তোবা শ্রমিকের অনশন- এ কেমন দেশ হলো আমাদের? by ফারুক ওয়াসিফ

অপহরণকারীরা নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে। যুদ্ধে দেখা যায় বন্দিবিনিময়। কিন্তু তোবা গ্রুপের এটা কেমন মুক্তিপণ, যেখানে ষোলো শ শ্রমিক হলেন জিম্মি? তারা বলছে, তাদের সহমালিক বন্দী দেলোয়ার হোসেনের জামিন না হলে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবে না। কোম্পানি আইনের কোথাও নেই যে একজন মালিকের অনুপস্থিতিতে অন্য অংশীদারেরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন না। তোবা গ্রুপ এই ফাঁদ পেতেছে এবং দেলোয়ার হোসেনের জামিন মঞ্জুর হয়েছে। যুদ্ধে যেমন নিরীহ মানুষদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা অপরাধ, তেমনি ক্ষুধার্ত ও বেতনবঞ্চিত শ্রমিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তোবা গ্রুপও অপরাধ করেছে। এই ব্যবহারকে বৈধতা দিচ্ছেন স্বয়ং শ্রম প্রতিমন্ত্রী। শামীম ওসমানদের ভরসা ক্ষমতাসীন দল, গার্মেন্টস মালিকদের ভরসা সরকার। এ কেমন দুর্দশা আমাদের?
উচ্চ আদালতের অবকাশকালীন বেঞ্চ থেকে দেলোয়ার হোসেন জামিন নেন ঈদের আগের কার্যদিবসের শেষ দিনে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, যেদিন এই জামিনের শুনানি চলছে, সেদিন আদালতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল উপস্থিত ছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর দায়িত্ব ছিল এই চাঞ্চল্যকর মামলার প্রধান আসামির জামিনে আইনানুগ বাধা দেওয়া। সেটাই নিয়ম। ক্রিমিনাল মামলার জামিনের শুনানি করতে হলে আগে সরকারপক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক। সুতরাং যা ঘটেছে সরকারের গোচরেই ঘটেছে।
তাজরীন ফ্যাশনসে ১১১ জন শ্রমিকের পুড়ে মৃত্যুর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই তৈরি করা তদন্ত কমিটি দেলোয়ার হোসেনকে আটক করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ধাক্কা-তত্ত্বের জনক তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সুপারিশ আমলে নেননি। তা হলেও নিহতদের আত্মীয়রা লোকটির বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত সেই মামলা আমলে নেন এবং একপর্যায়ে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। আশা ছিল, বিচার হবে।
এর মধ্যে ঈদ এল। যে শ্রমিকেরা ছুটি পান না, ঈদ তাঁদের জন্য আনন্দের খনি। যাঁরা মাসের পর মাস পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকেন, ঈদই তাঁদের সঙ্গে মেলার সুযোগ। ঈদ তাঁদের উৎসব-বিলাস না, অতিপ্রয়োজনীয়। যাঁরা সারা বছর ঋণ করেন, ছেলেমেয়েদের ভালো কিছু দিতে পারেন না, ঈদের বোনাসে তাঁরা ঋণ শোধ করেন, ভালোমন্দ খান ও পুত্রকন্যা-ভাইবোনদের নতুন জামা পরান। তোবা গ্রুপ শুধু শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন ও ঈদের বোনাসই আটকে দেয়নি, ঈদের ছুটিটাকেও জিম্মি করেছে। অথচ বেতনের টোপ দিয়ে তিন মাস কাজ করিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ইতিমধ্যে করা সারা। অতি পরিশ্রমে শ্রমিকের ঘাম আজকাল শুকায় না, তাই ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি দেওয়ার ধর্মীয় বিধানও কেউ মানে না!
ঈদের দিন থেকে আজ পর্যন্ত ষোলো শ শ্রমিক জীবনের দাবিতে অনশন করছেন। এ পথে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটা তাঁদের সেলফ ডিফেন্স, আত্মরক্ষার হাতিয়ার। এই ষোলো শ শ্রমিক যখন অনশন করছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ঈদ সংবর্ধনা নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন। একের পর এক শ্রমিকেরা অসুস্থ হয়ে যখন হাসপাতালে যাচ্ছেন, তখন শ্রম প্রতিমন্ত্রী গ্রামের বাড়িতে ঈদ করছিলেন। এত কিছু যখন ঘটছে, তখন বিজিএমইএর সভাপতি কানাডানিবাসী পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গেছেন। অনেক মালিকই তখন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে বেড়াতে গেছেন। তাঁদের অনেকেরই ঈদের বাজার দেশে হয় না, বিদেশে হয়।
এহেন দেশের শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক শ্রমিকের কান্না শুনতে পান না। তিনি শুনেছেন তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেনের ডাক। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেনের জামিন হয়েছে। আশা করছি, আগামী রোববার-সোমবারের মধ্যে তিনি যদি মুক্ত হয়ে আসেন, তাহলে সমস্যাটা সমাধান হয়ে যাবে।’ আরও বলেছেন, ‘আমার দৃঢ়বিশ্বাস, রোববার-সোমবারের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন নিশ্চয়ই মুক্ত হবেন।’ পাঠক খেয়াল করেন, এটা তাঁর ‘আশা’ এবং শত শত মানুষের মৃত্যুর দায়ে বিচারাধীন আসামির জামিন হওয়ায় তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস। এরপর শ্রম মন্ত্রণালয়ের নাম হওয়া উচিত মালিক কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কখনো এই মন্ত্রণালয় শ্রমিকের কাজে আসে না।
প্রথম আলোর ওই সংবাদে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বিজিএমইএ ও তোবা গ্রুপের কর্মকর্তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ঈদের আগেই শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করবেন। তবে খুবই দুঃখজনক, আজকে পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ হয়নি।’ পাওনা পরিশোধ করেনি, আবার জামিনও দেওয়া হলো। মালিকদের জন্য তাঁর অপার আশা, অপরাধীর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।তাই বলতে পারেন, ‘জেল থেকে বেরিয়ে আসলেই শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা হবে। আর যদি না করেন, তবে সরকারপক্ষ থেকে যে সমস্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সবই করা হবে। এ ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত সজাগ।’ তিন মাসের বেতন আটকে রাখার পরও আপনারা ব্যবস্থা নেননি। ঈদের আগে বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরও আপনি তাঁদের বিরুদ্ধে আঙুল নড়াননি। এখন বলছেন, ‘সরকার অত্যন্ত সজাগ’!!! জি, মালিকদের বাঁচাতে তাঁদের অঢেল মুনাফা নিশ্চিত করতে মন্ত্রী মহোদয় সজাগ বটে।
তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগানোর সময় কোনো অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা কাজ করেনি। আগুনের তাপে ছটফট করা শত শত শ্রমিককে আটকে রাখা কলাপসিবল গেটের তালা কেউ খুলে দেয়নি। অথচ দেলোয়ার হোসেনের জন্য জেলের তালা খোলার ব্যবস্থা হলো। রানা প্লাজার কুখ্যাত রানা একের পর এক মামলায় জামিন পাচ্ছেন। তাঁর বেলায় আইন কাজ করছে না, কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলন দমাতে আইনের হাত পুলিশ অত্যন্ত কঠোর। রানা প্লাজায় সরকারিভাবে বারো শ, বেসরকারিভাবে দুই হাজারের ওপর শ্রমিকের মৃত্যুর পরও অনুশোচনা জাগেনি যাঁদের মনে, তাঁরা মানুষ নন। তাঁরা হলো মুনাফা মেশিন। এই মেশিনের একদিকে মানুষ ঢোকে, অন্যদিকে বের হয় মুনাফার ঢল। নিচে, উচ্ছিষ্ট হিসেবে পড়ে থাকে শ্রমজীবী মানুষের ঘাম-রক্ত-লাশ।
ডুবন্ত বিপন্ন মানুষের জন্য একটিও লাইফবোট নেই। নেই আইনের জীবনবিমা। নেই আস্থার সনদ। এবং নেই আশা। এ দেশে গডফাদার আর মুনাফামত্তরাই শুধু আশাবাদী। এ কেমন দেশ হলো আমাদের?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.