মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হলে...by আসিফ নজরুল
৬ মে থেকে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে গুজবের দেশে। এই গুজব ভয়াবহ, অবিশ্বাস্য এবং আতঙ্কজনক। বলা হচ্ছে যে ৫ মে মধ্যরাতের পর শাপলা চত্বরে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে কয়েক হাজার হেফাজতের কর্মী নিহত হয়েছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামের বক্তব্যেও এমন দাবি করা হয়েছে। সাধারণ যুক্তিতে দেখলে শাপলা চত্বরে সরকারের হত্যাযজ্ঞ চালানোর কোনো কারণ নেই। স্পষ্টত, সেদিন সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল হেফাজতের কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত করা। এ কাজটি করার জন্য বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রয়োজন পড়ে না। তবে কোনো আন্দোলনস্থল ত্যাগ না করার জন্য অনেক মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলে সুকৌশলী অভিযান ছাড়া একদমই বিনা রক্তপাতে তাদের বিতাড়ন সব সময় সম্ভব হয় না। আমরা গত বছর থাইল্যান্ডে রেড শার্ট মুভমেন্ট দমন করার ক্ষেত্রে রক্তক্ষয়ের ঘটনা দেখেছি। শাপলা চত্বরে তাই প্রাণহানির ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। সমাবেশ উচ্ছেদ করতে গিয়ে কিছু প্রাণহানির খবর এমনকি ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যেও উঠে এসেছে।
শাপলা চত্বরে যৌথ বাহিনীর অভিযানের আগে-পরেও অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। আগে-পরের মুখোমুখি সংঘর্ষে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রাণ হারিয়েছে হেফাজতের কর্মীরা। কিন্তু শাপলা চত্বরে যৌথ বাহিনীর অভিযানটি ছিল একতরফা। পুলিশি কর্ডনের ভেতর থাকা স্লোগান বা জিকিররত মানুষকে মধ্যরাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে বিতাড়নকালে যে শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে, তা বিরল এবং ভয়ংকর একটি ঘটনা। এ ঘটনায় সরকারের ভাষ্যমতে, তিনজন আর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, ২০ থেকে ৪০ জন নিহত হয়েছে। ঠিক কতজন মারা গেছে বা গুলিতে আহত হয়েছে, তা নির্ভুলভাবে আমাদের জানা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মধ্যরাতের এই অভিযানের স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে আলোচনা এবং গোটা ২০১৩ সালে বিপুলসংখ্যায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনের কারণ উপলব্ধি করা
শাপলা চত্বরে যৌথ বাহিনীর অভিযানের আগে-পরেও অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। আগে-পরের মুখোমুখি সংঘর্ষে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রাণ হারিয়েছে হেফাজতের কর্মীরা। কিন্তু শাপলা চত্বরে যৌথ বাহিনীর অভিযানটি ছিল একতরফা। পুলিশি কর্ডনের ভেতর থাকা স্লোগান বা জিকিররত মানুষকে মধ্যরাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে বিতাড়নকালে যে শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে, তা বিরল এবং ভয়ংকর একটি ঘটনা। এ ঘটনায় সরকারের ভাষ্যমতে, তিনজন আর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, ২০ থেকে ৪০ জন নিহত হয়েছে। ঠিক কতজন মারা গেছে বা গুলিতে আহত হয়েছে, তা নির্ভুলভাবে আমাদের জানা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মধ্যরাতের এই অভিযানের স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে আলোচনা এবং গোটা ২০১৩ সালে বিপুলসংখ্যায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনের কারণ উপলব্ধি করা
২.
শাপলা চত্বরের অভিযানটি পরিচালিত হয় রাত আড়াইটার দিকে। অভিযানের রেকর্ডেড ভার্সন এই সরকারের সময় লাইসেন্স পাওয়া দুটো টিভি চ্যানেল (সময় ও ৭১) তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার করে। আমার জানামতে, পুলিশি অভিযানটি লাইভ সমপ্রচার করে কেবল দিগন্ত টিভি, যার মালিক জামায়াতের একজন নেতা। দিগন্ত টিভির সমপ্রচারে অভিযানের ভয়াবহতা বেশি দৃশ্যমান ছিল এবং টিভিটির নেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকারে শত শত প্রাণহানির দাবি করা হয়েছিল। চ্যানেলটির সমপ্রচার প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সরকার বন্ধ করে দেয়, অনুরূপ কারণে বন্ধ করে দেয় বিএনপিপন্থী চ্যানেল ইসলামিক টিভির সমপ্রচারও।
এই অভিযানের প্রকৃতি ঠিক কী রকম ছিল, তা আমাদের পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে এই প্রশ্ন তোলা অবান্তর নয় যে শাপলা চত্বরের অভিযানটি যথাযথ ছিল কি না। শাপলা চত্বরের মানুষ মধ্যরাতে কি কারও জানমালের প্রতি তাৎক্ষণিক কোনো হুমকি ছিল? তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগের সময় কি প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়নি? এই অভিযান ভোরের আলোয় সব গণমাধ্যমকে সামনে রেখে করা হলে কি প্রাণহানির আশঙ্কা এবং প্রাণহানিসংক্রান্ত গুজব হ্রাস করা যেত না? হেফাজতে ইসলাম, বিশেষ করে আল্লামা শফীর সঙ্গে আরও আলোচনা করে তাদের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কি শাপলা চত্বর ত্যাগ করানোতে রাজি করা যেত না? মধ্যরাতের অভিযানটির বিকল্প কোনো কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা কি সরকার করেছিল?
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সকালে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালানোর আশঙ্কা ছিল। পুলিশের বক্তব্য এই রাষ্ট্রের চরিত্রের প্রতিফলন হিসেবে সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নাও মনে হতে পারে। তবে এটি ঠিক যে হেফাজত অনুমোদিত সময়ের অতিরিক্ত সময় ধরে অবস্থান করার কারণে এবং ৫ মে শহরে বিভিন্নমুখী সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন ৬ মেতেও ঢাকার রাজপথে ব্যাপক গোলযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা ছিল। ৬ মে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ ডাকার কারণে এই আশঙ্কা আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। এসব বিবেচনায় শাপলা চত্বর হেফাজতের দখল থেকে মুক্ত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে হয়তো আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা গভীর রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে শত শত বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে কেন? কেন তা মিডিয়ার সীমাবদ্ধ উপস্থিতির মধ্যে? এই অভিযান প্রচারকারী বিরোধী দলপন্থী টিভি চ্যানেলগুলোকে কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান না করে?
শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড নিয়ে গুজবের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এসব কারণেই। সামপ্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের কর্মীদের প্রতি পুলিশের নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আত্মরক্ষার বা অন্যের জানমাল বাঁচানোর প্রয়োজন না হলে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের কোনো আইনি অধিকার নেই। এই শক্তি প্রয়োগও করতে হয় যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই। শটগানের ছররা গুলি বা রাবার বুলেট লেথ্যাল উইপন নয়, কিন্তু যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করলে এগুলোও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামপ্রতিক কালে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর এসব অস্ত্রে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা যদি এই রাষ্ট্রের কাছে সহনীয় হয়ে ওঠে, তাহলে ভয়াবহ এক অন্ধকারের দিকে আমরা ধাবিত হব।
শাপলা চত্বরে অভিযানের আগে পল্টন ও আশপাশের এলাকায় সারা দিন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কি শুধু হেফাজতে ইসলাম জড়িত ছিল, তাদের ভেতর অবস্থান নিয়ে বিএনপি বা জামায়াত-শিবির কি এসব কাজ করেছিল, সংঘর্ষ উসকে দিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও কি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল বা এ সময় পুলিশ আসলে কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল—এ ধরনের নানা প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। আমরা টেলিভিশনে দেখেছি যে পল্টন ও আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষের সময়ও শাপলা চত্বরে সমাবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। এসব সংঘর্ষের ঘটনা তাই গভীর রাতে শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানের যৌক্তিকতা সৃষ্টি করেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।
৩.
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরসহ নানা ঘটনায় বহু অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল দেখছি আমরা। বছরের শুরু থেকে নানা কর্মসূচি পালনকালে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামি সংগঠনগুলোর কর্মীদের ওপর পুলিশের ব্যাপক গুলিবর্ষণের নানা ঘটনা ঘটেছে। এসব কর্মসূচি কখনো কখনো অত্যন্ত সহিংস ছিল, কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের ওপর বর্বর আক্রমণের কিছু ঘটনাও ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়োজন ছাড়াই পুলিশি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর বা ঢাকার শাপলা চত্বরের মতো কিছু ঘটনায় পুলিশি অভিযানের যৌক্তিকতা ও তীব্রতা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
এসব ঘটনার সঙ্গে ভবিষ্যতে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার বা আসার লক্ষ্যে মাঠ পরিস্থিতির ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ রাখার রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এমনকি সাভারে রানা প্লাজায় হূদয়বিদারক গণমৃত্যুর ঘটনাও হয়তো ঘটত না, যদি সেদিন সেখান থেকে হরতালবিরোধী মিছিলের আয়োজনের চিন্তা সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে কাজ না করত। কোনো না কোনোভাবে এসব মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকার ও বিরোধী দলের বেপরোয়া ও সংঘাতমূলক রাজনীতি দায়ী। এই রাজনীতির উপসর্গই মৃত্যু, ধ্বংস, নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা।
এই পরিস্থিতির আশু অবসান প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি যে দেশের দুটো প্রধান গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বহুলাংশে দূর হবে। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সহায়ক আন্দোলন তাতে দুর্বল হয়ে যাবে, হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের পেছনে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক মদদও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। ক্রমাগত হরতাল ও পুলিশি অভিযানে ইতিমধ্যে সমাজে নানা অসন্তোষ, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হলে হরতাল ও বিরোধী দলের প্রতি দমনমূলক কর্মকাণ্ডও হ্রাস পেতে বাধ্য।
সমঝোতার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব প্রশংসনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, এ নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে কি না, তা আওয়ামী লীগকে আগে বলতে হবে। ১৯৯৬ সালে অনুরূপ পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মানতে রাজি হয়নি। কাজেই আওয়ামী লীগও এখন আশা করতে পারে না যে আগামী সর্বদলীয় সরকারের প্রধানহিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নেবে বর্তমান বিরোধী দলগুলো।
তা ছাড়া বাংলাদেশে সরকার পদ্ধতি এমনই যে সরকারপ্রধান এখানে প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ পদে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে দলীয় কোনো নেতা (বিশেষ করে হাসিনা বা খালেদার মতো পরাক্রমশালী কোনো নেতা) দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সবচেয়ে জরুরি। তা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান ঘটবে না দেশে।
রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার দ্বন্দ্বেও প্রাণ হারাচ্ছে বা সর্বস্বান্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ, সমাজের ওপরতলার কেউ নয়। দেশের মানুষকে ও দেশকে ভালোবাসলে তাই আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান দল দুটোকে করতেই হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়। ��� X)� � �mn �s ��িত করার পাশাপাশি অন্যদের নিরাপত্তা ও জীবনের অধিকারের সমন্বয় ঘটানো যেখানে সম্ভব হয়নি, সেখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশ কীভাবে এ রকম জোরালো প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর লন্ডনপ্রতিনিধি।
শাপলা চত্বরের অভিযানটি পরিচালিত হয় রাত আড়াইটার দিকে। অভিযানের রেকর্ডেড ভার্সন এই সরকারের সময় লাইসেন্স পাওয়া দুটো টিভি চ্যানেল (সময় ও ৭১) তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার করে। আমার জানামতে, পুলিশি অভিযানটি লাইভ সমপ্রচার করে কেবল দিগন্ত টিভি, যার মালিক জামায়াতের একজন নেতা। দিগন্ত টিভির সমপ্রচারে অভিযানের ভয়াবহতা বেশি দৃশ্যমান ছিল এবং টিভিটির নেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকারে শত শত প্রাণহানির দাবি করা হয়েছিল। চ্যানেলটির সমপ্রচার প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সরকার বন্ধ করে দেয়, অনুরূপ কারণে বন্ধ করে দেয় বিএনপিপন্থী চ্যানেল ইসলামিক টিভির সমপ্রচারও।
এই অভিযানের প্রকৃতি ঠিক কী রকম ছিল, তা আমাদের পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে এই প্রশ্ন তোলা অবান্তর নয় যে শাপলা চত্বরের অভিযানটি যথাযথ ছিল কি না। শাপলা চত্বরের মানুষ মধ্যরাতে কি কারও জানমালের প্রতি তাৎক্ষণিক কোনো হুমকি ছিল? তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগের সময় কি প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়নি? এই অভিযান ভোরের আলোয় সব গণমাধ্যমকে সামনে রেখে করা হলে কি প্রাণহানির আশঙ্কা এবং প্রাণহানিসংক্রান্ত গুজব হ্রাস করা যেত না? হেফাজতে ইসলাম, বিশেষ করে আল্লামা শফীর সঙ্গে আরও আলোচনা করে তাদের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কি শাপলা চত্বর ত্যাগ করানোতে রাজি করা যেত না? মধ্যরাতের অভিযানটির বিকল্প কোনো কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা কি সরকার করেছিল?
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সকালে শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ চালানোর আশঙ্কা ছিল। পুলিশের বক্তব্য এই রাষ্ট্রের চরিত্রের প্রতিফলন হিসেবে সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নাও মনে হতে পারে। তবে এটি ঠিক যে হেফাজত অনুমোদিত সময়ের অতিরিক্ত সময় ধরে অবস্থান করার কারণে এবং ৫ মে শহরে বিভিন্নমুখী সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন ৬ মেতেও ঢাকার রাজপথে ব্যাপক গোলযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা ছিল। ৬ মে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ ডাকার কারণে এই আশঙ্কা আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। এসব বিবেচনায় শাপলা চত্বর হেফাজতের দখল থেকে মুক্ত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে হয়তো আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা গভীর রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে শত শত বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে কেন? কেন তা মিডিয়ার সীমাবদ্ধ উপস্থিতির মধ্যে? এই অভিযান প্রচারকারী বিরোধী দলপন্থী টিভি চ্যানেলগুলোকে কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান না করে?
শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড নিয়ে গুজবের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এসব কারণেই। সামপ্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের কর্মীদের প্রতি পুলিশের নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আত্মরক্ষার বা অন্যের জানমাল বাঁচানোর প্রয়োজন না হলে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের কোনো আইনি অধিকার নেই। এই শক্তি প্রয়োগও করতে হয় যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই। শটগানের ছররা গুলি বা রাবার বুলেট লেথ্যাল উইপন নয়, কিন্তু যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করলে এগুলোও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামপ্রতিক কালে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর এসব অস্ত্রে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা যদি এই রাষ্ট্রের কাছে সহনীয় হয়ে ওঠে, তাহলে ভয়াবহ এক অন্ধকারের দিকে আমরা ধাবিত হব।
শাপলা চত্বরে অভিযানের আগে পল্টন ও আশপাশের এলাকায় সারা দিন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কি শুধু হেফাজতে ইসলাম জড়িত ছিল, তাদের ভেতর অবস্থান নিয়ে বিএনপি বা জামায়াত-শিবির কি এসব কাজ করেছিল, সংঘর্ষ উসকে দিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও কি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল বা এ সময় পুলিশ আসলে কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল—এ ধরনের নানা প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। আমরা টেলিভিশনে দেখেছি যে পল্টন ও আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষের সময়ও শাপলা চত্বরে সমাবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। এসব সংঘর্ষের ঘটনা তাই গভীর রাতে শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানের যৌক্তিকতা সৃষ্টি করেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।
৩.
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরসহ নানা ঘটনায় বহু অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল দেখছি আমরা। বছরের শুরু থেকে নানা কর্মসূচি পালনকালে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামি সংগঠনগুলোর কর্মীদের ওপর পুলিশের ব্যাপক গুলিবর্ষণের নানা ঘটনা ঘটেছে। এসব কর্মসূচি কখনো কখনো অত্যন্ত সহিংস ছিল, কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের ওপর বর্বর আক্রমণের কিছু ঘটনাও ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়োজন ছাড়াই পুলিশি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর বা ঢাকার শাপলা চত্বরের মতো কিছু ঘটনায় পুলিশি অভিযানের যৌক্তিকতা ও তীব্রতা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
এসব ঘটনার সঙ্গে ভবিষ্যতে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার বা আসার লক্ষ্যে মাঠ পরিস্থিতির ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ রাখার রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এমনকি সাভারে রানা প্লাজায় হূদয়বিদারক গণমৃত্যুর ঘটনাও হয়তো ঘটত না, যদি সেদিন সেখান থেকে হরতালবিরোধী মিছিলের আয়োজনের চিন্তা সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে কাজ না করত। কোনো না কোনোভাবে এসব মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকার ও বিরোধী দলের বেপরোয়া ও সংঘাতমূলক রাজনীতি দায়ী। এই রাজনীতির উপসর্গই মৃত্যু, ধ্বংস, নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা।
এই পরিস্থিতির আশু অবসান প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি যে দেশের দুটো প্রধান গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বহুলাংশে দূর হবে। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সহায়ক আন্দোলন তাতে দুর্বল হয়ে যাবে, হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের পেছনে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক মদদও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। ক্রমাগত হরতাল ও পুলিশি অভিযানে ইতিমধ্যে সমাজে নানা অসন্তোষ, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হলে হরতাল ও বিরোধী দলের প্রতি দমনমূলক কর্মকাণ্ডও হ্রাস পেতে বাধ্য।
সমঝোতার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব প্রশংসনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, এ নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে কি না, তা আওয়ামী লীগকে আগে বলতে হবে। ১৯৯৬ সালে অনুরূপ পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মানতে রাজি হয়নি। কাজেই আওয়ামী লীগও এখন আশা করতে পারে না যে আগামী সর্বদলীয় সরকারের প্রধানহিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নেবে বর্তমান বিরোধী দলগুলো।
তা ছাড়া বাংলাদেশে সরকার পদ্ধতি এমনই যে সরকারপ্রধান এখানে প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ পদে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে দলীয় কোনো নেতা (বিশেষ করে হাসিনা বা খালেদার মতো পরাক্রমশালী কোনো নেতা) দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সবচেয়ে জরুরি। তা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান ঘটবে না দেশে।
রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার দ্বন্দ্বেও প্রাণ হারাচ্ছে বা সর্বস্বান্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ, সমাজের ওপরতলার কেউ নয়। দেশের মানুষকে ও দেশকে ভালোবাসলে তাই আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান দল দুটোকে করতেই হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়। ��� X)� � �mn �s ��িত করার পাশাপাশি অন্যদের নিরাপত্তা ও জীবনের অধিকারের সমন্বয় ঘটানো যেখানে সম্ভব হয়নি, সেখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশ কীভাবে এ রকম জোরালো প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর লন্ডনপ্রতিনিধি।
No comments