এক অভিভাবকের প্রস্থান by ফজলুল হক সৈকত
নতুন
সমাজ বিনির্মাণে মৌলিক কারিগর হিসেবে বাংলাদেশে যে অল্প কয়জন ব্যক্তি
চিন্তা ও কর্মসাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সরদার
ফজলুল করিম একটি অনন্য নাম। প্রতিবাদী, আপসহীন, নির্ভীক, প্রাণোচ্ছল এবং
জীবনবাদী মানুষ ছিলেন এই লোকটি। সরদার একাধারে অ্যাকাডেমিশিয়ান, দার্শনিক,
অনুবাদক, রাজনৈতিক কর্মী ও নিবন্ধকার হিসেবে পরিচিত। মাত্র ২১ বছর বয়সে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করা এই কালজয়ী মানুষটি সৃজনশীল ও
প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই তৎকালীন
পাকিস্তান সরকারের ‘শত্র“’ রূপে চিহ্নিত হন। সাম্যবাদী বামপন্থি
সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে চার মেয়াদে প্রায় ১১ বছর জেল
খাটতে হয়েছে তাকে। কারাগারে থাকাকালে ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান ব্যবস্থাপনা
পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় কর্মস্থল বাংলা একাডেমির
অনুবাদ শাখায় যোগ দেন ১৯৬৩ সালে; ১৯৭১-এ সেখানে সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ
হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পুনরায়
আগের শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। ‘দর্শনকোষ’ সরদারের সাহিত্যিক ও লেখক
জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ। এ ছাড়া তিনি রাজনীতি ও সমাজ-রূপান্তর-বিষয়ক বেশ
কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক অনুবাদ করে সুধী সমাজের নজর কাড়েন। প্লেটোর ‘সংলাপ’
এবং ‘রিপাবলিক’, অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’, রুশোর ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ তার
বিখ্যাত অনুবাদকর্ম; ‘নূহের কিস্তি ও অন্যান্য’ তার অনন্য মৌলিক
নিবন্ধগ্রন্থ।
সরদার ছিলেন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক। তার চেতনায় সমাজতন্ত্রের চেয়ে জাতীয়তাবাদী বোধই বেশি জাগ্রত ছিল। আর সম্ভবত সে কারণেই কৃষকের ছেলে সরদার ফজলুল করিম মাটি-প্রেমী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অবিরাম লড়াইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিনিধি হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। কিংবদন্তি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি কিশোর সরদারকে বিপ্লবী হতে অনুপ্রাণিত করে। সারা জীবন সেই অভিজ্ঞান তিনি ধারণ ও লালন করেছেন। জ্ঞান-পিপাসু দার্শনিক সরদার মনেপ্রাণে লালিত আদর্শ থেকে কখনো একবিন্দু বিচলিত হননি; কোনো জাগতিক অপ্রাপ্তিও ছিল না তার। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও, চারপাশের প্রতিকূলতায় মাঝে-মধ্যে বিপন্ন হলেও ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন পরিপূর্ণ ও তৃপ্ত মানুষ। নিজ দেশের সমাজ রূপান্তরের প্রত্যাশায় তিনি ইংল্যান্ডের স্কলারশিপ প্রত্যাখ্যান করেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়েছেন। ছাত্রজীবনে সরদার ফজলুল করিম প্রগতি লেখক সংঘের কাজে সম্পৃক্ত হন। কলেজে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে তিনি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। কৃষকের ছেলে হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন এই বিপ্লবী দার্শনিক। যোগ দিয়েছেন ঐতিহাসিক কিছু কৃষক সমাবেশেও। গণমানুষের মুক্তির জন্য তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক সংগ্রামী এক সাহসী যোদ্ধা। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি সারা জীবন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমৃত্যু সত্য ও ন্যায়ের জন্য সাধনা করলেও শেষ জীবন পর্যন্ত শাসকদের শোষণ-নিপীড়ন আর নিজ সমাজের অধঃগতি দেখে বিচলিত হয়েছেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচিত্র পটপরিবর্তন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ প্রভৃতি ইতিবাচক ঘটনার সাক্ষী হয়েও রাষ্ট্রের সবখানে সুবিধাবাদীদের জয়জয়কারে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। যে সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কৈশোরে সংগ্রামের পাঠ নিয়েছিলেন, সারা জীবন যে চেতনা লালন করে গেছেন, তার বাস্তব প্রতিফলন না দেখতে পেয়ে একরকম প্রবল হতাশায় নিমজ্জিত হয়েই তাকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। শেষ কয়টি বছর অবহেলা আর সঙ্গীহীনতার যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে পার করেছেন তিনি। এটি সত্য কথা। বর্তমান বাংলাদেশের আদর্শ-বিচ্যুৎ রাজনীতিই হয়তো এর প্রধান কারণ। কিন্তু সরদাররা অন্য এক সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। উত্তর প্রজন্ম তাদের অবদানের কথা স্বীকার করবে কি না; তাদের কর্মপন্থা অনুসরণ করে সমাজ-পরিবর্তনের নতুন কোনো পাঠ গ্রহণ করবে কি না, তাও আজ সংশয়াবদ্ধ।
উৎপাদনমুখী রাজনীতি এবং জনগণের অধিকার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সরদার ফজলুল করিমের যে অংশগ্রহণ, জ্ঞানচর্চা ও অর্জনের জন্য তার যে সাধনা ও অনুপ্রেরণা, তার তাৎপর্য এবং সাফল্য কতটুকু, সে বিচারের জন্যও বোধকরি আমাদেরকে আরও কিছুটা ক্রান্তির কাল পারি দিতে হবে। প্রসঙ্গত, জ্ঞান-সাধনা ও চিন্তাচর্চার বিরল পথে সরদারের আরেক সহযাত্রী আহমদ ছফার ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ কবিতা থেকে খানিকটা পাঠ নিতে পারি : ‘যেইখানে সময়ের ধেনু/ বছরে বছরে শীর্ণকান্তি বছর বিয়ায়/হস্তীর বিষ্ঠার মতো স্তূপাকারে শতেক বছর/নিদ্রা যায় অচেতন মাটির ওপর।/ যেইখানে ইতিহাস করুণ গোঙায়/ কুয়াশার মতো এসে/ চুপিসারে ঘুমন্ত অতীত/ অতর্কিতে আগামীরে খুন করে যায়।’ আমরা আজ সমাজের গায়ে চাপিয়েছি নতুন চাদর। নাম দিয়েছি ‘পরিবর্তন’! সবুজ ভূমির বুকের ওপর আমরা নির্মমভাবে গড়ে তুলছি অট্টালিকা। হাউজিং আর বায়িং ব্যবসার জালে এখনকার তরুণ সমাজের স্বপ্ন আবদ্ধ। বিদেশের সোনালি জগতে পাড়ি জমানোর মোহেও আটকে গেছি আমরা। অথচ সরদার ফজলুল করিম, তার পূর্বসূরি ও সতীর্থরা স্বপ্ন দেখতেন একটি সুন্দর সাম্যচিন্তার রাষ্ট্র হবে আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি! কিন্তু হায় কপাল, একসময় যে ভারতের দিকে পৃথিবীর মানুষের চোখ ও মন নিবন্ধ ছিল, আজ তার সন্তানেরাই ছুটছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে! ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের এই সত্য ও বেদনার ছবি চোখে দেখে যেতে হয়েছে সরদার ফজলুল করিমকে।
মাটির মানুষের জগতে হিংস তা এবং হানাহানি দেখে আকাশের বিশাল জগতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। সেখানেও দেখেছেন জাতি-বৈরিতার প্রবল প্রকোপ। সুতরাং মানুষের মতো কর্তব্য পালনের জন্য তিনি বারবার মানুষের কাছেই ফিরে গেছেন। হয়তো অনেক কিছুই তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন; ব্যক্তিগত সাফল্যের পেছনে ছুটতে পারতেন। কিন্তু সামাজিকের কী এক প্রবল দায় থেকে তিনি যেন মুক্ত হতে পারেননি। উদাসীন, ভাবুক, বস্তুগত বিষয়-জ্ঞানহীন মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি, সরদার ফজলুল করিম ছিলেন তেমনই একজন সাধারণ মানুষ। ‘ক্ষুদ্র সাফল্যের চাইতে মহৎ ব্যর্থতা অনেক বেশি কাক্সিক্ষত’- সরদারের জীবনে বোধকরি এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত। সরদার কী ধরনের মানুষ ছিলেন, তাকে এই সমাজ চিনতে পেরেছিল কি না- ধারণ করতে সমর্থ হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন তো রয়েই গেল। অনাগতকালে কোনো সমাজবিজ্ঞানী হয়তো এসবের উত্তর খুঁজে দেখবেন। তবে এ কথা ঠিক- এই দেশ এবং এই দেশের মানুষকে নিয়ে সরদারের অনেক স্বপ্ন ছিল। আর তিনি স্বপ্ন ও চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের সর্বত্র। তিনি কেবল শিক্ষক, রাজনীতিক বা দার্শনিক ছিলেন না, ছিলেন শান্তির স্বপক্ষের একজন নিরন্তর যোদ্ধা। নির্বিবাদী নিরীহ সংসারি এই মানুষটি সৃজনশীলতা, সহনশীলতা, অভিভাবকীয় ভঙ্গি আর দার্শনিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।
সরদার ছিলেন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক। তার চেতনায় সমাজতন্ত্রের চেয়ে জাতীয়তাবাদী বোধই বেশি জাগ্রত ছিল। আর সম্ভবত সে কারণেই কৃষকের ছেলে সরদার ফজলুল করিম মাটি-প্রেমী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অবিরাম লড়াইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিনিধি হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। কিংবদন্তি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি কিশোর সরদারকে বিপ্লবী হতে অনুপ্রাণিত করে। সারা জীবন সেই অভিজ্ঞান তিনি ধারণ ও লালন করেছেন। জ্ঞান-পিপাসু দার্শনিক সরদার মনেপ্রাণে লালিত আদর্শ থেকে কখনো একবিন্দু বিচলিত হননি; কোনো জাগতিক অপ্রাপ্তিও ছিল না তার। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও, চারপাশের প্রতিকূলতায় মাঝে-মধ্যে বিপন্ন হলেও ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন পরিপূর্ণ ও তৃপ্ত মানুষ। নিজ দেশের সমাজ রূপান্তরের প্রত্যাশায় তিনি ইংল্যান্ডের স্কলারশিপ প্রত্যাখ্যান করেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়েছেন। ছাত্রজীবনে সরদার ফজলুল করিম প্রগতি লেখক সংঘের কাজে সম্পৃক্ত হন। কলেজে পড়ার সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে তিনি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। কৃষকের ছেলে হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন এই বিপ্লবী দার্শনিক। যোগ দিয়েছেন ঐতিহাসিক কিছু কৃষক সমাবেশেও। গণমানুষের মুক্তির জন্য তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক সংগ্রামী এক সাহসী যোদ্ধা। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি সারা জীবন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমৃত্যু সত্য ও ন্যায়ের জন্য সাধনা করলেও শেষ জীবন পর্যন্ত শাসকদের শোষণ-নিপীড়ন আর নিজ সমাজের অধঃগতি দেখে বিচলিত হয়েছেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচিত্র পটপরিবর্তন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ প্রভৃতি ইতিবাচক ঘটনার সাক্ষী হয়েও রাষ্ট্রের সবখানে সুবিধাবাদীদের জয়জয়কারে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। যে সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কৈশোরে সংগ্রামের পাঠ নিয়েছিলেন, সারা জীবন যে চেতনা লালন করে গেছেন, তার বাস্তব প্রতিফলন না দেখতে পেয়ে একরকম প্রবল হতাশায় নিমজ্জিত হয়েই তাকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। শেষ কয়টি বছর অবহেলা আর সঙ্গীহীনতার যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে পার করেছেন তিনি। এটি সত্য কথা। বর্তমান বাংলাদেশের আদর্শ-বিচ্যুৎ রাজনীতিই হয়তো এর প্রধান কারণ। কিন্তু সরদাররা অন্য এক সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। উত্তর প্রজন্ম তাদের অবদানের কথা স্বীকার করবে কি না; তাদের কর্মপন্থা অনুসরণ করে সমাজ-পরিবর্তনের নতুন কোনো পাঠ গ্রহণ করবে কি না, তাও আজ সংশয়াবদ্ধ।
উৎপাদনমুখী রাজনীতি এবং জনগণের অধিকার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সরদার ফজলুল করিমের যে অংশগ্রহণ, জ্ঞানচর্চা ও অর্জনের জন্য তার যে সাধনা ও অনুপ্রেরণা, তার তাৎপর্য এবং সাফল্য কতটুকু, সে বিচারের জন্যও বোধকরি আমাদেরকে আরও কিছুটা ক্রান্তির কাল পারি দিতে হবে। প্রসঙ্গত, জ্ঞান-সাধনা ও চিন্তাচর্চার বিরল পথে সরদারের আরেক সহযাত্রী আহমদ ছফার ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ কবিতা থেকে খানিকটা পাঠ নিতে পারি : ‘যেইখানে সময়ের ধেনু/ বছরে বছরে শীর্ণকান্তি বছর বিয়ায়/হস্তীর বিষ্ঠার মতো স্তূপাকারে শতেক বছর/নিদ্রা যায় অচেতন মাটির ওপর।/ যেইখানে ইতিহাস করুণ গোঙায়/ কুয়াশার মতো এসে/ চুপিসারে ঘুমন্ত অতীত/ অতর্কিতে আগামীরে খুন করে যায়।’ আমরা আজ সমাজের গায়ে চাপিয়েছি নতুন চাদর। নাম দিয়েছি ‘পরিবর্তন’! সবুজ ভূমির বুকের ওপর আমরা নির্মমভাবে গড়ে তুলছি অট্টালিকা। হাউজিং আর বায়িং ব্যবসার জালে এখনকার তরুণ সমাজের স্বপ্ন আবদ্ধ। বিদেশের সোনালি জগতে পাড়ি জমানোর মোহেও আটকে গেছি আমরা। অথচ সরদার ফজলুল করিম, তার পূর্বসূরি ও সতীর্থরা স্বপ্ন দেখতেন একটি সুন্দর সাম্যচিন্তার রাষ্ট্র হবে আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি! কিন্তু হায় কপাল, একসময় যে ভারতের দিকে পৃথিবীর মানুষের চোখ ও মন নিবন্ধ ছিল, আজ তার সন্তানেরাই ছুটছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে! ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের এই সত্য ও বেদনার ছবি চোখে দেখে যেতে হয়েছে সরদার ফজলুল করিমকে।
মাটির মানুষের জগতে হিংস তা এবং হানাহানি দেখে আকাশের বিশাল জগতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম। সেখানেও দেখেছেন জাতি-বৈরিতার প্রবল প্রকোপ। সুতরাং মানুষের মতো কর্তব্য পালনের জন্য তিনি বারবার মানুষের কাছেই ফিরে গেছেন। হয়তো অনেক কিছুই তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন; ব্যক্তিগত সাফল্যের পেছনে ছুটতে পারতেন। কিন্তু সামাজিকের কী এক প্রবল দায় থেকে তিনি যেন মুক্ত হতে পারেননি। উদাসীন, ভাবুক, বস্তুগত বিষয়-জ্ঞানহীন মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি, সরদার ফজলুল করিম ছিলেন তেমনই একজন সাধারণ মানুষ। ‘ক্ষুদ্র সাফল্যের চাইতে মহৎ ব্যর্থতা অনেক বেশি কাক্সিক্ষত’- সরদারের জীবনে বোধকরি এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত। সরদার কী ধরনের মানুষ ছিলেন, তাকে এই সমাজ চিনতে পেরেছিল কি না- ধারণ করতে সমর্থ হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন তো রয়েই গেল। অনাগতকালে কোনো সমাজবিজ্ঞানী হয়তো এসবের উত্তর খুঁজে দেখবেন। তবে এ কথা ঠিক- এই দেশ এবং এই দেশের মানুষকে নিয়ে সরদারের অনেক স্বপ্ন ছিল। আর তিনি স্বপ্ন ও চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের সর্বত্র। তিনি কেবল শিক্ষক, রাজনীতিক বা দার্শনিক ছিলেন না, ছিলেন শান্তির স্বপক্ষের একজন নিরন্তর যোদ্ধা। নির্বিবাদী নিরীহ সংসারি এই মানুষটি সৃজনশীলতা, সহনশীলতা, অভিভাবকীয় ভঙ্গি আর দার্শনিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।
No comments