সংঘাত নয়, সমঝোতাই প্রত্যাশিত by বদিউল আলম মজুমদার
বিএনপি প্রবল গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিয়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, আর তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন তাঁর সহকর্মীরা। এ ব্যাপারে সরকার অবশ্য নির্বিকার। বরং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরোধী দলকে নানাভাবে উসকানি দিচ্ছেন। এমনকি কেউ কেউ বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই বলেও দায়িত্বহীন উক্তি করছেন। এই বলে তাঁরা হুমকিও দিচ্ছেন যে বিরোধী দল রাস্তায় নামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বসে থাকবে না।
এ ধরনের পাল্টাপাল্টি হুমকিতে নাগরিকেরা উদ্বিগ্ন। কারণ, বিরোধী দল রাস্তায় নামলে সরকারি দল তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। এ কাজে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করবে। সাম্প্রতিক সময়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির ঘরোয়া বৈঠকও সরকার করতে দেয়নি। এমনকি রাস্তায়ও তাদের দাঁড়াতে দেয়নি। তাই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা ছত্রভঙ্গ করে দেবে। আর বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ ডাকলে সরকার তা কঠোরভাবে দমন করবে। নিঃসন্দেহে এর ফলে সহিংসতার সৃষ্টি হবে। এর পরিণতিতে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে আমরা রাজপথে আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা চাই না।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের শক্তির মূল উৎস হলো রাজপথে তাদের সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষমতা। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার। গত দুই দশকের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমবর্ধমান দলীয়করণের কারণে এখন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বল প্রয়োগের বৈধ সরকারি ক্ষমতা অবৈধভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভবপর হচ্ছে। ফলে পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই এখন দলীয় ক্যাডারদের পরিবর্তে বিরোধী দলের দমন-পীড়নে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই হয়তো সরকারি দল এখন নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুবিধা হলো যে তাদের হামলা-মামলা দুই কাজেই ব্যবহার করা যায়, যা ক্রমবর্ধমান হারে ঘটছে।
আমাদের জানমালের নিরাপত্তার খাতিরে বিরোধী জোটকে রাজপথে সহিংসতা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করব। অনুরোধ করব তাদের কর্মকাণ্ড যেন অশান্তি সৃষ্টি ও জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে। কিন্তু বিরোধী জোট আন্দোলন থেকে বিরত থাকলেই আমাদের বিরাজমান বিরোধের, বিশেষত নির্বাচন নিয়ে বিরোধের অবসান হবে না। বরং তাতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে, যা আমাদের এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধের মূল কারণ গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন, যে নির্বাচনে ১৫৩ সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন এবং এসব নির্বাচনী এলাকায় বসবাসকারী ৫২ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোট প্রদানের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক কালে উচ্চ আদালত ভোটাধিকারকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র ১২টি অর্থাৎ ২৯ শতাংশ দল অংশ নিয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ব্যালট বইয়ের মুড়ি গুনে তৈরি হিসাব অনুযায়ী, ১৪৭ আসনের নির্বাচনে ৩০ শতাংশ বা সার্বিকভাবে তথা ৩০০ আসনের বিপরীতে ১৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচন ঘিরে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। অর্থাৎ ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের কলঙ্কজনক নির্বাচন ছাড়া, যে নির্বাচনের ফলাফল স্থায়িত্ব অর্জন করেনি—মোটামুটিভাবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদানের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, ৫ জানুয়ারি তা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা বিনষ্ট হয়ে গেছে। এটাই বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধের মূল উৎস।
প্রসঙ্গত, বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধ শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই বিরাজ করছে না, দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীও এ বিরোধের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষও ‘ভাত ও ভোটের’ অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার আওয়ামী লীগকেই ৫ জানুয়ারির কারসাজিমূলক নির্বাচনের জন্য দায়ী করছে।ভোটাধিকার-বঞ্চিত এই বিরাট জনগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ, কিন্তু তাদের অনেকেই চায় না আন্দোলনের মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ঘটুক এবং তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক। এ ছাড়া এদের অনেকের কাছেই বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা নেই। তঁারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অপকর্মের মধ্যে তেমন তফাত নেই; বরং আওয়ামী লীগের বর্তমান অপশাসন বিএনপির অতীতের অপশাসনের ধারাবাহিকতারই ফসল।তদুপরি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আঁতাত, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তাদের দোদুল্যমানতা এবং দলে পরিবারতন্ত্রের প্রভাবও বহু গণতন্ত্রকামী নাগরিককে বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। উপরন্তু অনেকের মতে, অদূর ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই জাতির জন্য একটি সর্ব-রোগ-হর মহৌষধ নয়। তঁারা বিরাজমান সমস্যার একটি স্থায়ী ও টেকসই সমাধান চান। তঁারা চান কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার। আওয়ামী লীগের ‘দিনবদলের’ অঙ্গীকারে প্রলুব্ধ হয়ে তঁারা প্রতারিত হয়েছেন, কিন্তু তঁারা বিএনপির ব্যাপারেও চরমভাবে সন্দিহান। কারণ, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কী করবে, সে ব্যাপারে বিএনপি সম্পূর্ণ নিশ্চুপ।
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ নাগরিকদের অধিকাংশের অনীহার কারণে বিএনপি আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমানে হয়তো রাজপথে পরাস্ত করতে পারবে না। তবে এ জন্য আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা যদি মনে করে যে তারা অপ্রতিরোধ্য, তাহলে তারা ভুল করবে বলেই আমাদের ধারণা। কারণ, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের ‘জন্মই’ শুধু বিতর্কিত নয়, তাদের গত ছয় মাসের ‘কর্মও’ হতাশাব্যঞ্জক।
অতীতের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মহোৎসব এখন যেন নতুন উদ্যমে অব্যাহত রয়েছে। এ মহোৎসব ভবিষ্যতেও চলমান থাকলে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমবে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারকে ক্রমাগতভাবে বলপ্রয়োগ এবং নাগরিকের অধিকার হরণ করতে হবে, যার আলামত ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ করছি।ব্যক্তিতন্ত্র, সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সত্যিকারের বিরোধী দলবিহীন রাজনৈতিক অঙ্গন সরকারের বাড়াবাড়ি করার ক্ষমতাকে এখন যেন অনেকটা সীমাহীন করে তুলেছে। তবে পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে কোনো দেশেই কোনো সরকার বল প্রয়োগ করে চিরকাল ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাই বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আরেকটি কারণও রয়েছে। সরকারি দলের নেতারা বারবার বলছেন যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে—যদিও সরকারের সমর্থকদের কারও কারও মতে এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে। তবে আমরা মনে করি যে সাম্প্রতিক তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে একধরনের ‘টক্সিক’ বা ‘বিষাক্ত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নির্ভর করে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির কার্যকারিতার ওপর। আমাদের এক সাবেক প্রধান বিচারপতির মতে, আমাদের বিচারাঙ্গনে ইতিমধ্যেই প্রলয় ঘটেছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও এখন পর্যন্ত তাদের নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। এদিকে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চলছে। এসব প্রতিষ্ঠান আরও কার্যকারিতা হারালে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এটা অনেকটা আগুন নিয়ে খেলা, যা পুরো জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এমনি পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের কাছে আমাদের নিবেদন থাকবে, তারা যেন সহিংস আন্দোলন থেকে বিরত থাকে। একই সঙ্গে সরকারি দলের কাছে আবেদন থাকবে, তারা যেন বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সংলাপের আয়োজন করে, যাতে বিবদমান বিষয়গুলোর ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছা যায় এবং সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
এ ধরনের পাল্টাপাল্টি হুমকিতে নাগরিকেরা উদ্বিগ্ন। কারণ, বিরোধী দল রাস্তায় নামলে সরকারি দল তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। এ কাজে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করবে। সাম্প্রতিক সময়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির ঘরোয়া বৈঠকও সরকার করতে দেয়নি। এমনকি রাস্তায়ও তাদের দাঁড়াতে দেয়নি। তাই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি দিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা ছত্রভঙ্গ করে দেবে। আর বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ ডাকলে সরকার তা কঠোরভাবে দমন করবে। নিঃসন্দেহে এর ফলে সহিংসতার সৃষ্টি হবে। এর পরিণতিতে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে আমরা রাজপথে আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা চাই না।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের শক্তির মূল উৎস হলো রাজপথে তাদের সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষমতা। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার। গত দুই দশকের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমবর্ধমান দলীয়করণের কারণে এখন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বল প্রয়োগের বৈধ সরকারি ক্ষমতা অবৈধভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভবপর হচ্ছে। ফলে পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই এখন দলীয় ক্যাডারদের পরিবর্তে বিরোধী দলের দমন-পীড়নে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাই হয়তো সরকারি দল এখন নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুবিধা হলো যে তাদের হামলা-মামলা দুই কাজেই ব্যবহার করা যায়, যা ক্রমবর্ধমান হারে ঘটছে।
আমাদের জানমালের নিরাপত্তার খাতিরে বিরোধী জোটকে রাজপথে সহিংসতা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করব। অনুরোধ করব তাদের কর্মকাণ্ড যেন অশান্তি সৃষ্টি ও জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে। কিন্তু বিরোধী জোট আন্দোলন থেকে বিরত থাকলেই আমাদের বিরাজমান বিরোধের, বিশেষত নির্বাচন নিয়ে বিরোধের অবসান হবে না। বরং তাতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে, যা আমাদের এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধের মূল কারণ গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন, যে নির্বাচনে ১৫৩ সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন এবং এসব নির্বাচনী এলাকায় বসবাসকারী ৫২ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোট প্রদানের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক কালে উচ্চ আদালত ভোটাধিকারকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র ১২টি অর্থাৎ ২৯ শতাংশ দল অংশ নিয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের ব্যালট বইয়ের মুড়ি গুনে তৈরি হিসাব অনুযায়ী, ১৪৭ আসনের নির্বাচনে ৩০ শতাংশ বা সার্বিকভাবে তথা ৩০০ আসনের বিপরীতে ১৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচন ঘিরে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। অর্থাৎ ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের কলঙ্কজনক নির্বাচন ছাড়া, যে নির্বাচনের ফলাফল স্থায়িত্ব অর্জন করেনি—মোটামুটিভাবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদানের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, ৫ জানুয়ারি তা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা বিনষ্ট হয়ে গেছে। এটাই বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধের মূল উৎস।
প্রসঙ্গত, বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধ শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই বিরাজ করছে না, দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীও এ বিরোধের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষও ‘ভাত ও ভোটের’ অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার আওয়ামী লীগকেই ৫ জানুয়ারির কারসাজিমূলক নির্বাচনের জন্য দায়ী করছে।ভোটাধিকার-বঞ্চিত এই বিরাট জনগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ, কিন্তু তাদের অনেকেই চায় না আন্দোলনের মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ঘটুক এবং তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক। এ ছাড়া এদের অনেকের কাছেই বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা নেই। তঁারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অপকর্মের মধ্যে তেমন তফাত নেই; বরং আওয়ামী লীগের বর্তমান অপশাসন বিএনপির অতীতের অপশাসনের ধারাবাহিকতারই ফসল।তদুপরি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আঁতাত, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তাদের দোদুল্যমানতা এবং দলে পরিবারতন্ত্রের প্রভাবও বহু গণতন্ত্রকামী নাগরিককে বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। উপরন্তু অনেকের মতে, অদূর ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই জাতির জন্য একটি সর্ব-রোগ-হর মহৌষধ নয়। তঁারা বিরাজমান সমস্যার একটি স্থায়ী ও টেকসই সমাধান চান। তঁারা চান কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার। আওয়ামী লীগের ‘দিনবদলের’ অঙ্গীকারে প্রলুব্ধ হয়ে তঁারা প্রতারিত হয়েছেন, কিন্তু তঁারা বিএনপির ব্যাপারেও চরমভাবে সন্দিহান। কারণ, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কী করবে, সে ব্যাপারে বিএনপি সম্পূর্ণ নিশ্চুপ।
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ নাগরিকদের অধিকাংশের অনীহার কারণে বিএনপি আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমানে হয়তো রাজপথে পরাস্ত করতে পারবে না। তবে এ জন্য আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা যদি মনে করে যে তারা অপ্রতিরোধ্য, তাহলে তারা ভুল করবে বলেই আমাদের ধারণা। কারণ, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের ‘জন্মই’ শুধু বিতর্কিত নয়, তাদের গত ছয় মাসের ‘কর্মও’ হতাশাব্যঞ্জক।
অতীতের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মহোৎসব এখন যেন নতুন উদ্যমে অব্যাহত রয়েছে। এ মহোৎসব ভবিষ্যতেও চলমান থাকলে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও কমবে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারকে ক্রমাগতভাবে বলপ্রয়োগ এবং নাগরিকের অধিকার হরণ করতে হবে, যার আলামত ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ করছি।ব্যক্তিতন্ত্র, সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সত্যিকারের বিরোধী দলবিহীন রাজনৈতিক অঙ্গন সরকারের বাড়াবাড়ি করার ক্ষমতাকে এখন যেন অনেকটা সীমাহীন করে তুলেছে। তবে পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে কোনো দেশেই কোনো সরকার বল প্রয়োগ করে চিরকাল ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাই বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আরেকটি কারণও রয়েছে। সরকারি দলের নেতারা বারবার বলছেন যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে—যদিও সরকারের সমর্থকদের কারও কারও মতে এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে ‘গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে। তবে আমরা মনে করি যে সাম্প্রতিক তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে একধরনের ‘টক্সিক’ বা ‘বিষাক্ত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নির্ভর করে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির কার্যকারিতার ওপর। আমাদের এক সাবেক প্রধান বিচারপতির মতে, আমাদের বিচারাঙ্গনে ইতিমধ্যেই প্রলয় ঘটেছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও এখন পর্যন্ত তাদের নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। এদিকে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চলছে। এসব প্রতিষ্ঠান আরও কার্যকারিতা হারালে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এটা অনেকটা আগুন নিয়ে খেলা, যা পুরো জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এমনি পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের কাছে আমাদের নিবেদন থাকবে, তারা যেন সহিংস আন্দোলন থেকে বিরত থাকে। একই সঙ্গে সরকারি দলের কাছে আবেদন থাকবে, তারা যেন বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সংলাপের আয়োজন করে, যাতে বিবদমান বিষয়গুলোর ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছা যায় এবং সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments