গৃহবধূ ও তরুণীরা ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব ডেইলি সিরিয়ালে এমন সব পারিবারিক কল্প-কাহিনী থাকে, যা সহজেই প্রভাবিত করে মেয়েদের। তাদের মনমননে ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পায় অযাচিত চাহিদা ও চাওয়া-পাওয়ার আকাক্সক্ষা। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত এসব সিরিয়াল নিঃসন্দেহে ধ্বংস করছে বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোকে, ধ্বংস করছে আমাদের হাজারও বছরের ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবান্বিত সংস্কৃতিকে; ধ্বংস করছে পরোক্ষভাবে আমাদের রাষ্ট্রকেও।
ভালো মানুষ বা অন্য ভালো যা অর্জন, তা সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই সূচিত হয়। সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা অনেকটা পরিবারের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের প্রথম নিরাপত্তা তার পরিবারে। পরিবার বলতে টুকরো টুকরো পরিবার নয়, যৌথ পরিবার; যৌথ পরিবারে মানুষের মনমনন ও নৈতিকতা-মূল্যবোধ এবং মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। আয়-উন্নতিও যৌথ পরিবারে বেশি হয়। সুতরাং যৌথ পরিবার গড়তে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রকে দিতে হবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা; রাষ্ট্রের সার্বিক শাসন কাঠামোও হতে হবে যৌথ পরিবারমুখী। বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে সমাজে দিন দিন ভয়ঙ্কর সব পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের আইন-শৃংখলা অবনতির ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ট্রাজেডি, বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যাও। পরিবারে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়, বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে। রাষ্ট্রকে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করেই টিকে থাকতে হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভয়ানক হারে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। এই পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের গত এক বছরের ‘ডিভোর্স রেকর্ড’ পর্যালোচনায় পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে এগিয়ে মেয়েরা। শতকরা সত্তর ভাগ তালাক আবেদন জমা পড়েছে মেয়েদের তরফ থেকে। শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের চিত্রও একই। পরিবার ভাঙার ঘটনা ছাড়াও পরিবার একেবারে ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে মেয়েদের তরফ থেকে বেশি, যা সমাজ বিশ্লেষকদের রীতিমতো স্তম্ভিত ও হতবাক করছে। যৌথ পরিবারের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাওয়া এর কারণ বলে সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাজেই পরিবার ভাঙা নিরুৎসাহিত করতে হবে। যৌথ পরিবারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। পরিবার গড়তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে হবে।
এশিয়ায় চীন ও জাপান ঐতিহ্যগতভাবে যৌথ পরিবারের উদাহরণ। যৌথ পরিবার ও পারিবারিক নিরাপত্তাই এ দুটি দেশকে দ্রুত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করেছে। জাপান ও চীনের পরিবারগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির জন্য একটি জাতির যেসব সামাজিক ও মানবীয় গুণাবলী প্রয়োজন তা নির্দ্বিধায় বলা যায় জাপানি ও চীনা পরিবারগুলোর মধ্যে আছে। জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ, আধুনিক প্রযুক্তি ও কর্মনিষ্ঠা, স্বভাব-চরিত্র, অতিথিপরায়ণতা, পরপোকার, আত্মত্যাগ, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ বিশ্বে যে কোনো জাতির জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য। যৌথ পরিবার গড়েই জাপানিরা এমন উন্নত নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অধিকারী হয়েছে।
সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য। শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক ধর্মেই সৎ চরিত্র গঠনের নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্তানদের ছোট থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেয়াও বাধ্যতামূলক করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে ওঠা সন্তানদের অন্তর্নিহিত শক্তি হয় পরিশুদ্ধ। অন্যায়, পাপাচার, কাম-ক্রোধ-মোহ ও যাবতীয় লোভ-লালসা এবং অযাচিত চাওয়া-পাওয়া তাদের মনোবৃত্তিকে দুর্বল করতে পারে না। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, সর্বস্তরে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। সভা, সেমিনার গোলটেবিল বৈঠক, টিভি টকশো, মতবিনিময় সভা ইত্যাদির মাধ্যমে এই সামাজিক আন্দোলনের অপরিহার্যতার বিষয়টি ‘ফোকাসে’ আনতে হবে। এ ছাড়াও আলেম সমাজ, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশের অসংখ্য যুবক শরীরে বেঁচে থাকলেও তারা ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। মরণঘাতী নেশা ও অপসংস্কৃতির ছোবল তাদের জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছে। নেশা ও অপসংস্কৃতির মরণব্যাধি তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। খাচ্ছে তাদের ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, মেধাশক্তি, দৈহিক শক্তি ও মানসিক শক্তিকেও। যে দেশের যুব সমাজের বিরাট একটি অংশের এ পরিণতি, সে দেশের ভবিষ্যৎ কী? সে দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী? হ্যাঁ, উপায় হচ্ছে আত্মজাগরণ ও আত্মশুদ্ধি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দেশে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার এবং বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে গাঁজা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ অন্যান্য নেশাদ্রব্যের সহজলভ্যতাও। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি পরিবারে জীবনসঙ্গীর মতো জায়গা করে নিয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত মেগা সিরিয়াল। খাওয়া-নাওয়া ও সংসারের কাজকর্ম ফেলে রেখে গৃহবধূ ও তরুণীরা ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব ডেইলি সিরিয়ালে এমন সব পারিবারিক কল্প-কাহিনী থাকে, যা সহজেই প্রভাবিত করে মেয়েদের। তাদের মনমননে ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পায় অযাচিত চাহিদা ও চাওয়া-পাওয়ার আকাক্সক্ষা। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত এসব সিরিয়াল নিঃসন্দেহে ধ্বংস করছে বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোকে, ধ্বংস করছে আমাদের হাজারও বছরের ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবান্বিত সংস্কৃতিকে; ধ্বংস করছে পরোক্ষভাবে আমাদের রাষ্ট্রকেও।
ভালো মানুষ বা অন্য ভালো যা অর্জন, তা সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই সূচিত হয়। সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা অনেকটা পরিবারের ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের প্রথম নিরাপত্তা তার পরিবারে। পরিবার বলতে টুকরো টুকরো পরিবার নয়, যৌথ পরিবার; যৌথ পরিবারে মানুষের মনমনন ও নৈতিকতা-মূল্যবোধ এবং মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। আয়-উন্নতিও যৌথ পরিবারে বেশি হয়। সুতরাং যৌথ পরিবার গড়তে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রকে দিতে হবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা; রাষ্ট্রের সার্বিক শাসন কাঠামোও হতে হবে যৌথ পরিবারমুখী। বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে সমাজে দিন দিন ভয়ঙ্কর সব পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের আইন-শৃংখলা অবনতির ক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ট্রাজেডি, বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যাও। পরিবারে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়, বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে। রাষ্ট্রকে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করেই টিকে থাকতে হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভয়ানক হারে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। এই পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের গত এক বছরের ‘ডিভোর্স রেকর্ড’ পর্যালোচনায় পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে এগিয়ে মেয়েরা। শতকরা সত্তর ভাগ তালাক আবেদন জমা পড়েছে মেয়েদের তরফ থেকে। শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের চিত্রও একই। পরিবার ভাঙার ঘটনা ছাড়াও পরিবার একেবারে ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে মেয়েদের তরফ থেকে বেশি, যা সমাজ বিশ্লেষকদের রীতিমতো স্তম্ভিত ও হতবাক করছে। যৌথ পরিবারের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাওয়া এর কারণ বলে সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাজেই পরিবার ভাঙা নিরুৎসাহিত করতে হবে। যৌথ পরিবারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। পরিবার গড়তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে হবে।
এশিয়ায় চীন ও জাপান ঐতিহ্যগতভাবে যৌথ পরিবারের উদাহরণ। যৌথ পরিবার ও পারিবারিক নিরাপত্তাই এ দুটি দেশকে দ্রুত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করেছে। জাপান ও চীনের পরিবারগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির জন্য একটি জাতির যেসব সামাজিক ও মানবীয় গুণাবলী প্রয়োজন তা নির্দ্বিধায় বলা যায় জাপানি ও চীনা পরিবারগুলোর মধ্যে আছে। জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ, আধুনিক প্রযুক্তি ও কর্মনিষ্ঠা, স্বভাব-চরিত্র, অতিথিপরায়ণতা, পরপোকার, আত্মত্যাগ, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ বিশ্বে যে কোনো জাতির জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য। যৌথ পরিবার গড়েই জাপানিরা এমন উন্নত নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অধিকারী হয়েছে।
সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য। শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক ধর্মেই সৎ চরিত্র গঠনের নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্তানদের ছোট থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেয়াও বাধ্যতামূলক করতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে ওঠা সন্তানদের অন্তর্নিহিত শক্তি হয় পরিশুদ্ধ। অন্যায়, পাপাচার, কাম-ক্রোধ-মোহ ও যাবতীয় লোভ-লালসা এবং অযাচিত চাওয়া-পাওয়া তাদের মনোবৃত্তিকে দুর্বল করতে পারে না। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, সর্বস্তরে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। সভা, সেমিনার গোলটেবিল বৈঠক, টিভি টকশো, মতবিনিময় সভা ইত্যাদির মাধ্যমে এই সামাজিক আন্দোলনের অপরিহার্যতার বিষয়টি ‘ফোকাসে’ আনতে হবে। এ ছাড়াও আলেম সমাজ, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামসহ সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশের অসংখ্য যুবক শরীরে বেঁচে থাকলেও তারা ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। মরণঘাতী নেশা ও অপসংস্কৃতির ছোবল তাদের জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছে। নেশা ও অপসংস্কৃতির মরণব্যাধি তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। খাচ্ছে তাদের ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, মেধাশক্তি, দৈহিক শক্তি ও মানসিক শক্তিকেও। যে দেশের যুব সমাজের বিরাট একটি অংশের এ পরিণতি, সে দেশের ভবিষ্যৎ কী? সে দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী? হ্যাঁ, উপায় হচ্ছে আত্মজাগরণ ও আত্মশুদ্ধি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments