গম গবেষক ড. নিজামের সাফল্যগাথা by ফজলুল বারী

কজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানির আবিষ্কার অস্ট্রেলিয়ার গম উৎপাদন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি ড নিজাম উদ্দিন আহমদ। ডাবলড হাপলয়েড পদ্ধতিতে (Doubled haploid breeding in wheat) উদ্ভাবিত স্পিটফায়ার প্রজাতির নতুন এক ঘরানার গম বীজের উৎপাদন বদলে দিয়েছে দেশটির গম চাষের পুরনো অনেককিছু। ইংরেজি Spitfire শব্দের অর্থ আগুন বেরোয় এমন কোন জিনিস যেমনঃ কামান, আগ্নেয়গিরি এসব। ড নিজামের আবিষ্কার তেমনই আগুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে অস্ট্রেলিয়ার গম উৎপাদন ক্ষেত্রে।

এই উদ্ভাবন কমিয়ে দিয়েছে নতুন প্রজাতির বীজ উৎপাদনের সময়। নতুন জাতের বীজের ৯৮% থেকে ১০০% ফলন দিচ্ছে। ফলন বেড়েছে ৫৩% থেকে ৭৬%! এ আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এদেশের সেরা জাতের গম ছিল অস্ট্রেলিয়ান প্রাইম হার্ড। কিন্তু নতুন এই জাতটি প্রাইম হার্ডের চেয়ে উন্নত ফলনশীল। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই জেনেটিক সায়েন্টিস্ট’র বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব এগ্রিকালচার, ফুড অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস এর অধীনে রিসার্স ফেলো হিসাবে তিনি কাজ করছেন।

নিজাম উদ্দিন আহমদের জীবনের গল্পটিও যেন অনেকটা ‘গেয়ো যোগী ভিখ পায় না’র মতো। অর্থাৎ দেশে তিনি কিছু করার চেষ্টা করেও পারেননি। মনের দূঃখে চলে এসেছিলেন  অস্ট্রেলিয়ার স্বেচ্ছা নির্বাসনে!

গম আর ভূট্টার জিনকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সন্নিবেশিত করে তুলনামূলক অধিক প্রোটিন আর ফলনের গমের নতুন জাত আবিষ্কারে ড নিজাম যে সাফল্য পেয়েছেন, তার আগে আরও অনেকে সে চেষ্টাটি করে সফল হতে পারেননি। জেনেটিক সায়েন্সে যে কোন নতুন বীজ উৎপাদনে ১০ বছর বা এরও বেশি সময় লাগে। এই গবেষনার পিছনে বিপুল অর্থনৈতিক আর অবকাঠামোগত বিষয়াদিও জড়িত। কিন্তু ড নিজামের উদ্ভাবন অস্ট্রেলিয়া বা উন্নত যেকোন দেশের যে কোন জেনেটিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে নতুন একটি রেকর্ড! এমন আবিষ্কারের গড়পড়তা ১০ বছরের সময়সীমাকে তিনি নামিয়ে এনেছেন ৭ বছরে। অস্ট্রেলিয়ার সায়েন্টেফিক রিচার্স কর্তৃপক্ষ নতুন এই আবিষ্কারটি ঘোষণার পর সারা দুনিয়া থেকে জেনেটিক বিজ্ঞানিরা তাকে অভিনন্দন পাঠাচ্ছেন। অনেক দেশ থেকে তার দাওয়াত আসছে। অনেকে দেখতে আসছেন তার ল্যাবরেটরি।

উল্লেখ্য বিভিন্ন স্পন্সর কোম্পানির অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়ার নানা গবেষণার কাজ চলে। ড নিজামের আবিষ্কার নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্পন্সর প্রতিষ্ঠান এরমাঝে তার উদ্ভাবিত গমবীজের জাত নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গমচাষীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বিশেষ সাফল্য পাওয়াতে গোটা গমচাষ সেক্টরে তা খুলে দিয়েছে নতুন এক দিগনত! নতুন এই গমবীজের ফলন ও এর ফসলের প্রোটিনগত সমৃদ্ধি অনেক বেশি হওয়াতে সারা অস্ট্রলিয়ার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ড নিজামের আবিষ্কার। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে ড. নিজাম যেন হয়ে উঠেছেন সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস! তার পক্ষে নতুন নতুন স্পন্সরের প্রস্তাব আসছে।

ছোটখাটো গড়নের লাজুক স্বভাবের ড নিজামের অবশ্য এসব নিয়ে আলাদা উচ্ছ্বাস নেই। একটি আক্ষেপ আছে। তার আক্ষেপের উক্তি আমিতো কিছু করতে চেয়েছি বাংলাদেশে। মানুষের জীবনের অনেক আশা পূর্ণ হয়না। এ আমার সে রকম একটি অপূর্ণ। ড নিজাম মনে করেন বাংলাদেশে বিশ্বমানের অনেক গবেষক-বিজ্ঞানি আছেন। অভাব পৃষ্ঠপোষকতার। স্পন্সরের। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানির আক্ষেপ, তার আবিষ্কার নিয়ে এখন পর্যন্ত জন্মভূমি থেকেই শুধু কারও কোন আগ্রহ দেখা গেল না! বাংলাদেশ কী জানল না তার এক সন্তানের বিরল বিশেষ এক উদ্ভাবন বৃত্তান্ত?

প্রধানমনত্রীর একজন উপদেষ্টা প্রফেসর ডা মোদাচ্ছের আলী কিছুদিন আগে সিডনি ঘুরে গেছেন। এক দাওয়াতে তার সঙ্গে দেখা হলে প্রধানমনত্রী তথা বাংলাদেশ সরকারকে আবিষ্কারটি সম্পর্কে সবিস্তার জানাতে সমুদয় কাগজপত্র তাকে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা কৃষিবিদ বাহাউদ্দিন নাছিম সিডনি এসে তার ল্যাবরেটরি দেখতে গিয়েছিলেন। ডা মোদাচ্ছের বা নাছিম কী তা প্রধানমন্ত্রী বা কৃষি মনত্রীকে জানানোর চেষ্টা করেছেন? কেউ জানে না। বাংলাদেশ সরকার বা দেশের কাছেতো কিছু চাইছেন না ড নিজাম। বাংলাদেশি বিদেশে যে যাই করুক তারতো নাড়ি বাংলাদেশে। সবাই যার যার সাফল্য সবার আগে নিজের জন্মভূমির মানুষকে জানাতে চায় আগে।
  
জন্মভূমি বাংলাদেশ নিয়ে নিজাম উদ্দিন আহমদের একান্ত কিছু ব্যক্তিগত কষ্টও আছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটে পেশা জীবন শুরু করা ড নিজাম অস্ট্রেলিয়া সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা-গবেষনার জন্য এদেশে আসেন। এখানে পড়াশুনা শেষে দেশে ফেরতও গিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল যা কিছু করার নিজের দেশেই করবেন। কিন্তু অপরাজনীতির কারনেই বুঝি তিনি টিকতে পারেননি দেশে। বিএনপির সরকার তখন দেশের ক্ষমতায়। ড নিজাম দেশে ফেরত গেলেও সরকার তার কৃষি গবেষণা  ইনষ্টিটিউটের চাকরি ফেরত দিতে গড়িমসি করে। ফাইল যায় মনত্রণালয়ে। আবার ফিরে আসে নিস্ফলা ফাইল! আশৈশব বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী ড নিজাম। এর কারণেই কী বিএনপি সরকার চায়নি তিনি দেশে ফেরত যান, অথবা দেশে থাকুন? আজও এর উত্তর জানা নেই তার।

অতএব আবার অস্ট্রেলিয়া ফিরলে তাকে লুফে নেয় সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়। এখন তিনি যে গবেষনায় সাফল্য পেয়েছেন, একই প্রজেক্টে গবেষণায় তার আগে বিভিন্ন দেশের গবেষক-বিজ্ঞানিরা কাজ করে সাফল্য পাননি। সেখানে টার্গেটকৃত সময়েরও আগে তিন বছর বাঁচিয়ে তার বিরল আবিষ্কারে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ খুশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বাংলানিউজকে বলেছেন, ড নিজামকে নিয়ে আমরা গর্বিত। বাংলাদেশি হিসাবে তোমরাও তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারো।
বাংলাদেশি ড নিজামকে শুভেচ্ছা জানাতে চান? অথবা তার আবিষ্কার নিয়ে জানতে চান আরও? মেইল করুন nizam.ahmed@sydney.edu.au ঠিকানায়।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.