রোহিঙ্গা: নিজ দেশে পরবাসী by সোহরাব হাসান
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনে
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা অন্য সব
বিষয়ে ছাড় দিতে রাজি আছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অনড়। তাঁরা মানতেই
চান না যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি
সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এই মনোভাব কেবল অযৌক্তিক নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও
পরিপন্থী।
মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীরা মনে করেন, রাখাইন মুসলমানরা বহিরাগত। অথচ ইতিহাস তাদের এই দাবি সমর্থন করে না। উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা যায়, অষ্টম ও নবম শতকে যখন আরবরা এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসেন, তখনই পশ্চিম মিয়ানমারে মুসলমানরা বসতি শুরু করেন। রাখাইন প্রদেশের ৪০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৩০ লাখ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, যারা রাখাইন নামে পরিচিত। বাকি ১০ লাখ মুসলমান ধর্মাবলম্বী এবং বেশির ভাগই বাংলাভাষী।
ব্রিটিশ সরকার ১৮২৪ সালে মিয়ানমার দখল করার পর ভারতীয়দের এখানে আসতে উৎসাহিত করা হয়। ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের খোঁজে স্বেচ্ছায় অনেকে অর্থনৈতিভাবে ঋদ্ধ এ অঞ্চলে আসেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ সরকার জাপানের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমর্থন আদায় করে এই শর্তে যে, যুদ্ধে জয়ী হলে তাদের জন্য ‘ন্যাশনাল এরিয়া’ ঘোষণা করা হবে। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে রোহিঙ্গা মুসলমান নেতারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে পশ্চিম মিয়ানমারের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাকে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করার দাবি জানান। যদিও সে দাবি গ্রাহ্য হয়নি।
দেশ বিভাগের পর ওমর মিয়ার নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ধর্মীয় নেতারা জমিয়াতুল উলেমা-ই ইসলাম নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং মেও অঞ্চলকে নিয়ে পৃথক মুসলিম রাজ্য গঠনের দাবি জানান। মিয়ানমার সরকার এই দাবি অগ্রাহ্য করলে রোহিঙ্গারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। মিয়ানমার সরকার তাদের মোকাবিলায় ১৯৫০ ও ১৯৫৪ সালে সেনা অভিযান চালায়। ‘অপারেশন মনসুনের’ মাধ্যমে সেনাবাহিনী বেশির ভাগ মুজাহিদ ঘাঁটি দখল করে নেয়। কয়েকজন মুজাহিদ নেতা নিহত হন।
এরপর ১৯৬১ সালের ৪ জুলাই সরকারের শান্তি-প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে মুজাহিদিন নেতারা ব্রিগেডিয়ার অং গির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে নে উইনের নেতৃত্বে সেনাশাসন জারি হলে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রোহিঙ্গারা নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং সীমান্ত এলাকায় তৎপরতা চালায়। ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই রোহিঙ্গা লিবারেশন পার্টি (আরএলপি) গঠিত হয়, যার সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ জাফর হাবিব নামে ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক। তাদের ঘাঁটি ছিল বুথি ডং জঙ্গলে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে তাদের তৎপরতা থেমে যায়। আরএলএফ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর মোহাম্মদ জাফর হাবিব গঠন করেন রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়ট ফ্রন্ট (আরপিএফ)। এর কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ ইউনুস নামের এক চিকিৎসক।
১৯৭৮ সালে নে উইন সরকার বহিরাগতদের বিরুদ্ধে অপারেশেন কিং ড্রাগন শুরু করলে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আশির দশকের শুরুতে জঙ্গি সদস্যরা আরপিএফ থেকে বেরিয়ে গিয়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) গঠন করে। পরবর্তী সময়ে এটিই হয়ে ওঠে রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে জঙ্গি সংগঠন। এটি মুসলিম বিশ্বের যেসব সংগঠনের সমর্থন পায় তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানের জামায়াত-ই-ইসলামী, আফগানিস্তানের হিজব-ই ইসলামি, জম্মু কাশ্মীরের হিজবউল মুজাহিদিন প্রভৃতি। ১৯৮৬ সালে নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে।
প্রখ্যাত সুইডিশ সাংবাদিক ও ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর সাবেক সংবাদদাতা বার্টিল লিনটার ১৯৮১ সালে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘুরে দেখতে পান যে আরএসওর অনেক সামরিক ঘাঁটি আছে। এসব ঘাঁটিতে হালকা মেশিনগান একে-৪৭ রাইফেল, আরপিজি ২ রকেট লঞ্চার, ক্লেমো মাইন ও বিস্ফোরক মজুত রয়েছে। এসব ক্যাম্পে আফগানিস্তানের তালেবান প্রশিক্ষকদেরও দেখা গেছে। অন্যদিকে আরএসওর ১০০ জঙ্গি আফগানিস্তানের খোশত প্রদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। আল-কায়েদার ভিডিও টেপ থেকে আরও জানা যায় যে মিয়ানমারের মুসলমানরা আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে আরএসও বহু রোহিঙ্গা গেরিলাকে সংগ্রহ করে এবং এর বিনিময়ে তারা প্রত্যেককে ৩০ হাজার বাংলাদেশি টাকা দেয়। এ ছাড়া তারা ১০ হাজার টাকা করে মাসিক বেতন পেত। যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে দেওয়া হতো এক লাখ টাকা। অনেক রোহিঙ্গাকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছে।
এই জঙ্গিদের প্রতিহত করতে মিয়ানমার সরকার সীমান্তে ব্যাপক অভিযান চালায় এবং ১৯৯২ সালের এপ্রিলে আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করে। যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরে ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হলেও বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে গেছে।
১৯৯৪ সালের ২৮ এপ্রিল আরএসও জঙ্গিরা মংডুর বিভিন্ন স্থানে ১২টি টাইমবোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৯৮ সালে আরএসও, এআইএফ যুক্ত হয়ে গঠন করে রোহিঙ্গা ন্যাশনাল কাউন্সিল, যাদের সামরিক শাখার নাম রোহিঙ্গা ন্যাশনাল আর্মি।
মিয়ানমার সরকারের দমন-পীড়ন এবং মৌলবাদী জঙ্গিদের সশস্ত্র তৎপরতাই সাধারণ রোহিঙ্গাদের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নিজ দেশে হয়েছে পরবাসী।
পরের কিস্তি: মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে কি?
সংশোধনী: মিয়ানমারের মুদ্রার নাম ‘চ্যাত’। ১০০ ডলারে পাওয়া যায় ৯৭ হাজার চ্যাত। অং সান সু চির বাড়ির পাশের লেকটির নাম ইনলে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
No comments