বনের বাঘে খায় না লো সই খায় মনের বাঘে by মোকাম্মেল হোসেন
আকাশের
মুখ ভার। লবণ বেগমের মুখও ভার। কে কার দুঃখে ব্যথিত হয়ে মুখ ভার করেছে-
বুঝতে পারছি না। আকাশের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে লাভ নেই। সে কোনো জবাব
দেবে না। দেখি, লবণ বেগম কী বলে! লবণ বেগমের কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলাম-
: তোমার কি শরীর খারাপ!
বিছানার পাশেই জানালা। জানালায় এক টুকরো আকাশ। লবণ বেগম জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে মাথা নেড়ে বলল-
: না।
- তাইলে সকালবেলাই মুখটা মলিন হইছে কীজন্য!
এ কথা শুনে লবণ বেগম আরও গম্ভীর হয়ে গেল। নরম গলায় বললাম-
: কথা না বললে বুঝব কেমনে- কী হইছে! কথা বল।
লবণ বেগম মুখ দিয়ে দম ছেড়ে বলল-
: তাসিনের আব্বা- আমার আত্মাটা মইরা গেছে!
আত্মা হচ্ছে জীবের প্রাণভোমরা। এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সমাপ্তি রেখার ওপারে অবস্থান করে লবণ বেগম তার অস্তিত্ব নিয়ে, মুখের ভাষা দিয়ে আমার সামনে বিরাজ করছে- এ এক অসম্ভব কল্পনা। এ ধরনের কল্পনার রূপায়ণ নাটক-সিনেমার জগতে দৃশ্যমান হয়। আমরা নাটক-সিনেমার পাত্র-পাত্রী নই। প্রতিদিনের মতো গতকালও আমাদের জীবনে রাত এসেছে। সেই রাতের কোলে আশ্রয় নিয়ে আমরা ঘুমের জগতে প্রবেশ করেছি। আবার ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগেও উঠেছি। কোথাও কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। তাহলে আত্মা মরে যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন? বিষয়টাকে হালকা করার জন্য লবণ বেগমের ডানহাতের কব্জিতে জোরে একটা চিমটি দিলাম। সে উঃ উঃ করে বলল-
: কী আশ্চর্য! চিমটি দিলা কীজন্য?
- জিন্দাজগৎ আর মৃত্যুজগতের মধ্যে ব্যবধান বোঝার জন্য।
: মানে?
- মানে দেখলাম, তুমি জিন্দাজগতে আছ, না মৃত্যুজগতে প্রবেশ করার পর মহিলা ভূতে পরিণত হইয়া আমার সামনে বিরাজ করতেছ!
উদাসীন ভঙ্গিতে লবণ বেগম বলল-
: ঠাট্টা না তাসিনের আব্বা! আমার আত্মাটা সত্যি সত্যি মইরা গেছে!
- কেন!
: ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেইখ্যা।
সব মানুষই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে কেউ ভয় পায়। কেউ উজ্জীবিত হয়। স্বপ্নের মাধ্যমে কেউ কেউ তার ভবিষ্যতও দেখতে পায়। হজরত ইউসুফ (আ.) ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখলেন- আকাশের চাঁদ, সূর্য ও এগারটি নক্ষত্র মাটিতে নেমে এসে তাকে সেজদা করছে। হজরত ইউসুফ (আ.) পরবর্তীকালে মিসরের বাদশাহ হয়েছিলেন। বলা হয়, এ ঘটনা তার বাল্যকালীন স্বপ্নের তা’বির। হজরত ইউসুফের (আ.) নামের সঙ্গে বিবি জুলেখার নামটিও জড়িয়ে আছে। বিবি জুলেখা যৌবনে হজরত ইউসুফের (আ.) প্রেমে পড়েন। বিবি জুলেখার এ প্রেম সফলতা পায় ষাট বছর বয়সে। তখন তার শরীর মরে গেছে। শরীর মরে গেলেও হজরত ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি তার প্রেম ও প্রণয়াবেগের মৃত্যু হয়নি। বলা হয়, এ প্রেমের উছিলায় আল্লাহপাক বিবি জুলেখাকে ষোল বছরের যুবতীর রূপ-যৌবন দান করেন। আজকাল ঘরে-বাইরে প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপক সমারোহ। চারদিকে হাই হানি, হাই ডার্লিং, ওগো প্রিয়তমের নিনাদ। কিন্তু ষাট বছরের বৃদ্ধাকে ষোল বছরের যুবতীতে পরিণত করে যে প্রেম- সে প্রেম কোথায়? কোথাও নেই। না থাকার কারণ শরীর মরার আগেই আমাদের মন মরে যায়। ভোগবাদীর মোড়কে আবৃত মরা মন যে শরীর বয়ে বেড়ায় তাতে প্রেম জাগে না, কেবল পচা দুর্গন্ধ ছড়ায়।
বাজারে সোলায়মানি খাবনামা নামে একটা কিতাব পাওয়া যায়। এ কিতাবে ঘুমের মধ্যে দেখা কোন স্বপ্ন কীসের ইঙ্গিত বহন করে তার বর্ণনা রয়েছে। ছোটবেলায় এক-দুইবার এ কিতাব হাতে নেয়ার সুযোগ হয়েছে। সেই জ্ঞানের ওপর ভরসা রেখে লবণ বেগমকে বললাম-
: তোমার খাবের বিষয় বল তো, দেখি- এর তাৎপর্য বাইর করতে পারি কি না?
- তুমি তাৎপর্য খুঁইজ্যা কী করবা? এই পচা স্বপ্নটা তোমারে লইয়াই দেখছি!
মরছি! আমি কবিরাজ, আমিই রোগী? মুখে বললাম-
: পচা স্বপ্ন! কী দেখছ, কও!
- দেখছি, একজন নারী সাংবাদিকরে সঙ্গে লইয়া তুমি বাসায় আসছ। তারপরে তারে কী খাতির-কী যত্ন!
: বাসায় কোনো মেহমান আইলে তারে আদর-আপ্যায়ন করাটাই তো স্বাভাবিক।
: তাসিনের আব্বা- সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নেওন যায় না!
লবণ বেগমের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলাম সমস্যা কোথায়! তাকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে বললাম-
: আরে পাগলি, নারী সাংবাদিক তো পরের কথা, কয়জন পুরুষ সাংবাদিক আমারে চিনে- সেইটা আঙুলের কড় গুইন্যা বইল্যা দেওয়া যায়। কাজেই এই ব্যাপারে তোমার চিন্তাযুক্ত হওয়ার কোনো কারণ নাই...
এ ঘটনার কয়েকদিন পরে ময়মনসিংহে গেছি। প্লাটফরমে পা রাখতেই লবণ বেগমের ফোন পেলাম-
: ট্রেন থেইক্যা নামছ?
- নামছি।
: কোনো সমস্যা হয় নাই তো!
- না, সমস্যা হয় নাই। খুবই আনন্দদায়ক ভ্রমণ হইছে। আমার পাশের সিটে একজন মহিলা যাত্রী ছিলেন। তার সঙ্গে গল্প-গুজব কইরা সময়টা ভালোই কাটছে।
: কী কইলা?
- কইলাম, সময়টা ভালো কাটছে।
: মহিলার বয়স কত?
- বয়স বেশি না। ২০১০ সালে মাস্টার্স শেষ করছে।
: কোন সালে, কত তারিখে বিএ-এমএ পাস করছে- সেইটাও জানা হইয়া গেছে? আর কী কী আলাপ করছ- কও!
- চলন্ত ট্রেনে আলাপ আর কী! এইটা-সেইটা, টুকটাক। আলাপের একপর্যায়ে তোমার প্রসঙ্গ উঠল। আমি তোমার অনেক প্রশংসা করলাম...
: থাম! যাদের খাসলত খারাপ- তারাই অন্য মহিলার কাছে নিজের বউয়ের প্রশংসা করে। কী জন্য করে জান? যাতে প্রশংসা শুইন্যা ওই মহিলার মনে ঈর্ষা জাগে। ঈর্ষা থেইক্যা মানুষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব তৈরি হয়।
- লে বাবা! এতকিছু তো জানতাম না!
: কেমনে জানবা! তুমি তো সাধুবাবা- এইমাত্র হিমালয়ের গুহা থেইক্যা মাটিতে পাও রাখলা! বুঝলা, স্বপ্ন আল্লাহ আমারে এমনি এমনি দেখায় নাই। এই স্বপ্নের মাধ্যমে আমারে সাবধান কইরা দেওয়া হইছে!
- দেখ, মনে কোনো দাগ থাকলে পাশের সিটে সাপ বসছে, না ব্যাঙ বসছে- সেইটা নিশ্চয়ই তোমারে বলতাম না! বরং সত্য গোপন কইরা বলতাম- উফ! তাসিনের আম্মা, পাশের সিটে গোফওয়ালা ইয়া মোটা এক খাটাস বসছিল। তার যন্ত্রণায় জান কয়লা হইয়া গেছে...
নানা যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে লবণ বেগমকে বোঝাতে গিয়ে মনে হল, আমি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়াল বা মেগা সিরিয়ালের কোনো অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলছি। এসব সিরিয়ালে পারিবারিক কাহিনীর নামে ষড়যন্ত্র-কূটচাল, হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা-পরশ্রীকাতরতা, অহংবোধ ইত্যাদি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা এক কথায় ভয়ংকর। লবণ বেগম এসবের দ্বারা প্রভাবিত হলে কঠিন বিপদ। আমার জীবনে শান্তি বলে আর কিছু থাকবে না!
চায়ের তৃষ্ণা নিয়ে একটি হোটেলে ঢুকেছি- আবার লবণ বেগমের ফোন পেলাম। সে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল-
: তুমি ওই মেয়েটারে তোমার ফোন নম্বর দেও নাই তো!
- অপরিচিত কাউরে আমি আমার ফোন নম্বর দেই না।
: দাদারে আদাপড়া শিখাইও না! গলায়-গলায় ভাব কইরা ঢাকা থেইক্যা মমিসিং পর্যন্ত যাওয়ার পরও কেউ অপরিচিত থাকে?
- তুমি কি আমারে অবিশ্বাস করতেছ?
লবণ বেগম এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। দম ছেড়ে আমি বললাম-
: তাসিনের আম্মা, মনটারে স্থির কর! একটা কথা মনে রাখবা- বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘেই খায়। এই মনের বাঘ কী- জান তো? মনের বাঘ হইল সন্দেহ, অবিশ্বাস। এইগুলা খুবই মারাত্মক। সন্দেহ-অবিশ্বাস কেবল মানুষের পারিবারিক জীবনই ধ্বংস করে না, একটা রাষ্ট্রকেও ধ্বংস কইরা ফেলে। আইজ বাংলাদেশের অবস্থা কী দাঁড়াইছে- একবার চিন্তা কইরা দেখ। অথচ দুই নেত্রী যদি মনের সন্দেহ-অবিশ্বাস ঝাইড়া ফেইল্যা একসঙ্গে বসতেন- তাইলে পরিবেশ কী মধুর হইত, ভাব একবার!
- পরিবেশ স্বাভাবিক না হইলে তো মসিবত। নভেম্বরের ২০ তারিখ থেইক্যা তাসিনের সমাপনী পরীক্ষা।
: শুধু তোমার তাসিনের সমাপনী না, আরও অনেক পরীক্ষা আছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর হইল শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাস। এসব পরীক্ষার সঙ্গে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী জড়িত। এরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। স্রেফ সন্দেহ-অবিশ্বাস আর জেদাজেদির মাসুল দিতে গিয়া একটা প্রজন্ম ধ্বংস হইয়া যাইতেছে অথচ এই ব্যাপারে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।
- ফোন কইরা তো আরও আউলা লাগছে!
: ফোনের কথা আর বইল্য না! জাতি হিসেবে আমরা কতটা দুর্ভাগা- দুই নেত্রীর ফোনালাপ তার অনন্য দলিল হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। কী আচানক কারবার! রাজনৈতিক শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়া ফালতু কিছু বিষয় লইয়া ক্যাচাল করতে করতে তারা ৩৭ মিনিটি পার কইরা দিলেন!
ওপাশ থেকে লবণ বেগমের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। সে বলল-
: ৩৭ মিনিট তো খুবই কম সময়। দেখ- এইভাবে আরও ৩৭ বছর পার হয় কিনা!
এ সময় হোটেলের ওয়েটার ইশারায় দেয়ালের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেখানে লেখা রয়েছে-
: এখানে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে লবণ বেগম জিজ্ঞেস করল-
: কী ব্যাপার, কথা বলতেছ না কী জন্য?
আমি ফিসফিস করে বললাম-
: এইখানে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
লবণ বেগম অবাক হয়ে জানতে চাইল-
: কেন, নিষিদ্ধ কেন?
লবণ বেগমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। দেশ ক্রমশ যে পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে- হোটেলের দেয়ালে লেখা কথাগুলো সমগ্র বাংলাদেশের জন্য সত্যি হয়ে দেখা দেবে না তো!
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: তোমার কি শরীর খারাপ!
বিছানার পাশেই জানালা। জানালায় এক টুকরো আকাশ। লবণ বেগম জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে মাথা নেড়ে বলল-
: না।
- তাইলে সকালবেলাই মুখটা মলিন হইছে কীজন্য!
এ কথা শুনে লবণ বেগম আরও গম্ভীর হয়ে গেল। নরম গলায় বললাম-
: কথা না বললে বুঝব কেমনে- কী হইছে! কথা বল।
লবণ বেগম মুখ দিয়ে দম ছেড়ে বলল-
: তাসিনের আব্বা- আমার আত্মাটা মইরা গেছে!
আত্মা হচ্ছে জীবের প্রাণভোমরা। এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সমাপ্তি রেখার ওপারে অবস্থান করে লবণ বেগম তার অস্তিত্ব নিয়ে, মুখের ভাষা দিয়ে আমার সামনে বিরাজ করছে- এ এক অসম্ভব কল্পনা। এ ধরনের কল্পনার রূপায়ণ নাটক-সিনেমার জগতে দৃশ্যমান হয়। আমরা নাটক-সিনেমার পাত্র-পাত্রী নই। প্রতিদিনের মতো গতকালও আমাদের জীবনে রাত এসেছে। সেই রাতের কোলে আশ্রয় নিয়ে আমরা ঘুমের জগতে প্রবেশ করেছি। আবার ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগেও উঠেছি। কোথাও কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। তাহলে আত্মা মরে যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন? বিষয়টাকে হালকা করার জন্য লবণ বেগমের ডানহাতের কব্জিতে জোরে একটা চিমটি দিলাম। সে উঃ উঃ করে বলল-
: কী আশ্চর্য! চিমটি দিলা কীজন্য?
- জিন্দাজগৎ আর মৃত্যুজগতের মধ্যে ব্যবধান বোঝার জন্য।
: মানে?
- মানে দেখলাম, তুমি জিন্দাজগতে আছ, না মৃত্যুজগতে প্রবেশ করার পর মহিলা ভূতে পরিণত হইয়া আমার সামনে বিরাজ করতেছ!
উদাসীন ভঙ্গিতে লবণ বেগম বলল-
: ঠাট্টা না তাসিনের আব্বা! আমার আত্মাটা সত্যি সত্যি মইরা গেছে!
- কেন!
: ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেইখ্যা।
সব মানুষই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে কেউ ভয় পায়। কেউ উজ্জীবিত হয়। স্বপ্নের মাধ্যমে কেউ কেউ তার ভবিষ্যতও দেখতে পায়। হজরত ইউসুফ (আ.) ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখলেন- আকাশের চাঁদ, সূর্য ও এগারটি নক্ষত্র মাটিতে নেমে এসে তাকে সেজদা করছে। হজরত ইউসুফ (আ.) পরবর্তীকালে মিসরের বাদশাহ হয়েছিলেন। বলা হয়, এ ঘটনা তার বাল্যকালীন স্বপ্নের তা’বির। হজরত ইউসুফের (আ.) নামের সঙ্গে বিবি জুলেখার নামটিও জড়িয়ে আছে। বিবি জুলেখা যৌবনে হজরত ইউসুফের (আ.) প্রেমে পড়েন। বিবি জুলেখার এ প্রেম সফলতা পায় ষাট বছর বয়সে। তখন তার শরীর মরে গেছে। শরীর মরে গেলেও হজরত ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি তার প্রেম ও প্রণয়াবেগের মৃত্যু হয়নি। বলা হয়, এ প্রেমের উছিলায় আল্লাহপাক বিবি জুলেখাকে ষোল বছরের যুবতীর রূপ-যৌবন দান করেন। আজকাল ঘরে-বাইরে প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপক সমারোহ। চারদিকে হাই হানি, হাই ডার্লিং, ওগো প্রিয়তমের নিনাদ। কিন্তু ষাট বছরের বৃদ্ধাকে ষোল বছরের যুবতীতে পরিণত করে যে প্রেম- সে প্রেম কোথায়? কোথাও নেই। না থাকার কারণ শরীর মরার আগেই আমাদের মন মরে যায়। ভোগবাদীর মোড়কে আবৃত মরা মন যে শরীর বয়ে বেড়ায় তাতে প্রেম জাগে না, কেবল পচা দুর্গন্ধ ছড়ায়।
বাজারে সোলায়মানি খাবনামা নামে একটা কিতাব পাওয়া যায়। এ কিতাবে ঘুমের মধ্যে দেখা কোন স্বপ্ন কীসের ইঙ্গিত বহন করে তার বর্ণনা রয়েছে। ছোটবেলায় এক-দুইবার এ কিতাব হাতে নেয়ার সুযোগ হয়েছে। সেই জ্ঞানের ওপর ভরসা রেখে লবণ বেগমকে বললাম-
: তোমার খাবের বিষয় বল তো, দেখি- এর তাৎপর্য বাইর করতে পারি কি না?
- তুমি তাৎপর্য খুঁইজ্যা কী করবা? এই পচা স্বপ্নটা তোমারে লইয়াই দেখছি!
মরছি! আমি কবিরাজ, আমিই রোগী? মুখে বললাম-
: পচা স্বপ্ন! কী দেখছ, কও!
- দেখছি, একজন নারী সাংবাদিকরে সঙ্গে লইয়া তুমি বাসায় আসছ। তারপরে তারে কী খাতির-কী যত্ন!
: বাসায় কোনো মেহমান আইলে তারে আদর-আপ্যায়ন করাটাই তো স্বাভাবিক।
: তাসিনের আব্বা- সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নেওন যায় না!
লবণ বেগমের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলাম সমস্যা কোথায়! তাকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে বললাম-
: আরে পাগলি, নারী সাংবাদিক তো পরের কথা, কয়জন পুরুষ সাংবাদিক আমারে চিনে- সেইটা আঙুলের কড় গুইন্যা বইল্যা দেওয়া যায়। কাজেই এই ব্যাপারে তোমার চিন্তাযুক্ত হওয়ার কোনো কারণ নাই...
এ ঘটনার কয়েকদিন পরে ময়মনসিংহে গেছি। প্লাটফরমে পা রাখতেই লবণ বেগমের ফোন পেলাম-
: ট্রেন থেইক্যা নামছ?
- নামছি।
: কোনো সমস্যা হয় নাই তো!
- না, সমস্যা হয় নাই। খুবই আনন্দদায়ক ভ্রমণ হইছে। আমার পাশের সিটে একজন মহিলা যাত্রী ছিলেন। তার সঙ্গে গল্প-গুজব কইরা সময়টা ভালোই কাটছে।
: কী কইলা?
- কইলাম, সময়টা ভালো কাটছে।
: মহিলার বয়স কত?
- বয়স বেশি না। ২০১০ সালে মাস্টার্স শেষ করছে।
: কোন সালে, কত তারিখে বিএ-এমএ পাস করছে- সেইটাও জানা হইয়া গেছে? আর কী কী আলাপ করছ- কও!
- চলন্ত ট্রেনে আলাপ আর কী! এইটা-সেইটা, টুকটাক। আলাপের একপর্যায়ে তোমার প্রসঙ্গ উঠল। আমি তোমার অনেক প্রশংসা করলাম...
: থাম! যাদের খাসলত খারাপ- তারাই অন্য মহিলার কাছে নিজের বউয়ের প্রশংসা করে। কী জন্য করে জান? যাতে প্রশংসা শুইন্যা ওই মহিলার মনে ঈর্ষা জাগে। ঈর্ষা থেইক্যা মানুষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব তৈরি হয়।
- লে বাবা! এতকিছু তো জানতাম না!
: কেমনে জানবা! তুমি তো সাধুবাবা- এইমাত্র হিমালয়ের গুহা থেইক্যা মাটিতে পাও রাখলা! বুঝলা, স্বপ্ন আল্লাহ আমারে এমনি এমনি দেখায় নাই। এই স্বপ্নের মাধ্যমে আমারে সাবধান কইরা দেওয়া হইছে!
- দেখ, মনে কোনো দাগ থাকলে পাশের সিটে সাপ বসছে, না ব্যাঙ বসছে- সেইটা নিশ্চয়ই তোমারে বলতাম না! বরং সত্য গোপন কইরা বলতাম- উফ! তাসিনের আম্মা, পাশের সিটে গোফওয়ালা ইয়া মোটা এক খাটাস বসছিল। তার যন্ত্রণায় জান কয়লা হইয়া গেছে...
নানা যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে লবণ বেগমকে বোঝাতে গিয়ে মনে হল, আমি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়াল বা মেগা সিরিয়ালের কোনো অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলছি। এসব সিরিয়ালে পারিবারিক কাহিনীর নামে ষড়যন্ত্র-কূটচাল, হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা-পরশ্রীকাতরতা, অহংবোধ ইত্যাদি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা এক কথায় ভয়ংকর। লবণ বেগম এসবের দ্বারা প্রভাবিত হলে কঠিন বিপদ। আমার জীবনে শান্তি বলে আর কিছু থাকবে না!
চায়ের তৃষ্ণা নিয়ে একটি হোটেলে ঢুকেছি- আবার লবণ বেগমের ফোন পেলাম। সে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল-
: তুমি ওই মেয়েটারে তোমার ফোন নম্বর দেও নাই তো!
- অপরিচিত কাউরে আমি আমার ফোন নম্বর দেই না।
: দাদারে আদাপড়া শিখাইও না! গলায়-গলায় ভাব কইরা ঢাকা থেইক্যা মমিসিং পর্যন্ত যাওয়ার পরও কেউ অপরিচিত থাকে?
- তুমি কি আমারে অবিশ্বাস করতেছ?
লবণ বেগম এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। দম ছেড়ে আমি বললাম-
: তাসিনের আম্মা, মনটারে স্থির কর! একটা কথা মনে রাখবা- বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘেই খায়। এই মনের বাঘ কী- জান তো? মনের বাঘ হইল সন্দেহ, অবিশ্বাস। এইগুলা খুবই মারাত্মক। সন্দেহ-অবিশ্বাস কেবল মানুষের পারিবারিক জীবনই ধ্বংস করে না, একটা রাষ্ট্রকেও ধ্বংস কইরা ফেলে। আইজ বাংলাদেশের অবস্থা কী দাঁড়াইছে- একবার চিন্তা কইরা দেখ। অথচ দুই নেত্রী যদি মনের সন্দেহ-অবিশ্বাস ঝাইড়া ফেইল্যা একসঙ্গে বসতেন- তাইলে পরিবেশ কী মধুর হইত, ভাব একবার!
- পরিবেশ স্বাভাবিক না হইলে তো মসিবত। নভেম্বরের ২০ তারিখ থেইক্যা তাসিনের সমাপনী পরীক্ষা।
: শুধু তোমার তাসিনের সমাপনী না, আরও অনেক পরীক্ষা আছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর হইল শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাস। এসব পরীক্ষার সঙ্গে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী জড়িত। এরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। স্রেফ সন্দেহ-অবিশ্বাস আর জেদাজেদির মাসুল দিতে গিয়া একটা প্রজন্ম ধ্বংস হইয়া যাইতেছে অথচ এই ব্যাপারে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।
- ফোন কইরা তো আরও আউলা লাগছে!
: ফোনের কথা আর বইল্য না! জাতি হিসেবে আমরা কতটা দুর্ভাগা- দুই নেত্রীর ফোনালাপ তার অনন্য দলিল হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। কী আচানক কারবার! রাজনৈতিক শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়া ফালতু কিছু বিষয় লইয়া ক্যাচাল করতে করতে তারা ৩৭ মিনিটি পার কইরা দিলেন!
ওপাশ থেকে লবণ বেগমের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। সে বলল-
: ৩৭ মিনিট তো খুবই কম সময়। দেখ- এইভাবে আরও ৩৭ বছর পার হয় কিনা!
এ সময় হোটেলের ওয়েটার ইশারায় দেয়ালের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেখানে লেখা রয়েছে-
: এখানে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে লবণ বেগম জিজ্ঞেস করল-
: কী ব্যাপার, কথা বলতেছ না কী জন্য?
আমি ফিসফিস করে বললাম-
: এইখানে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
লবণ বেগম অবাক হয়ে জানতে চাইল-
: কেন, নিষিদ্ধ কেন?
লবণ বেগমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। দেশ ক্রমশ যে পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে- হোটেলের দেয়ালে লেখা কথাগুলো সমগ্র বাংলাদেশের জন্য সত্যি হয়ে দেখা দেবে না তো!
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments