অ্যাক্টিভিস্ট-রামমাধব-ফিউশন লীগ এবং আত্মজীবনী by মিনা ফারাহ
২০০৯
সালের জানুয়ারিতে একই সময়ে ক্ষমতা বদল হয়েছে আমেরিকা-বাংলাদেশে। কোনো
দেশের সংবাদপত্রের খবর যখন সাত বছরের অধিক সময় ধরে একই জায়গায় আটকে থাকে,
বুঝতে হবে গণতন্ত্রের ব্যাধি মহামারী আকার ধারণ করেছে। আমেরিকানরা যখন
ওবামার বিদায় লগ্নে দুই দলের প্রায় ডজনখানেক প্রার্থীর মধ্যে যাচাই-বাছাইয়ে
ব্যস্ত, বাংলাদেশে তখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেই আরো কয়েক টার্ম
প্রধানমন্ত্রী রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই কাজ কি আওয়ামী লীগের? উন্নতির
নামে প্রত্যেক দিনই ঘোড়া দাবড়ানোও আওয়ামী লীগের বুদ্ধিতে নয়। সালমান
খুরশিদের আত্মজীবনী সেই ইঙ্গিত দিলো। এটা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দুর্গতির
প্রমাণ। ক্ষমতা মহামারী আকার ধারণ করলে মিডিয়ার প্রয়োজন যেমন বাড়ে, তেমনি
গুজব সৃষ্টির দুই হাত আরো লম্বা হয়। মিডিয়ার চেহারা তখন কার্যত এক ব্যক্তির
আকার ধারণ করে। ক্ষমতার মালিক ভোটার, ব্যক্তিকে যারা পদে বসায়। ভোটের
বাক্সে নয়-ছয় করা আইনত অপরাধ। ৫ জানুয়ারিতে দিল্লির হস্তক্ষেপের তথ্য
আত্মজীবনীতে ফাঁস করে বহু প্রশ্নের সমাধান করলেন ভারতীয় মন্ত্রী। এ দিকে
বিজেপির মহাসচিব এবং আরএসএস-এর প্রচারক রামমাধবের অখণ্ড ভারতের সপক্ষে
বক্তব্যের পরেও ঢাকার সরকারের প্রতিক্রিয়া না থাকাই স্বাভাবিক। লীগের দাবি,
‘মানুষ চাইলে বিএনপিও নিষিদ্ধ হবে।’ মিডিয়ায় চাউর, জামায়াতকে নির্মূল করার
জন্য বাইরের চাপ রয়েছে।
বিজেপির অখণ্ড ভারত বক্তব্য এবং কানেকটিভিটি নিয়ে মোদির অতি উচ্ছ্বাসের সাথে ২০৪১-এর কানেকটিভিটি সংযুক্ত। খুরশিদের আত্মজীবনী নিয়ে তোলপাড় সোস্যাল মিডিয়া। ‘আওয়ামী লীগকেই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া ভারত।’ সব সীমান্ত খুলে দিতে লীগের ওপর অস্বাভাবিক চাপের মূলে আসলেই কানেকটিভিটি, নাকি অন্য কিছু? আলজাজিরাকে ৭ ডিসেম্বরে রামমাধবের দেয়া সাক্ষাৎকার, ‘দুই ভিয়েতনাম, দুই জার্মানি এক হলে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ কেন অখণ্ড ভারতে আসবে না। ভোটে না হোক, পাবলিক উইলের মাধ্যমে হবে।’ -মনে হচ্ছে পানি বহু দূর গড়িয়েছে। ইউটিউবে এই ধরনের প্রচার অনেক। আরএসএস-এর কার্যালয়ে সব ম্যাপেই অখণ্ড ভারত এবং মোদিও আরএসএসের সদস্য। দেশ বিভাগের ক্ষোভ থেকেই গান্ধীকে হত্যা করেছিল আরএসএস। তাদের বিশ্বাস, সিন্ধু-গঙ্গা এক হবে, গান্ধীর ঘাতক নাথুরামের রক্ষিত দেহভস্মও সেখানে ঢালা হবে। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯২ সালে ভয়ানক দাঙ্গার মূলে আদভানী, নরসিমা ও মোদির নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞ এবং লজ্জা বইয়ের থিমটিও অখণ্ড বনাম খণ্ডিত ভারত (আদভানীর মতো বাবরি সন্ত্রাসীদের পুরস্কৃত করা হলো)। গণতন্ত্র ভক্ষণ করে ঢাকা-দিল্লির ফিউশন কার্যকলাপ- সন্দেহাতীতভাবে অস্বাভাবিক।
২.
দার্শনিক হেগেল বলেছেন, ‘একটি দেশের জন্ম হলেই বীরের কর্ম শেষ। এরপরও যারা বীরের দাবি করে, ওদের উদ্দেশ্য কুকর্ম করা।’ এখন বুঝি, মইন-ফখরুলরা কাদের পাঠানো আদম। ১/১১ থেকে আজ অবধি ৯৯ ভাগ খবরের চেহারায় পরিবর্তন হয়নি, শুধু কমানো-বাড়ানো ছাড়া। ২০০৯ থেকে ২০১৫-এর সংবাদপত্র পার্থক্য করতে না পারাটা, গণতন্ত্রের গুটিবসন্তের প্রমাণ। ১/১/১৬তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘নেত্রী কয়েক টার্ম প্রধানমন্ত্রী থাকা দরকার’- ঘোষণা গণতান্ত্রিক নয়। ১৯৭০-৯০-এর আওয়ামী লীগ এই দাবি করতেই পারে না, পারে ফিউশন লীগ। অন্তত একবার খোলামেলাই বলুন, ‘প্রত্যেকবারই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কিন্তু ২০৪১ এর আগে ক্ষমতা থেকে কিছুতেই নামছি না।’
প্রায় ১৮ মাস আগেই মিডিয়ায় মার্কিন নির্বাচনের ঢাক বেজে উঠেছে। দুই পক্ষের বিতর্ক দেখে ভালো সময় কাটছে। গণতন্ত্র এমনই হওয়া উচিত, কিন্তু আশরাফুলদের বক্তব্যে দীর্ঘ উপনিবেশের গর্জন। এমনকি প্রতিবেশী ভারতের নির্বাচনও আমেরিকার মতোই। তাহলে দিল্লির কার্যকলাপ এবং পাকিস্তানে মোদির কদমবুচি রাজনীতির ব্যাখ্যা কী? উত্তর, গণতন্ত্রের অজুহাতে আরব বসন্ত করে যারাই পছন্দের স্বৈরাচার বসাল, বিশ্বের চোখে তারাই গণতন্ত্রের সবচে’ বড় ধারক-বাহক। ভারত এখন ‘এই অঞ্চলের আমেরিকা’। অক্যুপেশন রাজনীতি আর মৌলিক গণতন্ত্র ভিন্ন। কাশিমবাজারে একটি দোকান খোলার মধ্যে দিয়ে ২০০ বছর অখণ্ড ভারতে রাজত্ব করল ব্রিটিশ। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাই পশ্চিমাদের ১ নম্বর কাজ। যেমন ৫ জানুয়ারি ঘটিয়ে দিল্লিও নিশ্চিত করল নিজের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ।
অবশেষে ৫ জানুয়ারি নিয়ে দিল্লির পরিকল্পিত অপকৌশল বিশ্ব মিডিয়ায়। এরপরেও ২০ দলের ঘরে বসে থাকা? নিজেদের গণতন্ত্রের সতীত্ব অক্ষত রেখে, অন্যেরটা অসতী করতে প্রণববাবুদের গোপন এজেন্ডা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করলেন মন্ত্রী। বিশ্ব-মিডিয়ার চোখে আমরা শিয়া-সুন্নিদের মতো দুই ফাইটিং বেগমের জাত। আর বেগমদের অঘোষিত যুদ্ধের কারণে উপনিবেশবাদ, জঙ্গিবাদ, স্বৈরতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র একই সাথে যেভাবে ঢুকে পড়েছে, শিয়া-সুন্নির সাথে এর পার্থক্য কী? ২০০৯-এর পত্রিকার সাথে ২০১৫ কে পার্থক্য করতে না পারাটা ফের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ। ২০২১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার অগ্রিম প্রোগ্রাম আর সালমান-মাধবদের বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার উৎস কার হাতে। জামায়াতের পর এবার বিএনপি নিষিদ্ধ করার ব্যান্ডমিউজিক বাজিয়ে হইচই ফেলে দিলো আত্মজীবনী।
যে বিষয়গুলো ভুলে গেছি। মইনুকে দাওয়াত দিয়ে ঘোড়া উপহার দিয়েছিল দিল্লি। ৫ জানুয়ারির আগে এরশাদকে দিল্লিতে হাজিরা দিতে বাধ্য করা হলো। এরশাদকে ‘হাইজ্যাক’ করে সুজাতার নির্বাচন সার্জারি। ক্ষমতায় এসেই প্রটোকল বাদ দিয়ে দিল্লির সাথে করা চুক্তিগুলো আওয়ামী লীগের ইচ্ছায় বলে মনে করা যায় না। এবার হাজিরা দিতে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সাঙ্গপাঙ্গরা। এসব কেন? সালমান খুরশিদ সাহেব জানালেন, ‘সরকার সমর্থিত যুবশক্তি এবং জামায়াত রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে গেলে, সেই পরিস্থিতিতে ভারত আওয়ামী লীগকেই বেছে নেয়।’ সজীব ওয়াজেদ যে দিন টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে বললেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় যাবে।’ আমরা তখন কি গুরুত্ব দিয়েছি? এত কিছুর পরেও জনরোষ মহামারী আকার ধারণ করলে লীগের সমস্যা কী? ‘ভারতের নির্দেশে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ হয়তো ইতস্তত বোধ করছে; কিন্তু ভারত চায় জামায়াত নিষিদ্ধ হোক’ -সোস্যাল মিডিয়া।
এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ নয়। বাংলাদেশের মানুষ এতো নিষ্ঠুর না। বিচারকেরাও এতটা অবিবেচক নন। গণতন্ত্রের জন্য একদা লড়াকু আওয়ামী লীগ হেরে গেলেও ‘৫ জানুয়ারি’ সৃষ্টি করত না। সকালে রায়, বিকেলে ফাঁসি দিতো না। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কখনোই এমন আচরণ করত না, যা তারা করতে বাধ্য হচ্ছে। মূলত বাংলাদেশীরা কোমল হৃদয়ের জন্য প্রশংসিত। কর্মক্ষেত্রে বিদেশীদের ইতিবাচক দৃষ্টি। তাহলে কার সন্দেহ সত্য? তথ্য-উপাত্ত বলছে, শিয়া-সুন্নির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী বিশেষ বহিঃশক্তি। জোট ভাঙার চিন্তা আওয়ামী লীগ করবে না; কারণ, ১৯৮৪ থেকে সব দলই এক সাথে পার্লামেন্টে। ইরান-ইরাকের মতো কিছুই ঘটেনি। তাহলে রাতারাতি এমন কী ঘটল?
জামায়াত ও বিএনপিকে অবৈধ ঘোষণার বার্তাও বাইরে থেকে আসা। খোলামেলাই খালেদাকে মোদি পছন্দ করেন না এবং রাজনীতিতেও চান না, সেটাই বেরিয়ে এলো সালমানের আত্মজীবনীতে। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে দিল্লির সরাসরি চাপ এবং আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল বানানোর ইঙ্গিতও এ বইতে। পঙ্কজ শরণও যা জানেন, ২০ দল জানে না। পঙ্কজ ও সালমানের বক্তব্য হুবহু হওয়ায় প্রমাণিত হলো, এ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে কারা। জোটের রাজনীতি বাঁচিয়ে রাখার মতো ভুল প্রণব বাবুরা করবেনই না। প্রণবের সাথে হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই খালেদার ভারত সফরের তথ্য বইটিতে। রাষ্ট্র নয়, বরং ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক এবং ২০২১-২০৪১ নিয়ে উল্টাপাল্টা দাবি ফিউশন লীগের কাজ।
৩.
‘সন্ত্রাস’ নিয়ে দুই দেশের একই জিরো টলারেন্স রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের অপপ্রচার সন্দেহজনক। দশম সংসদের চেহারা পাল্টে যাওয়ার মূলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঢাকা-দিল্লি জিরো টলারেন্সের বিষয়ে ন্যূনতম গবেষণা নেই। প্রয়োজন হলেই জঙ্গি আছে, আবার নেই।
সাত বছরের অধিক সময় ধরে ‘সন্ত্রাসীর’ তকমাটি বিনা হিসেবেই নয়। গোয়েবলসের উক্তি, ‘সাতবার মিথ্যা বললে মিথ্যাও সত্য মনে হয়।’ বিষয়টি খেয়াল করুন। ইনুরা আর ২০ দল না বলে, বলেন সন্ত্রাসী দল। অবৈধ সরকারের ভাষায় বিএনপি একটি সন্ত্রাসী জোট। খালেদার নাম সন্ত্রাসের রানী। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সন্ত্রাস প্রচারে মরিয়া ঢাকা-দিল্লি। অদৃশ্য যোগসূত্র আছে বলেই স্বাভাবিক বাঙালির চরিত্র ত্যাগ করতে বাধ্য ৯০-এর আওয়ামী লীগ। আমরা আমাদের মা-বোনদের মায়া-মমতা সম্পর্কে জানি। কখনোই তারা এই মাত্রায় অসহিষ্ণু নয়। পাওয়ার লোভে সন্তানের রক্ত কখনোই হাতে মাখাবে না কিন্তু সেটাই করা হলো ক্ষমতার জন্য। মুজিব থাকলে ট্রাইবুন্যালের প্রেসক্রিশন নাকচ হতো। যেমন হয়েছিল বাংলাদেশে ভারতের সেনাঘাঁটি বানাতে ইন্দিরার অনুরোধ। গণহত্যার পরেও ১৯৭৪ সালে ভুট্টোকে তিনিই দাওয়াত দিয়ে এনে ঢাকার বিমানবন্দরে শুধু বুকেই জড়িয়ে ধরেননি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও লালগালিচা সংবর্ধনা। ভুট্টোর গাড়িতে পাকিস্তান-বাংলাদেশের পতাকাসহ জাতীয়সৌধে নিয়ে তরুণ তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে পুষ্পস্তবক অর্পণের ভিডিও ইউটিউবে (২৭ জুন ১৯৭৪, ভুট্টোর পাশে তোফায়েল ভাইয়ের মাথা ভরা কালো চুল)। ওআইসি সম্মেলনেও পাকিস্তানে দুই নেতার ভ্রাতৃসুলভ বহু ছবি ইন্টারনেটে। ’৭১-এর মুসোলিনি টিক্কা খানের সাথে হ্যান্ডশেক? আসলে ক্ষমার এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশীদের মৌলিক চরিত্র। গণহত্যা সত্ত্বেও ভুট্টোকে ঢাকায় আনার মধ্যে সূক্ষ্ম বার্তা, অতীত না ভুললে সামনে যাওয়া যাবে না। যুদ্ধপরবর্তী জার্মানিতে মুসোলিনিকে জার্মানির চ্যান্সেলরের দাওয়াতের অবাস্তব ঘটনাই বাস্তব করলেন মুজিব। আদালতে নিজামীর বক্তব্য, ‘গণহত্যা করেছে ভুট্টো।’ কোনো কোনো নেতা ইউটার্নের জন্য দায়ী কি সত্যিই আওয়ামী লীগ, নাকি ফিউশন লীগ?
৪.
হোটেল সোনারগাঁওয়ে জোটের ১০ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে মোদির প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি খালেদা। বিচ্ছিন্নবাদীদের আশ্রয় প্রশ্নেও বিভ্রান্ত খালেদা। গুজব আমলে নিতে হবে। মিডিয়ার প্রকাশ, জামায়াতকে নিষিদ্ধ দেখতে চায় ভারত। সুতরাং সন্ত্রাসী তকমা কপালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ... সব শ্রেণীরই হয়তো ফাঁসি হবে। ১০০ ভাগ প্রস্তুতি ট্রাইব্যুনাল এবং নির্বাহীর বডিল্যাংগুয়েজে। আমরা ৭৩-৭৪-এর মতো কোনো দলকেই গর্তে দেখতে চাই না, কিন্তু খবর, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে কোনো কোনো দল। এই দেশে শিয়া-সুন্নির পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে লাভ একটি দেশের।
যেহেতু সব কিছুই ইন্টারনেটে, ব্লেমগেইম থেকে বের হয়ে আসাটা আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে জরুরি। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ৯ মাস মুজিব পরিবার ঢাকাতেই ছিল এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তাতেই ছিল। রাও ফরমান আলীর ইতিবাচক আচরণ ছাড়া এসব কিছু অসম্ভব। যেখানে সবাই দৌড়ের ওপরে, মাইরের ওপরে, ’৭১-এ মুজিবের মাকে টুঙ্গিপাড়া থেকে হেলিকপ্টারে এনে পিজিতে চিকিৎসা দেয়ার সৌভাগ্য তখন আর কোন বাঙালির? ৩২ নম্বর থেকে বের হয়ে ভারতীয়দের জিপে চড়লেন ১৭ ডিসেম্বর (সাক্ষাৎকারগুলো ইউটিউবে)।
অস্তিত্ব এবং অধিকারসঙ্কটে জর্জরিত ভিকটিম দলগুলোর হাইকমান্ডের অনেক কিছুই আমলে নেয়া উচিত ছিল। তাদের সামনে জীবনমৃত্যু প্রশ্ন। মোদিকে লিখিত অভিযোগ করার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কোন দল নিষিদ্ধ হবে, ভোটে কে জিতবে, সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাইরের কারো হতে পারে না । বাংলাদেশের বেশির মানুষই জুডিশিয়াল কিলিং সমর্থন করে না। মানুষ যতেই ঘুমাবে, খুঁটি ততই গভীরে যাবে।
৫.
যদি সন্তানের মৃত্যুর পর আবিষ্কার করেন, ডাক্তারের ফার্মেসি ব্যবসা এবং অতিরিক্ত ওষুধ বিক্রির কারণেই পুত্রের মৃত্যু, তখন? রায় লেখা বিচারকই যদি দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে খোলামেলা অ্যাক্টিভিজমে নামে এটা অন্যায়, জুরিসপ্র“ডেন্সে এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় খালেদার বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে দুই ফাঁসির রায় টিমের অন্যতম বিচারক ছিলেন। ২০১৩ সালে ইকোনমিস্ট পত্রিকার দাবি, ৩০ লাখ শহীদ হলে জনসংখ্যা অনুযায়ী, ২৫ জনে ১ জন। শর্মিলা বসুসহ অনেকেই সংখ্যার ব্যাখ্যা করায় সরকার নাখোশ। ২৫ জনে ১ জন শহীদ হলে, সংখ্যা করা কি কঠিন? বড়জোর ৩ বাড়ি মিলে ২৫ সদস্য। তাহলে তালিকা না করে খালেদার লেজে আগুন দেয়া কেন? আসলে ’৭১-এর অনেক কিছু অন্ধকারে রেখে, গুজবের ফসল ঘরে তুলছে ফিউশন লীগ। অথচ ৬৪টি জেলায় ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেই ১ মাসে শহীদের সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব। গাঁটের টাকায় নিজ জেলায় সংখ্যা নির্ণয় করেছি অতি সহজে। আসছি মূল কথায়। জুডিশিয়াল কিলিং বিষয় নিয়ে পাবলিকের সন্দেহ মিথ্যা হলে, রায় লেখা বিচারপতিকে কেন অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকায় দেখতে হলো? ঘাদানি ও ছাত্রলীগের সাথে আন্দোলন করার পরেও ২০ দলের বিরুদ্ধে কোন আইনে বক্তব্য দিতে পারেন এই বিচারপতি? খালেদার বাড়ি ঘেরাওয়ের পর টকশোতে দলীয় এমপির মতোই বক্তব্য কি আপত্তিকর নয়? তবুও আমজনতার দীর্ঘ দিনের সন্দেহ দূর করার জন্য বিচারপতি মানিককে ধন্যবাদ। তিনি অ্যাক্টিভিস্ট এবং আইনের লোকদের কাজ অনেক সহজ করে দিলেন।
বিচারক কখনোই নিজের এজলাসে ব্যক্তিগত মক্কেলের বিচার করতে পারেন না। জুরিসপ্র“ডেন্সে সেটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বহুল বিতর্কিত বিচারপতি তার আগের চরিত্রে ফিরেছেন। কর্মসূচিতে আবারো সক্রিয়... ২৬ নভেম্বর ঘাদানিক-এর সভায় অন্যান্য নেতার সাথে তিনি স্টেজেই ছিলেন। ...রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাংবিধানিক শপথ লঙ্ঘন করেছেন। ...বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার পেছনে বড় ভূমিকা ঘাদানিকের। ...যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচারক ছিলেন তিনি তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রেখেছিলেন, একই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির কর্মসূচিতেও তিনিই আবার সশরীরে হাজিরা যেন সাপ হয়ে কামড়ানো আর ওঝা হয়ে ঝাড়ো। খালেদার বাড়ির সামনে ‘জয়বাংলা’ বলে সেøাগান দিয়ে তার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। তার চিঠি থেকে জানা গেছে, অবসরের যাওয়ার পর তিনি আর কোনো রায় লিখতে পারবেন না বলে প্রধান বিচারপতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলন...।
জামায়াত না জাপা নিষিদ্ধ হবে, সিদ্ধান্ত বাংলাদেশীদের। স্বাইপ কেলেঙ্কারির পর বিচারপতি মানিকের অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোটিভ পুরোপুরি উন্মোচিত হলো। খালেদাকেও মোদির ১০ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে ২০ দলের পতন ফাইনাল। এ দিকে ফিউশন আওয়ামী লীগ অস্তিত্বসঙ্কটে। দিল্লি এখন তাদের গলার কাঁটা। না পারে গিলতে, না পারে উগরাতে। সম্মিলিতভাবে আগ্রাসী শক্তি ঠেকানোর এখনই সময়। মানবাধিকারের পত্র হাতে রাজপথে দাঁড়ালে এক কোটি মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের মতো যথেষ্ট বুলেট আর পুলিশ নেই। অচলাবস্থা অবসানের একমাত্র উপায়- রাজপথে অন্তত মানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থান।
সারমর্ম : ‘আওয়ামী লীগই বেছে নেয় ভারতকে’- ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গোমর ফাঁসের জন্য অনেক অভিনন্দন। তবে ২০০ বছর দেরিতে হলেও কুঠিবাড়ির ষড়যন্ত্রকারীর বিচার হবেই।
ইমেইল: farahmina@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.minafarah.com
বিজেপির অখণ্ড ভারত বক্তব্য এবং কানেকটিভিটি নিয়ে মোদির অতি উচ্ছ্বাসের সাথে ২০৪১-এর কানেকটিভিটি সংযুক্ত। খুরশিদের আত্মজীবনী নিয়ে তোলপাড় সোস্যাল মিডিয়া। ‘আওয়ামী লীগকেই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া ভারত।’ সব সীমান্ত খুলে দিতে লীগের ওপর অস্বাভাবিক চাপের মূলে আসলেই কানেকটিভিটি, নাকি অন্য কিছু? আলজাজিরাকে ৭ ডিসেম্বরে রামমাধবের দেয়া সাক্ষাৎকার, ‘দুই ভিয়েতনাম, দুই জার্মানি এক হলে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ কেন অখণ্ড ভারতে আসবে না। ভোটে না হোক, পাবলিক উইলের মাধ্যমে হবে।’ -মনে হচ্ছে পানি বহু দূর গড়িয়েছে। ইউটিউবে এই ধরনের প্রচার অনেক। আরএসএস-এর কার্যালয়ে সব ম্যাপেই অখণ্ড ভারত এবং মোদিও আরএসএসের সদস্য। দেশ বিভাগের ক্ষোভ থেকেই গান্ধীকে হত্যা করেছিল আরএসএস। তাদের বিশ্বাস, সিন্ধু-গঙ্গা এক হবে, গান্ধীর ঘাতক নাথুরামের রক্ষিত দেহভস্মও সেখানে ঢালা হবে। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯২ সালে ভয়ানক দাঙ্গার মূলে আদভানী, নরসিমা ও মোদির নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞ এবং লজ্জা বইয়ের থিমটিও অখণ্ড বনাম খণ্ডিত ভারত (আদভানীর মতো বাবরি সন্ত্রাসীদের পুরস্কৃত করা হলো)। গণতন্ত্র ভক্ষণ করে ঢাকা-দিল্লির ফিউশন কার্যকলাপ- সন্দেহাতীতভাবে অস্বাভাবিক।
২.
দার্শনিক হেগেল বলেছেন, ‘একটি দেশের জন্ম হলেই বীরের কর্ম শেষ। এরপরও যারা বীরের দাবি করে, ওদের উদ্দেশ্য কুকর্ম করা।’ এখন বুঝি, মইন-ফখরুলরা কাদের পাঠানো আদম। ১/১১ থেকে আজ অবধি ৯৯ ভাগ খবরের চেহারায় পরিবর্তন হয়নি, শুধু কমানো-বাড়ানো ছাড়া। ২০০৯ থেকে ২০১৫-এর সংবাদপত্র পার্থক্য করতে না পারাটা, গণতন্ত্রের গুটিবসন্তের প্রমাণ। ১/১/১৬তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘নেত্রী কয়েক টার্ম প্রধানমন্ত্রী থাকা দরকার’- ঘোষণা গণতান্ত্রিক নয়। ১৯৭০-৯০-এর আওয়ামী লীগ এই দাবি করতেই পারে না, পারে ফিউশন লীগ। অন্তত একবার খোলামেলাই বলুন, ‘প্রত্যেকবারই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কিন্তু ২০৪১ এর আগে ক্ষমতা থেকে কিছুতেই নামছি না।’
প্রায় ১৮ মাস আগেই মিডিয়ায় মার্কিন নির্বাচনের ঢাক বেজে উঠেছে। দুই পক্ষের বিতর্ক দেখে ভালো সময় কাটছে। গণতন্ত্র এমনই হওয়া উচিত, কিন্তু আশরাফুলদের বক্তব্যে দীর্ঘ উপনিবেশের গর্জন। এমনকি প্রতিবেশী ভারতের নির্বাচনও আমেরিকার মতোই। তাহলে দিল্লির কার্যকলাপ এবং পাকিস্তানে মোদির কদমবুচি রাজনীতির ব্যাখ্যা কী? উত্তর, গণতন্ত্রের অজুহাতে আরব বসন্ত করে যারাই পছন্দের স্বৈরাচার বসাল, বিশ্বের চোখে তারাই গণতন্ত্রের সবচে’ বড় ধারক-বাহক। ভারত এখন ‘এই অঞ্চলের আমেরিকা’। অক্যুপেশন রাজনীতি আর মৌলিক গণতন্ত্র ভিন্ন। কাশিমবাজারে একটি দোকান খোলার মধ্যে দিয়ে ২০০ বছর অখণ্ড ভারতে রাজত্ব করল ব্রিটিশ। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাই পশ্চিমাদের ১ নম্বর কাজ। যেমন ৫ জানুয়ারি ঘটিয়ে দিল্লিও নিশ্চিত করল নিজের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ।
অবশেষে ৫ জানুয়ারি নিয়ে দিল্লির পরিকল্পিত অপকৌশল বিশ্ব মিডিয়ায়। এরপরেও ২০ দলের ঘরে বসে থাকা? নিজেদের গণতন্ত্রের সতীত্ব অক্ষত রেখে, অন্যেরটা অসতী করতে প্রণববাবুদের গোপন এজেন্ডা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করলেন মন্ত্রী। বিশ্ব-মিডিয়ার চোখে আমরা শিয়া-সুন্নিদের মতো দুই ফাইটিং বেগমের জাত। আর বেগমদের অঘোষিত যুদ্ধের কারণে উপনিবেশবাদ, জঙ্গিবাদ, স্বৈরতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র একই সাথে যেভাবে ঢুকে পড়েছে, শিয়া-সুন্নির সাথে এর পার্থক্য কী? ২০০৯-এর পত্রিকার সাথে ২০১৫ কে পার্থক্য করতে না পারাটা ফের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ। ২০২১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার অগ্রিম প্রোগ্রাম আর সালমান-মাধবদের বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার উৎস কার হাতে। জামায়াতের পর এবার বিএনপি নিষিদ্ধ করার ব্যান্ডমিউজিক বাজিয়ে হইচই ফেলে দিলো আত্মজীবনী।
যে বিষয়গুলো ভুলে গেছি। মইনুকে দাওয়াত দিয়ে ঘোড়া উপহার দিয়েছিল দিল্লি। ৫ জানুয়ারির আগে এরশাদকে দিল্লিতে হাজিরা দিতে বাধ্য করা হলো। এরশাদকে ‘হাইজ্যাক’ করে সুজাতার নির্বাচন সার্জারি। ক্ষমতায় এসেই প্রটোকল বাদ দিয়ে দিল্লির সাথে করা চুক্তিগুলো আওয়ামী লীগের ইচ্ছায় বলে মনে করা যায় না। এবার হাজিরা দিতে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সাঙ্গপাঙ্গরা। এসব কেন? সালমান খুরশিদ সাহেব জানালেন, ‘সরকার সমর্থিত যুবশক্তি এবং জামায়াত রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে গেলে, সেই পরিস্থিতিতে ভারত আওয়ামী লীগকেই বেছে নেয়।’ সজীব ওয়াজেদ যে দিন টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে বললেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় যাবে।’ আমরা তখন কি গুরুত্ব দিয়েছি? এত কিছুর পরেও জনরোষ মহামারী আকার ধারণ করলে লীগের সমস্যা কী? ‘ভারতের নির্দেশে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ হয়তো ইতস্তত বোধ করছে; কিন্তু ভারত চায় জামায়াত নিষিদ্ধ হোক’ -সোস্যাল মিডিয়া।
এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ নয়। বাংলাদেশের মানুষ এতো নিষ্ঠুর না। বিচারকেরাও এতটা অবিবেচক নন। গণতন্ত্রের জন্য একদা লড়াকু আওয়ামী লীগ হেরে গেলেও ‘৫ জানুয়ারি’ সৃষ্টি করত না। সকালে রায়, বিকেলে ফাঁসি দিতো না। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কখনোই এমন আচরণ করত না, যা তারা করতে বাধ্য হচ্ছে। মূলত বাংলাদেশীরা কোমল হৃদয়ের জন্য প্রশংসিত। কর্মক্ষেত্রে বিদেশীদের ইতিবাচক দৃষ্টি। তাহলে কার সন্দেহ সত্য? তথ্য-উপাত্ত বলছে, শিয়া-সুন্নির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী বিশেষ বহিঃশক্তি। জোট ভাঙার চিন্তা আওয়ামী লীগ করবে না; কারণ, ১৯৮৪ থেকে সব দলই এক সাথে পার্লামেন্টে। ইরান-ইরাকের মতো কিছুই ঘটেনি। তাহলে রাতারাতি এমন কী ঘটল?
জামায়াত ও বিএনপিকে অবৈধ ঘোষণার বার্তাও বাইরে থেকে আসা। খোলামেলাই খালেদাকে মোদি পছন্দ করেন না এবং রাজনীতিতেও চান না, সেটাই বেরিয়ে এলো সালমানের আত্মজীবনীতে। জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে দিল্লির সরাসরি চাপ এবং আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল বানানোর ইঙ্গিতও এ বইতে। পঙ্কজ শরণও যা জানেন, ২০ দল জানে না। পঙ্কজ ও সালমানের বক্তব্য হুবহু হওয়ায় প্রমাণিত হলো, এ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে কারা। জোটের রাজনীতি বাঁচিয়ে রাখার মতো ভুল প্রণব বাবুরা করবেনই না। প্রণবের সাথে হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই খালেদার ভারত সফরের তথ্য বইটিতে। রাষ্ট্র নয়, বরং ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক এবং ২০২১-২০৪১ নিয়ে উল্টাপাল্টা দাবি ফিউশন লীগের কাজ।
৩.
‘সন্ত্রাস’ নিয়ে দুই দেশের একই জিরো টলারেন্স রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের অপপ্রচার সন্দেহজনক। দশম সংসদের চেহারা পাল্টে যাওয়ার মূলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঢাকা-দিল্লি জিরো টলারেন্সের বিষয়ে ন্যূনতম গবেষণা নেই। প্রয়োজন হলেই জঙ্গি আছে, আবার নেই।
সাত বছরের অধিক সময় ধরে ‘সন্ত্রাসীর’ তকমাটি বিনা হিসেবেই নয়। গোয়েবলসের উক্তি, ‘সাতবার মিথ্যা বললে মিথ্যাও সত্য মনে হয়।’ বিষয়টি খেয়াল করুন। ইনুরা আর ২০ দল না বলে, বলেন সন্ত্রাসী দল। অবৈধ সরকারের ভাষায় বিএনপি একটি সন্ত্রাসী জোট। খালেদার নাম সন্ত্রাসের রানী। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সন্ত্রাস প্রচারে মরিয়া ঢাকা-দিল্লি। অদৃশ্য যোগসূত্র আছে বলেই স্বাভাবিক বাঙালির চরিত্র ত্যাগ করতে বাধ্য ৯০-এর আওয়ামী লীগ। আমরা আমাদের মা-বোনদের মায়া-মমতা সম্পর্কে জানি। কখনোই তারা এই মাত্রায় অসহিষ্ণু নয়। পাওয়ার লোভে সন্তানের রক্ত কখনোই হাতে মাখাবে না কিন্তু সেটাই করা হলো ক্ষমতার জন্য। মুজিব থাকলে ট্রাইবুন্যালের প্রেসক্রিশন নাকচ হতো। যেমন হয়েছিল বাংলাদেশে ভারতের সেনাঘাঁটি বানাতে ইন্দিরার অনুরোধ। গণহত্যার পরেও ১৯৭৪ সালে ভুট্টোকে তিনিই দাওয়াত দিয়ে এনে ঢাকার বিমানবন্দরে শুধু বুকেই জড়িয়ে ধরেননি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও লালগালিচা সংবর্ধনা। ভুট্টোর গাড়িতে পাকিস্তান-বাংলাদেশের পতাকাসহ জাতীয়সৌধে নিয়ে তরুণ তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে পুষ্পস্তবক অর্পণের ভিডিও ইউটিউবে (২৭ জুন ১৯৭৪, ভুট্টোর পাশে তোফায়েল ভাইয়ের মাথা ভরা কালো চুল)। ওআইসি সম্মেলনেও পাকিস্তানে দুই নেতার ভ্রাতৃসুলভ বহু ছবি ইন্টারনেটে। ’৭১-এর মুসোলিনি টিক্কা খানের সাথে হ্যান্ডশেক? আসলে ক্ষমার এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশীদের মৌলিক চরিত্র। গণহত্যা সত্ত্বেও ভুট্টোকে ঢাকায় আনার মধ্যে সূক্ষ্ম বার্তা, অতীত না ভুললে সামনে যাওয়া যাবে না। যুদ্ধপরবর্তী জার্মানিতে মুসোলিনিকে জার্মানির চ্যান্সেলরের দাওয়াতের অবাস্তব ঘটনাই বাস্তব করলেন মুজিব। আদালতে নিজামীর বক্তব্য, ‘গণহত্যা করেছে ভুট্টো।’ কোনো কোনো নেতা ইউটার্নের জন্য দায়ী কি সত্যিই আওয়ামী লীগ, নাকি ফিউশন লীগ?
৪.
হোটেল সোনারগাঁওয়ে জোটের ১০ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে মোদির প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি খালেদা। বিচ্ছিন্নবাদীদের আশ্রয় প্রশ্নেও বিভ্রান্ত খালেদা। গুজব আমলে নিতে হবে। মিডিয়ার প্রকাশ, জামায়াতকে নিষিদ্ধ দেখতে চায় ভারত। সুতরাং সন্ত্রাসী তকমা কপালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ... সব শ্রেণীরই হয়তো ফাঁসি হবে। ১০০ ভাগ প্রস্তুতি ট্রাইব্যুনাল এবং নির্বাহীর বডিল্যাংগুয়েজে। আমরা ৭৩-৭৪-এর মতো কোনো দলকেই গর্তে দেখতে চাই না, কিন্তু খবর, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে কোনো কোনো দল। এই দেশে শিয়া-সুন্নির পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে লাভ একটি দেশের।
যেহেতু সব কিছুই ইন্টারনেটে, ব্লেমগেইম থেকে বের হয়ে আসাটা আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে জরুরি। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ৯ মাস মুজিব পরিবার ঢাকাতেই ছিল এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তাতেই ছিল। রাও ফরমান আলীর ইতিবাচক আচরণ ছাড়া এসব কিছু অসম্ভব। যেখানে সবাই দৌড়ের ওপরে, মাইরের ওপরে, ’৭১-এ মুজিবের মাকে টুঙ্গিপাড়া থেকে হেলিকপ্টারে এনে পিজিতে চিকিৎসা দেয়ার সৌভাগ্য তখন আর কোন বাঙালির? ৩২ নম্বর থেকে বের হয়ে ভারতীয়দের জিপে চড়লেন ১৭ ডিসেম্বর (সাক্ষাৎকারগুলো ইউটিউবে)।
অস্তিত্ব এবং অধিকারসঙ্কটে জর্জরিত ভিকটিম দলগুলোর হাইকমান্ডের অনেক কিছুই আমলে নেয়া উচিত ছিল। তাদের সামনে জীবনমৃত্যু প্রশ্ন। মোদিকে লিখিত অভিযোগ করার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কোন দল নিষিদ্ধ হবে, ভোটে কে জিতবে, সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাইরের কারো হতে পারে না । বাংলাদেশের বেশির মানুষই জুডিশিয়াল কিলিং সমর্থন করে না। মানুষ যতেই ঘুমাবে, খুঁটি ততই গভীরে যাবে।
৫.
যদি সন্তানের মৃত্যুর পর আবিষ্কার করেন, ডাক্তারের ফার্মেসি ব্যবসা এবং অতিরিক্ত ওষুধ বিক্রির কারণেই পুত্রের মৃত্যু, তখন? রায় লেখা বিচারকই যদি দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে খোলামেলা অ্যাক্টিভিজমে নামে এটা অন্যায়, জুরিসপ্র“ডেন্সে এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় খালেদার বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে দুই ফাঁসির রায় টিমের অন্যতম বিচারক ছিলেন। ২০১৩ সালে ইকোনমিস্ট পত্রিকার দাবি, ৩০ লাখ শহীদ হলে জনসংখ্যা অনুযায়ী, ২৫ জনে ১ জন। শর্মিলা বসুসহ অনেকেই সংখ্যার ব্যাখ্যা করায় সরকার নাখোশ। ২৫ জনে ১ জন শহীদ হলে, সংখ্যা করা কি কঠিন? বড়জোর ৩ বাড়ি মিলে ২৫ সদস্য। তাহলে তালিকা না করে খালেদার লেজে আগুন দেয়া কেন? আসলে ’৭১-এর অনেক কিছু অন্ধকারে রেখে, গুজবের ফসল ঘরে তুলছে ফিউশন লীগ। অথচ ৬৪টি জেলায় ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেই ১ মাসে শহীদের সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব। গাঁটের টাকায় নিজ জেলায় সংখ্যা নির্ণয় করেছি অতি সহজে। আসছি মূল কথায়। জুডিশিয়াল কিলিং বিষয় নিয়ে পাবলিকের সন্দেহ মিথ্যা হলে, রায় লেখা বিচারপতিকে কেন অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকায় দেখতে হলো? ঘাদানি ও ছাত্রলীগের সাথে আন্দোলন করার পরেও ২০ দলের বিরুদ্ধে কোন আইনে বক্তব্য দিতে পারেন এই বিচারপতি? খালেদার বাড়ি ঘেরাওয়ের পর টকশোতে দলীয় এমপির মতোই বক্তব্য কি আপত্তিকর নয়? তবুও আমজনতার দীর্ঘ দিনের সন্দেহ দূর করার জন্য বিচারপতি মানিককে ধন্যবাদ। তিনি অ্যাক্টিভিস্ট এবং আইনের লোকদের কাজ অনেক সহজ করে দিলেন।
বিচারক কখনোই নিজের এজলাসে ব্যক্তিগত মক্কেলের বিচার করতে পারেন না। জুরিসপ্র“ডেন্সে সেটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বহুল বিতর্কিত বিচারপতি তার আগের চরিত্রে ফিরেছেন। কর্মসূচিতে আবারো সক্রিয়... ২৬ নভেম্বর ঘাদানিক-এর সভায় অন্যান্য নেতার সাথে তিনি স্টেজেই ছিলেন। ...রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাংবিধানিক শপথ লঙ্ঘন করেছেন। ...বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার পেছনে বড় ভূমিকা ঘাদানিকের। ...যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচারক ছিলেন তিনি তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রেখেছিলেন, একই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির কর্মসূচিতেও তিনিই আবার সশরীরে হাজিরা যেন সাপ হয়ে কামড়ানো আর ওঝা হয়ে ঝাড়ো। খালেদার বাড়ির সামনে ‘জয়বাংলা’ বলে সেøাগান দিয়ে তার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। তার চিঠি থেকে জানা গেছে, অবসরের যাওয়ার পর তিনি আর কোনো রায় লিখতে পারবেন না বলে প্রধান বিচারপতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলন...।
জামায়াত না জাপা নিষিদ্ধ হবে, সিদ্ধান্ত বাংলাদেশীদের। স্বাইপ কেলেঙ্কারির পর বিচারপতি মানিকের অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোটিভ পুরোপুরি উন্মোচিত হলো। খালেদাকেও মোদির ১০ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে ২০ দলের পতন ফাইনাল। এ দিকে ফিউশন আওয়ামী লীগ অস্তিত্বসঙ্কটে। দিল্লি এখন তাদের গলার কাঁটা। না পারে গিলতে, না পারে উগরাতে। সম্মিলিতভাবে আগ্রাসী শক্তি ঠেকানোর এখনই সময়। মানবাধিকারের পত্র হাতে রাজপথে দাঁড়ালে এক কোটি মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের মতো যথেষ্ট বুলেট আর পুলিশ নেই। অচলাবস্থা অবসানের একমাত্র উপায়- রাজপথে অন্তত মানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থান।
সারমর্ম : ‘আওয়ামী লীগই বেছে নেয় ভারতকে’- ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে গোমর ফাঁসের জন্য অনেক অভিনন্দন। তবে ২০০ বছর দেরিতে হলেও কুঠিবাড়ির ষড়যন্ত্রকারীর বিচার হবেই।
ইমেইল: farahmina@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.minafarah.com
No comments