জানমালের রক্ষক যেভাবে হন ভক্ষক by জসিম উদ্দিন
পুলিশের নির্যাতনের শিকার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাশ |
নিরাপত্তা
নিয়ে মানুষ কতটা আশঙ্কার মধ্যে থাকেন রাস্তায় নামলে তা সহজে অনুমান করা
যায়। গাড়ির গায়ে বড় করে স্টিকারে লেখা থাকে ‘আইনজীবী’, ‘সাংবাদিক’,
‘প্রেস’। সরকারি বিভিন্ন বিভাগের নামও লেখা থাকে। ডাক্তার, প্রকৌশলীরাও
ব্যবহার করেন এমন স্টিকার। নিজেকে সমাজে উঁচুস্তরের একজন মানুষ হিসেবে তুলে
ধরার দৃষ্টিকটু চেষ্টা রাস্তায় প্রদর্শিত হওয়ার বিষয় নয়। মূলত নিজেদের
একটি বিশিষ্ট শ্রেণীতে শনাক্তকরণে লক্ষ্য থাকে রাস্তায় অনাকাক্সিক্ষত
পরিস্থিতি এড়ানো। এ ধরনের পরিচিতি প্রকাশের চেষ্টা আগে চোখে পড়ত না। এখন
দেখা যাচ্ছে, পুলিশ নিজেই তার ব্যক্তিগত গাড়িতে নিজের পরিচিতি লিখে রাখছে।
নিরাপত্তার সাথে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর গাড়ি চেনা যায়। সেনাবাহিনীর গাড়িতে
নিজেদের পরিচিতি চিহ্ন স্পষ্ট সাঁটানো থাকে। সাধারণ মানুষ যারা ক্ষমতা
চর্চার কোনো সুয়োগ রাখে না তারা এই সুযোগের বাইরে থাকছে। এই পরিচিতি
নিপীড়কদের জন্য সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম
রাব্বী একা রাস্তায় চলতে গিয়ে মাশুল দিয়েছেন। কারণ তার পরিচিতি কোথাও
সাঁটানো দেখতে পায়নি নির্য়তানকারী পুলিশ। তিনি একাই এ নির্যাতনের শিকার
হননি, সাক্ষী হয়েছেন আরো অনেকের ওপর কিভাবে নির্যাতন চালায় পুলিশ তারও।
সামাজিক মাধ্যমে নিজের নির্যাতন চিত্রের পাশাপাশি সেগুলোও তুলে ধরেছেন
রাব্বী।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান হাসপাতালে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে দেখতে গিয়ে কিছু সত্য কথা বলেছেন। এত দিন চুপ হয়ে থাকলেও মানবাধিকার যে লুণ্ঠিত হচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার এবারের প্রতিক্রিয়ায়। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে বিকাশকে দেখে বের হওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে একধরনের দায়মুক্তির ভাব গ্রাস করেছে। তাদের কোনো কিছু হবে না, কোনো কিছু স্পর্শ করবে না ভাবছে।’ মিজানের এই বক্তব্যের মধ্যে গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সদ্য বিগত সংসদের বিরোধী দলের হুইপকে রাস্তায় প্রকাশ্যে পেটানোর পর ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যে দুইজন কর্মকর্তা সরসারি তাকে পিটিয়েছে উভয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাদের প্রমোট করার ক্ষেত্রে সুপারসিড করার অভিযোগ আছে। আইনশৃঙ্খলা ভাঙার প্রবণতা পুলিশের মধ্যে সব সময় লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এর একটা মাত্রা ছিল। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে তা ভয়ানক বেপরোয়া রূপ ধারণ করে। রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে কেন্দ্র করে সরকারের ঢিল দেয়া রশি ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে গেছে পুলিশের বিশাল একটা অংশ নিজেদের সম্ভবত আর কোনো শৃঙ্খলা কাঠামোর মধ্যে ভাবতে পারে না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, পাকড়াও এবং যেনতেনভাবে মামলায় জড়িয়ে দেয়ার একটা ফ্রি লাইসেন্স তাদের মধ্যে রয়েছে। যারা বিরোধীদের দমনে বেশি পারদর্শী তাদের প্রমোশন অন্যদের এ কাজে উৎসাহী করেছে।
ক্ষমতার ব্যবহার করে নিরস্ত্র বিরোধী নেতাকর্মীদের ছন্নছাড়া করে দেয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্য জায়গায়। বিরোধী শক্তি যখন নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় এই দানবীয় শক্তি প্রয়োগের জন্য নতুন জায়গা দরকার হয়। একবার কাঁচা মাংসের লোভ পেয়ে গেলে তা সংবরণ করা যেমন কঠিন, এটিও তেমন একটি কাজ। বিরোধীদের প্রতিরোধ শক্তি যখন শেষ হয়ে গেল কিংবা তাদের চিবিয়ে খাওয়ার যখন কিছুই থাকল না তখন লাগামহীন শক্তি প্রয়োগের শিকার হন সাধারণ মানুষ। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে মন্তব্য করেছেন এটা তার তাৎপর্য। বিকাশ-রাব্বীও এমন শিকার তবে বিশেষ কমিউনিটির সদস্য হওয়ায় সৌভাগ্যবান। নির্যাতনের একটি ন্যূনতম প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা তাদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে। একটু পিছু হটে পুলিশের সাথে তাল মিলিয়ে মানবাধিকারের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘ডিএমপি কমিশনার সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। আমরাও তার কথায় আস্থা রাখতে চাই, বিশ্বাস রাখতে চাই।’ বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো অন্যায় অপরাধের জন্য পুলিশ সদস্যের বিচার হয়েছে সম্প্রতি এমন কোনো নজির নেই। কর্মকর্তারা রীতিমতো সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিশেষ সুবিধা নিয়ে আছেন। খুন থেকে শুরু করে ছিনতাই, ধর্ষণ এমন কোনো অপরাধ নেই যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে আসেনি। এত দিনে পুলিশের একটি তদন্ত কমিশন এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। এর একটা ভাইটাল কারণও আছে। রাব্বীর সম্মান রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বয়ং চিঠি লিখে আবেদন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর। মহাশক্তিধর পুলিশ যদি ওপরের তলার মানুষের এমন আবেদন অগ্রাহ্য করে তাহলে আর কিছুই বাদ থাকে না। এই তদন্ত প্রতিবেদনও বিতর্কিক হয়ে যায় যখন দেখা গেল এটি তৈরির ক্ষেত্রে এমন একজন জড়িত রয়েছেন যিনি স্বয়ং আইন ভঙ্গ করেছিলেন। একজন আইনভঙ্গকারী কোনোভাবে অন্যের অপরাধের তদন্ত করার নৈতিক অধিকার রাখেন না।
মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বিকাশ চন্দ্র দাস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী এই দু’জনের বেলায় অন্ততপক্ষে দৃষ্টান্ত রাখুন। প্রমাণ করুন আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। পুলিশের কেউ অপরাধ করলেও রাষ্ট্র তা সহ্য করবে না তা আমরা দেখতে চাই। মিজানুর রহমান মানবাধিকারের লুণ্ঠন নিয়ে আগে পুলিশের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য না করলেও তার এই মন্তব্য এর একটা স্বীকৃতি এসেছে যে, আগে থেকেই পুলিশ নিপীড়কের ভূমিকায় রয়েছে। বিকাশ চন্দ্র দাসের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, তিনি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। কথাও অস্পষ্ট। ঘাড়ে, মাথার পেছনে, হাঁটুতে চরম আঘাত পেয়েছেন। দুটো পা নাকি তার অবশ মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে। তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছেন তিনি। এ ঘটনায় ভবিষ্যতে তার কিডনি বা লিভারে প্রভাব ফেলবে কি না তা চিকিৎসকেরা পরে বলতে পারবেন। মিজানের এমন দরদি পর্যবেক্ষণ দলমত ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে হলে তার পদের মর্যাদা রক্ষা হতো। নির্যাতনের শিকার ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা ব্যয়ভার রাষ্ট্রের বহন করা উচিত বলে তিনি এবার উল্লেখ করেন। তিনি জানান, মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও যথাযথ জায়গায় আবেদন, সুপারিশ করা হবে। মানাবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ভিকটিমের পক্ষ হয়ে শুরু থেকে যদি এমন কথা বলে আসতেন অনেকে উপকৃত হতেন। এমন প্রচেষ্টা চালিয়ে তিনি যদি ব্যর্থও হতেন অন্তত তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারতেন ফরিয়াদিদের পক্ষ থেকে।
প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশের অন্যায় অপকর্ম ও আইন ভঙ্গের ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে।
অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে আরো হাজারো ঘটনা। অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিক জায়গায় আনতে হলে তাদের প্রয়োজন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ। কার্যকর জোরালো জনসংযোগ ও কমিউনিটির সাথে অব্যাহত যোগাযোগ। এমন হলে নাগরিকদের সেবা দেয়ার মানসিকতা পুলিশের মধ্যে নতুন করে জাগতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের কার্যক্রম পুলিশের মধ্যে রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সঠিক জায়গাটি আমরা না দেখার ভান করছি। পুলিশি ব্যবস্থায় যে ব্যাপকভাবে দূষণ ছড়িয়ে গেছে এই বিষয়টা জোর গলায় বলতে সাহস পাচ্ছি না। বিকাশকে মারার সময় পুলিশের মুখ থেকে রোগটি প্রকাশ পেয়েছে। সে সময় একজন পুলিশ এমন বলে যে, ‘মাছের রাজা ইলিশ; দেশের রাজা পুলিশ’। এ ধরনের বচনের কারণ অবাস্তব কিছু নয়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরিবর্তে পেশিশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কাজটি এবার পুলিশ সাফল্যের সাথে করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে পুলিশ ঢের বেশি ব্যবহার হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয়ার কাজে। লাঠি ও রাইফেল কতটা কার্যকর বিকাশকে নির্যাতন করতে যাওয়া পুলিশ ভালো করে দেখেছে রাজনীতির টালমাটাল সময়গুলোতে। জনগণের বিরুদ্ধে সরকার ও পুলিশের এমন একাট্টাকে দোষের কিছু হিসেবে যারা দেখছেন না; তারা পরামর্শ দিচ্ছেন পুলিশের প্রশিক্ষণ ঘাটতিকে পূরণ করার। আসলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে পুলিশের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম এবং এর অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ব্যবহার। জনমনে ধারণা রয়েছে পুলিশে নিয়োগ পেতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ধরনের ঘুষপ্রবণতা এখন একেবারে সাধারণ সিপাহি নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে।
অত্যাচর নির্যাতন করে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করবে এমন নিকৃষ্ট মানসিকতা বাংলাদেশের পুলিশের মধ্যে এখনো বিস্তার লাভ করেনি। রাব্বীকে পুলিশের ওই পরিদর্শক প্রথমে জিজ্ঞাসা করে তিনি কত টাকা বেতন পান। এরপর পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই হিসাব-নিকাশ করেন তার আর্থিক অবস্থা কেমন হতে পারে। এর একটা বিবরণ তিনি সামনেই শুনিয়ে দেন রাব্বীকে। তার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে তখনই পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ইয়াবা বহনের মামলার হুমকি দেয়া হয়। টাকা কামানোর নেশা তাকে এতটাই উন্মাদ করে দেয় যে, রাব্বীর পোস্ট পজিশন এবং এ ধরনের ঘটনার পরিণতি কী হতে পারে তা ভাবারই অবকাশ পাননি তিনি। রাব্বী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সরকারি প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত তার বন্ধুদের রেফারেন্স দেন। সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছাত্রলীগের নেতাদের নামও নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নামও নেন। টাকার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা পুলিশ কর্তা রাব্বীর ঘটনাকে নিত্যকার একটি মামলা হিসেবে বিবেচনা করছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন অনেকেই তো অনেক কথা বলে বাঁচার জন্য। হাতিঘোড়া গেল তল চামচিকা বলে কত জল- এ ধরনের একটি বিষয়ই হয়তো তার কাছে ঘুরে ফিরে মনে হয়েছে। খাওয়া ধরতে যে তিনি ভুল করেছেন তিনি হয়তো এখন বুঝতে পেরেছেন। রাস্তায় জানমালের হেফাজত করছে না উল্টো এর ভক্ষক হয়ে উঠেছে পুলিশ, রাব্বীর ফেসবুক বয়ানে তা উঠে এসেছে। রাব্বী দেখতে পান রিকশা যাত্রী এক মহিলাকে টেনে-হেঁচড়ে আনা হয়। তার কাছে থাকা টাকা ও অলঙ্কার দিয়ে দিতে বলা হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে পতিতাবৃত্তির অভিযোগ এনে স্বামীকে জানানো হবে। এই সময় সেই মহিলাকে পেছনে আঘাত করা হয়। আলামত হিসেবে তারা কিছু কনডমও তৈরি রাখে। রাব্বী আরো দেখেন যে, ধরে আনা হয় এক কিশোরকে। ফোন করে মাকেও আনা হয়। উভয়কে বেধড়ক পেটানো হয়। পুলিশ দাবি করে ছেলেটি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা ছাড়া পান।
খেপ ধরার অভিযান যে একটি নিত্যকার ঘটনা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশকে নির্যাতনের স্টাইল থেকে তা আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। রাব্বীর ঘটনাটি এভাবে দৃশ্যপটে চলে না এলে বিকাশের মারধরের ঘটনাটি আড়ালে পড়ে যেত। ভাগ্য ভালো সমাজের উঁচুতলার রাব্বী পথ করে দিলেন বিকাশকে নির্যাতনের বিচারের। সকালে রাজধানীর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজ তদারকি করছিলেন তিনি। যাত্রাবাড়ী থানার টহলরত পুলিশ তাকে আটক করে বেধড়ক পেটায়। হোন্ডার গায়ে তার পরিচিত লেখা থাকার পরও পুলিশ কোনো ধরনের বিচলিত হয়নি। এ ধরনের আগ্রাসী মারধরের কারণ হচ্ছে ভয় লাগিয়ে দেয়া। যাতে করে টাকা হড়হড় করে বের হয়। রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে এতটাই আঘাত করা হয়েছে তিনি বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে অচেতন ছিলেন। কাঁড়িকাঁড়ি টাকা দিয়ে যারা নিয়োগ পান তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে উৎসাহী হবেন কেন? অনেকে ধারকর্জ কিংবা স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে নিয়োগ পান। তাকে তো আগে খরচ করা টাকা ওঠাতে হবে। তারপর না হয় সে নীতি-নৈতিকতা ও বৈধতার চিন্তা করবে।
jjshim146@yahoo.com
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান হাসপাতালে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে দেখতে গিয়ে কিছু সত্য কথা বলেছেন। এত দিন চুপ হয়ে থাকলেও মানবাধিকার যে লুণ্ঠিত হচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার এবারের প্রতিক্রিয়ায়। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে বিকাশকে দেখে বের হওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে একধরনের দায়মুক্তির ভাব গ্রাস করেছে। তাদের কোনো কিছু হবে না, কোনো কিছু স্পর্শ করবে না ভাবছে।’ মিজানের এই বক্তব্যের মধ্যে গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সদ্য বিগত সংসদের বিরোধী দলের হুইপকে রাস্তায় প্রকাশ্যে পেটানোর পর ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যে দুইজন কর্মকর্তা সরসারি তাকে পিটিয়েছে উভয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাদের প্রমোট করার ক্ষেত্রে সুপারসিড করার অভিযোগ আছে। আইনশৃঙ্খলা ভাঙার প্রবণতা পুলিশের মধ্যে সব সময় লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এর একটা মাত্রা ছিল। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে তা ভয়ানক বেপরোয়া রূপ ধারণ করে। রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে কেন্দ্র করে সরকারের ঢিল দেয়া রশি ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে গেছে পুলিশের বিশাল একটা অংশ নিজেদের সম্ভবত আর কোনো শৃঙ্খলা কাঠামোর মধ্যে ভাবতে পারে না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, পাকড়াও এবং যেনতেনভাবে মামলায় জড়িয়ে দেয়ার একটা ফ্রি লাইসেন্স তাদের মধ্যে রয়েছে। যারা বিরোধীদের দমনে বেশি পারদর্শী তাদের প্রমোশন অন্যদের এ কাজে উৎসাহী করেছে।
ক্ষমতার ব্যবহার করে নিরস্ত্র বিরোধী নেতাকর্মীদের ছন্নছাড়া করে দেয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্য জায়গায়। বিরোধী শক্তি যখন নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় এই দানবীয় শক্তি প্রয়োগের জন্য নতুন জায়গা দরকার হয়। একবার কাঁচা মাংসের লোভ পেয়ে গেলে তা সংবরণ করা যেমন কঠিন, এটিও তেমন একটি কাজ। বিরোধীদের প্রতিরোধ শক্তি যখন শেষ হয়ে গেল কিংবা তাদের চিবিয়ে খাওয়ার যখন কিছুই থাকল না তখন লাগামহীন শক্তি প্রয়োগের শিকার হন সাধারণ মানুষ। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যে মন্তব্য করেছেন এটা তার তাৎপর্য। বিকাশ-রাব্বীও এমন শিকার তবে বিশেষ কমিউনিটির সদস্য হওয়ায় সৌভাগ্যবান। নির্যাতনের একটি ন্যূনতম প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা তাদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে। একটু পিছু হটে পুলিশের সাথে তাল মিলিয়ে মানবাধিকারের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘ডিএমপি কমিশনার সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। আমরাও তার কথায় আস্থা রাখতে চাই, বিশ্বাস রাখতে চাই।’ বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো অন্যায় অপরাধের জন্য পুলিশ সদস্যের বিচার হয়েছে সম্প্রতি এমন কোনো নজির নেই। কর্মকর্তারা রীতিমতো সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিশেষ সুবিধা নিয়ে আছেন। খুন থেকে শুরু করে ছিনতাই, ধর্ষণ এমন কোনো অপরাধ নেই যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে আসেনি। এত দিনে পুলিশের একটি তদন্ত কমিশন এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। এর একটা ভাইটাল কারণও আছে। রাব্বীর সম্মান রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বয়ং চিঠি লিখে আবেদন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর। মহাশক্তিধর পুলিশ যদি ওপরের তলার মানুষের এমন আবেদন অগ্রাহ্য করে তাহলে আর কিছুই বাদ থাকে না। এই তদন্ত প্রতিবেদনও বিতর্কিক হয়ে যায় যখন দেখা গেল এটি তৈরির ক্ষেত্রে এমন একজন জড়িত রয়েছেন যিনি স্বয়ং আইন ভঙ্গ করেছিলেন। একজন আইনভঙ্গকারী কোনোভাবে অন্যের অপরাধের তদন্ত করার নৈতিক অধিকার রাখেন না।
মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বিকাশ চন্দ্র দাস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী এই দু’জনের বেলায় অন্ততপক্ষে দৃষ্টান্ত রাখুন। প্রমাণ করুন আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। পুলিশের কেউ অপরাধ করলেও রাষ্ট্র তা সহ্য করবে না তা আমরা দেখতে চাই। মিজানুর রহমান মানবাধিকারের লুণ্ঠন নিয়ে আগে পুলিশের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য না করলেও তার এই মন্তব্য এর একটা স্বীকৃতি এসেছে যে, আগে থেকেই পুলিশ নিপীড়কের ভূমিকায় রয়েছে। বিকাশ চন্দ্র দাসের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, তিনি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। কথাও অস্পষ্ট। ঘাড়ে, মাথার পেছনে, হাঁটুতে চরম আঘাত পেয়েছেন। দুটো পা নাকি তার অবশ মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে। তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছেন তিনি। এ ঘটনায় ভবিষ্যতে তার কিডনি বা লিভারে প্রভাব ফেলবে কি না তা চিকিৎসকেরা পরে বলতে পারবেন। মিজানের এমন দরদি পর্যবেক্ষণ দলমত ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে হলে তার পদের মর্যাদা রক্ষা হতো। নির্যাতনের শিকার ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা ব্যয়ভার রাষ্ট্রের বহন করা উচিত বলে তিনি এবার উল্লেখ করেন। তিনি জানান, মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও যথাযথ জায়গায় আবেদন, সুপারিশ করা হবে। মানাবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ভিকটিমের পক্ষ হয়ে শুরু থেকে যদি এমন কথা বলে আসতেন অনেকে উপকৃত হতেন। এমন প্রচেষ্টা চালিয়ে তিনি যদি ব্যর্থও হতেন অন্তত তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারতেন ফরিয়াদিদের পক্ষ থেকে।
প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশের অন্যায় অপকর্ম ও আইন ভঙ্গের ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে।
অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে আরো হাজারো ঘটনা। অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিক জায়গায় আনতে হলে তাদের প্রয়োজন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ। কার্যকর জোরালো জনসংযোগ ও কমিউনিটির সাথে অব্যাহত যোগাযোগ। এমন হলে নাগরিকদের সেবা দেয়ার মানসিকতা পুলিশের মধ্যে নতুন করে জাগতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের কার্যক্রম পুলিশের মধ্যে রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সঠিক জায়গাটি আমরা না দেখার ভান করছি। পুলিশি ব্যবস্থায় যে ব্যাপকভাবে দূষণ ছড়িয়ে গেছে এই বিষয়টা জোর গলায় বলতে সাহস পাচ্ছি না। বিকাশকে মারার সময় পুলিশের মুখ থেকে রোগটি প্রকাশ পেয়েছে। সে সময় একজন পুলিশ এমন বলে যে, ‘মাছের রাজা ইলিশ; দেশের রাজা পুলিশ’। এ ধরনের বচনের কারণ অবাস্তব কিছু নয়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরিবর্তে পেশিশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কাজটি এবার পুলিশ সাফল্যের সাথে করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে পুলিশ ঢের বেশি ব্যবহার হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয়ার কাজে। লাঠি ও রাইফেল কতটা কার্যকর বিকাশকে নির্যাতন করতে যাওয়া পুলিশ ভালো করে দেখেছে রাজনীতির টালমাটাল সময়গুলোতে। জনগণের বিরুদ্ধে সরকার ও পুলিশের এমন একাট্টাকে দোষের কিছু হিসেবে যারা দেখছেন না; তারা পরামর্শ দিচ্ছেন পুলিশের প্রশিক্ষণ ঘাটতিকে পূরণ করার। আসলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে পুলিশের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম এবং এর অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ব্যবহার। জনমনে ধারণা রয়েছে পুলিশে নিয়োগ পেতে হলে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ধরনের ঘুষপ্রবণতা এখন একেবারে সাধারণ সিপাহি নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে।
অত্যাচর নির্যাতন করে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করবে এমন নিকৃষ্ট মানসিকতা বাংলাদেশের পুলিশের মধ্যে এখনো বিস্তার লাভ করেনি। রাব্বীকে পুলিশের ওই পরিদর্শক প্রথমে জিজ্ঞাসা করে তিনি কত টাকা বেতন পান। এরপর পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই হিসাব-নিকাশ করেন তার আর্থিক অবস্থা কেমন হতে পারে। এর একটা বিবরণ তিনি সামনেই শুনিয়ে দেন রাব্বীকে। তার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে তখনই পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ইয়াবা বহনের মামলার হুমকি দেয়া হয়। টাকা কামানোর নেশা তাকে এতটাই উন্মাদ করে দেয় যে, রাব্বীর পোস্ট পজিশন এবং এ ধরনের ঘটনার পরিণতি কী হতে পারে তা ভাবারই অবকাশ পাননি তিনি। রাব্বী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সরকারি প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত তার বন্ধুদের রেফারেন্স দেন। সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছাত্রলীগের নেতাদের নামও নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নামও নেন। টাকার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা পুলিশ কর্তা রাব্বীর ঘটনাকে নিত্যকার একটি মামলা হিসেবে বিবেচনা করছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন অনেকেই তো অনেক কথা বলে বাঁচার জন্য। হাতিঘোড়া গেল তল চামচিকা বলে কত জল- এ ধরনের একটি বিষয়ই হয়তো তার কাছে ঘুরে ফিরে মনে হয়েছে। খাওয়া ধরতে যে তিনি ভুল করেছেন তিনি হয়তো এখন বুঝতে পেরেছেন। রাস্তায় জানমালের হেফাজত করছে না উল্টো এর ভক্ষক হয়ে উঠেছে পুলিশ, রাব্বীর ফেসবুক বয়ানে তা উঠে এসেছে। রাব্বী দেখতে পান রিকশা যাত্রী এক মহিলাকে টেনে-হেঁচড়ে আনা হয়। তার কাছে থাকা টাকা ও অলঙ্কার দিয়ে দিতে বলা হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে পতিতাবৃত্তির অভিযোগ এনে স্বামীকে জানানো হবে। এই সময় সেই মহিলাকে পেছনে আঘাত করা হয়। আলামত হিসেবে তারা কিছু কনডমও তৈরি রাখে। রাব্বী আরো দেখেন যে, ধরে আনা হয় এক কিশোরকে। ফোন করে মাকেও আনা হয়। উভয়কে বেধড়ক পেটানো হয়। পুলিশ দাবি করে ছেলেটি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা ছাড়া পান।
খেপ ধরার অভিযান যে একটি নিত্যকার ঘটনা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশকে নির্যাতনের স্টাইল থেকে তা আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। রাব্বীর ঘটনাটি এভাবে দৃশ্যপটে চলে না এলে বিকাশের মারধরের ঘটনাটি আড়ালে পড়ে যেত। ভাগ্য ভালো সমাজের উঁচুতলার রাব্বী পথ করে দিলেন বিকাশকে নির্যাতনের বিচারের। সকালে রাজধানীর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজ তদারকি করছিলেন তিনি। যাত্রাবাড়ী থানার টহলরত পুলিশ তাকে আটক করে বেধড়ক পেটায়। হোন্ডার গায়ে তার পরিচিত লেখা থাকার পরও পুলিশ কোনো ধরনের বিচলিত হয়নি। এ ধরনের আগ্রাসী মারধরের কারণ হচ্ছে ভয় লাগিয়ে দেয়া। যাতে করে টাকা হড়হড় করে বের হয়। রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাকে এতটাই আঘাত করা হয়েছে তিনি বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে অচেতন ছিলেন। কাঁড়িকাঁড়ি টাকা দিয়ে যারা নিয়োগ পান তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে উৎসাহী হবেন কেন? অনেকে ধারকর্জ কিংবা স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে নিয়োগ পান। তাকে তো আগে খরচ করা টাকা ওঠাতে হবে। তারপর না হয় সে নীতি-নৈতিকতা ও বৈধতার চিন্তা করবে।
jjshim146@yahoo.com
No comments