‘পানি নামছে, কষ্ট নামে নাই’ by তুহিন ওয়াদুদ
‘যামার (যার) বাড়ি-জমি সোগ (সব) নদীত ভাঙি গেইচে, কিন্তু লজ্জা করি ত্রাণ নিবার পায় না, তার কষ্ট হামার চেয়েও বেশি।’ কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ডাটিয়ার চরের নওশাদ আলী অষ্টমীর চরে ত্রাণ নিতে এসে এ কথাগুলো বলছিলেন। তর্জনী সোজা করে সম্মুখে অনেক দূর দেখিয়ে তিনি আরও বলছিলেন, ‘এখানে অনেকগুলো বাড়ি ছিল, সব এবারের বন্যায় ভাঙি গেইচে। অনেক গেরস্থ ফকির হইচে। কিন্তু লজ্জায় ত্রাণ চাইতে পারে না। এলা (এখন) পানি নামছে, কষ্ট নামে নাই।’ যশোরের এক শিল্পপতি ডিভাইন গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান রাহিম কুড়িগ্রামে বন্যার্ত মানুষের জন্য প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। বন্যার্ত এসব মানুষের জন্য সেই ত্রাণ দেওয়ার কাজে দুবার গিয়েছিলাম ব্রহ্মপুত্রের চরে। দুবারই সাধারণ সমতলের বন্যার্ত মানুষের একই অভিযোগ, ‘যত ত্রাণ সব চরে যায়, কাইমের (সাধারণ সমতল) লোককে কেউ ত্রাণ দেয় না।’ অনেক সময় সারা দিন অপেক্ষা করার পর জোটে খুবই সামান্য ত্রাণ। রমনা ঘাটে গরিবুল্লাহ হোটেলের নুরুল হক জানালেন, একদিন মাত্র তিনি ত্রাণ পেয়েছেন। সেই ত্রাণের পরিমাণ আধা কেজি চিড়া, ১০০ গ্রাম গুড়। অনেকেই সরকারিভাবে একবার ১০ কেজি করে চাল পেয়েছেন। সব সময় ত্রাণের পরিমাণ কম থাকে না। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হলো, ত্রাণ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। নয়ারহাট, কড়াই বরিশাল, অষ্টমীর চর, জোড়গাছ, রমনাসহ বিভিন্ন এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, বন্যায় যা ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। মাঠের পর মাঠ ছিল পাটখেত। সেগুলোর সবটাই পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে।
ধানখেতও তলিয়ে গেছে। অনেকের কলার চাষ নষ্ট হয়েছে। যাঁরা মাছের চাষ করতেন, তাঁদের পুকুরে আর মাছ নেই। নতুন করে ধান চাষের উপায় নেই। বন্যার্ত মানুষের মধ্যে সোলেমান নামের একজন বলছিলেন, ‘গত তিন বছর থাকি এই মৌসুমে একবারও ফসল পাই না। ডুবি যায়।’ সরকারিভাবে যদি ভাসমান বীজতলা তৈরি করে এখানকার কৃষকদের সহায়তা দেওয়া যেত তাহলেও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো ধান চাষ করা সম্ভব হতো। চরের মানুষের জীবন এমনিতেই কঠিন। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। চরগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বল্পতাহেতু সেখানে বাল্যবিবাহের প্রকোপ এখনো আছে। যেখানে যতটুকু পড়ার সুযোগ আছে, সেখানকার ছেলেমেয়েরা ততটুকুই পড়ে। তারপর মেয়েদের বিয়ে হয়। অবস্থাপন্ন ছেলেদের কেউ কেউ হয়তো কিছুটা লেখাপড়া করে। কিন্তু শ্রমজীবী মজুর পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার যবনিকাপাত ঘটে। যেমন অষ্টমীর চরে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বাস। সেখানে মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ আছে। কলেজে পড়ার জন্য যেতে হবে কমপক্ষে সাত কিলোমিটার দূরের পার্শ্ববর্তী চিলমারী-রৌমারী-রাজীবপুর। ফলে শ্রমজীবী দিনমজুরদের সন্তানদের পক্ষে লেখাপড়া করা সম্ভব হয় না। কুড়িগ্রাম জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে চরের সংখ্যা চার শতাধিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এসব এলাকায় এনজিওগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু তারা এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করেনি যাতে চরজীবনের কষ্টের স্থায়ী সমাধান সম্ভব হয়।
ব্রহ্মপুত্রের বজরাদি চরে গোড়ারকুঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাশারাতুল্লাহ চরগুলোতে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা দাবি করে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে চরের মানুষের আগ্রহ থাকলেও পড়ার সুযোগ পায় না।’ এ বছর কুড়িগ্রামে যে বন্যা হয়েছে তা কোনো কোনো স্থানে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে, কোথাও কোথাও ১৯৮৮ সালের বন্যার কাছাকাছি। এ বছর বন্যার শুরুতেই ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী কুড়িগ্রামে এসে বড় বন্যার আশঙ্কার কথা বলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও ত্রাণ কিংবা দুর্যোগ মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতি ছিল না। বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় যেহেতু প্রতিবছরই বন্যা হয়, তাই ওই জেলাগুলোতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আগে থেকেই রাখা প্রয়োজন। কুড়িগ্রামে ভয়াবহ বন্যারও অনেক পরে সামান্য ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। গাইবান্ধার অবস্থাও একই। চরাঞ্চলের মানুষের বিপদের অনেক বড় বন্ধু তাঁদের গৃহপালিত গবাদিপশু। বন্যা হলে এই গরু বিক্রি করে অনেকেই তাঁদের সংকটের সময় পার করেন। যাঁদের গরু নেই, তাঁরা এনজিও থেকে উচ্চহারের সুদে ঋণ নেন অথবা মহাজনের দ্বারস্থ হন। আর সারা বছর ধরে সেই ঋণের ঘানি টানতে থাকেন। কড়াই বরিশাল চরের সফিয়াল বলছিলেন, ‘ভাই, খুব কষ্টে আছি। সারা দিন যায় কোনো কাজ-কাম নাই। সারাটা দিন বসি থাকি।’ বন্যাদুর্গত এসব মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে হস্তশিল্পে দক্ষ করে বেকারদের সময়কে শ্রমে পরিণত করা সম্ভব। চরাঞ্চলগুলোতে আর কিছুদিন পরেই শুরু হবে বাদাম, সরিষা ও মসুরের চাষ। সরকারিভাবে মসুর, সরিষা কিংবা বাদামের বীজ দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করা যেতে পারে। যখন বন্যায় ঘরবাড়ি-পথ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রার্থনালয় সবকিছুই ডুবে যায়, তখন গণমাধ্যমগুলোতে বন্যা প্রসঙ্গ প্রচারণার শীর্ষে থাকে। তখন সামান্য কিছু ত্রাণ আসে। কষ্ট-সমুদ্রে কারও কারও কাছে সেই ত্রাণ জীবন বাঁচানোর নিয়ামক হয়ে দেখা দেয়। যখন বন্যার পানি নেমে যায়, কোথাও কোনো প্রচারণা থাকে না, তখনো নিভৃতে নেমে আসে দীর্ঘ কষ্টের ধারা। এই বন্যাচক্রে আবর্তিত বন্যার্ত এসব মানুষের জীবন। সরকার কি বন্যার্ত মানুষের পুনর্বাসনে মনোযোগ দেবে?
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
No comments