নিয়ন্ত্রিত দূষণের পথেই উন্নয়ন
দুই সপ্তাহজুড়ে টান টান উত্তেজনার স্বস্তিকর অবসান হলো প্যারিসের সফল জলবায়ু সম্মেলনে। অংশগ্রহণকারী ১৯৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সবাই মিলে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের (২০১৫) ঘোষণা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন নির্ধারিত সময়ের ১৬ ঘণ্টা পর। সংগতভাবেই বিশ্বজুড়ে দীর্ঘ সময়জুড়ে প্যারিস সম্মেলনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে আরও দীর্ঘ আলোচনা, বিশ্লেষণ চলবে। উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামর্থ্যের বিভিন্নতা রয়েছে। দেশগুলোর ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও বিভিন্ন। পরিবেশের বিপন্নতা সবুজ এই পৃথিবীর সব দেশের জন্য বিপন্নতার কারণ; তবে তার মাত্রাগুলো ভিন্ন ভিন্ন। তার ওপরে রয়েছে দেশে দেশে জীবনযাত্রার ধরন এবং মাথাপিছু ভোগ্যপণ্য ও সার্ভিস ব্যবহারের অভ্যাস, আকাঙ্ক্ষা ও সামর্থ্যের বিভিন্নতা। এত কিছুর পরও ১৯৫ দেশের সরকারকে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের অভিন্ন চুক্তিতে একমত করা সম্ভব হয়েছে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি সমঝোতা দলিল তৈরি করার মধ্য দিয়ে। বলা হচ্ছে, সবাইকে খুশি করার মতো একটি চুক্তি করা গেছে। সবাই যে দলিলে সম্মত হয়, তাতে নমনীয়তা ও সমঝোতার বাক্যমালা বেশি হবে, সেটিই তো স্বাভাবিক। তবে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন ২০১৫ তো শেষ কথা নয়; বরং প্যারিস ২০১৫ জলবায়ু চুক্তিতে বর্তমান শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে সীমিত (প্রাক্-শিল্প বিপ্লব সময়ের বিদ্যমান মাত্রার তুলনায়) রাখার সম্মিলিত বৈশ্বিক অঙ্গীকার খুব কম প্রাপ্তি নয়। ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কার্বন-দূষণ সর্বোচ্চ মাত্রায় ওঠার আশঙ্কা যখন তীব্র হয়ে উঠেছে, তখন বিশ্বের বড়-মাঝারি-ছোট দূষণকারী সব দেশের মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের আংশিক আইনি দায়বদ্ধতার চুক্তিতে পৌঁছানো অবশ্যই বড় অর্জন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দূষণের দায়ভার বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন।
কিন্তু প্যারিস সম্মেলনে সবাই নিজ নিজ দেশের দূষণ হ্রাস করার দায়িত্ব মেনে নিয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর পর বিশ্ব সম্মেলনে সমবেত হয়ে বিশ্বনেতারা দূষণ হ্রাসে তাঁদের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা কতটা অর্জিত হলো এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করার প্রতিশ্রুতিও নির্ধারণ করেছেন। সেই সঙ্গে এই সম্মেলন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দূষণ হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব মোকাবিলার জন্য সক্ষম হতে সহায়তার লক্ষ্যে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মূলত ধনী দেশগুলো এই তহবিলে অর্থের জোগান দেবে। সম্মেলনে গৃহীত চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২০ সাল থেকে। এ সম্মেলনের অর্জন নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘প্যারিস সম্মেলন পৃথিবীর সবাইকে কার্বন-দূষণ হ্রাস করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রশ্নে শক্তিশালী বার্তা জানিয়ে দিয়েছে।’ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও বৃহত্তম দূষণকারী দেশ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি জিন হুয়া প্যারিস চুক্তিকে ‘নিখুঁত না হলেও’ ঐতিহাসিক এই অর্জনকে সামনে এগিয়ে নিতে কোনো বাধা মনে করেন না। তিনি বরং চুক্তিকে ‘পক্ষপাতহীন, ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও সমন্বিত চুক্তি’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বে উদীয়মান অর্থনীতি ও বড় দূষণকারী দেশ ভারতের পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকার প্যারিস চুক্তিকে ‘ভারসাম্যপূর্ণ ও পৃথিবীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার দলিল’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। অপরদিকে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর সম্মিলিত জোটের চেয়ারম্যান গিজা গ্যাসপার মার্টিনস এই চুক্তিকে বলছেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশগুলো এবং পৃথিবীবাসী—সবার জন্য প্রত্যাশার সম্ভাব্য উত্তম অর্জন।’ এই চুক্তি বাস্তবায়নে আগামী কয়েক দশক ধরে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার নানামুখী জটিল কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এর অনেকগুলো অপ্রিয় এবং জনতুষ্টির বিপরীত কাজ। বিশেষভাবে হ্রাস করতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। উৎপাদন-প্রক্রিয়া সচল রাখার সব আয়োজনকে আরও দক্ষ এবং উৎসে দূষণ হ্রাস করার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য বড় বিনিয়োগ,
যৌক্তিক ভোগ এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা-কাঠামো গড়তে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রত্যাশিত আর্থিক সহায়তার সিংহভাগ ঋণ বা অনুগ্রহ নয়, প্রাপ্য হিসেবে পেতে চায়। সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো ব্যবসার বিষয়টি ভুলছে না; বরং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বিস্তৃত করার প্রযুক্তি তাদের জন্য বড় ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলোর কাছে কার্বন-দূষণ হ্রাস করতে যে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ চায়, তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সামর্থ্যবান দেশগুলো নিশ্চিত হতে চায় যে তাদের বিনিয়োগ ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে জবাবদিহির সঙ্গে ব্যবহৃত হবে। এর সঙ্গে সামগ্রিক সুশাসনের ইস্যু জড়িত। বিষয়গুলো দুই পক্ষের বিবেচনার মাপকাঠিতে সব ক্ষেত্রে সমার্থক নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কার্বন-দূষণ হ্রাস করার ঘোষণা দেওয়া যত সহজ, কার্যত দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদন-প্রক্রিয়ার গতিমুখ ঘোরানো তত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সময়, টেকসই প্রযুক্তির পর্যাপ্ত সমাবেশ এবং তাদের দক্ষ পরিচালন অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। সে জন্য মানবসম্পদ গড়ে তোলার বড় চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে। তবে আশার কথা, কার্বন-দূষণ হ্রাস করার বৈশ্বিক অঙ্গীকারকে বড় বড় ব্যবসার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোও ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তারা এ ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ, গবেষণা ও দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছে। সুতরাং বাজারের নিয়মে দূষণ হ্রাসের প্রযুক্তি উন্নয়নে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবে। ভোক্তা ও বিশ্বের নাগরিক হিসেবে প্রান্তিক অবস্থানে থাকলেও আমরা সেই অর্জনগুলোর চুইয়ে পড়া সুবিধা পাব। এর সঙ্গে আমরা নিজেদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে বিপন্ন পৃথিবীতে ভালোভাবে টিকে থাকার টেকসই কৌশল যত বেশি প্রয়োগ করতে পারব (বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অর্জন ফেলনা নয়) তত অন্যের দয়ার ওপর নির্ভরতা কমবে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments