জারদারি, নায়ক না খলনায়ক -রক্ত ও তরবারির গান by ফাতিমা ভুট্টো
নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার জন বার্নস তাঁর ‘হাউস অব গ্রাফট’ নিবন্ধে আসিফ জারদারির দুর্নীতি উন্মোচন করেছেন। তাঁরা (জারদারি ও বেনজির) ইংল্যান্ডে একটি বিশাল এস্টেট কিনেছেন, যার আনুমানিক মূল্য ৪০ লাখ ডলার। জারদারি-বেনজির দম্পতি অবশ্য বাড়ি কেনার কথা অস্বীকার করেছেন। যদিও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বাড়ির বিভিন্ন শিল্পকর্ম পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছেন, তাঁরা এগুলোকেও ওই দম্পতির জন্য উপহার বলে জানিয়েছেন। যখন ইংল্যান্ডের আদালত বাড়িটি বিক্রি করার বিজ্ঞপ্তি জারি করেন এবং এর কাগজপত্র পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন, তখন জারদারি বলেছিলেন, প্রকৃত মালিক হিসেবে তাঁর কাছেই সেগুলো পাঠাতে হবে।
বার্নসের অভিযোগ, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে জারদারি নাবটিয়ার ও বুলগেজি সোনার দোকানে পাঁচ লাখেরও বেশি ডলার ব্যয় করেছেন। কিন্তু ওটা নিছক কেনাকাটা নয়। ওই দম্পতি কমিশন-বাণিজ্য ও উচ্চপর্যায়ের সরকারি কাজের লেনদেনেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে একজন ফরাসি সামরিক ঠিকাদার বিলিয়ন ডলার মূল্যের জঙ্গি বিমানের চুক্তির জন্য জারদারি ও একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন, যদিও সেটি ফলপ্রসূ হয়নি।
বেনজির দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর সুইস ব্যাংকার ক্যাপরিকন ট্রেডিং নামের একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন; যার সিংহ ভাগ মালিকানা ছিল জারদারির।
বার্নসের নিবন্ধ অনুযায়ী, নয় মাস পরে ক্যাপরিকন ট্রেডিংয়ের নামে সিটি ব্যাংকের দুবাই অফিসে একটি হিসাব খোলা হয়। সেদিনই দুবাইভিত্তিক পাকিস্তানি ট্রেডিং কোম্পানি এআরআই ৫০ লাখ ডলার সেখানে জমা রাখে। দুই সপ্তাহ পর এআরআই একই হিসাবে আরও ৫০ লাখ ডলার জমা দেয়।
দুর্নীতির অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। পোলিশ ট্রাকটর কেনার জন্য আরেকটি সমঝোতা হয়, যার বিনিময়ে উল্লেখযোগ্য উেকাচ দেওয়া হয় এবং সেই অর্থে স্পেনে সম্পত্তি কেনা হয়। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে খাদ্যের বিনিময়ে তেলচুক্তি হয় ২০ লাখ ডলার কমিশনে। বিবিসির সাংবাদিক ওয়েন বেনার জোনসের অনুসন্ধানে খাদ্যের বিনিময়ে তেল কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হয় এবং তা ২০০৭ সালের অক্টোবরে প্রচারও করা হয়।
বেনজিরের সাবেক প্রেস সেক্রেটারি হোসেন হাক্কানি বলেছেন, তাঁর এককালীন বস (বেনজির) ভুট্টো পরিবার ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। বেনজির মনে করতেন, তিনিই পাকিস্তান এবং তাঁর যা খুশি তা করতে পারেন। হাক্কানি বর্তমানে ওয়াশিংটনে জারদারির রাষ্ট্রদূত। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এ দম্পতি ধরা খায় এসজিএস/কোটেরিনা মামলায়, যাতে সুইস আদালত জারদারিকে কারাদণ্ড দেন। একটি সুইস কোম্পানিকে একটি সরকারি শুল্ক চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য আনুমানিক এক কোটি ৫০ লাখ ডলার নিয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালের গ্রীষ্মের কোনো এক সময়ে, দুর্নীতি ও হত্যা মামলায় জারদারি যখন দ্বিতীয়বারের মতো জেলে ছিলেন, বেনজির কেনাকাটা করতে যান লন্ডনে। বন্ড স্ট্রিটের একটি স্বর্ণের দোকান থেকে তিনি এক লাখ ৯০ হাজার ডলার মূল্যের একটি নীলমণি ও হিরার অলংকার কেনেন। এক বছর পর সেই হার সুইস আদালত জব্দ করেন। ২০০৩ সালে সুইস আদালতের রায়ে বেনজির ও জারদারি দুজনই দোষী সাব্যস্ত হন। পরে তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও তাঁদের ভাবমূর্তির যা ক্ষতি হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে।
২০০৭ সালে স্বৈরশাসক জেনারেল মোশাররফের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সমঝোতা অধ্যাদেশ বিল পাসের মাধ্যমে রাজনীতিক, আমলা ও ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে ২০ বছরের পুরোনো দুর্নীতির মামলাগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে এবং এসজিএস/কোটেরিনা মামলাটি সুইস আদালতে স্থগিত আছে। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জারদারি জনসমক্ষে ঘোষণা দেন, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ হবে ১৮০ কোটি ডলার; যার একাংশ তিনি ও তাঁর স্ত্রী রাষ্ট্র থেকে চুরি করেছেন।
এপ্রিল ২০০৯
আমি যখন এই বই শেষ করলাম, তখন মনে হলো আমার চারপাশের পৃথিবী ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে লিখেছি। আমি উপলব্ধি করছি অনুরূপ বিপদের কথা, আমরা নিরাপদ নই। সাত মাস আগে আমি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি এবং ভাইকে বাইরের একটি দেশে রেখে আসার জন্য যাই।
জুলফি (জুলফিকার আলী জুনিয়র) করাচিতে আমাদের বাড়ির কাছে একটি বেসরকারি স্কুলে এ লেভেলে পড়া শুরু করেছিল। তার কিছু বন্ধুও সেখানে পড়ছে। ২০০৮-এর শরতে জুলফি ১৮ বছরে পা দিয়েছে মাত্র। এবং বাবার হত্যা মামলা থেকে আসিফ জারদারি নিজেকে দায়মুক্ত করার পর আমাদের পরিস্থিতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে সে সজাগ ছিল। সে এ ব্যাপারেও সজাগ ছিল, ওই ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কারণে দেশের ভেতরে আমরা নিরাপদ নই।
জারদারি যখন নিজেকে পিপলস পার্টির সর্বসম্মত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বেছে নিলেন, তখন আমরা জানতাম ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানে কোনো বাধাই তাঁকে থামাতে পারবে না। কোনো কিছুই তাঁকে পিছু হটাতে পারবে না। সব অসুবিধা সত্ত্বেও তিনিই পাকিস্তান শাসন করতে যাচ্ছেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বেনজির খুন হওয়ার পর থেকে আমাদের এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ভুট্টো পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য হওয়ায় আমরা তাঁকে (জুলফি) লক্ষ্যবস্তু করার ঝুঁকি নিতে পারলাম না।
আমরা এমন দেশে বাস করছি না, যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে; আমরা এমন দেশে বাস করছি না, যেখানে বিচার বিভাগ স্বাধীন। সহিংস ও প্রতিশোধপরায়ণ সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো রক্ষাকবচ নেই। আমরা বিদেশের কোনো বোর্ডিং স্কুলে তাকে ভর্তি করার প্রক্রিয়া শুরু করলাম। কিন্তু এও জানতাম যে, সেটি খুব সহজ হবে না। আমার চেয়ে আট বছরের ছোট জুলফি সব সময় ছোট্ট পরিবারটির সঙ্গে ছিল। (শেষ)
গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: সোহরাব হাসান।
বার্নসের অভিযোগ, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে জারদারি নাবটিয়ার ও বুলগেজি সোনার দোকানে পাঁচ লাখেরও বেশি ডলার ব্যয় করেছেন। কিন্তু ওটা নিছক কেনাকাটা নয়। ওই দম্পতি কমিশন-বাণিজ্য ও উচ্চপর্যায়ের সরকারি কাজের লেনদেনেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে একজন ফরাসি সামরিক ঠিকাদার বিলিয়ন ডলার মূল্যের জঙ্গি বিমানের চুক্তির জন্য জারদারি ও একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন, যদিও সেটি ফলপ্রসূ হয়নি।
বেনজির দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর সুইস ব্যাংকার ক্যাপরিকন ট্রেডিং নামের একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন; যার সিংহ ভাগ মালিকানা ছিল জারদারির।
বার্নসের নিবন্ধ অনুযায়ী, নয় মাস পরে ক্যাপরিকন ট্রেডিংয়ের নামে সিটি ব্যাংকের দুবাই অফিসে একটি হিসাব খোলা হয়। সেদিনই দুবাইভিত্তিক পাকিস্তানি ট্রেডিং কোম্পানি এআরআই ৫০ লাখ ডলার সেখানে জমা রাখে। দুই সপ্তাহ পর এআরআই একই হিসাবে আরও ৫০ লাখ ডলার জমা দেয়।
দুর্নীতির অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। পোলিশ ট্রাকটর কেনার জন্য আরেকটি সমঝোতা হয়, যার বিনিময়ে উল্লেখযোগ্য উেকাচ দেওয়া হয় এবং সেই অর্থে স্পেনে সম্পত্তি কেনা হয়। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে খাদ্যের বিনিময়ে তেলচুক্তি হয় ২০ লাখ ডলার কমিশনে। বিবিসির সাংবাদিক ওয়েন বেনার জোনসের অনুসন্ধানে খাদ্যের বিনিময়ে তেল কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হয় এবং তা ২০০৭ সালের অক্টোবরে প্রচারও করা হয়।
বেনজিরের সাবেক প্রেস সেক্রেটারি হোসেন হাক্কানি বলেছেন, তাঁর এককালীন বস (বেনজির) ভুট্টো পরিবার ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। বেনজির মনে করতেন, তিনিই পাকিস্তান এবং তাঁর যা খুশি তা করতে পারেন। হাক্কানি বর্তমানে ওয়াশিংটনে জারদারির রাষ্ট্রদূত। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এ দম্পতি ধরা খায় এসজিএস/কোটেরিনা মামলায়, যাতে সুইস আদালত জারদারিকে কারাদণ্ড দেন। একটি সুইস কোম্পানিকে একটি সরকারি শুল্ক চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য আনুমানিক এক কোটি ৫০ লাখ ডলার নিয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালের গ্রীষ্মের কোনো এক সময়ে, দুর্নীতি ও হত্যা মামলায় জারদারি যখন দ্বিতীয়বারের মতো জেলে ছিলেন, বেনজির কেনাকাটা করতে যান লন্ডনে। বন্ড স্ট্রিটের একটি স্বর্ণের দোকান থেকে তিনি এক লাখ ৯০ হাজার ডলার মূল্যের একটি নীলমণি ও হিরার অলংকার কেনেন। এক বছর পর সেই হার সুইস আদালত জব্দ করেন। ২০০৩ সালে সুইস আদালতের রায়ে বেনজির ও জারদারি দুজনই দোষী সাব্যস্ত হন। পরে তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও তাঁদের ভাবমূর্তির যা ক্ষতি হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে।
২০০৭ সালে স্বৈরশাসক জেনারেল মোশাররফের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সমঝোতা অধ্যাদেশ বিল পাসের মাধ্যমে রাজনীতিক, আমলা ও ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে ২০ বছরের পুরোনো দুর্নীতির মামলাগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে এবং এসজিএস/কোটেরিনা মামলাটি সুইস আদালতে স্থগিত আছে। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জারদারি জনসমক্ষে ঘোষণা দেন, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ হবে ১৮০ কোটি ডলার; যার একাংশ তিনি ও তাঁর স্ত্রী রাষ্ট্র থেকে চুরি করেছেন।
এপ্রিল ২০০৯
আমি যখন এই বই শেষ করলাম, তখন মনে হলো আমার চারপাশের পৃথিবী ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে লিখেছি। আমি উপলব্ধি করছি অনুরূপ বিপদের কথা, আমরা নিরাপদ নই। সাত মাস আগে আমি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি এবং ভাইকে বাইরের একটি দেশে রেখে আসার জন্য যাই।
জুলফি (জুলফিকার আলী জুনিয়র) করাচিতে আমাদের বাড়ির কাছে একটি বেসরকারি স্কুলে এ লেভেলে পড়া শুরু করেছিল। তার কিছু বন্ধুও সেখানে পড়ছে। ২০০৮-এর শরতে জুলফি ১৮ বছরে পা দিয়েছে মাত্র। এবং বাবার হত্যা মামলা থেকে আসিফ জারদারি নিজেকে দায়মুক্ত করার পর আমাদের পরিস্থিতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে সে সজাগ ছিল। সে এ ব্যাপারেও সজাগ ছিল, ওই ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কারণে দেশের ভেতরে আমরা নিরাপদ নই।
জারদারি যখন নিজেকে পিপলস পার্টির সর্বসম্মত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বেছে নিলেন, তখন আমরা জানতাম ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানে কোনো বাধাই তাঁকে থামাতে পারবে না। কোনো কিছুই তাঁকে পিছু হটাতে পারবে না। সব অসুবিধা সত্ত্বেও তিনিই পাকিস্তান শাসন করতে যাচ্ছেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বেনজির খুন হওয়ার পর থেকে আমাদের এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ভুট্টো পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য হওয়ায় আমরা তাঁকে (জুলফি) লক্ষ্যবস্তু করার ঝুঁকি নিতে পারলাম না।
আমরা এমন দেশে বাস করছি না, যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে; আমরা এমন দেশে বাস করছি না, যেখানে বিচার বিভাগ স্বাধীন। সহিংস ও প্রতিশোধপরায়ণ সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো রক্ষাকবচ নেই। আমরা বিদেশের কোনো বোর্ডিং স্কুলে তাকে ভর্তি করার প্রক্রিয়া শুরু করলাম। কিন্তু এও জানতাম যে, সেটি খুব সহজ হবে না। আমার চেয়ে আট বছরের ছোট জুলফি সব সময় ছোট্ট পরিবারটির সঙ্গে ছিল। (শেষ)
গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: সোহরাব হাসান।
No comments