নির্বাচন অনিশ্চিত করা কারও জন্যই উচিত হবে না by মাহমুদুল বাসার
ভালো-মন্দ মিলিয়ে প্রায় পাঁচ বছর একটি
নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করেছে এ জন্য আমরা খুশি। এ কারণে সাংবিধানিক
ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। দেশে কিছু না কিছু
উন্নতি হয়েছে। আমাদের নিরতিশয় প্রত্যাশা, সামনের পাঁচ বছরও একটি নির্বাচিত
সরকার দেশ পরিচালনা করবে, তা যারাই বা যে দলই হোক না কেন। এর ব্যতিক্রম
কিছুতেই আশা করি না। অনির্বাচিত সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এজন্য
নির্বাচিত সরকারই আমাদের কাম্য। ভালো-মন্দ, উন্নতি-অবনতি যা হওয়ার তা
জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের শাসনামলেই হোক। অন্তত ভোট পাওয়ার স্বার্থে
হলেও নির্বাচিত সরকার জনগণকে ভয় পায়, জবাবদিহিতার প্রবণতা থাকে। জনগণকে
ঘুমের মধ্যে রেখে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে যায়, তারা তো জনগণকে তোয়াক্কা করে
না। যারা জনগণের ভোটের প্রত্যাশা করে না, তারা তুঘলকি সরকারই কায়েম করে
শেষ পর্যন্ত।
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই শক্তের ভক্ত নরমের যম। অবশ্য কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম আছে। যারা বর্তমান সরকারকে পদে পদে সমালোচনা করে নাকাল করেছেন, এক-এগারোর পর সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকারকে কেমন তোয়াক্কা করেছেন তারা, তা বেশ মনে আছে আমাদের। আসলে কেন জানি আমাদের পেটে গণতন্ত্রের ঘি হজম হতে চায় না। প্রমথ চৌধুরী এক প্রবন্ধে বলেছেন, আমরা সাংঘাতিক রকম ইতি ইতি না হয় নেতি নেতি। মানলে ইট-কাঠ-গাছপালাও দেবতা, না মানলে স্বয়ং ভগবানও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। আমাদর রাজনীতির মাঠেও এমন প্রবণতা আছে। দেবতা মানতে দেখেছি সেনা, আমলা, সুশীল সমন্বিত অনির্বাচিত সরকারকে। অথচ তারা দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, অখ্যাত লোকদের মাঠে নামিয়ে একটা পাপেট দল খাড়া করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিকদের চরিত্র হনন শুরু করেছিলেন। জেলখানা ভরে ফেলেছিলেন রাজনীতিকদের ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে। জনপ্রিয় এমপি, মেয়ররা পর্যন্ত জেলের ঘানি টেনেছেন। দুই নেত্রীকে জেলে ঢোকালেন। নির্দেশ জারি করলেন, দলের সংস্কার করতে হবে। তারপর বললেন, দুই নেত্রীকে দেশ ছাড়তে হবে। কী সাংঘাতিক কথা! তখনও টিভি মিডিয়ায় টকশো চলত। টকশোওয়ালারা দুই নেত্রী আর দুই দলের নিন্দা করতে লাগলেন বড়ই তৃপ্তির সঙ্গে। এক জাঁদরেল উপদেষ্টা বললেন, আমাদের দুই নেত্রী সেনাবাহিনীকে তুচ্ছজ্ঞান করেন, এটা চলবে না, সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার অংশ দিতে হবে। তিনি তার কলামে অহরহ গণতন্ত্রের সবক দিয়ে থাকেন।
এমন চাঁদের অমাবস্যা, এমন ঘোর দুর্দিন আমরা আর চাই না। আমরা চাই জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। আমরা চাই সংসদীয় গণতন্ত্র, সংসদকেন্দ্রিক রাজনীতি। আমরা চাই, সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রাণবন্ত তর্ক হোক। আমরা চাই, বাংলাদেশে সার্বক্ষণিক গণতন্ত্রের চর্চা হোক। গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না। বড় দুই দলের উভয়পক্ষ যদি ইগো ত্যাগ করে; সদিচ্ছা নিয়ে, প্রত্যেকে ছাড় দিয়ে নির্বাচনকালীন তিন মাসের সরকার গঠনে এগিয়ে আসে, তাহলে দেশ বিপদ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। রাজনীতিকরা নিশ্চয়ই চান না আমাদের দেশটা সিরিয়া, মিসর, আফগানিস্তানের পথ ধরুক। নির্বাচন যাতে কারচুপিমুক্ত হয়, যাতে সুষ্ঠু, অভিযোগমুক্ত হয়- এ টার্গেট নিয়ে গণতন্ত্রই শুধু নয়, দেশের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা এগিয়ে আসবেন বলে আমরা আশা করছি। যুদ্ধংদেহি মনোভাব ত্যাগ করুন, একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করুন। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক হতে পারলেন, এক-এগারোর পর নাকাল অবস্থার মধ্যে একে অপরের কাছাকাছি আসতে পারলে এখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে কেন নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে একমত হতে পারবেন না? ছাড় না দিলে মীমাংসা হয় না। মনটা সব সময় জটিল করে রাখতে নেই, একটু সরলতার দরকার আছে। মহাÍা গান্ধীও অনেক সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ছাড় দিয়ে মীমাংসার জন্য আলোচনার টেবিলে বসেছেন। তাতে তিনি খাটো হয়ে যাননি। তালেবানের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রয়োজন অনুভব করছে মহাপ্রতাপশালী মার্কিন সরকার। তাহলে আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দল কেন মাত্র একটি ইস্যুতে এক হতে পারবে না?
১৮ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন হলে সে নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা নিশ্চিত। যেদিন বিরোধীদলীয় নেতা বললেন, তারা বিচারপতি খায়রুল হককে প্রধান উপদেষ্টা মানবেন না, তখনই প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কোদালের মতো বাঁকা হয়ে গেছেন। সবকিছুই কি নিজেদের ইচ্ছামতো হয়? শীতের দিনের কাঁথা দিনে আপনার আর রাতে আমার, গাছের গোড়ার অংশ আপনার আর মাথার অংশ আমার, গাভীর সামনের অংশ আপনার আর পেছনের অংশ আমার- এমন মনগড়া পরিকল্পনা কেউ মানে নাকি? বঙ্গবন্ধু নমনীয় হয়ে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে নিয়ে, আরও নানা শর্ত মেনে নিয়ে ইয়াহিয়াকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছিলেন। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শক্ত অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শক্ত হতে গেলে নির্বাচনই হতো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই-ই চাই, এমন ইগো ত্যাগ করে নিশ্চিত সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি অবকাঠামো দাঁড় করানোর তাগিদে সরকারের সঙ্গে সহজ ভঙ্গিতে কথা বলার জন্য বিরোধী দলকে অনুরোধ জানাব। ৫টি সিটি নির্বাচনের ফলাফল তাদের অহমিকাগ্রস্ত না করুক, সে আশাই করছি।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই শক্তের ভক্ত নরমের যম। অবশ্য কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম আছে। যারা বর্তমান সরকারকে পদে পদে সমালোচনা করে নাকাল করেছেন, এক-এগারোর পর সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকারকে কেমন তোয়াক্কা করেছেন তারা, তা বেশ মনে আছে আমাদের। আসলে কেন জানি আমাদের পেটে গণতন্ত্রের ঘি হজম হতে চায় না। প্রমথ চৌধুরী এক প্রবন্ধে বলেছেন, আমরা সাংঘাতিক রকম ইতি ইতি না হয় নেতি নেতি। মানলে ইট-কাঠ-গাছপালাও দেবতা, না মানলে স্বয়ং ভগবানও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। আমাদর রাজনীতির মাঠেও এমন প্রবণতা আছে। দেবতা মানতে দেখেছি সেনা, আমলা, সুশীল সমন্বিত অনির্বাচিত সরকারকে। অথচ তারা দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, অখ্যাত লোকদের মাঠে নামিয়ে একটা পাপেট দল খাড়া করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিকদের চরিত্র হনন শুরু করেছিলেন। জেলখানা ভরে ফেলেছিলেন রাজনীতিকদের ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে। জনপ্রিয় এমপি, মেয়ররা পর্যন্ত জেলের ঘানি টেনেছেন। দুই নেত্রীকে জেলে ঢোকালেন। নির্দেশ জারি করলেন, দলের সংস্কার করতে হবে। তারপর বললেন, দুই নেত্রীকে দেশ ছাড়তে হবে। কী সাংঘাতিক কথা! তখনও টিভি মিডিয়ায় টকশো চলত। টকশোওয়ালারা দুই নেত্রী আর দুই দলের নিন্দা করতে লাগলেন বড়ই তৃপ্তির সঙ্গে। এক জাঁদরেল উপদেষ্টা বললেন, আমাদের দুই নেত্রী সেনাবাহিনীকে তুচ্ছজ্ঞান করেন, এটা চলবে না, সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার অংশ দিতে হবে। তিনি তার কলামে অহরহ গণতন্ত্রের সবক দিয়ে থাকেন।
এমন চাঁদের অমাবস্যা, এমন ঘোর দুর্দিন আমরা আর চাই না। আমরা চাই জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। আমরা চাই সংসদীয় গণতন্ত্র, সংসদকেন্দ্রিক রাজনীতি। আমরা চাই, সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রাণবন্ত তর্ক হোক। আমরা চাই, বাংলাদেশে সার্বক্ষণিক গণতন্ত্রের চর্চা হোক। গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা কোনো পক্ষেরই উচিত হবে না। বড় দুই দলের উভয়পক্ষ যদি ইগো ত্যাগ করে; সদিচ্ছা নিয়ে, প্রত্যেকে ছাড় দিয়ে নির্বাচনকালীন তিন মাসের সরকার গঠনে এগিয়ে আসে, তাহলে দেশ বিপদ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। রাজনীতিকরা নিশ্চয়ই চান না আমাদের দেশটা সিরিয়া, মিসর, আফগানিস্তানের পথ ধরুক। নির্বাচন যাতে কারচুপিমুক্ত হয়, যাতে সুষ্ঠু, অভিযোগমুক্ত হয়- এ টার্গেট নিয়ে গণতন্ত্রই শুধু নয়, দেশের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা এগিয়ে আসবেন বলে আমরা আশা করছি। যুদ্ধংদেহি মনোভাব ত্যাগ করুন, একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করুন। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক হতে পারলেন, এক-এগারোর পর নাকাল অবস্থার মধ্যে একে অপরের কাছাকাছি আসতে পারলে এখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে কেন নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে একমত হতে পারবেন না? ছাড় না দিলে মীমাংসা হয় না। মনটা সব সময় জটিল করে রাখতে নেই, একটু সরলতার দরকার আছে। মহাÍা গান্ধীও অনেক সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ছাড় দিয়ে মীমাংসার জন্য আলোচনার টেবিলে বসেছেন। তাতে তিনি খাটো হয়ে যাননি। তালেবানের মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রয়োজন অনুভব করছে মহাপ্রতাপশালী মার্কিন সরকার। তাহলে আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দল কেন মাত্র একটি ইস্যুতে এক হতে পারবে না?
১৮ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন হলে সে নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা নিশ্চিত। যেদিন বিরোধীদলীয় নেতা বললেন, তারা বিচারপতি খায়রুল হককে প্রধান উপদেষ্টা মানবেন না, তখনই প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কোদালের মতো বাঁকা হয়ে গেছেন। সবকিছুই কি নিজেদের ইচ্ছামতো হয়? শীতের দিনের কাঁথা দিনে আপনার আর রাতে আমার, গাছের গোড়ার অংশ আপনার আর মাথার অংশ আমার, গাভীর সামনের অংশ আপনার আর পেছনের অংশ আমার- এমন মনগড়া পরিকল্পনা কেউ মানে নাকি? বঙ্গবন্ধু নমনীয় হয়ে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে নিয়ে, আরও নানা শর্ত মেনে নিয়ে ইয়াহিয়াকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছিলেন। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শক্ত অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শক্ত হতে গেলে নির্বাচনই হতো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই-ই চাই, এমন ইগো ত্যাগ করে নিশ্চিত সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি অবকাঠামো দাঁড় করানোর তাগিদে সরকারের সঙ্গে সহজ ভঙ্গিতে কথা বলার জন্য বিরোধী দলকে অনুরোধ জানাব। ৫টি সিটি নির্বাচনের ফলাফল তাদের অহমিকাগ্রস্ত না করুক, সে আশাই করছি।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক
No comments