কালো আইন, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা by ফরহাদ মজহার
মাহমুদুর
রহমান একবার আদালত অবমাননার দায়ে জেল খেটেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন।
দ্বিতীয়বারও তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন চালানো
হয়েছে। তার মতাদর্শ ও রাজনীতির বিরোধীরা এতে পুলকিত হয়েছেন, তার সমর্থকরা
তার পক্ষে লড়ে গেছেন। এই দুই পক্ষের বাইরেও অনেকে রয়েছেন যারা শুধু
মাহমুদুর রহমান কেন, যে কোনো ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার নীতি
অলংঘনীয় গণ্য করেন। তারা মাহমুদুর রহমানের মতাদর্শ ও রাজনীতির বিরোধী, সেটা
তারা বলেছেনও, কিন্তু তার অধিকার রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করেছেন। তারা
সেই নীতির জায়গায় দাঁড়িয়েই গ্রেফতার ও দমন-পীড়নের নিন্দা করেছেন। যদি তা না
করা হয় তাহলে রাষ্ট্র একটি ভীতিকর নিপীড়নের যন্ত্র হয়ে ওঠে; আর
ক্ষমতাসীনরা সেই যন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে
অস্থিতিশীল করে তোলে। রাষ্ট্র বা সরকারের বাইরের কেউ নয়, সরকার নিজেও সমাজ ও
রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। যারা এখন ক্ষমতায়, তারা বিতাড়িত হলে
বিরোধী পক্ষও উল্টা তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একই আচরণ করতে পারে।
সাধারণভাবে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সরাসরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে
জড়িত। রাষ্ট্র গড়বার গোড়ায় বা ভিত্তিতে যদি এই অধিকারগুলো স্বীকৃত না থাকে
তাহলে নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে দয়াভিক্ষা করে এই অধিকার
কায়েম করা যায় না।
বাংলাদেশে নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘন এবং তাকে কেন্দ্র করে সমাজে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যে ধরন আমরা লক্ষ্য করি, তার অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে কোনো নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা কেন বা কী কারণে সংস্কৃতি, রাজনীতি, সরকার ও রাষ্ট্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে সমাজে সচেতনতা খুবই কম। এই পরিস্থিতি ভীতিকর। ফলে এ ধরনের অধিকার লংঘনের ঘটনা যখন ঘটে তখন সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আসলে কী, সেই দিকগুলো অস্পষ্ট থেকে যায়। আইন নিয়ে যখন আমরা কথা বলি তখন আমরা শুধু আইন নিয়েই কথা বলি। আইনের দিক থেকে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা, গ্রেফতার করা, আদালতে তোলা ও বিচার সম্পন্ন করার একটা প্রক্রিয়া আছে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন থাকুক বা না থাকুক সেই প্রক্রিয়া মানাও নাগরিক ও মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। অভিযুক্তের পক্ষে ও বিপক্ষে নোংরা, কুৎসিত ও অশালীন তর্কবিতর্কের অধিক সমাজ আর অগ্রসর হতে পারে না। যারা মাহমুদুর রহমানের সমালোচক, তারা অবশ্যই তার সমালোচনা করবেন এবং তার পক্ষের যারা তার উত্তরও দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন সংবিধান ও আইনের অধীনে কোনো নাগরিককে অভিযুক্ত করে তখন তর্কের প্রসঙ্গ শুধু অভিযুক্ত নয়, একই সঙ্গে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও সরকারও বটে। যে কারণে কোনো কালো আইনে নাগরিকদের গ্রেফতার করলে আমরা কালো আইনের সমালোচনা করি এবং সে আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাই। আইনের শাসনের অর্থ কালো আইনের শাসন নয়, ঠিক একইভাবে সংবিধান মেনে চলার অর্থ নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘনকারী সংবিধান মেনে চলাও নয়। সেটা হতে পারে না। যেহেতু ‘আইন’ আছে, সে আইনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করলেই গণতান্ত্রিক নীতিনৈতিকতার জায়গা থেকে অভিযুক্ত ‘দোষী’ হবে তার কোনো কথা নেই। খোদ আইনটি কালো আইন কি-না সেটাও বিচার্য।
অভিযুক্তের ভূমিকা ও মতাদর্শের পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা চলুক, ক্ষতি নেই। মতাদর্শিক পার্থক্য ও রাজনৈতিক বিরোধিতা একটি সমাজের স্বাস্থ্যের লক্ষণ, রুগ্ণতার নয়। কিন্তু সবার আগে বুঝতে হবে একটি সমাজের রাজনৈতিক বিকাশের মাত্রা ও গতিশীলতা নির্ভর করে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকে সঠিক প্রশ্নগুলো ধরতে পাড়া, তোলা এবং তার মীমাংসার জন্য আন্তরিক তর্কবিতর্কের সংস্কৃতি বিকশিত করার সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যরে ওপর। যেমন ‘আদালত অবমাননা’র যে ঔপনিবেশিক আইন আমাদের দেশে বহাল রয়েছে তা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না। সুনির্দিষ্টভাবে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত না করলে আদালতের সমালোচনা কিভাবে ‘আদালত অবমাননা’ হয়? কোনো বিচারকের নীতিগর্হিত ভূমিকার সমালোচনা করলে সেটা ‘আদালত অবমাননা’ হয় কি-না। আরও গোড়ার প্রশ্ন, বিচারকরা কি আইন ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে? তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উপায় কী? এগুলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার গোড়ার প্রশ্ন। কিন্তু কংক্রিট সমস্যা হয়ে হাজির হওয়ার পরও গোড়ার প্রশ্নগুলো আমরা তুলি না, বা তুলতে পারি না। আমার ধারণা ছিল, মাহমুদুর রহমান নানা কারণে বিস্তর শত্র“ তৈরি করেছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে সমাজে একটি শক্তিশালী পক্ষ থাকা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়, যারা বিচারবুদ্ধি নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে কিভাবে তাকে শায়েস্তা করা যায় সেই দিকটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। কিন্তু মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খানের গ্রেফতার কেন্দ্র করে সমাজে যে প্রতিক্রিয়া দেখছি তাতে স্পষ্ট যে সমাজের অসুখ অনেক গভীরে। এর চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব সেটা আমি নিশ্চিত নই। এই অসুখ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে, সেটাও আমি অনুমান করতে পারছি না।
একজন মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনের প্রধানকে অপহরণের চেষ্টা এবং কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ৫৪ ধারায় গ্রেফতার, রিমান্ড চাওয়া এবং আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার তীব্র নিন্দা না করে প্রতিপক্ষরা যে যুক্তি তুলে ধরছেন সেটা হল ‘অধিকার’ তাদের প্রতিবেদনে ৬১ জনের শহীদ হওয়ার কথা বলেছে, এটা মিথ্যা। অতএব তথ্যপ্রযুক্তি আইন (Information & Communication Technology Act, 2006) অনুযায়ী তাকে শাস্তি পেতে হবে। যদি এই তথ্য হেফাজতিদের সমাবেশ সম্পর্কে না হয়ে যারা এ কথা বলছেন তাদের পক্ষের সমাবেশ হতো আর যারা মারা গেছে তারা টুপিওয়ালা মাদ্রাসার আলেম-ওলামা ছাত্র না হতো, তাহলে কিন্তু এই সংখ্যা নিয়ে বিবাদ হতো না। কারণ এর আগে ‘অধিকার’ বহু সংখ্যাই হাজির ও প্রচার করেছে, কিন্তু কেউই তাদের সততা বা সাধুতার প্রশ্ন তুলে ৫৪ ধারায় অধিকারের সম্পাদককে ধরে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেননি। আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অধিকারের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ আছে বলে দাবি করা হয়েছে, এখনও আদালতে তাকে পেশ করা হয়নি। তার আগেই তাকে গ্রেফতার শুধু নয়, তার অফিস থেকে কম্পিউটার ও অন্যান্য জিনিস গোয়েন্দা পুলিশ জব্দও করেছে। তর্কের খাতিরে ধরা যাক, অধিকার সঠিক সংখ্যা দেয়নি। তার জন্য তাকে গ্রেফতার করতে হবে কেন? সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যে ৫৭ ধারার কথা বলছে সেটা কি কালো আইন নয়? এই আইনের যে অপব্যবহার হবে সেটা পরিষ্কার। কালো আইন সম্পর্কে যারা সচেতন তারা এ আইনের বিরুদ্ধে লেখালিখি করেছেন। পাস হওয়ার শুরু থেকেই। এই কালো আইনটির বিরুদ্ধে জনমতও প্রবল। তারপরও আদিলুরের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারত, জামিন দিয়ে মামলা চলতে পারত। কিন্তু লজ্জার বিষয়, সংখ্যার তত্ত্ব দিয়ে তাকে গ্রেফতার, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেকে।
ইতিমধ্যে এই কালো আইনটিকে আরও কালো করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে কয়েকটি অপরাধ জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করার জন্য সংশোধিত আইনে ন্যূনতম ৭ বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২০০৬ সালে বানানো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজার বিধান ছিল।
নতুন সংশোধন অনুযায়ী কোনো পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করতে পারবে। আগে এ আইনে কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে পুলিশকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কন্ট্রোলারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। যে কোনো পুলিশ হলেই হবে না। কমপক্ষে সাব-ইন্সপেক্টর র্যাংকের হতে হবে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী পুলিশকে এ ধরনের কোনো আগাম অনুমতি নিতে হবে না, অভিযোগ পেলে যাকে খুশি তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে। পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে নিজেই মামলা করতে পারবে। আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করার সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ৬৯ বিধান অনুযায়ী আগাম অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই অনুমোদন ছিল না বলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে হয়েছে। এখন এসব অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে সরাসরি পুলিশকেই গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যাতে তারা দমন-পীড়ন চালাতে পারে। পুলিশ এখন কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে। আগে এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ জামিনযোগ্য ছিল। এখন এ আইনের অধীনে অভিযুক্ত হয়ে কেউ গ্রেফতার হলে তিনি আর জামিনও পাবেন না।
অনেকে সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, এর আগে অন্যরা কেউ আড়াই হাজার, কেউ তিন হাজার মারা গিয়েছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের ধরা হল না, অধিকারকে ধরা হল কেন? অধিকার বলেছে, এই সংখ্যাই শেষ নয়, তাদের তথ্য সংগ্রহ চলছে এবং তা আরও অনেক বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল অধিকারকে সঠিক তথ্য নির্ণয়ে সহযোগিতা করে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র অভিযোগের ফয়সালা করে। অধিকার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়েছে, এতে সরকারের বরং স্বস্তিবোধ করা উচিত ছিল। অধিকারের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের মূল উদ্দেশ্য তথ্যের সঠিকতা নিয়ে বিতর্ক নয়, বরং চলমান তদন্তকে বন্ধ করা। সেই কালোরাতে আরও কত শহীদ হয়েছে, সেই তদন্ত চলতে থাকলে সেটা বর্তমান সরকারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এটা সরকার ঠিকই বুঝেছে। সরকারের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ রয়েছে। সেই কালোরাতে নিহতদের তথ্য সংগ্রহ সেই অভিযোগের প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে।
বিপদ অন্যভাবেও ঘটতে পারে, যার নজির অনেকেই এখন দিচ্ছেন। যেমন আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে দুঃশাসনের সেই সময় (Reign of Terror 2001-2006) শিরোনামে ‘অন্ধকারের খণ্ড চিত্র’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছরে ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এই ‘দাবি’ কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে? যদি তার তালিকা সরকার চায়, আওয়ামী লীগ কি সেটা দিতে সক্ষম? দিতে ব্যর্থ হলে কি ওয়েবসাইটের কর্তাকে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার ও মামলা করা হবে? বলাবাহুল্য, অধিকারের সংখ্যা ঢালাও কোনো সংখ্যা নয়। ওপরে নজির দিয়েছি এ কারণে যে, সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক বিস্তর করা যায়। মূল কথা হচ্ছে, আসলে শাপলা চত্বরে দেশের কতজন নাগরিক শহীদ ও হতাহত হয়েছেন, তার সঠিক চিত্র সরকার প্রকাশ করতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এর ফয়সালা না করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। অথচ সরকার মানবাধিকার কর্মীর ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হওয়ার পথ গ্রহণ করেছে। আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করার যে কৈফিয়ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন, কূটনৈতিক মহলে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
মূল তর্কের বিষয়টা মোটেও সংখ্যার ঠিক বা বেঠিকতার বিষয় নয়, এটা আমাদের বুঝতে হবে। পুরোটাই রাজনৈতিক এবং এর পেছনে মানবাধিকার কর্মীদের শায়েস্তা করা যেমন, একই সঙ্গে ভীতি ও আতংক তৈরিই উদ্দেশ্য। মানবাধিকার লংঘনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে ছেদ ঘটাতে চায় ক্ষমতাসীনরা। মূল প্রশ্নটা নাগরিক ও মানবিক অধিকারের মামলা। সুনির্দিষ্টভাবে এ ক্ষেত্রে ইস্যুটা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং তার সাম্প্রতিক সংশোধনী। কোনো অভিযোগ ছাড়া ৫৪ ধারায় নাগরিকদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশকে দিতে আমরা রাজি কি-না। রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অপরাধের স্বীকৃতি আদায়ের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাজে একটি জনমত আছে, কিন্তু তাকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে আমরা হাজির করতে পারিনি। সমাজে চিন্তা ও মতাদর্শিক তর্কাতর্কি থাকুক, কিন্তু সব ধরনের কালো আইনের বিরোধিতা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এখনই না করা হয় তাহলে সরকারবিরোধী তথ্য, মত বা বক্তব্য প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সরকারি দমন-পীড়ন মতপ্রকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে। আমরা হুমকির মধ্যেই বাস করছি। সরকার সাইবার জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আসলে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আগে বলেছি, সমাজের রাজনৈতিক বিকাশের মাত্রা ও গতিশীলতা নির্ভর করে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকে সঠিক প্রশ্নগুলো ধরতে পারা, তোলা এবং তার মীমাংসার জন্য আন্তরিক তর্কবিতর্কের সংস্কৃতি বিকশিত করার সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য অর্জনের ওপর। এদিক থেকে আমরা জাহেলিয়া বা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে রয়েছি। নইলে রাষ্ট্রের পক্ষে সংবিধান বদলিয়ে এবং একের পর এক কালো আইন জারি করে দানব হয়ে ওঠা সম্ভব হতো না। এ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যাবে আশা করা বাতুলতা। রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন ভোগ করতে হবে আরও অনেককে। সব পক্ষেই। মাহমুদুর রহমান ও আদিলুর রহমান খান যেমন, তেমনি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, মশিউর রহমান, বিপ্লব অধিকারী শুভ্র ও রাসেল পারভেজও একই তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এ গ্রেফতার হয়েছেন। তাহলে এই কালো আইনের বিরুদ্ধে তো সমাজে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে ওঠাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করলে দেখব, এ আইনের হাত থেকে প্রত্যকে যার যার নিজের পক্ষের ব্যক্তিদের রেহাই দিতে রাজি, কিন্তু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যখন তার প্রয়োগ ঘটছে তখন তাতে পুলকিত ও উল্লসিত হয়ে উঠছে। যদি আরও গোড়ায় যাই তাহলে দেখব সমাজে আমাদের আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে খুবই কম। যেমন চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বিভিন্নজনে বিভিন্নভাবে এই ‘স্বাধীনতা’ ব্যাপারটা বোঝে। নিজের জন্য ‘স্বাধীনতা’ কিন্তু প্রতিপক্ষের জন্য দমন-পীড়ন। খুবই বিকৃত একটি সমাজে আমরা বাস করছি। চিন্তা ও মতপ্রকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনো সার্বজনীন মীমাংসাসূত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর দার্শনিক, সাংবিধানিক আর আইনি অর্থ ও বিচারের সঙ্গে ইউরোপের মিল নেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফলে সব দেশের জন্য একই পাজামা বানানোর দরকার নেই। সেই ক্ষেত্রে উচিত হচ্ছে, আমাদের নিজেদের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি বিবেচনা করে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির চেষ্টা করা, যাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সীমা আমরা বেঁধে দিতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মানবিক মর্যাদার নীতিকে অলংঘনীয় গণ্য করে চিন্তা ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সেটা বই, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম কিংবা সাইবার স্পেইস যাই হোক, যতক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে আমি আমার প্রকাশভঙ্গি দ্বারা অপরের মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করছি, ততক্ষণ নাগরিক হিসেবে আমার চিন্তা ও মতের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ একটি সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে ‘মানবিক মর্যাদা’ বলতে আমরা কী বুঝব তা নিয়ে পরের কোনো একটি লেখায় তর্ক হতে পারে। তবে ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’-এর নামে রাষ্ট্র যখন চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা নানা অজুহাতে খর্ব করে, তার বিরোধিতা করা দরকার। আমি মনে করি না অধিকারের সমস্যা সংখ্যার ঠিক-বেঠিকের মামলা। যারা অধিকারের সংখ্যা ভুল দাবি করছেন, তারা স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে তার ফয়সালা করতে ভয় পাচ্ছেন কেন? শেখ হাসিনার দাবি মিথ্যা হয়ে যাবে বলে? তাতে মন্ত্রীর মিথ্যা কথন ধরা পড়ে যাবে। তাই না? এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? গোড়ায় সমস্যাটা চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকারেরই প্রশ্ন। সে জন্য বলি, ব্যক্তি নিয়ে কথা না বলে ধারণাগত দিক নিয়ে কথা বললে আমরা আরও কাছাকাছি আসতে পারব। সেই তর্কের মধ্য দিয়েই যেতে রাজি হলে সমাজের বিভিন্ন পক্ষের কাছাকাছি আসার আদৌ কোনো বাস্তব শর্ত আছে কি-না সেটাও বোঝা যাবে। আমরা গর্তের কোথায় পড়ে আছি, হয়তো তারও একটা হদিস করা যাবে।
আজ হোক কাল হোক এই ময়লা গর্ত থেকে তো বেরিয়ে আসতে হবে। তাই না?
বাংলাদেশে নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘন এবং তাকে কেন্দ্র করে সমাজে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যে ধরন আমরা লক্ষ্য করি, তার অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে কোনো নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা কেন বা কী কারণে সংস্কৃতি, রাজনীতি, সরকার ও রাষ্ট্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে সমাজে সচেতনতা খুবই কম। এই পরিস্থিতি ভীতিকর। ফলে এ ধরনের অধিকার লংঘনের ঘটনা যখন ঘটে তখন সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আসলে কী, সেই দিকগুলো অস্পষ্ট থেকে যায়। আইন নিয়ে যখন আমরা কথা বলি তখন আমরা শুধু আইন নিয়েই কথা বলি। আইনের দিক থেকে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা, গ্রেফতার করা, আদালতে তোলা ও বিচার সম্পন্ন করার একটা প্রক্রিয়া আছে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন থাকুক বা না থাকুক সেই প্রক্রিয়া মানাও নাগরিক ও মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। অভিযুক্তের পক্ষে ও বিপক্ষে নোংরা, কুৎসিত ও অশালীন তর্কবিতর্কের অধিক সমাজ আর অগ্রসর হতে পারে না। যারা মাহমুদুর রহমানের সমালোচক, তারা অবশ্যই তার সমালোচনা করবেন এবং তার পক্ষের যারা তার উত্তরও দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন সংবিধান ও আইনের অধীনে কোনো নাগরিককে অভিযুক্ত করে তখন তর্কের প্রসঙ্গ শুধু অভিযুক্ত নয়, একই সঙ্গে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও সরকারও বটে। যে কারণে কোনো কালো আইনে নাগরিকদের গ্রেফতার করলে আমরা কালো আইনের সমালোচনা করি এবং সে আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাই। আইনের শাসনের অর্থ কালো আইনের শাসন নয়, ঠিক একইভাবে সংবিধান মেনে চলার অর্থ নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘনকারী সংবিধান মেনে চলাও নয়। সেটা হতে পারে না। যেহেতু ‘আইন’ আছে, সে আইনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করলেই গণতান্ত্রিক নীতিনৈতিকতার জায়গা থেকে অভিযুক্ত ‘দোষী’ হবে তার কোনো কথা নেই। খোদ আইনটি কালো আইন কি-না সেটাও বিচার্য।
অভিযুক্তের ভূমিকা ও মতাদর্শের পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা চলুক, ক্ষতি নেই। মতাদর্শিক পার্থক্য ও রাজনৈতিক বিরোধিতা একটি সমাজের স্বাস্থ্যের লক্ষণ, রুগ্ণতার নয়। কিন্তু সবার আগে বুঝতে হবে একটি সমাজের রাজনৈতিক বিকাশের মাত্রা ও গতিশীলতা নির্ভর করে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকে সঠিক প্রশ্নগুলো ধরতে পাড়া, তোলা এবং তার মীমাংসার জন্য আন্তরিক তর্কবিতর্কের সংস্কৃতি বিকশিত করার সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যরে ওপর। যেমন ‘আদালত অবমাননা’র যে ঔপনিবেশিক আইন আমাদের দেশে বহাল রয়েছে তা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না। সুনির্দিষ্টভাবে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত না করলে আদালতের সমালোচনা কিভাবে ‘আদালত অবমাননা’ হয়? কোনো বিচারকের নীতিগর্হিত ভূমিকার সমালোচনা করলে সেটা ‘আদালত অবমাননা’ হয় কি-না। আরও গোড়ার প্রশ্ন, বিচারকরা কি আইন ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে? তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উপায় কী? এগুলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার গোড়ার প্রশ্ন। কিন্তু কংক্রিট সমস্যা হয়ে হাজির হওয়ার পরও গোড়ার প্রশ্নগুলো আমরা তুলি না, বা তুলতে পারি না। আমার ধারণা ছিল, মাহমুদুর রহমান নানা কারণে বিস্তর শত্র“ তৈরি করেছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে সমাজে একটি শক্তিশালী পক্ষ থাকা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়, যারা বিচারবুদ্ধি নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে কিভাবে তাকে শায়েস্তা করা যায় সেই দিকটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। কিন্তু মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খানের গ্রেফতার কেন্দ্র করে সমাজে যে প্রতিক্রিয়া দেখছি তাতে স্পষ্ট যে সমাজের অসুখ অনেক গভীরে। এর চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব সেটা আমি নিশ্চিত নই। এই অসুখ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে, সেটাও আমি অনুমান করতে পারছি না।
একজন মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনের প্রধানকে অপহরণের চেষ্টা এবং কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ৫৪ ধারায় গ্রেফতার, রিমান্ড চাওয়া এবং আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার তীব্র নিন্দা না করে প্রতিপক্ষরা যে যুক্তি তুলে ধরছেন সেটা হল ‘অধিকার’ তাদের প্রতিবেদনে ৬১ জনের শহীদ হওয়ার কথা বলেছে, এটা মিথ্যা। অতএব তথ্যপ্রযুক্তি আইন (Information & Communication Technology Act, 2006) অনুযায়ী তাকে শাস্তি পেতে হবে। যদি এই তথ্য হেফাজতিদের সমাবেশ সম্পর্কে না হয়ে যারা এ কথা বলছেন তাদের পক্ষের সমাবেশ হতো আর যারা মারা গেছে তারা টুপিওয়ালা মাদ্রাসার আলেম-ওলামা ছাত্র না হতো, তাহলে কিন্তু এই সংখ্যা নিয়ে বিবাদ হতো না। কারণ এর আগে ‘অধিকার’ বহু সংখ্যাই হাজির ও প্রচার করেছে, কিন্তু কেউই তাদের সততা বা সাধুতার প্রশ্ন তুলে ৫৪ ধারায় অধিকারের সম্পাদককে ধরে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেননি। আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, যে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অধিকারের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ আছে বলে দাবি করা হয়েছে, এখনও আদালতে তাকে পেশ করা হয়নি। তার আগেই তাকে গ্রেফতার শুধু নয়, তার অফিস থেকে কম্পিউটার ও অন্যান্য জিনিস গোয়েন্দা পুলিশ জব্দও করেছে। তর্কের খাতিরে ধরা যাক, অধিকার সঠিক সংখ্যা দেয়নি। তার জন্য তাকে গ্রেফতার করতে হবে কেন? সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যে ৫৭ ধারার কথা বলছে সেটা কি কালো আইন নয়? এই আইনের যে অপব্যবহার হবে সেটা পরিষ্কার। কালো আইন সম্পর্কে যারা সচেতন তারা এ আইনের বিরুদ্ধে লেখালিখি করেছেন। পাস হওয়ার শুরু থেকেই। এই কালো আইনটির বিরুদ্ধে জনমতও প্রবল। তারপরও আদিলুরের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারত, জামিন দিয়ে মামলা চলতে পারত। কিন্তু লজ্জার বিষয়, সংখ্যার তত্ত্ব দিয়ে তাকে গ্রেফতার, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেকে।
ইতিমধ্যে এই কালো আইনটিকে আরও কালো করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে কয়েকটি অপরাধ জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করার জন্য সংশোধিত আইনে ন্যূনতম ৭ বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২০০৬ সালে বানানো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজার বিধান ছিল।
নতুন সংশোধন অনুযায়ী কোনো পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করতে পারবে। আগে এ আইনে কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে পুলিশকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কন্ট্রোলারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। যে কোনো পুলিশ হলেই হবে না। কমপক্ষে সাব-ইন্সপেক্টর র্যাংকের হতে হবে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী পুলিশকে এ ধরনের কোনো আগাম অনুমতি নিতে হবে না, অভিযোগ পেলে যাকে খুশি তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে। পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে নিজেই মামলা করতে পারবে। আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করার সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ৬৯ বিধান অনুযায়ী আগাম অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই অনুমোদন ছিল না বলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে হয়েছে। এখন এসব অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে সরাসরি পুলিশকেই গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যাতে তারা দমন-পীড়ন চালাতে পারে। পুলিশ এখন কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে। আগে এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ জামিনযোগ্য ছিল। এখন এ আইনের অধীনে অভিযুক্ত হয়ে কেউ গ্রেফতার হলে তিনি আর জামিনও পাবেন না।
অনেকে সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, এর আগে অন্যরা কেউ আড়াই হাজার, কেউ তিন হাজার মারা গিয়েছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের ধরা হল না, অধিকারকে ধরা হল কেন? অধিকার বলেছে, এই সংখ্যাই শেষ নয়, তাদের তথ্য সংগ্রহ চলছে এবং তা আরও অনেক বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল অধিকারকে সঠিক তথ্য নির্ণয়ে সহযোগিতা করে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র অভিযোগের ফয়সালা করে। অধিকার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়েছে, এতে সরকারের বরং স্বস্তিবোধ করা উচিত ছিল। অধিকারের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের মূল উদ্দেশ্য তথ্যের সঠিকতা নিয়ে বিতর্ক নয়, বরং চলমান তদন্তকে বন্ধ করা। সেই কালোরাতে আরও কত শহীদ হয়েছে, সেই তদন্ত চলতে থাকলে সেটা বর্তমান সরকারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এটা সরকার ঠিকই বুঝেছে। সরকারের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ রয়েছে। সেই কালোরাতে নিহতদের তথ্য সংগ্রহ সেই অভিযোগের প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে।
বিপদ অন্যভাবেও ঘটতে পারে, যার নজির অনেকেই এখন দিচ্ছেন। যেমন আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে দুঃশাসনের সেই সময় (Reign of Terror 2001-2006) শিরোনামে ‘অন্ধকারের খণ্ড চিত্র’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছরে ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এই ‘দাবি’ কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে? যদি তার তালিকা সরকার চায়, আওয়ামী লীগ কি সেটা দিতে সক্ষম? দিতে ব্যর্থ হলে কি ওয়েবসাইটের কর্তাকে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার ও মামলা করা হবে? বলাবাহুল্য, অধিকারের সংখ্যা ঢালাও কোনো সংখ্যা নয়। ওপরে নজির দিয়েছি এ কারণে যে, সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক বিস্তর করা যায়। মূল কথা হচ্ছে, আসলে শাপলা চত্বরে দেশের কতজন নাগরিক শহীদ ও হতাহত হয়েছেন, তার সঠিক চিত্র সরকার প্রকাশ করতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এর ফয়সালা না করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। অথচ সরকার মানবাধিকার কর্মীর ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হওয়ার পথ গ্রহণ করেছে। আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করার যে কৈফিয়ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন, কূটনৈতিক মহলে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
মূল তর্কের বিষয়টা মোটেও সংখ্যার ঠিক বা বেঠিকতার বিষয় নয়, এটা আমাদের বুঝতে হবে। পুরোটাই রাজনৈতিক এবং এর পেছনে মানবাধিকার কর্মীদের শায়েস্তা করা যেমন, একই সঙ্গে ভীতি ও আতংক তৈরিই উদ্দেশ্য। মানবাধিকার লংঘনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে ছেদ ঘটাতে চায় ক্ষমতাসীনরা। মূল প্রশ্নটা নাগরিক ও মানবিক অধিকারের মামলা। সুনির্দিষ্টভাবে এ ক্ষেত্রে ইস্যুটা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং তার সাম্প্রতিক সংশোধনী। কোনো অভিযোগ ছাড়া ৫৪ ধারায় নাগরিকদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশকে দিতে আমরা রাজি কি-না। রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অপরাধের স্বীকৃতি আদায়ের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাজে একটি জনমত আছে, কিন্তু তাকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে আমরা হাজির করতে পারিনি। সমাজে চিন্তা ও মতাদর্শিক তর্কাতর্কি থাকুক, কিন্তু সব ধরনের কালো আইনের বিরোধিতা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এখনই না করা হয় তাহলে সরকারবিরোধী তথ্য, মত বা বক্তব্য প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সরকারি দমন-পীড়ন মতপ্রকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে। আমরা হুমকির মধ্যেই বাস করছি। সরকার সাইবার জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আসলে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আগে বলেছি, সমাজের রাজনৈতিক বিকাশের মাত্রা ও গতিশীলতা নির্ভর করে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির দিক থেকে সঠিক প্রশ্নগুলো ধরতে পারা, তোলা এবং তার মীমাংসার জন্য আন্তরিক তর্কবিতর্কের সংস্কৃতি বিকশিত করার সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য অর্জনের ওপর। এদিক থেকে আমরা জাহেলিয়া বা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে রয়েছি। নইলে রাষ্ট্রের পক্ষে সংবিধান বদলিয়ে এবং একের পর এক কালো আইন জারি করে দানব হয়ে ওঠা সম্ভব হতো না। এ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যাবে আশা করা বাতুলতা। রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন ভোগ করতে হবে আরও অনেককে। সব পক্ষেই। মাহমুদুর রহমান ও আদিলুর রহমান খান যেমন, তেমনি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, মশিউর রহমান, বিপ্লব অধিকারী শুভ্র ও রাসেল পারভেজও একই তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এ গ্রেফতার হয়েছেন। তাহলে এই কালো আইনের বিরুদ্ধে তো সমাজে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে ওঠাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করলে দেখব, এ আইনের হাত থেকে প্রত্যকে যার যার নিজের পক্ষের ব্যক্তিদের রেহাই দিতে রাজি, কিন্তু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যখন তার প্রয়োগ ঘটছে তখন তাতে পুলকিত ও উল্লসিত হয়ে উঠছে। যদি আরও গোড়ায় যাই তাহলে দেখব সমাজে আমাদের আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে খুবই কম। যেমন চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বিভিন্নজনে বিভিন্নভাবে এই ‘স্বাধীনতা’ ব্যাপারটা বোঝে। নিজের জন্য ‘স্বাধীনতা’ কিন্তু প্রতিপক্ষের জন্য দমন-পীড়ন। খুবই বিকৃত একটি সমাজে আমরা বাস করছি। চিন্তা ও মতপ্রকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনো সার্বজনীন মীমাংসাসূত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর দার্শনিক, সাংবিধানিক আর আইনি অর্থ ও বিচারের সঙ্গে ইউরোপের মিল নেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফলে সব দেশের জন্য একই পাজামা বানানোর দরকার নেই। সেই ক্ষেত্রে উচিত হচ্ছে, আমাদের নিজেদের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি বিবেচনা করে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরির চেষ্টা করা, যাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সীমা আমরা বেঁধে দিতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মানবিক মর্যাদার নীতিকে অলংঘনীয় গণ্য করে চিন্তা ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সেটা বই, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম কিংবা সাইবার স্পেইস যাই হোক, যতক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে আমি আমার প্রকাশভঙ্গি দ্বারা অপরের মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করছি, ততক্ষণ নাগরিক হিসেবে আমার চিন্তা ও মতের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ একটি সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে ‘মানবিক মর্যাদা’ বলতে আমরা কী বুঝব তা নিয়ে পরের কোনো একটি লেখায় তর্ক হতে পারে। তবে ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’-এর নামে রাষ্ট্র যখন চিন্তা ও মতের স্বাধীনতা নানা অজুহাতে খর্ব করে, তার বিরোধিতা করা দরকার। আমি মনে করি না অধিকারের সমস্যা সংখ্যার ঠিক-বেঠিকের মামলা। যারা অধিকারের সংখ্যা ভুল দাবি করছেন, তারা স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে তার ফয়সালা করতে ভয় পাচ্ছেন কেন? শেখ হাসিনার দাবি মিথ্যা হয়ে যাবে বলে? তাতে মন্ত্রীর মিথ্যা কথন ধরা পড়ে যাবে। তাই না? এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? গোড়ায় সমস্যাটা চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকারেরই প্রশ্ন। সে জন্য বলি, ব্যক্তি নিয়ে কথা না বলে ধারণাগত দিক নিয়ে কথা বললে আমরা আরও কাছাকাছি আসতে পারব। সেই তর্কের মধ্য দিয়েই যেতে রাজি হলে সমাজের বিভিন্ন পক্ষের কাছাকাছি আসার আদৌ কোনো বাস্তব শর্ত আছে কি-না সেটাও বোঝা যাবে। আমরা গর্তের কোথায় পড়ে আছি, হয়তো তারও একটা হদিস করা যাবে।
আজ হোক কাল হোক এই ময়লা গর্ত থেকে তো বেরিয়ে আসতে হবে। তাই না?
No comments