প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে বিচারাঙ্গনে নানামুখী আলোচনা by গোলাম রব্বানী
অবসরে
যাওয়া বিচারপতিদের রায় লেখা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস
কে) সিনহার দেয়া বক্তব্য নিয়ে বিচারাঙ্গনে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, যেসব বিচারপতি অবসর গ্রহণ করে রায় লিখেছেন বা লিখছেন, তাদের
রায়ের আইনগত বৈধতা নিয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলো সবচেয়ে আলোচিত ত্রয়োদশ
সংশোধনীবিষয়ক রায়ও লেখা হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক
অবসরে যাওয়ার পর।
২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। গত ১৭ জানুয়ারি তার মেয়াদের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি একটি লিখিত বিবৃতি দেন। গত ১৯ জানুয়ারি রাতে বিবৃতিটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘ দিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত রায় হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনীবিষয়ক রায়। অবসরে গিয়েই এ রায় লিখেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরে রায়ের আলোকে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। সংশ্লিøষ্টরা সংবিধানের এ সংশোধনীকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এ ছাড়া বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ফতোয়াবিষয়ক একটি রায়ও দিয়েছেন অবসরে গিয়ে। ২০১১ সালে ১২ মে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করেছিলেন। পরে এর পূর্ণাঙ্গ কপি বের হয় ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। কিন্তু এর আগেই তিনি অবসরে যান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়া হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। এর আগে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ এ মামলার রায় দেন। এ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি অবসরে যান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন। তারও প্রায় এক বছর পর গত ৩১ ডিসেম্বর দেয়া হয় পূর্ণাঙ্গ রায়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সাবেক এ প্রধান বিচারপতি এখনো বহু মামলার রায় লিখছেন। রায় লিখছেন অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও। এখনো তার বহু রায় লেখা বাকি থাকলেও তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এবং সুপ্রিম কোর্ট বার বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছিল। এখন স্বয়ং প্রধান বিচারপতি এ ধরনের কার্মকাণ্ডকে সংবিধান পরিপন্থী বলে বিবৃতি দিয়েছেন। এ নিয়ে দেশের বিচারাঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা চলছে।
এ দিকে প্রধান বিচারপতির বিবৃতি বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট’, ‘নো কমেন্ট’।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি যদি এমন কথা বলে থাকেন তবে অনেক গোলমাল হয়ে যাবে। তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় অবৈধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বৈধ থেকে যায়। এটা ফিরে আসবে।’
প্রধান বিচারপতির বিবৃতিকে সমর্থন জানিয়ে আজ বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন।
সম্মেলনে বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণের নিয়োগপ্রাপ্তির পর সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ গ্রহণপূর্বক তার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। বিচারক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের যে শপথ বিচারক হিসেবে গ্রহণ করেন অবসরের পর তিনি আর ওই শপথের আওতায় থাকেন না।’
এ সময় তিনি আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে আমরা বারবার এ বিষয়টি বলে এসেছি। এখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্যে এটি আরো স্পষ্ট হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থী বলে যে রায়টি দিয়েছিলেন, তা তিনি স্বাক্ষর করেন তার অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর। তাই ওই রায়ের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই এবং তা অবৈধ। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ওই রায়ের সুযোগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজকে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে যে সঙ্কট, অস্থিরতা ও হানাহানি চলছে তার একমাত্র কারণ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনপদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন। আর এ বাতিলের পেছনে রয়েছে এ বি এম খায়রুল হকের সংবিধান পরিপন্থী অবৈধ রায়। তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সঙ্কট নিরসন করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, যখন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন, তখন তিনি বিচারক হিসেবে শপথে ছিলেন। ঘোষিত তারিখের দিন হিসেবেই রায়ে সই করা হয়। এ চর্চা দীর্ঘ দিনের। অবসরের পরে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয়, তাহলে মাসদার হোসেন মামলাসহ অনেক মামলাই হয়তো টিকবে না। কারণ, মাসদার হোসেন মামলার রায় বিচারপতি মোস্তফা কামাল অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন। আর এ চর্চা ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে, এমনকি ইংল্যান্ডেও আছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, কোনো বিচারপতি অবসরে গেলে তিনি শপথ থেকে মুক্ত হয়ে যান। সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে রায় লেখা এবং তাতে স্বাক্ষর করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুল ও হাইকোর্ট বিভাগের রুলে স্পষ্ট বলা আছে, যেকোনো মামলার রায় অবশ্যই প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করতে হবে এবং প্রকাশ্য আদালতে রায়ে স্বাক্ষর দিতে হবে। এখন কোনো প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারক অবসরে গেলে তার পক্ষে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা বা তাতে স্বাক্ষর করার সুযোগ কোথায়? আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা সঠিক।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশ্লেষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষক ড. শাহদীন মালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আগে বিচারপতিরা তাদের মেয়াদকালেই রায় লেখা শেষ করতেন। কিন্তু এখন অবসরে যাওয়ার পর অনেক বিচারপতি রায় লিখছেন। এটাকে গ্রহণযোগ্য ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। তবে অবসরে যাওয়ার আগেই রায় লেখা শেষ করা কাম্য বলে তিনি মনে করেন। সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী আরো বলেন, প্রধান বিচারপতি হয়তো অন্য বিচারপতিদের দায়িত্ব সম্পর্কে মনে করিয়ে দিতেই এটা বলেছেন। কারণ অনেক বিচারপতির রায় লিখতে অনেক সময় লাগে। তবে এর অন্যতম প্রধান কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ লোকজনের অভাব। বিচারপতিদের রায় লেখা সঠিক সময়ে শেষ করার জন্য তাদের সহকারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি এবং মানোন্নয়ন দরকার। সে জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ তদবিরভিত্তিক না হয়ে মেধাভিত্তিক হওয়া দরকার।
প্রসঙ্গত, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার বিবৃতিতে আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও আর বহাল থাকে না। আদালতের দলিল সরকারি নথি। একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের কাছে সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে স্বাক্ষর করার অধিকার হারান। আশা করি, বিচারকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকবেন।
তিনি আরো বলেন, বিচার বিভাগের বর্তমান সন্ধিক্ষণে বেঞ্চ ও বার সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের ওপর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বার-এর ভূমিকাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী ও সহযোগিতামূলক বার নিঃসন্দেহে বেঞ্চের সবচেয়ে কার্যকর বন্ধু।
তিনি আরো বলেন, ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণের স্বার্থে যদি আইনজীবী ও বিচারকদের উদ্যোগের সম্মিলন ঘটানো যায়, তাহলে আমরা ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারব। আইন পেশার সাথে দায়িত্বশীলতার একটি সম্পর্ক রয়েছে। সুদূরপরাহত ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় জনগণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আইনজীবী ও বিচারকগণই তাদের প্রত্যাশা পূরণের প্রধান সারথি। একটি প্রার্থনালয় যেমন কখনো বন্ধ থাকতে পারে না, তেমনি লাখ লাখ বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের মন্দিরও কখনো বন্ধ থাকা উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। বিচার বিভাগ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে এবং গণমাধ্যম সেই বার্তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। গত ১৭ জানুয়ারি তার মেয়াদের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি একটি লিখিত বিবৃতি দেন। গত ১৯ জানুয়ারি রাতে বিবৃতিটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘ দিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত রায় হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনীবিষয়ক রায়। অবসরে গিয়েই এ রায় লিখেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরে রায়ের আলোকে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। সংশ্লিøষ্টরা সংবিধানের এ সংশোধনীকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এ ছাড়া বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ফতোয়াবিষয়ক একটি রায়ও দিয়েছেন অবসরে গিয়ে। ২০১১ সালে ১২ মে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করেছিলেন। পরে এর পূর্ণাঙ্গ কপি বের হয় ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। কিন্তু এর আগেই তিনি অবসরে যান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়া হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। এর আগে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ এ মামলার রায় দেন। এ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি অবসরে যান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন। তারও প্রায় এক বছর পর গত ৩১ ডিসেম্বর দেয়া হয় পূর্ণাঙ্গ রায়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সাবেক এ প্রধান বিচারপতি এখনো বহু মামলার রায় লিখছেন। রায় লিখছেন অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও। এখনো তার বহু রায় লেখা বাকি থাকলেও তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এবং সুপ্রিম কোর্ট বার বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছিল। এখন স্বয়ং প্রধান বিচারপতি এ ধরনের কার্মকাণ্ডকে সংবিধান পরিপন্থী বলে বিবৃতি দিয়েছেন। এ নিয়ে দেশের বিচারাঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা চলছে।
এ দিকে প্রধান বিচারপতির বিবৃতি বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট’, ‘নো কমেন্ট’।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি যদি এমন কথা বলে থাকেন তবে অনেক গোলমাল হয়ে যাবে। তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় অবৈধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বৈধ থেকে যায়। এটা ফিরে আসবে।’
প্রধান বিচারপতির বিবৃতিকে সমর্থন জানিয়ে আজ বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন।
সম্মেলনে বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণের নিয়োগপ্রাপ্তির পর সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ গ্রহণপূর্বক তার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। বিচারক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের যে শপথ বিচারক হিসেবে গ্রহণ করেন অবসরের পর তিনি আর ওই শপথের আওতায় থাকেন না।’
এ সময় তিনি আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে আমরা বারবার এ বিষয়টি বলে এসেছি। এখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বক্তব্যে এটি আরো স্পষ্ট হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থী বলে যে রায়টি দিয়েছিলেন, তা তিনি স্বাক্ষর করেন তার অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর। তাই ওই রায়ের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই এবং তা অবৈধ। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ওই রায়ের সুযোগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজকে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে যে সঙ্কট, অস্থিরতা ও হানাহানি চলছে তার একমাত্র কারণ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনপদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন। আর এ বাতিলের পেছনে রয়েছে এ বি এম খায়রুল হকের সংবিধান পরিপন্থী অবৈধ রায়। তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সঙ্কট নিরসন করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, যখন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন, তখন তিনি বিচারক হিসেবে শপথে ছিলেন। ঘোষিত তারিখের দিন হিসেবেই রায়ে সই করা হয়। এ চর্চা দীর্ঘ দিনের। অবসরের পরে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয়, তাহলে মাসদার হোসেন মামলাসহ অনেক মামলাই হয়তো টিকবে না। কারণ, মাসদার হোসেন মামলার রায় বিচারপতি মোস্তফা কামাল অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন। আর এ চর্চা ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে, এমনকি ইংল্যান্ডেও আছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, কোনো বিচারপতি অবসরে গেলে তিনি শপথ থেকে মুক্ত হয়ে যান। সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে রায় লেখা এবং তাতে স্বাক্ষর করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুল ও হাইকোর্ট বিভাগের রুলে স্পষ্ট বলা আছে, যেকোনো মামলার রায় অবশ্যই প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করতে হবে এবং প্রকাশ্য আদালতে রায়ে স্বাক্ষর দিতে হবে। এখন কোনো প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারক অবসরে গেলে তার পক্ষে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা বা তাতে স্বাক্ষর করার সুযোগ কোথায়? আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তা সঠিক।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশ্লেষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষক ড. শাহদীন মালিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আগে বিচারপতিরা তাদের মেয়াদকালেই রায় লেখা শেষ করতেন। কিন্তু এখন অবসরে যাওয়ার পর অনেক বিচারপতি রায় লিখছেন। এটাকে গ্রহণযোগ্য ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। তবে অবসরে যাওয়ার আগেই রায় লেখা শেষ করা কাম্য বলে তিনি মনে করেন। সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী আরো বলেন, প্রধান বিচারপতি হয়তো অন্য বিচারপতিদের দায়িত্ব সম্পর্কে মনে করিয়ে দিতেই এটা বলেছেন। কারণ অনেক বিচারপতির রায় লিখতে অনেক সময় লাগে। তবে এর অন্যতম প্রধান কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ লোকজনের অভাব। বিচারপতিদের রায় লেখা সঠিক সময়ে শেষ করার জন্য তাদের সহকারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি এবং মানোন্নয়ন দরকার। সে জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ তদবিরভিত্তিক না হয়ে মেধাভিত্তিক হওয়া দরকার।
প্রসঙ্গত, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার বিবৃতিতে আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও আর বহাল থাকে না। আদালতের দলিল সরকারি নথি। একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের কাছে সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে স্বাক্ষর করার অধিকার হারান। আশা করি, বিচারকগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকবেন।
তিনি আরো বলেন, বিচার বিভাগের বর্তমান সন্ধিক্ষণে বেঞ্চ ও বার সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার বিভাগের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের ওপর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বার-এর ভূমিকাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী ও সহযোগিতামূলক বার নিঃসন্দেহে বেঞ্চের সবচেয়ে কার্যকর বন্ধু।
তিনি আরো বলেন, ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণের স্বার্থে যদি আইনজীবী ও বিচারকদের উদ্যোগের সম্মিলন ঘটানো যায়, তাহলে আমরা ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারব। আইন পেশার সাথে দায়িত্বশীলতার একটি সম্পর্ক রয়েছে। সুদূরপরাহত ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় জনগণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আইনজীবী ও বিচারকগণই তাদের প্রত্যাশা পূরণের প্রধান সারথি। একটি প্রার্থনালয় যেমন কখনো বন্ধ থাকতে পারে না, তেমনি লাখ লাখ বিচারপ্রার্থী জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের মন্দিরও কখনো বন্ধ থাকা উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। বিচার বিভাগ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে এবং গণমাধ্যম সেই বার্তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
No comments