সংবাদ শিরোনামে বাংলাদেশ এবংমানবাধিকার by কামাল আহমেদ
ব্রিটেনে অন্তত গত দুই দশকে যে রকমটি আর কখনো দেখা যায়নি, গত দুই সপ্তাহে সে রকমটিই দেখা গেল। ২৪ ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেলগুলোর জাতীয় শিরোনামে বাংলাদেশ হয় প্রথম, নয়তো দ্বিতীয় অবস্থানে। অন্যান্য দেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে চিত্রটি কী ছিল জানি না, তবে, ইংরেজি ভাষার বৈশ্বিক সব সংবাদমাধ্যমে ঘুরেফিরে প্রতিদিনই বাংলাদেশ নামটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এগুলোর সব কটিতেই মৃত্যু, মানবিক সংকট, আইন লঙ্ঘন, দলবাজি, শ্রমশোষণকে দাসব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা, ধর্মীয় উন্মত্ততা, নৃশংস রাজনৈতিক সহিংসতার কথা উঠে এসেছে। এমনকি, বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্বান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাণ্ডজ্ঞানহীন ভবনঝাঁকুনি তত্ত্ব এবং বুজুর্গ অর্থমন্ত্রীর ভবনধসের প্রভাব তেমন কিছু নয় মন্তব্যগুলোরও বিশ্লেষণ প্রচারিত হয়েছে।
২ মে জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরের একটি মিলনায়তনে ২০০-এর মতো দেশের কূটনীতিকদের কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির কাছ থেকে যখন শুনতে পাই যে তাঁর সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবে না—তখনই মনে খটকা লাগছিল যে এমন প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের পক্ষে কীভাবে দেওয়া সম্ভব? তিনি যেদিন এই দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন, তার ঠিক দুই দিন আগে সাভারে মর্মান্তিক ভবনধসে নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের বিক্ষোভ ঠেকাতে সেখানে পুলিশকে লাঠিপেটা করতে হয়েছে (এপ্রিল ৩০, ২০১৩)। পুলিশ বা তার অনুসৃত কৌশলের সমালোচনা নয়, বরং যে বিষয়টি এখানে মূল বিবেচ্য তা হলো, বাস্তবে এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সামর্থ্য ও যোগ্যতার অভাব। যেখানে আপনজনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মানুষের সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রাপ্য, সেখানে যে আচরণের শিকার হলেন তাঁরা, তাতে ‘নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা’র অঙ্গীকার নিশ্চয়ই খুব তেতো শোনাবে।
হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাওকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেল, তাতে অধিকাংশ মানুষই হতবাক। কথা ছিল ঢাকার চারদিকে শান্তিপূর্ণ অবরোধ হবে। অবরোধ শুরুর পর তারা যখন ঢাকায় ঢুকে সমাবেশ করতে চাইল, তখন তাদেরকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়টির যৌক্তিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ। মাত্র ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ সামাল দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সময়স্বল্পতার জন্য যে তা সম্ভব নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। অনেকেই যুক্তি দিতে পারেন যে ঢাকায় ঢুকতে না দিলে সহিংসতা চারদিকে ছড়িয়ে যেত। কিন্তু, তাতে প্রশাসন অন্তত দুটো দিক দিয়ে সুবিধা পেত। প্রথমত, যেটা ঘটত তা ঢাকার প্রান্তসীমায়, আর দ্বিতীয়ত, প্রতিটা স্থানেই সহিংসতার মাত্রা অনেক কম হতো। কেননা তাদের ক্ষমতা তখন এতটা কেন্দ্রীভূত থাকত না।
হেফাজতের অবরোধ ও সমাবেশ ঘিরে যে সহিংসতা, অনেকেই তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক বলে বর্ণনা করেছেন। তাহলে, এর জন্য নিশ্চয়ই বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাহলে কী করেছে? কেন তারা এ ক্ষেত্রে আগাম হুঁশিয়ারি দিতে ব্যর্থ হলো? গোয়েন্দা কার্যক্রমের এই ব্যর্থতা তো বিডিআর বিদ্রোহের সময় যেমনটি দেখা গেছে, তার সঙ্গে তুলনীয়।
হেফাজতের প্রথম সমাবেশ যেটি সরকার-সমর্থক পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সমাবেশের প্রাক্কালে সরকার বলেছিল, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে যে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অথচ, যখন হাঙ্গামা হলো, তখন তাদের কাছে কোনো আভাস-ইঙ্গিত কেন এল না, সেটা বোঝা মুশকিল। তাহলে কি এটি সেই বাঘ আসার গল্পের মতো?
হেফাজতের কিছু নেতাকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে যে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকেরা সহিংসতায় জড়িত নন। বিএনপির মঙ্গলবারের বিবৃতিতেও বলা হয়েছে যে হেফাজত এসব সহিংসতার জন্য দায়ী নয়। তাহলে দায়ী কারা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কোনো তদন্ত হবে কি না বা তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণনির্ভর ব্যাখ্যা মিলবে কি না, তার জন্য কত দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে কে জানে। তবে, এই পটভূমিতে কতগুলো বিষয় আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই প্রতিবাদ বিক্ষোভের জন্য যেসব নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়, সে রকমটি আমাদেরও ভাবা প্রয়োজন।
প্রথমত, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সবার জন্য উন্মুক্ত কোনো সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মিছিল ইত্যাদি যারা আয়োজন করবে, সেই কর্মসূচির নিরাপত্তাব্যবস্থার খুঁটিনাটি সব বিষয়ে পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আয়োজকদের একটা সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। আয়োজকদের স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের দলীয় সদস্যদের পরিচয় নিশ্চিত করা, কোনো বিপদ বা দুর্ঘটনা ঘটলে সভায় আগতদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া এবং তাঁদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করবেন।
দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্বটাও তাঁদেরকেই নিতে হবে। সংগঠনগুলোর আকারভেদে এসব কর্মসূচিতে সহজেই চোখে পড়ে এ রকম জ্যাকেট বা টি-শার্ট পরিহিত শত শত স্টুয়ার্ট এ ধরনের সমাবেশ বা শোভাযাত্রাকে ঘিরে রেখে সেগুলোর শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো এ রকম ব্যবস্থা নিলে তাদের কর্মসূচিতেও কথিত অনুপ্রবেশকারীদের নাশকতার ঝুঁকি কমে যাবে।
এখন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেটা সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে না এমন নয়। মিছিল ও শোভাযাত্রার ক্ষেত্রেও পুলিশের সঙ্গে আগাম সমঝোতা হতে হবে। এর ভিত্তিতে মিছিলের গতিপথ ঠিক করে নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ রাখলে তাতে জনভোগান্তি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এতে করে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, যাত্রীদের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার মতো নিষ্ঠুর ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা অবশ্য দলনিরপেক্ষভাবে কার্যকর করতে হবে। বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে অনুমতি দেওয়া হবে না, কিন্তু, সরকার-সমর্থকদের নানা অজুহাতে রাস্তায় নামতে দিলে এই ব্যবস্থায় ফল পাওয়া যাবে না।
কেউ আইন লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, সেই আইনগত ব্যবস্থাও আইনসম্মত পন্থাতেই কার্যকর করার কথা। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিলে আইনসম্মত ব্যবস্থা হিসেবে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সম্প্রচার নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে যে দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তা সে জন্যই অগ্রহণযোগ্য। এই ঘটনা ঘটল বৈশ্বিক একটি চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রীর এক সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠার পর। বাংলাদেশের কুটিল রাজনীতির জটিল সমীকরণ, তার ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে জানার অবকাশ বিদেশিদের থাকার কথা নয়। তাঁরা শুধু এটুকুই জানবেন যে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। এটা কোনোভাবে কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
সিএনএনের ক্রিস্টিনা আমানপুর প্রধানমন্ত্রীকে বললেন যে সাংবাদিক হিসেবে ভিসার জন্য তাঁর কাছে ওয়েভার বা দায়মুক্তির একটি লিখিত ঘোষণা চাওয়া হয়েছিল, যেটি তাঁদের সম্পাদকীয় নীতিমালার জন্য তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে সাংবাদিকদের ভিসা আবেদনের নির্ধারিত ফরমটি দেখে অবাক হলাম। এটি তো সেই সামরিক শাসনামলের বিধান, যাতে আবেদনকারী সাংবাদিককে মুচলেকা দিতে হবে যে তিনি তাঁর কার্যক্রমের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তাঁর তোলা ছবি ও রিপোর্ট কর্তৃপক্ষকে দেখাবেন এবং কোনো অংশ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বলে প্রতীয়মান হলে সেটুকু সম্পাদন করতে তিনি সম্মত হবেন। আমি জানি না বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপালনীয় হিসেবে এসব শর্ত, যিনি বা যাঁরা বহাল রেখেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়ককে আসলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন হিসেবে বিবেচনা করেন কি না। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের এই যুগে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে ঢুকতে না দিলেই কি ঘটনা-দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আড়াল করা যায়?
এর আগে, সূত্র হিসেবে খুবই অনির্ভরযোগ্য, ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারলাম যে ঢাকায় আল-জাজিরার সংবাদদাতা নিকোলাস হকের কাজ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। জেনেভায় সুযোগ পেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। তবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে খবর নিয়ে জানালেন যে বিদেশি পাসপোর্টধারী নিকোলাসের ওয়ার্ক পারমিট নেই বলে তাঁকে সেই অনুমতি নিতে বলা হয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজ করতে পারবেন না। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো ব্যক্তি যাঁর বাংলাদেশে ঢুকতে ভিসা লাগে না, তাঁর কেন কাজ করার জন্য ওয়ার্ক পারমিট লাগবে? দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বাংলাদেশিদের তো বাংলাদেশে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আলাদা অনুমতি লাগে না। শ্রম ও মেধা বিনিয়োগে কেন আলাদা অনুমোদন লাগবে? আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কবে বুঝবেন যে এসব ছোটখাটো নিষেধাজ্ঞা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার র্যাংকিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?
নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আয়োজনের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্যদের নিরাপত্তা ও জীবনের অধিকারের সমন্বয় ঘটানো যেখানে সম্ভব হয়নি, সেখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশ কীভাবে এ রকম জোরালো প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর লন্ডনপ্রতিনিধি।
২ মে জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরের একটি মিলনায়তনে ২০০-এর মতো দেশের কূটনীতিকদের কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির কাছ থেকে যখন শুনতে পাই যে তাঁর সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবে না—তখনই মনে খটকা লাগছিল যে এমন প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের পক্ষে কীভাবে দেওয়া সম্ভব? তিনি যেদিন এই দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন, তার ঠিক দুই দিন আগে সাভারে মর্মান্তিক ভবনধসে নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের বিক্ষোভ ঠেকাতে সেখানে পুলিশকে লাঠিপেটা করতে হয়েছে (এপ্রিল ৩০, ২০১৩)। পুলিশ বা তার অনুসৃত কৌশলের সমালোচনা নয়, বরং যে বিষয়টি এখানে মূল বিবেচ্য তা হলো, বাস্তবে এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সামর্থ্য ও যোগ্যতার অভাব। যেখানে আপনজনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মানুষের সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রাপ্য, সেখানে যে আচরণের শিকার হলেন তাঁরা, তাতে ‘নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা’র অঙ্গীকার নিশ্চয়ই খুব তেতো শোনাবে।
হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাওকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেল, তাতে অধিকাংশ মানুষই হতবাক। কথা ছিল ঢাকার চারদিকে শান্তিপূর্ণ অবরোধ হবে। অবরোধ শুরুর পর তারা যখন ঢাকায় ঢুকে সমাবেশ করতে চাইল, তখন তাদেরকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়টির যৌক্তিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ। মাত্র ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ সামাল দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সময়স্বল্পতার জন্য যে তা সম্ভব নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। অনেকেই যুক্তি দিতে পারেন যে ঢাকায় ঢুকতে না দিলে সহিংসতা চারদিকে ছড়িয়ে যেত। কিন্তু, তাতে প্রশাসন অন্তত দুটো দিক দিয়ে সুবিধা পেত। প্রথমত, যেটা ঘটত তা ঢাকার প্রান্তসীমায়, আর দ্বিতীয়ত, প্রতিটা স্থানেই সহিংসতার মাত্রা অনেক কম হতো। কেননা তাদের ক্ষমতা তখন এতটা কেন্দ্রীভূত থাকত না।
হেফাজতের অবরোধ ও সমাবেশ ঘিরে যে সহিংসতা, অনেকেই তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক বলে বর্ণনা করেছেন। তাহলে, এর জন্য নিশ্চয়ই বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাহলে কী করেছে? কেন তারা এ ক্ষেত্রে আগাম হুঁশিয়ারি দিতে ব্যর্থ হলো? গোয়েন্দা কার্যক্রমের এই ব্যর্থতা তো বিডিআর বিদ্রোহের সময় যেমনটি দেখা গেছে, তার সঙ্গে তুলনীয়।
হেফাজতের প্রথম সমাবেশ যেটি সরকার-সমর্থক পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সমাবেশের প্রাক্কালে সরকার বলেছিল, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে যে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অথচ, যখন হাঙ্গামা হলো, তখন তাদের কাছে কোনো আভাস-ইঙ্গিত কেন এল না, সেটা বোঝা মুশকিল। তাহলে কি এটি সেই বাঘ আসার গল্পের মতো?
হেফাজতের কিছু নেতাকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে যে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকেরা সহিংসতায় জড়িত নন। বিএনপির মঙ্গলবারের বিবৃতিতেও বলা হয়েছে যে হেফাজত এসব সহিংসতার জন্য দায়ী নয়। তাহলে দায়ী কারা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কোনো তদন্ত হবে কি না বা তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণনির্ভর ব্যাখ্যা মিলবে কি না, তার জন্য কত দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে কে জানে। তবে, এই পটভূমিতে কতগুলো বিষয় আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই প্রতিবাদ বিক্ষোভের জন্য যেসব নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়, সে রকমটি আমাদেরও ভাবা প্রয়োজন।
প্রথমত, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সবার জন্য উন্মুক্ত কোনো সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মিছিল ইত্যাদি যারা আয়োজন করবে, সেই কর্মসূচির নিরাপত্তাব্যবস্থার খুঁটিনাটি সব বিষয়ে পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আয়োজকদের একটা সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। আয়োজকদের স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের দলীয় সদস্যদের পরিচয় নিশ্চিত করা, কোনো বিপদ বা দুর্ঘটনা ঘটলে সভায় আগতদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া এবং তাঁদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করবেন।
দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্বটাও তাঁদেরকেই নিতে হবে। সংগঠনগুলোর আকারভেদে এসব কর্মসূচিতে সহজেই চোখে পড়ে এ রকম জ্যাকেট বা টি-শার্ট পরিহিত শত শত স্টুয়ার্ট এ ধরনের সমাবেশ বা শোভাযাত্রাকে ঘিরে রেখে সেগুলোর শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো এ রকম ব্যবস্থা নিলে তাদের কর্মসূচিতেও কথিত অনুপ্রবেশকারীদের নাশকতার ঝুঁকি কমে যাবে।
এখন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেটা সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে না এমন নয়। মিছিল ও শোভাযাত্রার ক্ষেত্রেও পুলিশের সঙ্গে আগাম সমঝোতা হতে হবে। এর ভিত্তিতে মিছিলের গতিপথ ঠিক করে নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ রাখলে তাতে জনভোগান্তি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এতে করে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, যাত্রীদের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার মতো নিষ্ঠুর ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা অবশ্য দলনিরপেক্ষভাবে কার্যকর করতে হবে। বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে অনুমতি দেওয়া হবে না, কিন্তু, সরকার-সমর্থকদের নানা অজুহাতে রাস্তায় নামতে দিলে এই ব্যবস্থায় ফল পাওয়া যাবে না।
কেউ আইন লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, সেই আইনগত ব্যবস্থাও আইনসম্মত পন্থাতেই কার্যকর করার কথা। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিলে আইনসম্মত ব্যবস্থা হিসেবে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সম্প্রচার নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে যে দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তা সে জন্যই অগ্রহণযোগ্য। এই ঘটনা ঘটল বৈশ্বিক একটি চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রীর এক সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠার পর। বাংলাদেশের কুটিল রাজনীতির জটিল সমীকরণ, তার ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে জানার অবকাশ বিদেশিদের থাকার কথা নয়। তাঁরা শুধু এটুকুই জানবেন যে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। এটা কোনোভাবে কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
সিএনএনের ক্রিস্টিনা আমানপুর প্রধানমন্ত্রীকে বললেন যে সাংবাদিক হিসেবে ভিসার জন্য তাঁর কাছে ওয়েভার বা দায়মুক্তির একটি লিখিত ঘোষণা চাওয়া হয়েছিল, যেটি তাঁদের সম্পাদকীয় নীতিমালার জন্য তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে সাংবাদিকদের ভিসা আবেদনের নির্ধারিত ফরমটি দেখে অবাক হলাম। এটি তো সেই সামরিক শাসনামলের বিধান, যাতে আবেদনকারী সাংবাদিককে মুচলেকা দিতে হবে যে তিনি তাঁর কার্যক্রমের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তাঁর তোলা ছবি ও রিপোর্ট কর্তৃপক্ষকে দেখাবেন এবং কোনো অংশ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বলে প্রতীয়মান হলে সেটুকু সম্পাদন করতে তিনি সম্মত হবেন। আমি জানি না বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপালনীয় হিসেবে এসব শর্ত, যিনি বা যাঁরা বহাল রেখেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়ককে আসলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন হিসেবে বিবেচনা করেন কি না। প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের এই যুগে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে ঢুকতে না দিলেই কি ঘটনা-দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আড়াল করা যায়?
এর আগে, সূত্র হিসেবে খুবই অনির্ভরযোগ্য, ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারলাম যে ঢাকায় আল-জাজিরার সংবাদদাতা নিকোলাস হকের কাজ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। জেনেভায় সুযোগ পেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। তবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে খবর নিয়ে জানালেন যে বিদেশি পাসপোর্টধারী নিকোলাসের ওয়ার্ক পারমিট নেই বলে তাঁকে সেই অনুমতি নিতে বলা হয়েছে এবং সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজ করতে পারবেন না। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো ব্যক্তি যাঁর বাংলাদেশে ঢুকতে ভিসা লাগে না, তাঁর কেন কাজ করার জন্য ওয়ার্ক পারমিট লাগবে? দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বাংলাদেশিদের তো বাংলাদেশে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আলাদা অনুমতি লাগে না। শ্রম ও মেধা বিনিয়োগে কেন আলাদা অনুমোদন লাগবে? আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কবে বুঝবেন যে এসব ছোটখাটো নিষেধাজ্ঞা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার র্যাংকিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?
নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আয়োজনের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্যদের নিরাপত্তা ও জীবনের অধিকারের সমন্বয় ঘটানো যেখানে সম্ভব হয়নি, সেখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশ কীভাবে এ রকম জোরালো প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর লন্ডনপ্রতিনিধি।
No comments