স্মৃতিচারণা-‘শিকড়ের সন্ধান খুব জরুরি’ by কাইয়ুম চৌধুরী
শৈশব আমার জন্ম ১৯৩৪ সাল, ৯ মার্চ, ফেনীর পাদ্রি কুঠিতে। আমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনীর শর্শদীতে। আমরা তিন ভাই, ছয় বোন। আমি দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। যে জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি শৈশবজুড়েই। অন্য বাচ্চাদের মতোই শৈশব কেটেছে। তবে বাবা প্রচণ্ড সংস্কৃতিমনা লোক ছিলেন। বাবা শিশুদের জন্য লিখতেন, যদিও লেখা ছাপানোর প্রতি আগ্রহ ছিল না কখনোই। বাবার বন্ধুরা ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গোপাল হালদার, শচীনদেব
বর্মন প্রমুখ। বাবার সেই সাহিত্যপ্রীতি আমাদের প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছে ছোটবেলা থেকেই। ঘরে গ্রামোফোন ছিল। বাবা মাসের বেতনের পয়সা বাঁচিয়ে রেকর্ড কিনতেন। যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, তখন বাবা-মায়ের সঙ্গে হলে গিয়ে প্রথম ছবি দেখি জীবন-মরণ। ব্রিটিশ আমলের কথা বলছি, ১৯৩৯ সাল। নিতিন বসু পরিচালিত, অভিনয়ে ছিলেন কে এল সাইগল এবং লীলা দেশাই। বাড়িতে পত্রিকা রাখা হতো। ভারতবর্ষ প্রবাসী। ওতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ তখনকার নামকরা শিল্পীদের আঁকা ছবি ছাপা হতো। ওগুলো দেখতাম। মোট কথা বইপড়া, গান, সাহিত্য, ছবি দেখা—এসবের সঙ্গেই শৈশব কেটেছে। বাবাও খুব উৎসাহ দিতেন আমাদের। প্রথম স্কুল চট্টগ্রাম নরমাল হাইস্কুল।
ছবি আঁকার প্রতি ভালো লাগা ছিল। ছবি দেখতে ভালো লাগত। কিন্তু চিত্রশিল্পী হব, এটা কখনোই ভাবিনি স্কুলসময়ে। হাইস্কুলে উঠলাম। স্কুলে পত্রিকা বের হতো। হাতে লেখা পত্রিকাটির নাম ছিল প্রভাতী। ফেনী হাইস্কুলে তখন সেই পত্রিকায় ‘ইলাস্ট্রেশনের’ দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। চেষ্টা ছিল কীভাবে আরও ভালো করা যায়। কলকাতার ‘দেব সাহিত্য কুটির’ প্রকাশনার ছড়ার বই, রহস্য রোমাঞ্চ, কিশোর বই খুব পড়তাম তখন। কিশোর বয়সে সবারই যেমনটা হয় আরকি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজের বইয়ে প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত ইলাস্ট্রেশন করতেন। আমি খুব অবাক হয়ে দেখতাম তাঁর কাজ। এত সুন্দর, এত দক্ষতা। বলতে পারো, ইনিই আমার জীবনের আঁকাআঁকির প্রথম উৎসাহদাতা। আমার জীবনে ছবি আঁকার মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এখনো আমার কাছে ইলাস্ট্রেশনের মানের দিক থেকে শিল্পী প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজই সেরা। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা বেড়ে উঠেছি অবিভক্ত ভারতবর্ষে।
যেভাবে বেড়ে উঠি
ম্যাট্রিক পাস করলাম ১৯৪৯ সালে। বাবা জানতে চাইলেন যে কী নিয়ে পড়তে চাই। বললাম, ছবি আঁকার ওপর লেখাপড়া করব। আমি অঙ্কে খুব কাঁচা ছিলাম। অঙ্কভীতি ছিল। ভেবেছিলাম, আর্ট কলেজে পড়লে অঙ্ক করতে হবে না। আর তত দিনে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহও তৈরি হয়েছে। কিন্তু কলকাতায় বাবা পড়াবেন না জানালেন। তখন ময়মনসিংহে থাকি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তত দিনে ঢাকায় আর্ট কলেজ দিয়েছেন। বাবার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো আমাদের বাসায়। উনি আমার আঁকা ছবি দেখতে চাইলেন। দেখালাম। বললেন ঢাকায় যেতে। ভর্তি হলাম ঢাকা আর্ট কলেজে।
আর্ট কলেজ ছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের ওখানে। আমরা দ্বিতীয় ব্যাচ ছিলাম। ১৯৪৮-এর প্রথম ব্যাচ শিল্পী আমিনুল ইসলামদের। আমাদের ব্যাচের শিল্পী মুর্তজা বশীর, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, শিল্পী আবদুর রাজ্জাক—আমরা সব সময় স্কেচ করতাম। স্কেচ করতে ফুলবাড়ী রেলস্টেশনে যেতাম। তখন আর্ট কলেজের বেতন ছিল চার টাকা। বাবা বললেন, এত টাকা তিনি দিতে পারবেন না, ঘরে এতগুলো ভাইবোন তোমার। তাই বইয়ের ইলাস্ট্রেশনের কাজ শুরু করলাম। দেখা যেত, প্রকাশকের দেওয়ার কথা পাঁচ টাকা, কিন্তু কাজ শেষে দিতেন মাত্র আড়াই টাকা। ওটা নিয়েই চলতে হতো। মাত্র দুটো বাস তখন ঢাকা শহরে যাতায়াতের জন্য চলত। এত বড় বড় রাস্তা ছিল না। একটা মফস্বল শহরের মতো নিরিবিলি ছিল তোমাদের আজকের ঢাকা। বাসভাড়া ৬ পয়সা। মাঝে মাঝে বাসভাড়া বাঁচানোর চেষ্টা করতাম দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য। আমাদের মধ্যে ভালো অবস্থা ছিল রশিদের। মাঝে মাঝে আমরা ওকে পটিয়ে দুপুরের লাঞ্চ করতাম। ওর মনটাও অনেক বড় ছিল। ও এসব দুষ্টুমি বুঝত। ১৯৫৪ তে পাস করলাম।
তখন ও এখন
আমার মনে হয়, সময় অনেক বদলেছে। আমাদের সময়ে তো ছাত্রজীবনে আমরা খুব সিরিয়াসলি ছবি আঁকতাম। আউটডোর করতাম। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সাহেবও আমাদের নিয়ে আউটডোরে যেতেন। মনে আছে, একবার আমরা সহপাঠীরা মিলে গন্তব্যহীন হেঁটে বেরিয়ে ছবি এঁকেছি। সারা দিনই। কেউ লক্ষ করিনি কোথায় পৌঁছালাম। সন্ধ্যায় ফেরার সময় টনক নড়েছে সবার। এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোন জায়গা? বলল, টঙ্গী। প্রচণ্ড ক্লান্ত, হাঁটার শক্তি শেষ! কী আর, বাস ধরে ঘরে ফেরা। এখনকার ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনেই দেখেছি চাকরি করে। আমাদের সময়ে এত ফার্ম-টার্ম ছিল না। ফলে ছবি আঁকার পেছনেই পুরো সময় ব্যয় করেছি। শিক্ষকেরাও খুব সহযোগিতা করতেন। একটা পরিবারের মতো। এখনকার ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনে এত ব্যস্ত যে ছবি আঁকার জন্য সময় নেই তাদের। তারা আর বই পড়ে না। অবশ্য আমাদের সময়ে বড় বড় সাহিত্যিক-লেখকেরা শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করতেন, ওগুলো ওই বয়সের মানসিক গঠনে খুব প্রয়োজন। কিন্তু এখন সে রকম লেখক ও বই আমার চোখে পড়ে না। বইয়ের ইলাস্ট্রেশনও মানসম্মত নয়। আমাদেরই দোষ আসলে, আমরাই পারিনি নতুন প্রজন্মকে তৈরি করতে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এখন বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ বেড়েছে। যোগাযোগমাধ্যম ভালো। বই-পুস্তক পাওয়া যায়। আমরা ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের লাইব্রেরিতে যেতাম বাইরের শিল্পীদের ছবি দেখতে, জানতে। পরে অবশ্য ১৯৭৭-এ আমেরিকার ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী ভ্যান গঘ, পল গগাঁর আসল কাজ সামনাসামনি দেখি। ওটা আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত। আমার শরীর কাঁপছিল ভ্যান গঘের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে।
জয়নুল আবেদিন আমার দেখা সেরা শিক্ষক। তিনি তো আমাদের তৈরি করেছেন হাতে ধরে। একবার আউটডোরে নদীতে নৌকায় আমরা স্যারের সঙ্গে। দেখলাম, উনি কিছুই আঁকছেন না। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু আঁকছেন না কেন? বললেন, আরে, আগে তো নৌকোর দুলুনি অনুভব করতে হবে, না হলে নৌকোর ছবি আঁকবে কীভাবে? এই কাহিনি নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছি সাম্প্রতিক। উনি আমাদের কখনো বলতেন না, এভাবে করো বা ওভাবে করো। কিন্তু ছাত্রদের দেখাতেন কীভাবে একজন লোকশিল্পী মাধ্যমগত সীমাবদ্ধতার কারণে ‘মিনিমাইজ’ করেছে ফর্মগুলোকে। বিভিন্ন ধরনের পুতুল দেখাতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল। ওগুলো আমাদের দেখাতেন। একবার ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁকে আনলেন চারুকলায়। আমরা গান শুনলাম। লোকশিল্পীদের আনতেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতেন। এভাবে ছাত্রদের তৈরি করে সময় পার করেছেন। উনি যদি নিজের শিল্পকর্মের জন্য আরেকটু সময় দিতেন, তবে অবশ্যই আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে নতুন কিছু দিতে পারতেন।
একাত্তরে দেশের অবস্থা খারাপ। ‘শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আমি আর মুর্তজা কনভেনর ছিলাম। নামীদামি শিল্পীরা, সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবারই অবদান ছিল দেশের স্বাধীনতার পক্ষে।
যা করতে চাই
আমি চেষ্টা করি, আমার কাজে বাংলাদেশের স্বাদ থাকুক। লোকজ ফর্মকে ব্যবহার করি আমার মতো করে, রং ব্যবহারেও তেমনটাই পছন্দ। আমার ছবি ও ছবির বক্তব্য যেন সহজে বোধগম্য হয়। যদিও নানাভাবে নিরীক্ষাও করি। তেলরঙে কাজ করতে পছন্দ করি। তেলরঙের মাত্রাগত বৈশিষ্ট্য ভালো লাগে। অ্যাক্রিলিক দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ভালো। এ ছাড়া ভালো রঙের স্বচ্ছতা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। এখনকার অনেক শিল্পীর কাজেই ‘শিকড়’হীনতা। শিকড়ের সন্ধান খুব জরুরি। আধুনিকতা তো সময়ের দাবি, নিজ উৎসমূলের বাইরের বিষয় নয়। সামনে নকশিকাঁথার মোটিফ নিয়ে কাজ করছি। এ বছরের মার্চে একক প্রদর্শনী করব। আমার ৮০ বছর পূর্তি। সবাইকে নিমন্ত্রণ।
নবীন প্রজন্মকে বলব, মানুষের সাহিত্যশিল্পের সব বিষয়ে আগ্রহ থাকা উচিত। জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। আর যারা শিল্পচর্চা করে, তাদের আরও ব্যাপকভাবে বিচরণ করতে হবে শিল্পের সব জায়গায়। তবেই আসল গভীরতা তৈরি হয়, যা কাজের ক্ষেত্রে সুপ্রভাব ফেলে। নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে।
অনুলিখন: জাফরিন গুলশান।
ছবি আঁকার প্রতি ভালো লাগা ছিল। ছবি দেখতে ভালো লাগত। কিন্তু চিত্রশিল্পী হব, এটা কখনোই ভাবিনি স্কুলসময়ে। হাইস্কুলে উঠলাম। স্কুলে পত্রিকা বের হতো। হাতে লেখা পত্রিকাটির নাম ছিল প্রভাতী। ফেনী হাইস্কুলে তখন সেই পত্রিকায় ‘ইলাস্ট্রেশনের’ দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। চেষ্টা ছিল কীভাবে আরও ভালো করা যায়। কলকাতার ‘দেব সাহিত্য কুটির’ প্রকাশনার ছড়ার বই, রহস্য রোমাঞ্চ, কিশোর বই খুব পড়তাম তখন। কিশোর বয়সে সবারই যেমনটা হয় আরকি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজের বইয়ে প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত ইলাস্ট্রেশন করতেন। আমি খুব অবাক হয়ে দেখতাম তাঁর কাজ। এত সুন্দর, এত দক্ষতা। বলতে পারো, ইনিই আমার জীবনের আঁকাআঁকির প্রথম উৎসাহদাতা। আমার জীবনে ছবি আঁকার মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এখনো আমার কাছে ইলাস্ট্রেশনের মানের দিক থেকে শিল্পী প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজই সেরা। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা বেড়ে উঠেছি অবিভক্ত ভারতবর্ষে।
যেভাবে বেড়ে উঠি
ম্যাট্রিক পাস করলাম ১৯৪৯ সালে। বাবা জানতে চাইলেন যে কী নিয়ে পড়তে চাই। বললাম, ছবি আঁকার ওপর লেখাপড়া করব। আমি অঙ্কে খুব কাঁচা ছিলাম। অঙ্কভীতি ছিল। ভেবেছিলাম, আর্ট কলেজে পড়লে অঙ্ক করতে হবে না। আর তত দিনে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহও তৈরি হয়েছে। কিন্তু কলকাতায় বাবা পড়াবেন না জানালেন। তখন ময়মনসিংহে থাকি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তত দিনে ঢাকায় আর্ট কলেজ দিয়েছেন। বাবার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো আমাদের বাসায়। উনি আমার আঁকা ছবি দেখতে চাইলেন। দেখালাম। বললেন ঢাকায় যেতে। ভর্তি হলাম ঢাকা আর্ট কলেজে।
আর্ট কলেজ ছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের ওখানে। আমরা দ্বিতীয় ব্যাচ ছিলাম। ১৯৪৮-এর প্রথম ব্যাচ শিল্পী আমিনুল ইসলামদের। আমাদের ব্যাচের শিল্পী মুর্তজা বশীর, শিল্পী রশিদ চৌধুরী, শিল্পী আবদুর রাজ্জাক—আমরা সব সময় স্কেচ করতাম। স্কেচ করতে ফুলবাড়ী রেলস্টেশনে যেতাম। তখন আর্ট কলেজের বেতন ছিল চার টাকা। বাবা বললেন, এত টাকা তিনি দিতে পারবেন না, ঘরে এতগুলো ভাইবোন তোমার। তাই বইয়ের ইলাস্ট্রেশনের কাজ শুরু করলাম। দেখা যেত, প্রকাশকের দেওয়ার কথা পাঁচ টাকা, কিন্তু কাজ শেষে দিতেন মাত্র আড়াই টাকা। ওটা নিয়েই চলতে হতো। মাত্র দুটো বাস তখন ঢাকা শহরে যাতায়াতের জন্য চলত। এত বড় বড় রাস্তা ছিল না। একটা মফস্বল শহরের মতো নিরিবিলি ছিল তোমাদের আজকের ঢাকা। বাসভাড়া ৬ পয়সা। মাঝে মাঝে বাসভাড়া বাঁচানোর চেষ্টা করতাম দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য। আমাদের মধ্যে ভালো অবস্থা ছিল রশিদের। মাঝে মাঝে আমরা ওকে পটিয়ে দুপুরের লাঞ্চ করতাম। ওর মনটাও অনেক বড় ছিল। ও এসব দুষ্টুমি বুঝত। ১৯৫৪ তে পাস করলাম।
তখন ও এখন
আমার মনে হয়, সময় অনেক বদলেছে। আমাদের সময়ে তো ছাত্রজীবনে আমরা খুব সিরিয়াসলি ছবি আঁকতাম। আউটডোর করতাম। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সাহেবও আমাদের নিয়ে আউটডোরে যেতেন। মনে আছে, একবার আমরা সহপাঠীরা মিলে গন্তব্যহীন হেঁটে বেরিয়ে ছবি এঁকেছি। সারা দিনই। কেউ লক্ষ করিনি কোথায় পৌঁছালাম। সন্ধ্যায় ফেরার সময় টনক নড়েছে সবার। এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোন জায়গা? বলল, টঙ্গী। প্রচণ্ড ক্লান্ত, হাঁটার শক্তি শেষ! কী আর, বাস ধরে ঘরে ফেরা। এখনকার ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনেই দেখেছি চাকরি করে। আমাদের সময়ে এত ফার্ম-টার্ম ছিল না। ফলে ছবি আঁকার পেছনেই পুরো সময় ব্যয় করেছি। শিক্ষকেরাও খুব সহযোগিতা করতেন। একটা পরিবারের মতো। এখনকার ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনে এত ব্যস্ত যে ছবি আঁকার জন্য সময় নেই তাদের। তারা আর বই পড়ে না। অবশ্য আমাদের সময়ে বড় বড় সাহিত্যিক-লেখকেরা শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করতেন, ওগুলো ওই বয়সের মানসিক গঠনে খুব প্রয়োজন। কিন্তু এখন সে রকম লেখক ও বই আমার চোখে পড়ে না। বইয়ের ইলাস্ট্রেশনও মানসম্মত নয়। আমাদেরই দোষ আসলে, আমরাই পারিনি নতুন প্রজন্মকে তৈরি করতে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এখন বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ বেড়েছে। যোগাযোগমাধ্যম ভালো। বই-পুস্তক পাওয়া যায়। আমরা ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের লাইব্রেরিতে যেতাম বাইরের শিল্পীদের ছবি দেখতে, জানতে। পরে অবশ্য ১৯৭৭-এ আমেরিকার ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী ভ্যান গঘ, পল গগাঁর আসল কাজ সামনাসামনি দেখি। ওটা আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত। আমার শরীর কাঁপছিল ভ্যান গঘের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে।
জয়নুল আবেদিন আমার দেখা সেরা শিক্ষক। তিনি তো আমাদের তৈরি করেছেন হাতে ধরে। একবার আউটডোরে নদীতে নৌকায় আমরা স্যারের সঙ্গে। দেখলাম, উনি কিছুই আঁকছেন না। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু আঁকছেন না কেন? বললেন, আরে, আগে তো নৌকোর দুলুনি অনুভব করতে হবে, না হলে নৌকোর ছবি আঁকবে কীভাবে? এই কাহিনি নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছি সাম্প্রতিক। উনি আমাদের কখনো বলতেন না, এভাবে করো বা ওভাবে করো। কিন্তু ছাত্রদের দেখাতেন কীভাবে একজন লোকশিল্পী মাধ্যমগত সীমাবদ্ধতার কারণে ‘মিনিমাইজ’ করেছে ফর্মগুলোকে। বিভিন্ন ধরনের পুতুল দেখাতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল। ওগুলো আমাদের দেখাতেন। একবার ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁকে আনলেন চারুকলায়। আমরা গান শুনলাম। লোকশিল্পীদের আনতেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতেন। এভাবে ছাত্রদের তৈরি করে সময় পার করেছেন। উনি যদি নিজের শিল্পকর্মের জন্য আরেকটু সময় দিতেন, তবে অবশ্যই আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে নতুন কিছু দিতে পারতেন।
একাত্তরে দেশের অবস্থা খারাপ। ‘শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আমি আর মুর্তজা কনভেনর ছিলাম। নামীদামি শিল্পীরা, সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবারই অবদান ছিল দেশের স্বাধীনতার পক্ষে।
যা করতে চাই
আমি চেষ্টা করি, আমার কাজে বাংলাদেশের স্বাদ থাকুক। লোকজ ফর্মকে ব্যবহার করি আমার মতো করে, রং ব্যবহারেও তেমনটাই পছন্দ। আমার ছবি ও ছবির বক্তব্য যেন সহজে বোধগম্য হয়। যদিও নানাভাবে নিরীক্ষাও করি। তেলরঙে কাজ করতে পছন্দ করি। তেলরঙের মাত্রাগত বৈশিষ্ট্য ভালো লাগে। অ্যাক্রিলিক দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ভালো। এ ছাড়া ভালো রঙের স্বচ্ছতা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। এখনকার অনেক শিল্পীর কাজেই ‘শিকড়’হীনতা। শিকড়ের সন্ধান খুব জরুরি। আধুনিকতা তো সময়ের দাবি, নিজ উৎসমূলের বাইরের বিষয় নয়। সামনে নকশিকাঁথার মোটিফ নিয়ে কাজ করছি। এ বছরের মার্চে একক প্রদর্শনী করব। আমার ৮০ বছর পূর্তি। সবাইকে নিমন্ত্রণ।
নবীন প্রজন্মকে বলব, মানুষের সাহিত্যশিল্পের সব বিষয়ে আগ্রহ থাকা উচিত। জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। আর যারা শিল্পচর্চা করে, তাদের আরও ব্যাপকভাবে বিচরণ করতে হবে শিল্পের সব জায়গায়। তবেই আসল গভীরতা তৈরি হয়, যা কাজের ক্ষেত্রে সুপ্রভাব ফেলে। নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে।
অনুলিখন: জাফরিন গুলশান।
No comments