নারীদের সহায়তার পথ ধরতে হবে by সাজিয়া ওমর
সমাজে অতিদরিদ্রদের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। এই অতিদরিদ্রদের মধ্যে মেয়েদের অবস্থাটি যে আরও নাজুক, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে জীবনের তিনটি পর্যায় আছে, যখন মেয়েরা হয়ে পড়ে একেবারেই ক্ষমতাহীন; বয়ঃসন্ধি, বিবাহ প্রারম্ভে ও বিধবা অবস্থায়। বয়ঃসন্ধির সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিদরিদ্র মেয়েরা কোনো দক্ষতা অর্জন বা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় না। তারা এই বিশ্বাসে বেড়ে ওঠে যে তারা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে গৃহস্থালি কাজকর্ম। বিয়েতে যৌতুক দিতে হবে—এই চাপ বাড়িতে মেয়েদের দুর্বল অবস্থানে ফেলে দেয়। অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের আসন্ন যৌতুকের এই চাপ অনুভব করানো হয়, যাতে খাদ্যসহ গৃহস্থালির যে সামান্য সম্পদ রয়েছে, তাতে ভাগ বসানোর ব্যাপারে তারা সংযমী হয়। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাকে যৌতুকের চাপ থেকে মুক্তি দিতে তরুণীরা আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। বয়সভেদে যৌতুকেরও হেরফের হয়। মেয়ের বয়স যত কম, যৌতুকের চাহিদাও তত কম। আর পুরুষ যত বেশি বয়স্ক বা অক্ষম, তার যৌতুকের চাহিদাও তত কম। অল্প বয়স্ক কনেরা শ্বশুরবাড়িতে নতুন একগুচ্ছ পিতৃতান্ত্রিক ঝুঁকির সামনে অরক্ষিত থাকে। বিয়ের পর তারা তাদের আচার-ব্যবহার পরিবর্তন করে তাদের স্বামীদের খুশি করার কৌশল রপ্ত করে। অল্প বয়সী এই বধূদের কম খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাজ্যের একটি যৌথ বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন অল্প বয়স্ক বধূর চারজন বলেছে, স্বামীর খাদ্য গ্রহণের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তারা তা-ই খায়। তিনজন বলেছে, তারা তাদের স্বামীর সঙ্গে খায় এবং তারা যখন গর্ভবতী হয়, তখন তাদের স্বামীরা কখনো নিজের খাবার থেকে স্ত্রীদের দেওয়ার প্রস্তাব করে। তারা প্রত্যেকেই বলেছে, সব সময়ই তারা সেই খাবার ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ, তারা ভালো স্ত্রী হতে চায়। তাদের ভালো স্ত্রী হওয়া দরকার, যাতে তারা কখনো পরিত্যক্ত বা বিতাড়িত না হয়। কারণ, তাদের বাবা-মা আবার যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। যত দিন তাদের সন্তান বড় না হয়, তত দিন পর্যন্ত তারা অধিকারহীন এক নাজুক অবস্থার মধ্যেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই যৌতুকের অর্থ বা সম্পদ পুরোটা একবারে দেওয়া হলেও তা বর বা তার পরিবারের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয় না। ফলে মেয়েদের বাবা বা পরিবারের কাছ থেকে আরও টাকা আদায়ের চেষ্টা হিসেবে মেয়েটির প্রতি শুরু হয় নির্যাতন ও সহিংসতা। এত কিছুর পরও আরও যৌতুক না মিললে মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠানো বা মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েটি তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার এই সময়টিতে হয় ছোট ছোট সন্তানের মা অথবা সন্তানসম্ভবা। সে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয় যৌতুকের সম্পত্তিতে কোনো ধরনের অধিকার ছাড়া, সন্তানের বাবা থেকে তার প্রতিপালনের কোনো বরাদ্দ ছাড়া এবং কোনো ধরনের দক্ষতা ছাড়া। যদি মেয়েটিকে ফিরে যেতে হয় অর্থাৎ মা-বাবা বা ভাইয়ের কাছে, তবে তাঁরা কখনোই মেয়েটিকে হাসিমুখে গ্রহণ করেন না। কারণ, তাঁরা নিজেরাই রয়েছেন চরম অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে। তার সন্তানেরাও অনাহূত অতিথির মতো ব্যবহার পেয়ে থাকে। বোঝা হতে চায় না বলে মেয়েটিও কম খায়। সন্তানসম্ভবা হলেও কম খেয়েই তাকে বাঁচতে হয়।
একপর্যায়ে এই নারীকে কোনো না কোনো উপার্জনের পথ বেছে নিতে হয়। তাকে হয়তো প্রথমে গৃহস্থালি শ্রম, এরপর মাঠের কাজ (যেখানে সে পুরুষের অর্ধেক মজুরি পায়)। প্রায়ই গৃহস্থালি শ্রম পরিশোধিত হয় খাবার বা ভাতে, যা তাকে তার বাসায় নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। এই নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্বল, অপুষ্টির শিকার, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাহীন। ফলে তারা বেশি বেতনে কাজও পায় না। এই নারীদের সামান্য একটি অংশ আবার বিয়ে করতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিয়েগুলো হয় মানসিক বা শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ বা বয়স্ক লোকদের সঙ্গে। সম্ভাব্য ফল: তারা পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী হিসেবেই থাকে অথবা খুব দ্রুতই বিধবা হয়ে যায়। ক্রমবর্ধমান পিতৃতান্ত্রিক ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র সুযোগ, যদি কোনো নারীর একটি ছেলেসন্তান থাকে। যেসব নারীর ছেলেসন্তান আছে, তারা তাদের সবকিছু ব্যয় করে ছেলেটির পেছনে। কিন্তু এর পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা যখন বয়স্ক হয়ে যায়, তখন এই ছেলেরাই তাদের দেখভাল করতে চায় না। যখন এই ছেলেরা বিয়ে করে, তখন তারা তাদের মা ও অল্প বয়স্ক ভাইবোনদের পরিত্যাগ করার জন্য তাদের স্ত্রীদের চাপে থাকে। তারা তাদের মাকে ভালোবাসলেও আর্থিক চাপের কা তা পরাজিত হয়। যেসব বেসরকারি সংস্থা ও দাতাদের অর্থায়িত প্রকল্পগুলো অতিদরিদ্রদের সাহায্য করতে চায়, তাদের সাহায্য ও উদ্যোগগুলো স্বামীর বাড়িতে অবস্থানকারী নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত। এটা কিছু মাত্রায় হলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যখন কার্যক্রমগুলো নারীদের নিজেদের সম্পদ সৃষ্টির পরিস্থিতি বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়, তখন আমরা দেখি যে তাদের স্বামী ও সন্তানেরা সেই সম্পদ বিক্রি করে দেয় এবং তাদের পরিত্যাগ করে। কখনো আমরা নারীদের দেখি এমন অবস্থায়, যেখানে তারা তাদের নিজেদের জমিতে বা ব্যবসা করে কিছু উৎপাদন করলেও তা বিপণন করে স্বামী এবং আয়ের অর্থ নিজের কাছে রেখে দেয়। নারীরা বিনিয়োগ এবং নতুন সম্পদসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং তারা যদি বাড়ি থেকে বিতাড়িত বা বিধবা হয়, তাহলে তাদের ওই সব সম্পদের ওপর কোনো অধিকার থাকে না। কার্যক্রমগুলো বাড়ির পুরুষপ্রধানদের সহায়তা দিলে লিঙ্গবৈষম্য দৃঢ়তর হয় এবং অসমতা ও নারীর নাজুকতা বাড়ে। নারীদের সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করা গেলে সামাজিক পরিবর্তন আনা যায়।
সাজিয়া ওমর: উন্নয়নকর্মী।
একপর্যায়ে এই নারীকে কোনো না কোনো উপার্জনের পথ বেছে নিতে হয়। তাকে হয়তো প্রথমে গৃহস্থালি শ্রম, এরপর মাঠের কাজ (যেখানে সে পুরুষের অর্ধেক মজুরি পায়)। প্রায়ই গৃহস্থালি শ্রম পরিশোধিত হয় খাবার বা ভাতে, যা তাকে তার বাসায় নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। এই নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্বল, অপুষ্টির শিকার, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাহীন। ফলে তারা বেশি বেতনে কাজও পায় না। এই নারীদের সামান্য একটি অংশ আবার বিয়ে করতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিয়েগুলো হয় মানসিক বা শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ বা বয়স্ক লোকদের সঙ্গে। সম্ভাব্য ফল: তারা পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী হিসেবেই থাকে অথবা খুব দ্রুতই বিধবা হয়ে যায়। ক্রমবর্ধমান পিতৃতান্ত্রিক ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র সুযোগ, যদি কোনো নারীর একটি ছেলেসন্তান থাকে। যেসব নারীর ছেলেসন্তান আছে, তারা তাদের সবকিছু ব্যয় করে ছেলেটির পেছনে। কিন্তু এর পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা যখন বয়স্ক হয়ে যায়, তখন এই ছেলেরাই তাদের দেখভাল করতে চায় না। যখন এই ছেলেরা বিয়ে করে, তখন তারা তাদের মা ও অল্প বয়স্ক ভাইবোনদের পরিত্যাগ করার জন্য তাদের স্ত্রীদের চাপে থাকে। তারা তাদের মাকে ভালোবাসলেও আর্থিক চাপের কা তা পরাজিত হয়। যেসব বেসরকারি সংস্থা ও দাতাদের অর্থায়িত প্রকল্পগুলো অতিদরিদ্রদের সাহায্য করতে চায়, তাদের সাহায্য ও উদ্যোগগুলো স্বামীর বাড়িতে অবস্থানকারী নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত। এটা কিছু মাত্রায় হলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যখন কার্যক্রমগুলো নারীদের নিজেদের সম্পদ সৃষ্টির পরিস্থিতি বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়, তখন আমরা দেখি যে তাদের স্বামী ও সন্তানেরা সেই সম্পদ বিক্রি করে দেয় এবং তাদের পরিত্যাগ করে। কখনো আমরা নারীদের দেখি এমন অবস্থায়, যেখানে তারা তাদের নিজেদের জমিতে বা ব্যবসা করে কিছু উৎপাদন করলেও তা বিপণন করে স্বামী এবং আয়ের অর্থ নিজের কাছে রেখে দেয়। নারীরা বিনিয়োগ এবং নতুন সম্পদসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং তারা যদি বাড়ি থেকে বিতাড়িত বা বিধবা হয়, তাহলে তাদের ওই সব সম্পদের ওপর কোনো অধিকার থাকে না। কার্যক্রমগুলো বাড়ির পুরুষপ্রধানদের সহায়তা দিলে লিঙ্গবৈষম্য দৃঢ়তর হয় এবং অসমতা ও নারীর নাজুকতা বাড়ে। নারীদের সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করা গেলে সামাজিক পরিবর্তন আনা যায়।
সাজিয়া ওমর: উন্নয়নকর্মী।
No comments