গাজায় আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার শঙ্কা

ফিলিস্তিনের গাজায় আবার যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রিজার্ভ সেনা তলব করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস আগামী শনিবারের মধ্যে আরও ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি না দিলে গাজায় হামলা শুরু করতে পারে ইসরায়েল।

গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীন আগামী শনিবার আরও তিন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কথা। তবে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে অভিযোগ এনে চলতি সপ্তাহে অনির্দিষ্টকালের জন্য জিম্মি মুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয় হামাস।

হামাসের এ ঘোষণা পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, শনিবার দুপুরের মধ্যে হামাস সব জিম্মিকে মুক্তি না দিলে গাজায় ‘নরক নেমে আসবে’।

গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস যদি জিম্মি মুক্তির সময়সীমা মেনে না চলে, ‘তীব্র লড়াই’ শুরু করবে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি গাজার ভেতরে ও আশপাশে ইসরায়েলি বাহিনীকে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পরই গাজা সীমান্তবর্তী ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে অতিরিক্ত সেনা পাঠানো ও রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।

এ অচলাবস্থার কারণে গাজায় নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রায় ১৫ মাসের এ সংঘাতে গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। খাবার, সুপেয় পানি ও আশ্রয়কেন্দ্রের সংকট তৈরি হয়েছে। এ সংঘাত ঘিরে মধ্যপ্রাচ্য আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

ইসরায়েলের কর্মকর্তারা জানান, শনিবারের মধ্যে সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া না হলে যুদ্ধবিরতি বাতিলে ট্রাম্পের দেওয়া হুমকি ‘অনুমোদন করেছেন’ নেতানিয়াহু সরকারের মন্ত্রীরা।

এদিকেগতকাল মঙ্গলবার হামাসের এক নেতা বলেছেন, কেবল যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চললেই গাজা থেকে জিম্মিদের ফেরত নিতে পারবে ইসরায়েল। এ নিয়ে ট্রাম্পের দেওয়া হুমকিও নাকচ করে দিয়েছে সংগঠনটি।

হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সামি আবু জুহরি রয়টার্সকে বলেন, ট্রাম্পের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, এ বিষয়ে একটি চুক্তি রয়েছে, যা উভয় পক্ষেরই মেনে চলা উচিত। ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্ত করার এটাই একমাত্র উপায়। হুমকির সুরে কথা বলার কোনো মানে নেই এবং এটি বিষয়টিকে জটিল করবে।

এদিকে সম্ভাব্য সংকট এড়াতে চেষ্টা করছে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো। এ আলোচনার সঙ্গে যুক্ত একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, পরিস্থিতির সংঘাতে মোড় নেওয়া ঠেকাতে নিজেদের ভূমিকা জোরদার করেছেন মধ্যস্থতাকারীরা।

যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন না সিসি

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করার বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন না মিসরের প্রেসিডেন্ট আবেদল ফাত্তাহ আল-সিসি। মিসরের দুটি গোয়েন্দা সূত্র এ কথা জানিয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারি টেলিফোনে কথা বলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট সিসি। তখন সিসিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে এখনো এ সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি বলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অবশ্য এ নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এদিকে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নিতে ওয়াশিংটন সফররত জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহকে চাপ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, কিন্তু বাদশাহ আবদুল্লাহ তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের না সরিয়েই গাজা পুনর্গঠন করা হবে। এ বিষয়ে আরব দেশগুলো একমত।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ওভাল অফিসে দুই নেতা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, গাজা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও উপত্যকাটির বাসিন্দাদের স্থায়ীভাবে সরানোর পরিকল্পনা থেকে তিনি সরে আসবেন না।

জবাবে গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে জর্ডানের ‘অবিচল অবস্থান’ পুনর্ব্যক্ত করেছেন বাদশাহ আবদুল্লাহ। সংবাদ সম্মেলন শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘এটাই আরবদের সম্মিলিত অবস্থান। ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত না করে গাজা পুনর্গঠন করা এবং ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সবার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।’

ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে বিতাড়ন করার ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে চীনও। আজ বুধবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গো জিয়াকুন বলেন,‘গাজার মালিক ফিলিস্তিনিরা এবং এটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা গাজার বাসিন্দাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে।’

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন করার পরিকল্পনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আরব লিগের মহাসচিব আহমেদ গেইত। দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টস সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আজ গাজার কথা বলা হচ্ছে তো আগামীকাল পশ্চিম তীরে নিজেদের ইতিহাসিক আবাস থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হবে।’

শনিবারের মধ্যে জিম্মিদের মুক্তি না দিলে যুদ্ধবিরতি বাতিল, ইসরায়েলের হুঁশিয়ারি

আগামী শনিবার দুপুরের মধ্যে জিম্মিদের ফেরত দেওয়া না হলে গাজায় যুদ্ধবিরতি বাতিল এবং সেখানে আবার তীব্র লড়াই শুরু হবে বলে হামাসকে সতর্ক করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি গাজার ভেতরে এবং আশপাশে ইসরায়েলি বাহিনীকে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নতুন করে কোনো জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া স্থগিত করেছে হামাস। সংগঠনটির এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু এই নির্দেশ দেন।

নেতানিয়াহু বাদবাকি ৭৬ জিম্মির মুক্তির দাবি করেছেন নাকি শনিবার যে তিনজনকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল, তাঁদের মুক্তির দাবি করেছেন, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। তবে এক মন্ত্রী বলেছেন, তিনি সবার মুক্তির কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সাহায্য আটকে দেওয়াসহ নানাভাবে ইসরায়েল তিন সপ্তাহের পুরোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ করেছে হামাস। যদিও এ দাবি অস্বীকার করেছে ইসরায়েল।

নেতানিয়াহুর বক্তব্যের পর হামাস বলেছে, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং যেকোনো জটিলতা কিংবা বিলম্বের জন্য ইসরায়েল দায়ী।

হামাস এই সপ্তাহান্তে নির্ধারিত জিম্মিদের মুক্তি বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাব করেন, ইসরায়েল চুক্তিটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হবে এবং শনিবারের মধ্যে ‘সব জিম্মিকে’ ফিরিয়ে না দিলে গাজাকে নরকে পরিণত করা হবে।

গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভার চার ঘণ্টার বৈঠকের পর নেতানিয়াহু একটি ভিডিও বিবৃতিতে বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হামাসের চুক্তি লঙ্ঘন এবং আমাদের জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের আলোকে গত রাতে আমি আইডিএফকে (ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী) গাজা উপত্যকার ভেতরে এবং চারপাশে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।’

নেতানিয়াহু বলেন, যদি হামাস শনিবার দুপুরের মধ্যে আমাদের জিম্মিদের ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে যুদ্ধবিরতি শেষ হয়ে যাবে। হামাসের চূড়ান্ত পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত আইডিএফ পুনরায় তীব্র লড়াই শুরু করবে। তাঁর এই আলটিমেটাম মন্ত্রিসভায় সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পেয়েছে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হওয়ার কথা রয়েছে। এ সময় গাজার প্রায় ১ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনি বন্দীর বিনিময়ে মোট ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে।

গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। চুক্তির শর্তাবলির বাইরে হামাস পাঁচজন থাই জিম্মিকে হস্তান্তর করেছে।

বাকি ১৭ ইসরায়েলি জিম্মিকে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ শিশু, ১ নারী, ৫০ বছরের বেশি বয়সী ৫ পুরুষ এবং ৫০ বছরের কম বয়সী ৯ জন পুরুষ। উভয় পক্ষই জানিয়েছে, এই জিম্মিদের মধ্যে আটজন মারা গেছেন, তবে কেবল একজনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।

২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলে ভয়াবহ হামলা চালায়। এতে সেখানে ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়। জিম্মি করা হয় ২৫১ জনকে। এ হামলার জবাবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামাসকে ধ্বংস করতে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৪৮ হাজার ২১০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

গাজার বেশির ভাগ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে পড়েছে। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও আশ্রয় সংকটে আছে গাজার মানুষ।

হামলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নতুন করে সীমান্তে অবস্থান নিচ্ছে ইসরায়েলি ট্যাংক। আজ বুধবার উত্তর গাজার সীমান্তে
হামলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নতুন করে সীমান্তে অবস্থান নিচ্ছে ইসরায়েলি ট্যাংক। আজ বুধবার উত্তর গাজার সীমান্তে। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.