টেলিভিশনের টকশো বিতর্ক by রাজীন অভী মুস্তাফিজ
রেডিও
ও টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠান বা টকশো নতুন কোনো বিষয় নয়। টেলিভিশনের
জন্মলগ্ন থেকেই টকশো প্রচার হয়ে আসছে। ১৯৫১ সালে আমেরিকান টিভি ব্যক্তিত্ব
জো ফ্রাংকলিনের হাত ধরে টেলিভিশনে টকশোর যাত্রা শুরু হয়। এরপর নানা ধরনের
পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে টিভি অনুষ্ঠানের এই বিশেষ ধরনটি। পশ্চিমা
দেশে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের টকশো প্রচার হয়ে থাকে- যেমন দিনের
শুরুতে ব্রেকফাস্ট টকশো, দিনের মধ্যভাগে লেট মর্নিং টকশো এবং ডে টাইম টকশো,
তারকাদের নিয়ে সেলিব্রেটি টকশো, রাতের বেলা লেটনাইট টকশো এবং সাপ্তাহিক
ছুটির দিনে উইক অ্যান্ড টকশো। একেকটি টকশোর বিষয়বস্তু একেক ধরনের হয়ে থাকে।
যেমন ব্রেকফাস্ট টকশো সাধারণত রাজনৈতিক বিষয় এবং সংবাদ বিশ্লেষণের ওপর জোর
দেয়। লেট মর্নিং টকশো বিনোদন ও লাইফ স্টাইল নির্ভরশীল। ডে টাইম টকশোর
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক,
সামাজিক কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিদের সরাসরি প্রশ্ন করতে, এমনকি সামনাসামনি
সমালোচনাও করতে পারে। লেটনাইট টকশোগুলো সাধারণত একটু হালকা ধরনের হয়ে থাকে।
এই টকশোর একটা চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে উপস্থাপক ডেস্কের পেছনে অবস্থান
করেন, সেখান থেকেই তিনি অনুষ্ঠানের শুরুতে দিনের বিভিন্ন খবর নিয়ে কৌতুক
করেন এবং পরবর্তীকালে এক বা একাধিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন।
দর্শকদের একঘেয়েমি দূর করতে সঙ্গীতও লেটনাইট টকশোর একটি নিয়মিত অংশ।
বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই টকশো প্রচার হয়ে আসছে বিটিভিতে, তবে সেগুলো
টকশো নামে প্রচারিত হতো না, প্রচারিত হতো আলোচনা বা আলেখ্য অনুষ্ঠান নামে।
যেখানে দু-তিনজন দক্ষ আলোচক আসতেন, কোনো একটি বিষয়ের ওপর ভাবগম্ভীর আলোচনা
করতেন, মানুষকে উপদেশ দিতেন এবং কোনো বিষয়ে কোনো ধরনের সমালোচনা না করে
শুধুই ভালো ভালো কথা বলতেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে টকশো এখন টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই দিনের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে টকশোর প্রাধান্য। তবে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো দুটি বিষয়েই প্রাধান্য দিয়ে থাকে- সেলিব্রেটি টকশো যেখানে এক বা একাধিক তারকা আসেন এবং উপস্থাপক তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে থাকেন, অন্যটি হচ্ছে রাজনৈতিক টকশো যেখানে রাজনীতিক বা বোদ্ধাশ্রেণীর আলোচক আসেন এবং চলমান রাজনীতি নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করে থাকেন। এই টকশোগুলোর বেশিরভাগই সরাসরি সম্প্রচারিত হয় এবং দর্শকরা ফোন করে সরাসরি তাদের মতামত জানাতে পারে।
নব্বই দশকের শুরুতে গণতন্ত্রের শুভ সূচনার পর আমরা বিটিভিতে দেখতে পাই প্রথম রাজনৈতিক টকশো যার নাম ছিল ‘মুখোমুখি’। এ অনুষ্ঠানে সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রথম সারির রাজনীতিকরা উপস্থিত থাকতেন এবং আদালতের আদলে গড়া কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্ধারিত সময়ের ভেতর তাদের প্রতিপক্ষের গঠনমূলক সমালোচনা কিংবা কোনো বিষয়ে তাদের দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করতেন অথবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরতেন। যদিও খুব বেশিদিন প্রচারিত হয়নি সেই অনুষ্ঠানটি। বেসরকারি টিভি চ্যানেল যুগে প্রবেশের আগে আর খুব বেশি রাজনৈতিক টকশো উল্লেখযোগ্য নয়, যদিও ছিয়ানব্বইয়ের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ নামে একটি জবাবদিহিমূলক অনুষ্ঠান রাজনৈতিক স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছিল। আমাদের গভীর রাতের বর্তমান রাজনৈতিক টকশোগুলোর খুব চেনা একটা ছক আছে। একজন উপস্থাপক থাকেন এবং তার সঙ্গে থাকেন একাধিক রাজনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যদিও মাঝেমধ্যে শুধুই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দেখা যায়। যা হোক রাজনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানোর সময়ও এমনভাবে সেটা করা হয় যেন একজন সরকারদলীয় এবং একজন বিরোধীদলীয় হন। আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আমন্ত্রণ জানানোর সময়ও এই একই বিভাজনটি বিবেচনায় রাখা হয়। খুব সচেতনভাবে সরকার ও বিরোধীদলীয় লোকজনকে এমনভাবে নিয়ে আসা হয় যেন উভয়পক্ষের আলোচনাটি শেষ পর্যন্ত একটি বিতর্কে রূপ নেয়। বিশেষত রাজনীতিকদের আলোচনা শেষ পর্যন্ত প্রায় ঝগড়ার দিকে গড়ায়, দু’পক্ষই যার যার দলীয় সাফাই গাইতে থাকেন, বাস্তবতা যাই হোক না কেন, তারা শুধু দলীয় আনুগত্য প্রকাশেই ব্যস্ত থাকেন এবং আক্রমণাত্মক বাক্যের যথেচ্ছ ব্যবহার করে যান।
বিশ্লেষকরা রাজনীতিক নন। তাই তারা উচ্চস্বরে কথা বলেন না। অন্য কেউ কথা বলার সময় বাধা দেন না। অগণতান্ত্রিক কোনো আচরণও করেন না। তারা একজন আরেকজনকে সম্মান দেখান এবং প্রায়ই অন্য আলোচকদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে একমত হন। তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতার আড়ালেও কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকে। পক্ষপাতিত্ব থাকে কারণ বর্তমান সময়ের টকশোগুলোর অনেক বিশ্লেষক, অবশ্য সবাই নয়, বর্তমান বা পূর্ববর্তী সরকারের কাছ থেকে সুবিধাভোগ করেছেন কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কোনো সুবিধা পাওয়ার আশা করছেন। তাই তারা প্রচ্ছন্নভাবে তাদের সুবিধা প্রদানকারী দলের পক্ষে কথা বলেন এবং অনেক সময়ই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। তবে দর্শকও এখন আর অতটা বোকা নয় যে, সবাইকে তারা সমানভাবে বিশ্বাস করে। অনেক বিশ্লেষকেরই দলীয় পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি তাদের জানা। তাই তারা তাদের আর সেভাবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ দর্শক জানে কোনো কোনো বিশ্লেষক নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে শুধু গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে আগ্রহী।
তারপরও কেন বাংলাদেশে গভীর রাতের রাজনৈতিক টকশোগুলোর এত জনপ্রিয়তা? আসলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিদিনই আমরা এত সমস্যার সম্মুখীন হই যে প্রতি মুহূর্তেই আমাদের ভেতর নেতিবাচক শক্তি (নেগেটিভ এনার্জি) বা ক্ষোভ জমা হতে থাকে। এই ক্ষোভ প্রশমনের জন্য নিজের অজান্তেই কেউ কেউ হয়তো তার অধীনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকে, কেউবা সামান্য কারণেই দাম্পত্য কলহে জড়িয়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মন খুলে এসব বিষয়ে তাদের অসন্তোষের কথা অন্য সবার সামনে তুলে ধরেন। এমনি আরও অনেকভাবেই আমরা আমাদের ভেতরে জমা হওয়া নেতিবাচক শক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই। এক্ষেত্রে টকশো, বিশেষত রাজনৈতিক টকশোগুলোর সঙ্গে দর্শক নিজেদের একাÍ করার একটা সুযোগ পান। সাধারণ দর্শক এসব টকশো ও আলোচকদের তাদের মতো অসহায় মানুষদের পক্ষে কথা বলার প্রতিনিধি বলে মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে তাদের মতামতের কিছুটা হলেও প্রতিফলিত হয় গভীর রাতের রাজনৈতিক টকশো ও আলোচকদের মাধ্যমে। সে কারণে যখন কোনো আলোচক সরকার বা বিরোধী দলের কোনো সিদ্ধান্ত বা মতাদর্শের বিরুদ্ধে তত্ত্ব, তথ্য ও প্রমাণসহ যুক্তিযুক্তভাবে তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তখন সাধারণ দর্শক সেই আলোচনা বা সমালোচনায় নিজেদের কথাগুলোর প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পায় এবং পুরো বিষয়টির সঙ্গে আরও বেশি একাত্ম হয়ে যায়, যার ফলে ঊর্ধ্বমুখী টকশোর জনপ্রিয়তা ও সংখ্যা।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এদেশের টিভি চ্যানেলের টকশোগুলো সরকার বা বিরোধী দলের ভালো ও মন্দ কাজের বিশ্লেষণের অন্যতম একটি মাধ্যম। এ কারণে অগণতান্ত্রিক মতাদর্শ, সিদ্ধান্ত অথবা জনস্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সরকার, বিরোধী দল এবং যে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বাধ্য হয় যে, টিভি টকশোগুলো এসব বিষয় দর্শকদের সামনে তুলে ধরবে, যা সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরির পাশাপাশি তাদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে এটাও সত্য যে, আমাদের টিভি চ্যানেলে প্রচারিত টকশোগুলোর মান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া যখন দুই-তিনজন আলোচক চলমান বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রদান করেন, তখন প্রায়ই বোঝা যায় ওই বিষয়ে কথা বলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্তুত তারা সেই মুহূর্তে নন। এছাড়া আলোচনার বিষয়ভেদে আলোচকদের গ্রহণযোগ্যতারও একটি প্রশ্ন থাকে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত টকশো প্রচার হওয়ার কারণে প্রায়ই নিুমানের অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে। আবার একই আলোচক বিভিন্ন টকশোতে বারবার একই কথা বলে যাওয়ায় বৈচিত্র্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে।
ইদানীং প্রায়ই বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে টকশোকে ব্যঙ্গ করা হয়, হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়, তুলে ধরা হয় আলোচকদের একরোখা মনোভাব, আপসহীন মানসিকতা এবং উপস্থাপকদের অসহায়ত্ব। বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের কাছ থেকে যে অসহিষ্ণু আচরণ আমরা টকশোর মাধ্যমে দেখি, তা সত্যিই হতাশার সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের প্রত্যাশাও প্রায়ই পূরণ হয় না তাদের কারও কারও সুবিধাভোগী মানসিকতার জন্য। সে জন্য টকশোগুলোকে ঢালাওভাবে অপবাদ দেয়াটা অন্যায় হবে। প্রয়োজন আমাদের সহিষ্ণুতা, সচেতনতা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেম।
রাজীন অভী মুস্তাফিজ : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে টকশো এখন টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই দিনের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে টকশোর প্রাধান্য। তবে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো দুটি বিষয়েই প্রাধান্য দিয়ে থাকে- সেলিব্রেটি টকশো যেখানে এক বা একাধিক তারকা আসেন এবং উপস্থাপক তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে থাকেন, অন্যটি হচ্ছে রাজনৈতিক টকশো যেখানে রাজনীতিক বা বোদ্ধাশ্রেণীর আলোচক আসেন এবং চলমান রাজনীতি নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করে থাকেন। এই টকশোগুলোর বেশিরভাগই সরাসরি সম্প্রচারিত হয় এবং দর্শকরা ফোন করে সরাসরি তাদের মতামত জানাতে পারে।
নব্বই দশকের শুরুতে গণতন্ত্রের শুভ সূচনার পর আমরা বিটিভিতে দেখতে পাই প্রথম রাজনৈতিক টকশো যার নাম ছিল ‘মুখোমুখি’। এ অনুষ্ঠানে সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রথম সারির রাজনীতিকরা উপস্থিত থাকতেন এবং আদালতের আদলে গড়া কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্ধারিত সময়ের ভেতর তাদের প্রতিপক্ষের গঠনমূলক সমালোচনা কিংবা কোনো বিষয়ে তাদের দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করতেন অথবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরতেন। যদিও খুব বেশিদিন প্রচারিত হয়নি সেই অনুষ্ঠানটি। বেসরকারি টিভি চ্যানেল যুগে প্রবেশের আগে আর খুব বেশি রাজনৈতিক টকশো উল্লেখযোগ্য নয়, যদিও ছিয়ানব্বইয়ের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ নামে একটি জবাবদিহিমূলক অনুষ্ঠান রাজনৈতিক স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছিল। আমাদের গভীর রাতের বর্তমান রাজনৈতিক টকশোগুলোর খুব চেনা একটা ছক আছে। একজন উপস্থাপক থাকেন এবং তার সঙ্গে থাকেন একাধিক রাজনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যদিও মাঝেমধ্যে শুধুই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দেখা যায়। যা হোক রাজনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানোর সময়ও এমনভাবে সেটা করা হয় যেন একজন সরকারদলীয় এবং একজন বিরোধীদলীয় হন। আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আমন্ত্রণ জানানোর সময়ও এই একই বিভাজনটি বিবেচনায় রাখা হয়। খুব সচেতনভাবে সরকার ও বিরোধীদলীয় লোকজনকে এমনভাবে নিয়ে আসা হয় যেন উভয়পক্ষের আলোচনাটি শেষ পর্যন্ত একটি বিতর্কে রূপ নেয়। বিশেষত রাজনীতিকদের আলোচনা শেষ পর্যন্ত প্রায় ঝগড়ার দিকে গড়ায়, দু’পক্ষই যার যার দলীয় সাফাই গাইতে থাকেন, বাস্তবতা যাই হোক না কেন, তারা শুধু দলীয় আনুগত্য প্রকাশেই ব্যস্ত থাকেন এবং আক্রমণাত্মক বাক্যের যথেচ্ছ ব্যবহার করে যান।
বিশ্লেষকরা রাজনীতিক নন। তাই তারা উচ্চস্বরে কথা বলেন না। অন্য কেউ কথা বলার সময় বাধা দেন না। অগণতান্ত্রিক কোনো আচরণও করেন না। তারা একজন আরেকজনকে সম্মান দেখান এবং প্রায়ই অন্য আলোচকদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে একমত হন। তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতার আড়ালেও কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকে। পক্ষপাতিত্ব থাকে কারণ বর্তমান সময়ের টকশোগুলোর অনেক বিশ্লেষক, অবশ্য সবাই নয়, বর্তমান বা পূর্ববর্তী সরকারের কাছ থেকে সুবিধাভোগ করেছেন কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কোনো সুবিধা পাওয়ার আশা করছেন। তাই তারা প্রচ্ছন্নভাবে তাদের সুবিধা প্রদানকারী দলের পক্ষে কথা বলেন এবং অনেক সময়ই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। তবে দর্শকও এখন আর অতটা বোকা নয় যে, সবাইকে তারা সমানভাবে বিশ্বাস করে। অনেক বিশ্লেষকেরই দলীয় পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি তাদের জানা। তাই তারা তাদের আর সেভাবে বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ দর্শক জানে কোনো কোনো বিশ্লেষক নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে শুধু গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে আগ্রহী।
তারপরও কেন বাংলাদেশে গভীর রাতের রাজনৈতিক টকশোগুলোর এত জনপ্রিয়তা? আসলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিদিনই আমরা এত সমস্যার সম্মুখীন হই যে প্রতি মুহূর্তেই আমাদের ভেতর নেতিবাচক শক্তি (নেগেটিভ এনার্জি) বা ক্ষোভ জমা হতে থাকে। এই ক্ষোভ প্রশমনের জন্য নিজের অজান্তেই কেউ কেউ হয়তো তার অধীনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকে, কেউবা সামান্য কারণেই দাম্পত্য কলহে জড়িয়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মন খুলে এসব বিষয়ে তাদের অসন্তোষের কথা অন্য সবার সামনে তুলে ধরেন। এমনি আরও অনেকভাবেই আমরা আমাদের ভেতরে জমা হওয়া নেতিবাচক শক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই। এক্ষেত্রে টকশো, বিশেষত রাজনৈতিক টকশোগুলোর সঙ্গে দর্শক নিজেদের একাÍ করার একটা সুযোগ পান। সাধারণ দর্শক এসব টকশো ও আলোচকদের তাদের মতো অসহায় মানুষদের পক্ষে কথা বলার প্রতিনিধি বলে মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে তাদের মতামতের কিছুটা হলেও প্রতিফলিত হয় গভীর রাতের রাজনৈতিক টকশো ও আলোচকদের মাধ্যমে। সে কারণে যখন কোনো আলোচক সরকার বা বিরোধী দলের কোনো সিদ্ধান্ত বা মতাদর্শের বিরুদ্ধে তত্ত্ব, তথ্য ও প্রমাণসহ যুক্তিযুক্তভাবে তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তখন সাধারণ দর্শক সেই আলোচনা বা সমালোচনায় নিজেদের কথাগুলোর প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পায় এবং পুরো বিষয়টির সঙ্গে আরও বেশি একাত্ম হয়ে যায়, যার ফলে ঊর্ধ্বমুখী টকশোর জনপ্রিয়তা ও সংখ্যা।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এদেশের টিভি চ্যানেলের টকশোগুলো সরকার বা বিরোধী দলের ভালো ও মন্দ কাজের বিশ্লেষণের অন্যতম একটি মাধ্যম। এ কারণে অগণতান্ত্রিক মতাদর্শ, সিদ্ধান্ত অথবা জনস্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সরকার, বিরোধী দল এবং যে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বাধ্য হয় যে, টিভি টকশোগুলো এসব বিষয় দর্শকদের সামনে তুলে ধরবে, যা সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরির পাশাপাশি তাদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে এটাও সত্য যে, আমাদের টিভি চ্যানেলে প্রচারিত টকশোগুলোর মান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া যখন দুই-তিনজন আলোচক চলমান বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রদান করেন, তখন প্রায়ই বোঝা যায় ওই বিষয়ে কথা বলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্তুত তারা সেই মুহূর্তে নন। এছাড়া আলোচনার বিষয়ভেদে আলোচকদের গ্রহণযোগ্যতারও একটি প্রশ্ন থাকে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত টকশো প্রচার হওয়ার কারণে প্রায়ই নিুমানের অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে। আবার একই আলোচক বিভিন্ন টকশোতে বারবার একই কথা বলে যাওয়ায় বৈচিত্র্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে।
ইদানীং প্রায়ই বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে টকশোকে ব্যঙ্গ করা হয়, হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়, তুলে ধরা হয় আলোচকদের একরোখা মনোভাব, আপসহীন মানসিকতা এবং উপস্থাপকদের অসহায়ত্ব। বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের কাছ থেকে যে অসহিষ্ণু আচরণ আমরা টকশোর মাধ্যমে দেখি, তা সত্যিই হতাশার সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের প্রত্যাশাও প্রায়ই পূরণ হয় না তাদের কারও কারও সুবিধাভোগী মানসিকতার জন্য। সে জন্য টকশোগুলোকে ঢালাওভাবে অপবাদ দেয়াটা অন্যায় হবে। প্রয়োজন আমাদের সহিষ্ণুতা, সচেতনতা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেম।
রাজীন অভী মুস্তাফিজ : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক
No comments