সিরীয় সমঝোতা ও অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন by তারেক শামসুর রেহমান
জেনেভায়
লেভারভ-কেরি সমঝোতা স্বাক্ষর এবং জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের তদন্ত
রিপোর্ট দাখিলের পরও সিরিয়া সংকটের সমাধান হয়েছে এটা বলা যাবে না।
লেভারভ-কেরি সমঝোতায় আপাতত মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘যুদ্ধ’ এড়ানো গেছে সত্য, তবে
বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়ে গেছে, যার ওপর নির্ভর করছে সিরিয়ার
ভবিষ্যৎ। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি সমঝোতায় উপনীত
হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতিনির্ধারককে দেখেছি তারা রাশিয়ার উদ্দেশ্য
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উপরন্তু পুতিনের নিউইয়র্ক টাইমসে দেয়া একটি উন্মুক্ত
আবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে American Exceptionalism হিসেবে উল্লেখ করায়
একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে, আগামীতে স্নায়ুযুদ্ধ সময়কার পরিস্থিতির জন্ম
হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা American Exceptionalism বা
আমেরিকার রক্ষণশীলতাবাদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। মার্কসবাদীরা এ টার্ম
এক সময় ব্যবহার করতেন, বিশেষ করে স্ট্যালিনের সময়কালে মার্কিন গবেষকরা
অনেকেই এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ২০ বছর পার হয়ে
যাওয়ার পর আমেরিকার যুদ্ধবাজরা আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা
নিজে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার (২০০৮) পেলেও লিবিয়ায় তিনি যুদ্ধ শুরু
করেছিলেন। এখন সিরিয়ায় আরেকটি যুদ্ধের জন্য সারাবিশ্ব অপেক্ষা করছে।
সারাবিশ্ব জানে, ইসরাইলি লবি এবং ইসরাইল নিজেও সিরিয়ায় যুদ্ধ চায়। এখন
‘কূটনীতি’ যুদ্ধবাজদের পূর্ণ পরাস্ত করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। এখনও
যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে।
লেভারভ ও কেরির মধ্যে সমঝোতার পাশাপাশি আরও দুটি সংবাদ সম্প্রতি ছাপা হয়েছে, যা ওই অঞ্চল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিতে পারে। এক. জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল তাদের প্রতিবেদন নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্টে সরাসরি আসাদ সরকারকে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলার (২১ আগস্ট) ব্যাপারে অভিযুক্ত করা হয়নি। রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে, সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারা ওই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও এ হামলার জন্য পরোক্ষভাবে আসাদ সরকারকেই দায়ী করা হয়েছে। দুই. লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে’ আইএইচএস জেইন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ), সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এটা একটা উদ্বেগজনক খবর। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে জেইনের গবেষণা কোনো অপরিচিত বিষয় নয়। জেইনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিস্টার। তিনি তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার লোক রয়েছেন, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নন। এরা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো মহলে এমন ধারণাও জন্ম হয়েছে যে, সিরীয় যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে নয়া আল কায়দা সংগঠনগুলো। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন হলে আসাদ সরকারের সব অস্ত্র চলে যাবে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র এদের হাতে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। চার্লস লিস্টার তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেলপন্থী। সিরিয়া সংকটে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে, তা সম্প্রতি ওয়াশিংটনে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির (সিনেটের) এক শুনানিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। টম জোসেলিনের কমিটিতে সাক্ষ্যদানের খবর ইন্টারনেটে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে। তাই একটা প্রশ্ন থেকেই গেল- রুশ-মার্কিন সমঝোতা সিরিয়া সংকটের কতটুকু সমাধান বয়ে আনবে? এটা সত্য, আপাতত যুদ্ধ হচ্ছে না। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলোয় এমনকি ফরিদ জাকারিয়ার মতো টিভি ব্যক্তিত্বও এ চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, এ সমঝোতা কাজ করবে না। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এক. সমঝোতা অনুযায়ী সিরিয়ায় পরিপূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকরণের কাজ শেষ হবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এতদিন অপেক্ষা করবে কি-না? এখানে প্রশ্ন উঠেছে, বাশার আল আসাদকে স্বীকার করা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নকারী ও নীতিনির্ধারকরা এটা কি করবেন? দুই. এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে দেখা যায়, ক্ষমতায় একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে রেখে কোনো সমঝোতায় জট খোলেনি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ায় গাদ্দাফির ক্ষেত্রে কোনো জট খোলেনি। ফলে চূড়ান্ত বিচারে এদের উৎখাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের। এরা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি আর বাশারকে এক কাতারেই দেখে। কোনো পার্থক্য করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র কি বাশারকে আরও প্রায় এক বছর ক্ষমতায় রাখবে? তিন. সমঝোতায় সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের হিসাব, অবস্থান, মজুদ, অস্ত্রের ধরন, গবেষণা ইত্যাদির কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। নভেম্বরের মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার কথা। এখন যদি সিরীয় সরকার জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তখন কী হবে? চার. রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, সিরিয়াকে পুরোপুরিভাবে রাসায়নিক অস্ত্রমুক্ত করার কাজটি অত সহজ নয়। কারণ ধারণা করা হয়, সিরিয়ায় মোট ৪০টি রাসায়নিক কারখানা অথবা এলাকা রয়েছে, যেখানে এসব অস্ত্র উৎপাদন করা হয় অথবা তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন গ্যাস (সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) সিরিয়া সংরক্ষণ করেছে। এসব গ্যাস ধ্বংস করা কঠিন কাজ। একজন গবেষক লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৮ বছর ধরেই তাদের কাছে রক্ষিত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এখানে সিরিয়া নিয়ে যে বড় সমস্যা হবে তা হচ্ছে, এসব অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট প্লান্টে বা স্থানে ধ্বংস করতে হবে। সিরিয়ায় তা করা যাবে না। সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো দেশে ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ১৩টি প্লান্টের মধ্যে ৯টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউরোপে পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যে কোনো পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলবে। স্থানীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনও পরিবহন ব্যবস্থার বিপক্ষে। সুতরাং একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রাশিয়ার সমর্থন এবং রুশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা কারণে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের বিষয়টি নিয়ে আগামীতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। পাঁচ. সিরিয়ায় অস্ত্র পরিদর্শক হিসেবে কারা কারা থাকবেন, সেটা নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সংস্থা রয়েছে- Organization for the Prohibition of Chemical Weapons (OPCW)। এ সংস্থাটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকানরা। এ ক্ষেত্রে পরিদর্শক টিমে যদি আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি থাকে, তা সিরিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছয়. এ সমঝোতার ব্যাপারে সিরীয় বিদ্রোহীরা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। বাশার সরকার বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সেই দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন বিদ্রোহীরা যদি তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তাতে করে এ পরিদর্শন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। ভেঙে যেতে পারে সমঝোতা। সাত. এ সমঝোতার পেছনে মূল অ্যাক্টর দুই শক্তি- যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। অথচ সিরীয় সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ফলে অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার মতো হয়ে গেল বিষয়টা। আন্তর্জাতিক যে কোনো ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে যদি বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা এই সমঝোতার ওপর প্রভাব ফেলবে। সমঝোতা ভেঙেও যেতে পারে।
সিরিয়ায় একটি ‘সমঝোতার’ মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসে কি-না, সে বিষয়ে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ‘ব্যর্থ’ হয়েছে। বলা হচ্ছে, সেখানে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার পেছনে ইসরাইলি লবি কাজ করেছিল। নিঃসন্দেহে মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান মার্কিন নীতিনির্ধারকদের একটা দোটানায় ফেলে দিয়েছে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেদিকেও লক্ষ্য থাকবে অনেকের। বিশেষ করে নতুন প্রেসিডেন্ট ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, তা দেখতে চাইবে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকে। আর সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননের দিকে দৃষ্টি এখন অনেকের। পর্যবেক্ষকদের কারও কারও ধারণা, সিরিয়ার পর এখন লেবাননে অস্থিরতা দেখা দেবে। লেবাননের হিজবুল্লাহদের ব্যাপারে ইসরাইলের আপত্তি দীর্ঘদিনের। তাই সিরিয়ায় একটি সমঝোতা আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবে না। মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত থাকবেই আরও বেশ কিছুদিনের জন্য।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
লেভারভ ও কেরির মধ্যে সমঝোতার পাশাপাশি আরও দুটি সংবাদ সম্প্রতি ছাপা হয়েছে, যা ওই অঞ্চল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিতে পারে। এক. জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল তাদের প্রতিবেদন নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জমা দিয়েছে। ওই রিপোর্টে সরাসরি আসাদ সরকারকে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলার (২১ আগস্ট) ব্যাপারে অভিযুক্ত করা হয়নি। রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে, সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারা ওই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও এ হামলার জন্য পরোক্ষভাবে আসাদ সরকারকেই দায়ী করা হয়েছে। দুই. লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে’ আইএইচএস জেইন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে সিরিয়ায় আসাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ), সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এটা একটা উদ্বেগজনক খবর। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে জেইনের গবেষণা কোনো অপরিচিত বিষয় নয়। জেইনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিস্টার। তিনি তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার লোক রয়েছেন, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নন। এরা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো মহলে এমন ধারণাও জন্ম হয়েছে যে, সিরীয় যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে নয়া আল কায়দা সংগঠনগুলো। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন হলে আসাদ সরকারের সব অস্ত্র চলে যাবে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে। এমনকি রাসায়নিক অস্ত্র এদের হাতে পড়াও বিচিত্র কিছু নয়। চার্লস লিস্টার তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ তথা লিবারেলপন্থী। সিরিয়া সংকটে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো যে শক্তিশালী হয়েছে, তা সম্প্রতি ওয়াশিংটনে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির (সিনেটের) এক শুনানিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। টম জোসেলিনের কমিটিতে সাক্ষ্যদানের খবর ইন্টারনেটে সার্চ দিলে পাওয়া যাবে। তাই একটা প্রশ্ন থেকেই গেল- রুশ-মার্কিন সমঝোতা সিরিয়া সংকটের কতটুকু সমাধান বয়ে আনবে? এটা সত্য, আপাতত যুদ্ধ হচ্ছে না। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলোয় এমনকি ফরিদ জাকারিয়ার মতো টিভি ব্যক্তিত্বও এ চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, এ সমঝোতা কাজ করবে না। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এক. সমঝোতা অনুযায়ী সিরিয়ায় পরিপূর্ণভাবে নিরস্ত্রীকরণের কাজ শেষ হবে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এতদিন অপেক্ষা করবে কি-না? এখানে প্রশ্ন উঠেছে, বাশার আল আসাদকে স্বীকার করা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নকারী ও নীতিনির্ধারকরা এটা কি করবেন? দুই. এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে দেখা যায়, ক্ষমতায় একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে রেখে কোনো সমঝোতায় জট খোলেনি। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ায় গাদ্দাফির ক্ষেত্রে কোনো জট খোলেনি। ফলে চূড়ান্ত বিচারে এদের উৎখাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের। এরা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি আর বাশারকে এক কাতারেই দেখে। কোনো পার্থক্য করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র কি বাশারকে আরও প্রায় এক বছর ক্ষমতায় রাখবে? তিন. সমঝোতায় সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের হিসাব, অবস্থান, মজুদ, অস্ত্রের ধরন, গবেষণা ইত্যাদির কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। নভেম্বরের মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার কথা। এখন যদি সিরীয় সরকার জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তখন কী হবে? চার. রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, সিরিয়াকে পুরোপুরিভাবে রাসায়নিক অস্ত্রমুক্ত করার কাজটি অত সহজ নয়। কারণ ধারণা করা হয়, সিরিয়ায় মোট ৪০টি রাসায়নিক কারখানা অথবা এলাকা রয়েছে, যেখানে এসব অস্ত্র উৎপাদন করা হয় অথবা তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন গ্যাস (সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) সিরিয়া সংরক্ষণ করেছে। এসব গ্যাস ধ্বংস করা কঠিন কাজ। একজন গবেষক লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৮ বছর ধরেই তাদের কাছে রক্ষিত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এখানে সিরিয়া নিয়ে যে বড় সমস্যা হবে তা হচ্ছে, এসব অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট প্লান্টে বা স্থানে ধ্বংস করতে হবে। সিরিয়ায় তা করা যাবে না। সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো দেশে ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ১৩টি প্লান্টের মধ্যে ৯টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউরোপে পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যে কোনো পরিবহন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলবে। স্থানীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনও পরিবহন ব্যবস্থার বিপক্ষে। সুতরাং একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রাশিয়ার সমর্থন এবং রুশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা কারণে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের বিষয়টি নিয়ে আগামীতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। পাঁচ. সিরিয়ায় অস্ত্র পরিদর্শক হিসেবে কারা কারা থাকবেন, সেটা নিয়েও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সংস্থা রয়েছে- Organization for the Prohibition of Chemical Weapons (OPCW)। এ সংস্থাটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকানরা। এ ক্ষেত্রে পরিদর্শক টিমে যদি আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি থাকে, তা সিরিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছয়. এ সমঝোতার ব্যাপারে সিরীয় বিদ্রোহীরা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। বাশার সরকার বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সেই দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন বিদ্রোহীরা যদি তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তাতে করে এ পরিদর্শন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। ভেঙে যেতে পারে সমঝোতা। সাত. এ সমঝোতার পেছনে মূল অ্যাক্টর দুই শক্তি- যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। অথচ সিরীয় সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ফলে অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার মতো হয়ে গেল বিষয়টা। আন্তর্জাতিক যে কোনো ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে যদি বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা এই সমঝোতার ওপর প্রভাব ফেলবে। সমঝোতা ভেঙেও যেতে পারে।
সিরিয়ায় একটি ‘সমঝোতার’ মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসে কি-না, সে বিষয়ে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ‘ব্যর্থ’ হয়েছে। বলা হচ্ছে, সেখানে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার পেছনে ইসরাইলি লবি কাজ করেছিল। নিঃসন্দেহে মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান মার্কিন নীতিনির্ধারকদের একটা দোটানায় ফেলে দিয়েছে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেদিকেও লক্ষ্য থাকবে অনেকের। বিশেষ করে নতুন প্রেসিডেন্ট ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, তা দেখতে চাইবে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকে। আর সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননের দিকে দৃষ্টি এখন অনেকের। পর্যবেক্ষকদের কারও কারও ধারণা, সিরিয়ার পর এখন লেবাননে অস্থিরতা দেখা দেবে। লেবাননের হিজবুল্লাহদের ব্যাপারে ইসরাইলের আপত্তি দীর্ঘদিনের। তাই সিরিয়ায় একটি সমঝোতা আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবে না। মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত থাকবেই আরও বেশ কিছুদিনের জন্য।
হিউস্টন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments