সমাপনী পরীক্ষা : রাষ্ট্র মালির ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক by শেখ মাসুদ কামাল
শিক্ষা
প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, মানুষ অজ্ঞ হয়ে
জন্মায়, নির্বোধ হয়ে নয়। কিন্তু শিক্ষা মানুষকে নির্বোধ বানায়। প্রাথমিক
শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে এবার যে ধরনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ-আয়োজন লক্ষ্য
করা যাচ্ছে তাতে মনে হয় যে, শিক্ষার্থীদের অতি শিক্ষণের নামে এবার
নিশ্চিতভাবে বোকা বানানো হবে। প্রথমেই বলা যায়, এ বছর শিক্ষার্থীরা নতুন বই
পড়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী
বছরের প্রশ্নগুলো কোনো সহায়ক ভূমিকা রাখবে না। এ ছাড়া পরীক্ষার্থীদের হাতে
এবার নতুন সিলেবাসের বই এসেছে খানিকটা দেরিতে। ফলে চতুর্থ শ্রেণীর পরীক্ষা
শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রেও
শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে। এ রকম একটি লেজেগোবরে অবস্থায় পরীক্ষার্থীদের
পরীক্ষার জন্য সর্বমোট দুই ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু সময় সংকটের
কারণে যথাযথ প্রস্তুতিহীন এ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীরা তাদের স্ব-স্ব স্কুলের
পরীক্ষায় খারাপ করেছিল বিধায় এখন সেখানে সময় ৩০ মিনিট বাড়িয়ে মোট আড়াই
ঘণ্টা করা হয়েছে। এ বিষয়ে এক সংবাদ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ক্ষুদে
পরীক্ষার্থীদের কঠিন সিলেবাসের কারণে স্বল্প সময়ে পরীক্ষা দিতে সমস্যা হয়।
তাই এ সময় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু এ ৩০ মিনিট সময় বৃদ্ধি
পরীক্ষা সুসম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে কি-না, তা পরীক্ষার
ফলাফলের মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে।
কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য পরীক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকবে। কিন্তু নতুন সিলেবাসে নির্দিষ্ট এ কাঠামোটি প্রণয়ন ও তা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগেছে। আর প্রশ্ন কাঠামো না পাওয়ায় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রশ্নপত্র তুলে দিতে পারেননি। আর নতুন নিয়মের প্রশ্নকাঠামো প্রচলিত হওয়ায় পুরনো নিয়মের প্রস্তুতি আর কোনো কাজে আসেনি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। অন্তত শিক্ষকরা এমন অভিমতই পোষণ করেন।
উপরন্তু বিগত বছরগুলোর সঙ্গে তুলনায় এ বছর প্রশ্ন কাঠামো তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়েছে। কারণ আগে যেখানে প্রতি বিষয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক-বহির্ভূত যোগ্যতাভিত্তিক অংশের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ ছিল এখন সেক্ষেত্রে তা ২.৫ গুণ বাড়িয়ে ২৫ করা হয়েছে। এছাড়া এ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের ধরন, বিশেষত বাংলা ও ইংরেজি, এরকম যে বাবা-মা উচ্চশিক্ষিত না হলে সন্তানদের পড়াতে পারবেন না। এ ছাড়া বিগত বছরের তুলনায় এ বছর হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষার্থীদের বেশি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এলাকায় অবস্থিত একটি স্কুলের ছাত্রী এবং তাদের একটি ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা হরতালের কারণে অন্তত তিনবার পিছিয়েছে। রাজধানীর অন্যান্য স্কুলের অবস্থাও তথৈবচ, যার জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তদুপরি পরীক্ষার মধ্যবর্তী গ্যাপ অত্যন্ত কমিয়ে আনা হয়েছে। বাংলা, সমাজ ও ধর্ম পরীক্ষার মাঝখানে কোনো গ্যাপই নেই। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই একটু রিভিশনের জন্য সময় চাইতে পারে। এ চাওয়াটি একবারে মানবিক ও বৈজ্ঞানিক। বরং রিভিশন বা পুনর্পাঠের সুযোগ না দেয়াটাই অবৈজ্ঞানিক। এসব দিক বিবেচনায় পরীক্ষার গ্যাপ একটু বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষা, তাই পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে প্রশ্নপত্রে ‘অথবা’র সংযোজন বা পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার।
একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। শিক্ষণ বিষয়টিকে শিশুদের কাছে ভয়াবহ না করে আনন্দদায়ক করে তোলা দরকার। ঘন ঘন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিক্ষার বিষয়টিকে শিশুদের কাছে বিভীষিকাময় করে তোলে। আমাদের শিশুরা পিএসসির নামে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না, তারা প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট বা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, যা তাদের জীবনের প্রথম কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। এসব বিষয় মাথায় রেখে পরীক্ষার সময়সূচি ও প্রশ্নকাঠামোর পুরো বিষয়টিকে পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। শিশু বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ‘মালি’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। ‘মালি’ তার বাগানের কলিগুলোকে পরম যতœ আর মমতার উষ্ণতা দিয়ে বিকশিত হতে সাহায্য করবে। আর সবগুলো কলি যখন একত্রে ফুটে উঠবে, তখন এক অপূর্ব নন্দনকানন তৈরি হবে। এক্ষেত্রে যা জরুরি তা হল- শিশুর অতিবিকাশের প্রয়াস শিশুদের বিকশিত করার পরিবর্তে বিনষ্ট করে দিতে পারে। অনাবশ্যক আর অনিচ্ছুক এ ক্ষতিটা যেন শিশুদের বেলায় না ঘটে- এ দিকটিতে খেয়াল রেখে শিক্ষা পদ্ধতি, পাঠসূচি, প্রশ্নপত্র ও পরীক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত শিশুবান্ধব (ইন্টিগ্রেটেড চিলড্রেন ফ্রেন্ডলি) ব্যবস্থা গ্রহণ করা যুগপৎভাবে অনিবার্য ও অনস্বীকার্য।
শেখ মাসুদ কামাল : প্রাবন্ধিক
কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য পরীক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকবে। কিন্তু নতুন সিলেবাসে নির্দিষ্ট এ কাঠামোটি প্রণয়ন ও তা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগেছে। আর প্রশ্ন কাঠামো না পাওয়ায় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রশ্নপত্র তুলে দিতে পারেননি। আর নতুন নিয়মের প্রশ্নকাঠামো প্রচলিত হওয়ায় পুরনো নিয়মের প্রস্তুতি আর কোনো কাজে আসেনি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। অন্তত শিক্ষকরা এমন অভিমতই পোষণ করেন।
উপরন্তু বিগত বছরগুলোর সঙ্গে তুলনায় এ বছর প্রশ্ন কাঠামো তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়েছে। কারণ আগে যেখানে প্রতি বিষয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক-বহির্ভূত যোগ্যতাভিত্তিক অংশের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ ছিল এখন সেক্ষেত্রে তা ২.৫ গুণ বাড়িয়ে ২৫ করা হয়েছে। এছাড়া এ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের ধরন, বিশেষত বাংলা ও ইংরেজি, এরকম যে বাবা-মা উচ্চশিক্ষিত না হলে সন্তানদের পড়াতে পারবেন না। এ ছাড়া বিগত বছরের তুলনায় এ বছর হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষার্থীদের বেশি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এলাকায় অবস্থিত একটি স্কুলের ছাত্রী এবং তাদের একটি ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা হরতালের কারণে অন্তত তিনবার পিছিয়েছে। রাজধানীর অন্যান্য স্কুলের অবস্থাও তথৈবচ, যার জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তদুপরি পরীক্ষার মধ্যবর্তী গ্যাপ অত্যন্ত কমিয়ে আনা হয়েছে। বাংলা, সমাজ ও ধর্ম পরীক্ষার মাঝখানে কোনো গ্যাপই নেই। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই একটু রিভিশনের জন্য সময় চাইতে পারে। এ চাওয়াটি একবারে মানবিক ও বৈজ্ঞানিক। বরং রিভিশন বা পুনর্পাঠের সুযোগ না দেয়াটাই অবৈজ্ঞানিক। এসব দিক বিবেচনায় পরীক্ষার গ্যাপ একটু বাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষা, তাই পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে প্রশ্নপত্রে ‘অথবা’র সংযোজন বা পরিমাণ বৃদ্ধি করা দরকার।
একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। শিক্ষণ বিষয়টিকে শিশুদের কাছে ভয়াবহ না করে আনন্দদায়ক করে তোলা দরকার। ঘন ঘন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিক্ষার বিষয়টিকে শিশুদের কাছে বিভীষিকাময় করে তোলে। আমাদের শিশুরা পিএসসির নামে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না, তারা প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট বা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, যা তাদের জীবনের প্রথম কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। এসব বিষয় মাথায় রেখে পরীক্ষার সময়সূচি ও প্রশ্নকাঠামোর পুরো বিষয়টিকে পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। শিশু বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ‘মালি’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। ‘মালি’ তার বাগানের কলিগুলোকে পরম যতœ আর মমতার উষ্ণতা দিয়ে বিকশিত হতে সাহায্য করবে। আর সবগুলো কলি যখন একত্রে ফুটে উঠবে, তখন এক অপূর্ব নন্দনকানন তৈরি হবে। এক্ষেত্রে যা জরুরি তা হল- শিশুর অতিবিকাশের প্রয়াস শিশুদের বিকশিত করার পরিবর্তে বিনষ্ট করে দিতে পারে। অনাবশ্যক আর অনিচ্ছুক এ ক্ষতিটা যেন শিশুদের বেলায় না ঘটে- এ দিকটিতে খেয়াল রেখে শিক্ষা পদ্ধতি, পাঠসূচি, প্রশ্নপত্র ও পরীক্ষা পদ্ধতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত শিশুবান্ধব (ইন্টিগ্রেটেড চিলড্রেন ফ্রেন্ডলি) ব্যবস্থা গ্রহণ করা যুগপৎভাবে অনিবার্য ও অনস্বীকার্য।
শেখ মাসুদ কামাল : প্রাবন্ধিক
No comments