বাংলাদেশের অনিশ্চিত যাত্রা by আলী রীয়াজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্পষ্ট ভাষায়
বলেছেন যে আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই হবে। তাঁর ভাষায়, ‘জনগণের
ভোট নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছি।
যা হবে, সংবিধান মোতাবেক
হবে। একচুলও নড়া হবে না, ব্যস।’ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে দলের
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে তাঁরা এই
সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। খালেদা জিয়া আরও কঠিন ভাষায়
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন, ‘বাতাসে গেলেই চুল উড়ে যাবে।
জনগণের আন্দোলনের বাতাসে চুল তো থাকবেই না, সব এলোমেলো হয়ে যাবে। দিশেহারা
হয়ে যাবেন।’ ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক
সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ বলেছেন, বিএনপি না গেলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তাঁর
দলও অংশ নেবে না।
বিএনপির শরিক জামায়াতে ইসলামী এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি, কেননা তারা এখন কার্যত অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যাপৃত এবং আদালতের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে তাদের নিবন্ধন না থাকারই আশঙ্কা বেশি। তবে অনুমান করতে পারি যে বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে দলটি নির্বাচনে যাবে না, এমনকি সুযোগ থাকলেও। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আইনজীবী মইনুল হোসেন সংসদ নির্বাচন নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমি সব সময় বলে আসছি, নির্বাচন হবে না। ক্ষমতা ছাড়ার সম্ভাবনা আছে এমন কোনো নির্বাচন আওয়ামী লীগ করবে না।’
গত কয়েক দিনের এসব উক্তি একার্থে নতুন কিছু নয়, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী বলে এসেছেন যে তাঁর দল এ নিয়ে কোনো রকম আপসের পথে পা বাড়াবে না। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সরকারের নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক’ হবে, না ‘অন্তর্বর্তী’ হবে, সে ব্যাপারে আপসের কথা বললেও সরকারের চরিত্রের মর্মবস্তুর দিক থেকে কোনো আপসেই রাজি নন। কিন্তু তার পরেও এই কথাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে এমন সময়ে, যখন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা খুব ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না।
এসব বক্তব্যে আমরা তিনটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বা দৃশ্যকল্প (সিনারিও) দেখতে পাই। প্রধানমন্ত্রী যখন নির্বাচনের সময়কার সরকার নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি নিঃসন্দেহে সবার অংশগ্রহণের নির্বাচনের কথাই বলেন বলে আমরা ধরে নিতে পারি। এটি একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, একটি সিনারিও বা দৃশ্যকল্প। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলে, তখন দ্বিতীয় সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প তৈরি হয়: তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন। বিএনপির দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে দল নির্বাচনে যাবে না। তৃতীয় দৃশ্যকল্পের কথা বলেন আইনজীবী মইনুল হোসেন, তিনি সম্ভবত অনেকের মনের আশঙ্কাকেই তুলে ধরেছেন—নির্বাচন না হওয়া। রাজনীতিতে সুস্পষ্টভাবে কোনো দলের প্রতি পক্ষপাত না থাকলে যেকোনো নাগরিকের মনেই প্রশ্ন উঠবে যে এই তিন দৃশ্যকল্পের কোনটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলে যে এই তিন দৃশ্যকল্পের কোনোটাই নেহাত কল্পনা নয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের ইতিহাসে সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি আছে কার্যত এককভাবে, বিরোধী দল তৈরি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বিরোধীদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও সংসদ গঠিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের আন্দোলনের পর আশা করা হয়েছিল যে তার অবসান হবে। তা যে হয়নি সেটাও আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। চারটি নির্বাচন সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে হয়েছে। এর দুটো হয়েছে সময়মতো; বাকি দুটোকে সময়মতো বলা যাবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এককভাবে সরকারি দলের নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়নি, শেষ পর্যন্ত তা হয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। মাঝের দুই বছরে অনেক ঘটনাই ঘটেছে; নির্বাচন যে নির্ধারিত সময়ে হয়নি সে কথা সবাই স্বীকার করবেন। ফলে এই তিন দৃশ্যকল্পের যেকোনো একটিকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেওয়ার অবকাশ নেই।
এসব নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ১৯৯১ সালের আগে ও পরে একটা বিষয় আমাদের অবশ্যই শিক্ষা দিয়েছে; তা হলো সব দল অংশ না নিলে সেই নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি সংসদ তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারে না; তার গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না। এর পাশাপাশি এই পরিহাসের দিকটি তুলে না ধরলে অন্যায় হবে যে আজকে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের টানাহেঁচড়া, তার সাংবিধানিক রূপ তৈরি হয়েছিল এমনই একটি সংসদের হাতে, যা কেবল অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল তা নয়, উপরন্তু এর মেয়াদও ছিল বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম।
কিন্তু আগের যেকোনো সময়ের সঙ্গে এখনকার অবস্থার তুলনা একার্থে খুব সাহায্য না-ও করতে পারে। কেননা, এখনকার পরিস্থিতি বড়জোর তুলনীয় ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকের সঙ্গে। সে সময়ও সংবিধানে এই ব্যবস্থা ছিল না যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য বিরোধীদের দাবি মানা যেতে পারে। কিন্তু তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র একবারের এবং তা প্রীতিকরই ছিল। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা, বিশেষত ক্ষমতাসীনেরা, অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। এর মধ্যে একটা অভিজ্ঞতা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন সরকার আর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে না। শুধু তা-ই নয়, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা কমবেশি সব রাজনীতিবিদের জন্যই অস্বস্তিকর। প্রধানমন্ত্রী সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে মোটেই কুণ্ঠিত হন না। এমনকি ২১ জুন আওয়ামী লীগের ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি বিরোধী নেতার উদ্দেশে বলেন: ‘আগামীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আসলে আপনাকেও আবার জেলে যেতে হবে, আমাকেও যেতে হবে।’
এই তিনটি দৃশ্যকল্পের বিবেচনার পাশাপাশি ভালো করে লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই যে নির্বাচন পর্যন্ত যে সময় রয়েছে, তাকে তিনটি সময় পরিসরে ভাগ করা যায়। এই তিন ভাগের মধ্যে তিনটি প্রধান ঘটনা রয়েছে। একটি হলো, প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন-প্রক্রিয়া শুরু করার দিন ২৭ অক্টোবর ২০১৩; নির্বাচন তা যে দিনই হোক না কেন, অবশ্য সংবিধানের এক ধারা অনুযায়ী নির্বাচন ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে হবে; এবং ২৪ জানুয়ারি ২০১৪, যেদিন সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে। এই তিনটি প্রধান ঘটনাকে সামনে রেখে আমরা দেখতে পাই, এখন থেকে ২৭ অক্টোবর একটা সময় পরিসর যখন এই সরকার বহাল থাকবে এবং সংসদ সক্রিয় থাকবে; দ্বিতীয় সময় পরিসর হলো ২৭ অক্টোবর থেকে নির্বাচন বা ২৪ জানুয়ারি ২০১৪, যেদিন সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করবে। যদি নির্বাচন ২৪ জানুয়ারির আগে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলেও সংসদের মেয়াদের ক্ষেত্রে তার অন্যথা ঘটে না। তৃতীয় সময় পরিসর হলো নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতি বা ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পরবর্তী পরিস্থিতি যখন এই সংসদ আর কার্যকর থাকবে না এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাবে। আমরা এই তারিখগুলোকে বিবেচনায় নিচ্ছি সংবিধানের ১২৩ (৩) ধারার আলোকে, যেখানে বলা হচ্ছে যে ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বুই দিনের মধ্যে সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’
যে তিনটি দৃশ্যকল্পের কথা আমি উল্লেখ করেছি তার কোনোটিই এক দিনে ঘটবে না। তার ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাব যে তিনটি সময়ের কথা আমরা বলেছি সেই সময়ে, ক্ষেত্রবিশেষে পর্যায়ক্রমিকভাবে। অর্থাৎ এখন থেকে ঘটনাবলির দিকে নজর রাখলে আমরা হয়তো বুঝতে পারব যে কোন দৃশ্যকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর যেকোনো একটি বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য কিছু ঘটনাকে পূর্বশর্ত বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও এ কথা সত্য যে একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার জন্ম দিতে পারে, ঘটনা পরম্পরায় অনেক সময় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়: কিন্তু ঘটনার পেছনে থাকে ক্রীড়নক। অর্থাৎ রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তির ভূমিকাই ঘটনার জন্ম দেয় ও তা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এই তিনটি দৃশ্যকল্পের ক্ষেত্রেও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, কাদের ভূমিকা কখন প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ একটি সময়ে কোনো শক্তির বা রাজনৈতিক ক্রীড়নকের ভূমিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ এই নয় যে সেই শক্তি পরবর্তী সময়কালেও অব্যাহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকবে। বরং কোনো কোনো প্রধান শক্তির ব্যর্থতাই অন্য দৃশ্যকল্প তৈরির পথ সুগম করে। ফলে কোন দৃশ্যকল্পের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি এগোচ্ছে, তা বোঝার জন্য সময়ের পাশাপাশি আমাদের নজর রাখতে হবে এই শক্তিগুলোর ওপরে। কোন সময়ে কোন ঘটনাধারার ওপরে আমাদের নজর রাখা দরকার, কোন ঘটনা কিসের ইঙ্গিত দেবে এবং কোন শক্তিগুলো কোন দৃশ্যকল্পে প্রধান হয়ে উঠবে তার আলোচনা পরের কিস্তিতে।
লেখকঃ আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
বিএনপির শরিক জামায়াতে ইসলামী এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি, কেননা তারা এখন কার্যত অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যাপৃত এবং আদালতের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে তাদের নিবন্ধন না থাকারই আশঙ্কা বেশি। তবে অনুমান করতে পারি যে বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে দলটি নির্বাচনে যাবে না, এমনকি সুযোগ থাকলেও। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আইনজীবী মইনুল হোসেন সংসদ নির্বাচন নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমি সব সময় বলে আসছি, নির্বাচন হবে না। ক্ষমতা ছাড়ার সম্ভাবনা আছে এমন কোনো নির্বাচন আওয়ামী লীগ করবে না।’
গত কয়েক দিনের এসব উক্তি একার্থে নতুন কিছু নয়, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী বলে এসেছেন যে তাঁর দল এ নিয়ে কোনো রকম আপসের পথে পা বাড়াবে না। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সরকারের নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক’ হবে, না ‘অন্তর্বর্তী’ হবে, সে ব্যাপারে আপসের কথা বললেও সরকারের চরিত্রের মর্মবস্তুর দিক থেকে কোনো আপসেই রাজি নন। কিন্তু তার পরেও এই কথাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে এমন সময়ে, যখন নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা খুব ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না।
এসব বক্তব্যে আমরা তিনটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বা দৃশ্যকল্প (সিনারিও) দেখতে পাই। প্রধানমন্ত্রী যখন নির্বাচনের সময়কার সরকার নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি নিঃসন্দেহে সবার অংশগ্রহণের নির্বাচনের কথাই বলেন বলে আমরা ধরে নিতে পারি। এটি একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, একটি সিনারিও বা দৃশ্যকল্প। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলে, তখন দ্বিতীয় সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প তৈরি হয়: তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন। বিএনপির দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে দল নির্বাচনে যাবে না। তৃতীয় দৃশ্যকল্পের কথা বলেন আইনজীবী মইনুল হোসেন, তিনি সম্ভবত অনেকের মনের আশঙ্কাকেই তুলে ধরেছেন—নির্বাচন না হওয়া। রাজনীতিতে সুস্পষ্টভাবে কোনো দলের প্রতি পক্ষপাত না থাকলে যেকোনো নাগরিকের মনেই প্রশ্ন উঠবে যে এই তিন দৃশ্যকল্পের কোনটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলে যে এই তিন দৃশ্যকল্পের কোনোটাই নেহাত কল্পনা নয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের ইতিহাসে সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি আছে কার্যত এককভাবে, বিরোধী দল তৈরি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বিরোধীদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও সংসদ গঠিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের আন্দোলনের পর আশা করা হয়েছিল যে তার অবসান হবে। তা যে হয়নি সেটাও আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। চারটি নির্বাচন সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে হয়েছে। এর দুটো হয়েছে সময়মতো; বাকি দুটোকে সময়মতো বলা যাবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এককভাবে সরকারি দলের নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়নি, শেষ পর্যন্ত তা হয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। মাঝের দুই বছরে অনেক ঘটনাই ঘটেছে; নির্বাচন যে নির্ধারিত সময়ে হয়নি সে কথা সবাই স্বীকার করবেন। ফলে এই তিন দৃশ্যকল্পের যেকোনো একটিকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেওয়ার অবকাশ নেই।
এসব নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ১৯৯১ সালের আগে ও পরে একটা বিষয় আমাদের অবশ্যই শিক্ষা দিয়েছে; তা হলো সব দল অংশ না নিলে সেই নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি সংসদ তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারে না; তার গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না। এর পাশাপাশি এই পরিহাসের দিকটি তুলে না ধরলে অন্যায় হবে যে আজকে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের টানাহেঁচড়া, তার সাংবিধানিক রূপ তৈরি হয়েছিল এমনই একটি সংসদের হাতে, যা কেবল অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল তা নয়, উপরন্তু এর মেয়াদও ছিল বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম।
কিন্তু আগের যেকোনো সময়ের সঙ্গে এখনকার অবস্থার তুলনা একার্থে খুব সাহায্য না-ও করতে পারে। কেননা, এখনকার পরিস্থিতি বড়জোর তুলনীয় ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকের সঙ্গে। সে সময়ও সংবিধানে এই ব্যবস্থা ছিল না যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য বিরোধীদের দাবি মানা যেতে পারে। কিন্তু তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র একবারের এবং তা প্রীতিকরই ছিল। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা, বিশেষত ক্ষমতাসীনেরা, অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। এর মধ্যে একটা অভিজ্ঞতা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অব্যবহিত আগের ক্ষমতাসীন সরকার আর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে না। শুধু তা-ই নয়, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা কমবেশি সব রাজনীতিবিদের জন্যই অস্বস্তিকর। প্রধানমন্ত্রী সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে মোটেই কুণ্ঠিত হন না। এমনকি ২১ জুন আওয়ামী লীগের ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি বিরোধী নেতার উদ্দেশে বলেন: ‘আগামীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আসলে আপনাকেও আবার জেলে যেতে হবে, আমাকেও যেতে হবে।’
এই তিনটি দৃশ্যকল্পের বিবেচনার পাশাপাশি ভালো করে লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই যে নির্বাচন পর্যন্ত যে সময় রয়েছে, তাকে তিনটি সময় পরিসরে ভাগ করা যায়। এই তিন ভাগের মধ্যে তিনটি প্রধান ঘটনা রয়েছে। একটি হলো, প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন-প্রক্রিয়া শুরু করার দিন ২৭ অক্টোবর ২০১৩; নির্বাচন তা যে দিনই হোক না কেন, অবশ্য সংবিধানের এক ধারা অনুযায়ী নির্বাচন ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে হবে; এবং ২৪ জানুয়ারি ২০১৪, যেদিন সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে। এই তিনটি প্রধান ঘটনাকে সামনে রেখে আমরা দেখতে পাই, এখন থেকে ২৭ অক্টোবর একটা সময় পরিসর যখন এই সরকার বহাল থাকবে এবং সংসদ সক্রিয় থাকবে; দ্বিতীয় সময় পরিসর হলো ২৭ অক্টোবর থেকে নির্বাচন বা ২৪ জানুয়ারি ২০১৪, যেদিন সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করবে। যদি নির্বাচন ২৪ জানুয়ারির আগে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলেও সংসদের মেয়াদের ক্ষেত্রে তার অন্যথা ঘটে না। তৃতীয় সময় পরিসর হলো নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতি বা ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পরবর্তী পরিস্থিতি যখন এই সংসদ আর কার্যকর থাকবে না এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাবে। আমরা এই তারিখগুলোকে বিবেচনায় নিচ্ছি সংবিধানের ১২৩ (৩) ধারার আলোকে, যেখানে বলা হচ্ছে যে ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বুই দিনের মধ্যে সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’
যে তিনটি দৃশ্যকল্পের কথা আমি উল্লেখ করেছি তার কোনোটিই এক দিনে ঘটবে না। তার ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাব যে তিনটি সময়ের কথা আমরা বলেছি সেই সময়ে, ক্ষেত্রবিশেষে পর্যায়ক্রমিকভাবে। অর্থাৎ এখন থেকে ঘটনাবলির দিকে নজর রাখলে আমরা হয়তো বুঝতে পারব যে কোন দৃশ্যকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর যেকোনো একটি বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য কিছু ঘটনাকে পূর্বশর্ত বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও এ কথা সত্য যে একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার জন্ম দিতে পারে, ঘটনা পরম্পরায় অনেক সময় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়: কিন্তু ঘটনার পেছনে থাকে ক্রীড়নক। অর্থাৎ রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তির ভূমিকাই ঘটনার জন্ম দেয় ও তা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এই তিনটি দৃশ্যকল্পের ক্ষেত্রেও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, কাদের ভূমিকা কখন প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ একটি সময়ে কোনো শক্তির বা রাজনৈতিক ক্রীড়নকের ভূমিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ এই নয় যে সেই শক্তি পরবর্তী সময়কালেও অব্যাহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকবে। বরং কোনো কোনো প্রধান শক্তির ব্যর্থতাই অন্য দৃশ্যকল্প তৈরির পথ সুগম করে। ফলে কোন দৃশ্যকল্পের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি এগোচ্ছে, তা বোঝার জন্য সময়ের পাশাপাশি আমাদের নজর রাখতে হবে এই শক্তিগুলোর ওপরে। কোন সময়ে কোন ঘটনাধারার ওপরে আমাদের নজর রাখা দরকার, কোন ঘটনা কিসের ইঙ্গিত দেবে এবং কোন শক্তিগুলো কোন দৃশ্যকল্পে প্রধান হয়ে উঠবে তার আলোচনা পরের কিস্তিতে।
লেখকঃ আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments