স্কিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা কেন জরুরি
সম্প্রতি আমি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী থেকে নয় ঘণ্টার বাস ভ্রমণ করে টাঙ্গাইলের মধুপুরে অবস্থিত আমাদের কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পে এসে পৌঁছাই। বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি প্রথম আলো পত্রিকার একটি কপি কিনি। ভ্রমণের সময় আমি বাংলাদেশে স্কিন ব্যাংক স্থাপনবিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকের ওপর প্রতিবেদনটি পড়ি। আমার মনে হয়েছে, বক্তারা খুব ভালো বলেছেন। আর স্কিন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টিও দারুণ। একটি বিষয় আমাকে অবাক করেছে।
আমার মনে হয়েছে, বক্তারা এটি স্থাপনের খরচের বিষয়টি এবং কত দামে তা মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে, সেটা নিয়ে তঁারা কথা বলেননি। যদিও এ বিষয়টি পরিষ্কার যে মেডিকেল প্রযুক্তির বিকাশ এবং এর উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে খরচও বেড়ে যায়। আর দাতব্য চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় চিকিৎসাসেবা সমাজের বেশির ভাগ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। সেমিনারে একজন বক্তা বলেছেন, আগুনে পোড়ার বিষয়টি দুনিয়ার দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি ভোগায়। আমরা আরও কিছুটা দূরে যেতে পারতাম। দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দরিদ্রতম এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সহজেই চিকিৎসাসেবা লাভ করতে পারে না, পোড়ার ঘটনায় এরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (তাজরীন ফ্যাশনসের ট্র্যাজেডির দিকে লক্ষ করুন) বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব। তবে আমাদের এই দরিদ্র রোগীদের সেবাকেন্দ্রে কিডনির গুরুতর রোগে আক্রান্ত মানুষ এলে আমরা তঁাদের ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য পাঠাই না। রোগীর আত্মীয়-পরিজনকে আমরা বলি, এই চিকিৎসা তঁাদের ও আমাদের উভয়ের জন্যই দামি। তঁারা যেন রোগীদের বাড়িতে নিয়ে যান, যাতে রোগী বাড়িতে মারা যেতে পারেন। সেমিনারে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। আমার বাড়ি নিউজিল্যান্ডে।
সেখানে পোড়া কোনো গুরুতর রোগীকে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সরকারি খরচে অকল্যান্ডের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়। এমনকি চিকিৎসার খরচও সরকার বহন করে থাকে। বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়। এখানে সব জায়গায়ই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতালেও ড্রেসিং ও চিকিৎসা হাসপাতালের বাইরে টাকা দিয়ে করাতে হয়, আর রোগীর আত্মীয়স্বজনেরই সাধারণত ড্রেসিং পরিবর্তন করতে হয়। সেমিনারে বলা হয়েছে, ৬০ শতাংশ পোড়া রোগীকে চামড়া প্রতিস্থাপন ছাড়া বঁাচানো যায় না। আমাদের গ্রামের এই ছোট্ট হাসপাতালটিতে পোড়া রোগীই ৬০ ভাগ, স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত প্রত্যয়নবিহীন মানুষেরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। তঁারা তঁাদের কাজ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে করে থাকেন৷ কাজের প্রতি তঁাদের নিবেদন অসাধারণ। মমতা বেঁচে গেছেন, ১২ মাস পর তিনি তঁার বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন। আমরা এর জন্য ৩০০ টাকা ফি নিয়েছিলাম। এক বছর পর দেহে ৬০ ভাগ পোড়াসহ এক তরুণী আমাদের কাছে আসেন। তঁাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল, কিন্তু তঁার পরিবারের জন্য সেখানে চিকিৎসা চালানো খুব কঠিন ও ব্যয়বহুল ছিল। তঁারা একটি ব্যক্তিগত অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে রোগীকে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। আমাদের হাসপাতালের বিছানার সংখ্যা ৩৫, ইতিমধ্যে ৪৩ জন ভর্তি ছিল। আমাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হতো। রোগীর আত্মীয়স্বজন তঁাকে ভর্তি করানোর জন্য আরজি জানান। এটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। আমাদের একজন মুসলমান কর্মী রোগীর জন্য নফল নামাজের আয়োজন করেন, তিনি নিজেই ইমামতি করেন। আমরা তঁাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিই, পঁাচ দিন পর তিনি মারা যান। বাংলাদেশে একটি জাতীয় স্কিন সেন্টার হলে তা দারুণ হবে। একই সঙ্গে আমি আরও আরজি করব, খরচটা যেন কমানো সম্ভব হয়, সেবাদান প্রক্রিয়া রোগীবান্ধব ও দ্রুত হয় এবং খরচের কারণে সবচেয়ে ভুক্তভোগী শ্রেণীটি যেন সেবার আওতার বাইরে না থাকে।
এডরিক এস বেকার: মেডিকেল অফিসার, ইনচার্জ, কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প৷
এডরিক এস বেকার: মেডিকেল অফিসার, ইনচার্জ, কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প৷
No comments