শাসকশ্রেণীর রাজনীতির বিরুদ্ধ স্রোত জনগণকেই সৃষ্টি করতে হবে by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশের
শাসকশ্রেণীর রাজনীতি এখন আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চরকির মতো ঘুরছে।
চরকি ঘোরার একটা সংকটজনক দিক হচ্ছে এর কোনো শেষ থাকে না। এটা অধিকতর
সংকটজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এ কারণে যে, নির্বাচনে দেশ ও জনগণের বিভিন্ন সমস্যা
নিয়ে এই চরকি ঘোরা হচ্ছে না। এটা হচ্ছে নির্বাচন কীভাবে হবে তার ধরন নিয়ে।
সাধারণত যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কীভাবে পরিচালিত হবে তার কতগুলো
সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকে, যা আবার লিপিবদ্ধ থাকে সর্বজনমান্য সংবিধানের
মধ্যে। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনকালীন সংকটের একটা দিক হচ্ছে, দেশে এখন এ
ধরনের সর্বজনমান্য সংবিধান নেই। সংবিধানের দলীয়করণ করে, দলীয় স্বার্থে এতে
নানা রকম সংশোধনী সংযোজন করে এমনভাবে এর দলীয়করণ হয়েছে যে, সরকারবিরোধী
দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি জানানো হচ্ছে সংবিধানের উপরোক্ত সব সংশোধনী বাতিল
করে তার অধীনে নিয়মকানুন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপযোগী করার। এক কথায়
বলা চলে, বর্তমানে শাসকশ্রেণীর প্রধান দুই দলের নেতৃত্বে তাদের দলগুলোর
মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ দেখা যাচ্ছে, তার কোনো সহজ সমাধান সংবিধান সংশোধন
ছাড়া হওয়ার মতো কোনো পথ আর খোলা নেই। এই পথ যদি শাসকশ্রেণী নিজেই বন্ধ
রাখে, তাহলে তাদের শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে অন্য পথ ধরতে
হবে, যার দৃষ্টান্ত এদেশে অপরিচিত নয়।
শাসকশ্রেণীর এই রাজনীতির সঙ্গে জনস্বার্থের যে কোনো সম্পর্ক নেই এটা বলাই বাহুল্য। এ জন্য আগামী নির্বাচনে জনগণ ভোট দিয়ে কোন দলকে জয়যুক্ত করবে সেটা দেখে শাসকশ্রেণীর প্রতি সাধারণভাবে জনগণের মনোভাব বোঝার কোনো উপায় নেই। তারা এক দলের পরিবর্তে অন্য দলকে ভোট দেন, কারণ যাকে তারা ভোট দেবেন তার একাধিক বিকল্প এখন জনগণের সামনে নেই। বাংলাদেশে এক ধরনের অপরিণত বুর্জুয়াদের শাসনই জারি আছে এবং এই বুর্জুয়া শ্রেণী নিজের রাজনীতিকে কঠোরভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। এখানে তাদের শ্রেণীর মধ্যে কোনো তৃতীয় বিকল্প দেখা দেয়ার মতো কোনো শর্ত নেই। এ অবস্থায় সংসদীয় রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে সরকার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের সুযোগ নেই। জনগণ পরিবর্তন চান, তাদের জীবন বর্তমান শাসকশ্রেণীর শাসনে অতিষ্ঠ ও দুর্বিষহ। এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার লাভের একমাত্র উপায় এই শাসকশ্রেণী পরিবর্তন করা। কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা বর্তমানে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে না থাকায় ভোটের মাধ্যমে বিদ্যমান ক্ষমতাসীন সরকার পরিবর্তনই তারা পাঁচ বছর অন্তর করে থাকেন। এর ফলে তারা এক দলের শাসন থেকে মুক্তি পেলেও শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার জাল ছিন্ন করে বাইরে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
পরিস্থিতির এ দিকটি কিন্তু আজ শাসকশ্রেণীর নয়, জনগণের জীবনে সব থেকে বড় রাজনৈতিক সংকট। জনগণের প্রয়োজন ১৯৭২ সাল থেকে বলবৎ লুণ্ঠনজীবীদের শাসন ব্যবস্থাকেই পরিবর্তন করে দেশে এমন এক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন, যাতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতারণার উদ্দেশ্যে যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে এক প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের এই মৌলিক কর্মসূচির সূত্রায়ন, পরিকল্পনা ও সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শাসকশ্রেণীর কোনো অংশের দ্বারাই যে সম্ভব নয়, এটা বাংলাদেশের বিগত ৪২ বছরের শাসন আমলে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বামপন্থী নামে পরিচিত যে রাজনৈতিক দল ও গ্র“পগুলো এখন পর্যন্ত শাসকশ্রেণীর প্রচার মাধ্যমে আনুকূল্য পেয়ে আসছে, তাদের দ্বারা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ এগুলো শাসকশ্রেণীরই বাম অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই বিদ্যমান দল ও সংগঠনগুলোকে হিসাবের বাইরে রেখে এবং শুধু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, এই তথাকথিত বামপন্থী সংগঠনগুলোর শ্রেণী-চরিত্র জনগণের সামনে উন্মোচিত করেই এই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সচল করতে হবে।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, জনগণের নিজের স্বার্থেই এর প্রয়োজন হলেও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সাড়াশব্দ, এ নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের কোনো নড়াচড়া নেই। সামাজিক উন্নতি ও পরিবর্তনের পরিবর্তে আত্ম উন্নতির এক সর্বব্যাপী প্রক্রিয়া জনগণেরই বিভিন্ন অংশের মধ্যে এমন শক্তিশালীভাবে জারি আছে, যার ফলে শাসকশ্রেণীর রাজনীতির বিপরীতে কোনো প্রক্রিয়া এখনো দানা বাঁধছে না। বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে এর থেকে বড় আতংকজনক ব্যাপার জনগণের নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে আর নেই।
শোষক-শাসকশ্রেণী ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের কবল থেকে দেশের রাজনীতিকে বাইরে এনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক প্রবল স্রোত সৃষ্টি করে জনগণকেই সেখানে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে জনগণের এই নিশ্চেষ্ট অবস্থান যে এক অতি সংকটজনক ব্যাপার এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এ বিতর্ক একমাত্র শাসকশ্রেণীর এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্য কেউই করতে পারে না। কিন্তু এই প্রয়োজন যতই জরুরি হোক, এক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেশের নতুন প্রজন্ম, তাদের শিক্ষিত অংশের মধ্যে আজ অনুপস্থিত। এ বিষয়টি উল্লেখ করায় তাদের কোনো কোনো অংশের মধ্যে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে পারে, হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়াবহ দিক। শাসকশ্রেণীর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নিজেদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও সংঘর্ষ চলছে সেটাই প্রচার মাধ্যমের সমগ্র অংশজুড়ে থাকলেও জনগণের জীবনের এই সংকট নিয়ে কোনো আলোচনা, কোনো উদ্বেগ ও আতংকের দেখা প্রচার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। পত্রপত্রিকায় এখন শাসকশ্রেণীর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নিুশ্রেণীর কোন্দল নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। টেলিভিশনে এটাই টকশো নামক আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে সর্বক্ষেত্রেই দেখা যায়। কিন্তু দেশের পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তনের জন্য জনগণের মধ্যে সংগ্রাম ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কিছুই শোনা যায় না। অবস্থা দেখে মনে হয়, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা এসব বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের আলোড়িত করে না। শুধু তাই নয়, এ বিষয়কে তারা সযত্ন সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলেন।
বর্তমানে নতুন প্রজন্মর শিক্ষিত নবীন ও যুবকদের মধ্যে, যৌবনোত্তর ব্যক্তিদের মধ্যে আগের থেকে পড়াশোনার চর্চা কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জনগণের জন্য কাজ করতেও অনেকভাবে নিযুক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে এটা-ওটা নানা সমস্যা সমাধানের জন্য তারা ব্যক্তিগতভাবে বা ছোট ছোট সংগঠনের মাধ্যমে কিছু চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো সংস্থার দারিদ্র্য দূরীকরণবিরোধী কাজকর্মের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের ঢেঁড়ী পেটানো কর্মসূচির মাধ্যমে যেমন বাংলাদেশের জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণের কোনো সামাজিক সমাধান হয়নি এবং হওয়ার নয়, তেমনি নতুন প্রজন্মর কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের পরোপকারের উদ্দেশ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন কাজের দ্বারাও পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, যদিও এই দ্বিতীয়োক্তদের উদ্যোগের আন্তরিকতা গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের থেকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রয়োজন অনস্বীকার্য ও জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত উন্নতির চিন্তাকে সমাজের উন্নতির চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন না রেখে বৃহত্তর অর্থে নিজের উন্নতি, নিজের মুক্তিকে সমাজের উন্নতি এবং সমাজের মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা। তার জন্য নিজেদের চিন্তাশক্তিকে জাগ্রত করা, দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা, গণতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করা। এ কাজ শুরু হলে সেই সংগ্রামের পথে যে বাতাস লাগবে এবং তার গতি দ্রুত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের জন্য এই সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। এ সংগ্রামে জনগণ ও নতুন প্রজন্ম কীভাবে, কত শিগগির ও কত ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসবেন- তার ওপরই নির্ভর করছে যে সংকট আজ জনগণের জীবনকে শোষণ-নির্যাতনের কারাগারে আটকে রেখেছে, তার থেকে তাদের মুক্তির সম্ভাবনা।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
শাসকশ্রেণীর এই রাজনীতির সঙ্গে জনস্বার্থের যে কোনো সম্পর্ক নেই এটা বলাই বাহুল্য। এ জন্য আগামী নির্বাচনে জনগণ ভোট দিয়ে কোন দলকে জয়যুক্ত করবে সেটা দেখে শাসকশ্রেণীর প্রতি সাধারণভাবে জনগণের মনোভাব বোঝার কোনো উপায় নেই। তারা এক দলের পরিবর্তে অন্য দলকে ভোট দেন, কারণ যাকে তারা ভোট দেবেন তার একাধিক বিকল্প এখন জনগণের সামনে নেই। বাংলাদেশে এক ধরনের অপরিণত বুর্জুয়াদের শাসনই জারি আছে এবং এই বুর্জুয়া শ্রেণী নিজের রাজনীতিকে কঠোরভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। এখানে তাদের শ্রেণীর মধ্যে কোনো তৃতীয় বিকল্প দেখা দেয়ার মতো কোনো শর্ত নেই। এ অবস্থায় সংসদীয় রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে সরকার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের সুযোগ নেই। জনগণ পরিবর্তন চান, তাদের জীবন বর্তমান শাসকশ্রেণীর শাসনে অতিষ্ঠ ও দুর্বিষহ। এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার লাভের একমাত্র উপায় এই শাসকশ্রেণী পরিবর্তন করা। কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা বর্তমানে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে না থাকায় ভোটের মাধ্যমে বিদ্যমান ক্ষমতাসীন সরকার পরিবর্তনই তারা পাঁচ বছর অন্তর করে থাকেন। এর ফলে তারা এক দলের শাসন থেকে মুক্তি পেলেও শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার জাল ছিন্ন করে বাইরে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
পরিস্থিতির এ দিকটি কিন্তু আজ শাসকশ্রেণীর নয়, জনগণের জীবনে সব থেকে বড় রাজনৈতিক সংকট। জনগণের প্রয়োজন ১৯৭২ সাল থেকে বলবৎ লুণ্ঠনজীবীদের শাসন ব্যবস্থাকেই পরিবর্তন করে দেশে এমন এক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন, যাতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতারণার উদ্দেশ্যে যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে এক প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের এই মৌলিক কর্মসূচির সূত্রায়ন, পরিকল্পনা ও সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শাসকশ্রেণীর কোনো অংশের দ্বারাই যে সম্ভব নয়, এটা বাংলাদেশের বিগত ৪২ বছরের শাসন আমলে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বামপন্থী নামে পরিচিত যে রাজনৈতিক দল ও গ্র“পগুলো এখন পর্যন্ত শাসকশ্রেণীর প্রচার মাধ্যমে আনুকূল্য পেয়ে আসছে, তাদের দ্বারা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ এগুলো শাসকশ্রেণীরই বাম অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই বিদ্যমান দল ও সংগঠনগুলোকে হিসাবের বাইরে রেখে এবং শুধু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, এই তথাকথিত বামপন্থী সংগঠনগুলোর শ্রেণী-চরিত্র জনগণের সামনে উন্মোচিত করেই এই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সচল করতে হবে।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, জনগণের নিজের স্বার্থেই এর প্রয়োজন হলেও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সাড়াশব্দ, এ নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের কোনো নড়াচড়া নেই। সামাজিক উন্নতি ও পরিবর্তনের পরিবর্তে আত্ম উন্নতির এক সর্বব্যাপী প্রক্রিয়া জনগণেরই বিভিন্ন অংশের মধ্যে এমন শক্তিশালীভাবে জারি আছে, যার ফলে শাসকশ্রেণীর রাজনীতির বিপরীতে কোনো প্রক্রিয়া এখনো দানা বাঁধছে না। বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে এর থেকে বড় আতংকজনক ব্যাপার জনগণের নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে আর নেই।
শোষক-শাসকশ্রেণী ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের কবল থেকে দেশের রাজনীতিকে বাইরে এনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক প্রবল স্রোত সৃষ্টি করে জনগণকেই সেখানে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে জনগণের এই নিশ্চেষ্ট অবস্থান যে এক অতি সংকটজনক ব্যাপার এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এ বিতর্ক একমাত্র শাসকশ্রেণীর এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী ছাড়া অন্য কেউই করতে পারে না। কিন্তু এই প্রয়োজন যতই জরুরি হোক, এক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেশের নতুন প্রজন্ম, তাদের শিক্ষিত অংশের মধ্যে আজ অনুপস্থিত। এ বিষয়টি উল্লেখ করায় তাদের কোনো কোনো অংশের মধ্যে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হতে পারে, হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়াবহ দিক। শাসকশ্রেণীর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নিজেদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও সংঘর্ষ চলছে সেটাই প্রচার মাধ্যমের সমগ্র অংশজুড়ে থাকলেও জনগণের জীবনের এই সংকট নিয়ে কোনো আলোচনা, কোনো উদ্বেগ ও আতংকের দেখা প্রচার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। পত্রপত্রিকায় এখন শাসকশ্রেণীর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নিুশ্রেণীর কোন্দল নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। টেলিভিশনে এটাই টকশো নামক আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে সর্বক্ষেত্রেই দেখা যায়। কিন্তু দেশের পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তনের জন্য জনগণের মধ্যে সংগ্রাম ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কিছুই শোনা যায় না। অবস্থা দেখে মনে হয়, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা এসব বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের আলোড়িত করে না। শুধু তাই নয়, এ বিষয়কে তারা সযত্ন সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলেন।
বর্তমানে নতুন প্রজন্মর শিক্ষিত নবীন ও যুবকদের মধ্যে, যৌবনোত্তর ব্যক্তিদের মধ্যে আগের থেকে পড়াশোনার চর্চা কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জনগণের জন্য কাজ করতেও অনেকভাবে নিযুক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে এটা-ওটা নানা সমস্যা সমাধানের জন্য তারা ব্যক্তিগতভাবে বা ছোট ছোট সংগঠনের মাধ্যমে কিছু চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো সংস্থার দারিদ্র্য দূরীকরণবিরোধী কাজকর্মের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের ঢেঁড়ী পেটানো কর্মসূচির মাধ্যমে যেমন বাংলাদেশের জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণের কোনো সামাজিক সমাধান হয়নি এবং হওয়ার নয়, তেমনি নতুন প্রজন্মর কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের পরোপকারের উদ্দেশ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন কাজের দ্বারাও পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, যদিও এই দ্বিতীয়োক্তদের উদ্যোগের আন্তরিকতা গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের থেকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রয়োজন অনস্বীকার্য ও জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত উন্নতির চিন্তাকে সমাজের উন্নতির চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন না রেখে বৃহত্তর অর্থে নিজের উন্নতি, নিজের মুক্তিকে সমাজের উন্নতি এবং সমাজের মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা। তার জন্য নিজেদের চিন্তাশক্তিকে জাগ্রত করা, দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা, গণতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করা। এ কাজ শুরু হলে সেই সংগ্রামের পথে যে বাতাস লাগবে এবং তার গতি দ্রুত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের জন্য এই সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। এ সংগ্রামে জনগণ ও নতুন প্রজন্ম কীভাবে, কত শিগগির ও কত ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসবেন- তার ওপরই নির্ভর করছে যে সংকট আজ জনগণের জীবনকে শোষণ-নির্যাতনের কারাগারে আটকে রেখেছে, তার থেকে তাদের মুক্তির সম্ভাবনা।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments