আমার মক্কা সফর by মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান
আমি
আরেকবার কাবাঘর তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় থামলাম। এবার প্রচ- রোদের মধ্যে।
আরো অনেক হাজির মতো আমিও ছাতা মেলে রোদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। কিন্তু
অন্যের চোখে খোঁচা না দিয়ে কিংবা নিজেরটা খোয়ানোর আশঙ্কা ছাড়া সেটা অসম্ভব
বলে মনে হলো।
কাবা চত্বরের সবকিছুই থমকে আছে বলে মনে হলো। তা-ই আমি ছায়াযুক্ত প্রথম তলার গ্যালারি চলে গেলাম। এর ফলে আমাকে আরো বেশি দূর ঘুরতে হলো।
কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করা মানে সাড়ে তিন মাইল হাঁটা, আর সেটা ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায়। তবে আপনার নিয়ত যদি ঠিক থাকে, আল্লাহর ধ্যানে থাকেন, তবে সবকিছুই সহজ মনে হবে। আমার পাশে যিনি তাওয়াফ করছিলেন, তিনি পুরো দূরত্বটা অতিক্রম করলেন তার ছোট ছেলেকে কাঁধে নিয়ে।
প্রথম তলা থেকে তাকালে যে ছবিটি দেখা যায়, সেটা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, আসমানি শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করা যায। কাবাকে মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটার গতিকে প্রতিরোধ করতে মন্থর ও নীরবে চলা একটা বিশাল ডিস্কের গতিহীন কেন্দ্র।
কেবল নামাজের সময় দৃশ্যটা বদলে যায়। এ সময় কাবা হয়ে যায় সমকেন্দ্রিকতার কেন্দ্র, ৪০ হাজারের বেশি উজ্জ্বল সাদা দেহের বৃত্ত। তারা সবাই একই জিনিস চায়, একই লক্ষ্যে ছুটছে, একই কাজ করছে। ফলে সেটা বৈশ্বিক মাত্রায় পূর্ণ আনুগত্য ফুটিয়ে তোলে।
সবকিছুতেই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে দামি মার্বেল, বেশির ভাগই সবুজ। ইন্দো-ইসলামি রীতিতে নির্মিত সাতটি বিশাল মিনার কাবাকে মূল্যবান রতেœর মতো ধরে রাখা কাঠামোকে সংযুক্ত করেছে।
আমাকে একটু দূরে থাকতে হয়েছে, নইলে বাস মিস করার আশঙ্কা ছিল। ৪৫ মিনিট বাসে চড়ে আমরা মিনায় পৌঁছালাম। স্থানটা মক্কা থেকে তিন মাইলের কিছু বেশি দূরে। মিনা থেকেই আরাফাতের ময়দানে যাওয়ার ক্ষণ শুরু হয়। আরাফাত কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হজ হলো আরাফা, তা-ই নবিজি বলেছেন, আরাফা হলো হজ। হাজিদের মক্কা থেকে এখানে আনার কাজটি করে প্রায় ৫০ হাজার বাস। এতে যে পরিশ্রম, কষ্ট এবং বিশাল কাজ হয়, তা আনায়াসেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস হতে পারে।
আমরা যখন আরাফাত পর্বতের পাশে থাকা তাঁবুর শহরে প্রবেশ করলাম, তখন তাপমাত্রা ছিল ভয়াবহ। মনে হচ্ছে, বাতাসও তাপে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাগরিব পর্যন্ত আরাফাতে থাকার নিয়ম।
আমার পাশের তাঁবুতে ছিলেন আলজেরিয়ার শেখ মাহফুজ নাহনাহ। দিনটা ছিল আত্মনিবেদন, ইবাদত, ধ্যান, নামাজের দিন। আর ছিল অমূল্য সংলাপ। জেসুইট ধর্ম ত্যাগ করার পর আর কখনো আল্লাহর দিকে এমন একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশন করতে পারিনি।
আরাফাত দিবসে আসলে আল্লাহর সামনে হাজির হওয়া। তার কাছে হাজির হয়ে বারবার বলা : আমি আপনার সামনে হাজির হয়েছি, আল্লাহ, আমি আপনার সামনে হাজির হয়েছি। লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে আমরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সমর্পণ করলাম।
সবকিছু ফেলে কেবল কাফনের কাপড় পরে, মৃত্যুকে বরণ করে লাখ লাখ লোক শুধু আল্লাহর জন্যই অস্তিত্বশীল থাকে। তাদের মনে এমন এক বিশ্বাস জন্মে যা আগে কখনো ছিল না, সম্ভবত পরেও কখনো হবে না।
এখান থেকে সবাই ছোটে মুজদালিফার দিকে। এই সময় এত বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হলো যে, আমি আমাদের বাস হারিয়ে ফেললাম। হাজার হাজার বাসের মধ্যে আমাদেরটা খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি, কেউ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তিনি আমার বন্ধু মরক্কোর শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আজমানি। ২০ লাখ লোকের ভিড় ঠেলে আমি তার দিকে ছুটলাম। এই সঙ্কটের মধ্যে আমি কিছু সময়ের জন্য হলেও মরক্কা হজদলের সদস্য হয়ে গেলাম। বাসে জায়গা পেলেও চলার উপায় ছিল না। ঝাড়া তিন ঘণ্টা থমকে থাকল সবকিছু। তারপর বাসটি চলতে শুরু করল। কিন্তু না, তিন গজ গিয়ে আবার থামল। মুজদালিফায় পৌঁছালাম রাত ১১টায়।
পরের আনুষ্ঠানিকতাগুলো সারতে থাকলাম। তারপর হঠাৎ করে কী ভেবে কয়েকজন আবার ছুটলাম মক্কার দিকে। আবার তওয়াফ করতে থাকলাম। মনে হলো, এটা কেবল আমাদের আইডিয়াই ছিল না। অন্তত দুই লাখ হাজি আবার ছুটে এসেছেন তাওয়াফ করতে। ফজরের সময় মনে হলো আট লাখ লোক নামাজ পড়ছি।
ক্স মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান ১৯৩১ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে ছিলেন ক্যাথলিক। প্রখ্যাত এই কূটনীতিক ও লেখক ১৯৮০ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্নি টু মক্কা, ইসলাম : দ্য অলটারনেটিভ।
অনুবাদ : আসিফ হাসান
কাবা চত্বরের সবকিছুই থমকে আছে বলে মনে হলো। তা-ই আমি ছায়াযুক্ত প্রথম তলার গ্যালারি চলে গেলাম। এর ফলে আমাকে আরো বেশি দূর ঘুরতে হলো।
কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করা মানে সাড়ে তিন মাইল হাঁটা, আর সেটা ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায়। তবে আপনার নিয়ত যদি ঠিক থাকে, আল্লাহর ধ্যানে থাকেন, তবে সবকিছুই সহজ মনে হবে। আমার পাশে যিনি তাওয়াফ করছিলেন, তিনি পুরো দূরত্বটা অতিক্রম করলেন তার ছোট ছেলেকে কাঁধে নিয়ে।
প্রথম তলা থেকে তাকালে যে ছবিটি দেখা যায়, সেটা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, আসমানি শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করা যায। কাবাকে মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটার গতিকে প্রতিরোধ করতে মন্থর ও নীরবে চলা একটা বিশাল ডিস্কের গতিহীন কেন্দ্র।
কেবল নামাজের সময় দৃশ্যটা বদলে যায়। এ সময় কাবা হয়ে যায় সমকেন্দ্রিকতার কেন্দ্র, ৪০ হাজারের বেশি উজ্জ্বল সাদা দেহের বৃত্ত। তারা সবাই একই জিনিস চায়, একই লক্ষ্যে ছুটছে, একই কাজ করছে। ফলে সেটা বৈশ্বিক মাত্রায় পূর্ণ আনুগত্য ফুটিয়ে তোলে।
সবকিছুতেই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে দামি মার্বেল, বেশির ভাগই সবুজ। ইন্দো-ইসলামি রীতিতে নির্মিত সাতটি বিশাল মিনার কাবাকে মূল্যবান রতেœর মতো ধরে রাখা কাঠামোকে সংযুক্ত করেছে।
আমাকে একটু দূরে থাকতে হয়েছে, নইলে বাস মিস করার আশঙ্কা ছিল। ৪৫ মিনিট বাসে চড়ে আমরা মিনায় পৌঁছালাম। স্থানটা মক্কা থেকে তিন মাইলের কিছু বেশি দূরে। মিনা থেকেই আরাফাতের ময়দানে যাওয়ার ক্ষণ শুরু হয়। আরাফাত কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হজ হলো আরাফা, তা-ই নবিজি বলেছেন, আরাফা হলো হজ। হাজিদের মক্কা থেকে এখানে আনার কাজটি করে প্রায় ৫০ হাজার বাস। এতে যে পরিশ্রম, কষ্ট এবং বিশাল কাজ হয়, তা আনায়াসেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস হতে পারে।
আমরা যখন আরাফাত পর্বতের পাশে থাকা তাঁবুর শহরে প্রবেশ করলাম, তখন তাপমাত্রা ছিল ভয়াবহ। মনে হচ্ছে, বাতাসও তাপে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাগরিব পর্যন্ত আরাফাতে থাকার নিয়ম।
আমার পাশের তাঁবুতে ছিলেন আলজেরিয়ার শেখ মাহফুজ নাহনাহ। দিনটা ছিল আত্মনিবেদন, ইবাদত, ধ্যান, নামাজের দিন। আর ছিল অমূল্য সংলাপ। জেসুইট ধর্ম ত্যাগ করার পর আর কখনো আল্লাহর দিকে এমন একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশন করতে পারিনি।
আরাফাত দিবসে আসলে আল্লাহর সামনে হাজির হওয়া। তার কাছে হাজির হয়ে বারবার বলা : আমি আপনার সামনে হাজির হয়েছি, আল্লাহ, আমি আপনার সামনে হাজির হয়েছি। লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে আমরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সমর্পণ করলাম।
সবকিছু ফেলে কেবল কাফনের কাপড় পরে, মৃত্যুকে বরণ করে লাখ লাখ লোক শুধু আল্লাহর জন্যই অস্তিত্বশীল থাকে। তাদের মনে এমন এক বিশ্বাস জন্মে যা আগে কখনো ছিল না, সম্ভবত পরেও কখনো হবে না।
এখান থেকে সবাই ছোটে মুজদালিফার দিকে। এই সময় এত বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হলো যে, আমি আমাদের বাস হারিয়ে ফেললাম। হাজার হাজার বাসের মধ্যে আমাদেরটা খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি, কেউ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তিনি আমার বন্ধু মরক্কোর শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আজমানি। ২০ লাখ লোকের ভিড় ঠেলে আমি তার দিকে ছুটলাম। এই সঙ্কটের মধ্যে আমি কিছু সময়ের জন্য হলেও মরক্কা হজদলের সদস্য হয়ে গেলাম। বাসে জায়গা পেলেও চলার উপায় ছিল না। ঝাড়া তিন ঘণ্টা থমকে থাকল সবকিছু। তারপর বাসটি চলতে শুরু করল। কিন্তু না, তিন গজ গিয়ে আবার থামল। মুজদালিফায় পৌঁছালাম রাত ১১টায়।
পরের আনুষ্ঠানিকতাগুলো সারতে থাকলাম। তারপর হঠাৎ করে কী ভেবে কয়েকজন আবার ছুটলাম মক্কার দিকে। আবার তওয়াফ করতে থাকলাম। মনে হলো, এটা কেবল আমাদের আইডিয়াই ছিল না। অন্তত দুই লাখ হাজি আবার ছুটে এসেছেন তাওয়াফ করতে। ফজরের সময় মনে হলো আট লাখ লোক নামাজ পড়ছি।
ক্স মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান ১৯৩১ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে ছিলেন ক্যাথলিক। প্রখ্যাত এই কূটনীতিক ও লেখক ১৯৮০ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্নি টু মক্কা, ইসলাম : দ্য অলটারনেটিভ।
অনুবাদ : আসিফ হাসান
No comments