স্বৈরতন্ত্রের শেকড় উপড়ানো সহজ নয় by মানিক আনিসুজ্জামান

নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু মাগুরা উপনির্বাচন জানান দিয়ে যায় স্বৈরতন্ত্রের শেকড় উপড়ানো এত সহজ নয়। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, মননে-মগজে সময়-সুযোগ পেলে স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে-পরে সহিংসতা বিবেকবান মানুষকে আহত করে। জাতীয় নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নব-উদ্ভাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হয় প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঁধে চেপে থাকে সামরিক সরকার দুই বছর। এই দুই বছর দেশের মানুষ সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকলেও নির্বাচনব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য অর্জন কম হয়নি। ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে। অল্প সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বেড়েছে। শাসনতন্ত্রে গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য এগুলো আমাদের অর্জন। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হলেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থায়ী রূপ নেবে এমন কথা বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বাস করানো কঠিন। রাজনৈতিক দল ছাড়া সামাজিক-সাংস্কৃতিক অ্যামেচারিস্ট কল্পনাবিলাসী কিছু মানুষ দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলই শাসনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। আমাদের সেই জবাবদিহিমূলক দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল কোথায়? প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা প্রায় শূন্যের ঘরে। অবশ্য রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা এবং বিকশিত হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ এ দেশে কখনো ছিল না। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকেই সামরিক শাসন এবং ছদ্ম সামরিক শাসন চলছে। একাত্তর থেকে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত বাদ দিলে বাকি সময় এ দেশে সামরিক শাসনমুক্ত পরিবেশ ছিল না। সেনাছাউনি থেকে জন্ম নিয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দল। এসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিকাল্ট করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে থেকে যেসব রাজনৈতিক দলের জন্ম এবং যারা জনশক্তির ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করে, তারাও বিভ্রান্ত হয়েছে। এসব দলও জনশক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার কঠিন পথ পরিত্যাগ করে অন্ধকারের কানা গলিতে সহজ পথে পা বাড়ায়। এ পথে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গণতন্ত্র একটি আদর্শিক মতবাদ। প্রতিনিয়ত চর্চার মধ্য দিয়ে এটি বিকশিত হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়ে কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্ম নিয়েছে। আমরা এখনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারিনি। রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ শাসন করে। স্বাভাবিকভাবেই দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা না হলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা একেবারেই নেই। দলপ্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব। দলপ্রধানের কর্মসূচির সমালোচনা করলে দলের সদস্যপদ রাখাই কঠিন। শুধু রাজনৈতিক দলে নয়, আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, সরকারি-বেসরকারি অফিসে এমনকি এনজিওগুলোতে সবাই যেন ডিকটেটর। তোষামোদকারীদের ভাগে মুলাটা-কলাটা জোটে। কিছু এনজিও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেও নিজেদের ডিকটেটরশিপ অক্ষুণ্ন রাখে। এনজিও-প্রধানের কাজকর্ম সম্পর্কে কর্মকর্তাদের মতামত ব্যক্ত করাও অনেক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নির্বাচন কমিশন খবরদারি করেও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্ধারিত সময়ে নামমাত্র কাউন্সিল পর্যন্ত করতে পারেনি। কাউন্সিলের কথা এ কারণেই বলছি যে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্মেলন-কাউন্সিল জড়িত। দলের কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে কখনো কখনো দিকনির্দেশনা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বেরিয়ে আসে। ভারতবর্ষে চরম সংকট মূহূর্তে সম্মেলনের মধ্য দিয়েই নতুন দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। সম্মেলন করার ইতিহাসও ভারতবর্ষে প্রাচীন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের আচার-আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে কয়েকটি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তার সমাধান ঘটে। সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটেছিল সম্রাট অশোকের সময়। আকবরের দরবারে বিরুদ্ধ মতের গুরুত্ব ছিল। ভারতবর্ষের এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী কিছুটা আমরাও। মওলানা ভাসানী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সম্মেলন করেছেন। দেশ-বিদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা-কমী, সংবাদকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী ভাসানীর সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। সম্মেলন ছিল উৎসব। কাগমারী সম্মেলনের পর এ দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে রাজনৈতিক দলের আর সম্মেলন হয়নি।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনের পর গণতন্ত্রের চর্চার জায়গাগুলো জাতীয় পার্টির শাসনামলের শেষ দিকের চেয়ে সংকুচিত হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। ডাকসু, রাকসু, চাকসু, বাকসু নামে এখন শুধু ভবন রয়েছে, ছাত্র সংসদ নেই। সবশেষ রাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে, আজ থেকে ২০ বছর আগে। সে সময় যাঁরা রাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের সন্তানেরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সরকারি-বেসরকারি কোনো কলেজেই নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। আমরা আশা করেছিলাম, স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচিত সরকারের সময় প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হবে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্র সংসদ হল পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাধ্যক্ষ এবং আবাসিক শিক্ষকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এসবের আয়োজন কোথায়? শুধু উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন, স্কুল-কলেজের পরিচালনা পরিষদে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবছর নির্বাচন করা হলে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বাড়বে। কলকারখানার শ্রমিক সংগঠনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলে পোশাকশিল্পে শ্রমিক সহিংসতা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকত। সংবাদপত্র হাউসে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকা কি উচিত নয়?
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অঙ্গীকার করে। কিন্তু নির্বাচনের পর বিরোধী দলের অবিরাম সংসদ বর্জন সংসদীয় সংস্কৃতির অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকে সুযোগ-সুবিধা নিতে কারও কোনো অসুবিধা হয় না। সংসদ বর্জনকারী দলগুলো যদি নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিত যে আমরা বিরোধী দলে গেলে যত দিন সংসদে গেলে সদস্যপদ থাকবে, কেবল তত দিনই সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকব। তাহলে ভোটারদের সঙ্গে প্রার্থীদের অঙ্গীকার ভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন করার সুযোগ ছিল না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে সরকার যেমন অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তেমনই সংসদ অধিবেশনে যোগ না দেওয়াও ওয়াদার বরখেলাপ।
সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রবাসীরা বিশ্বে অবদান রাখছে। আমাদের পোশাকশিল্প বিশ্বে সমাদৃত। শ্রমঘন শিল্প বিকাশের এ দেশে সুযোগ রয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা দাবি করছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবেশী ভারত বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমপর্যায়ে যেতে না পারলেও আমাদের উন্নয়নের একটি ওয়াগনে উঠতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। বিশ্ব-পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো তাল মেলাতে না পারলে নিজেরা মুসলিম লীগের মতো সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দলে পরিণত হবে এবং জনগণের ক্ষতির কারণ হয়েই দাঁড়াবে। সমাজের সর্বস্তরে যে স্বৈরাচারী অসহিষ্ণু মনোভাব প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা থিতিয়ে আনতে হলে প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও ন্যূনতম সহযোগিতা জরুরি। এ ছাড়া দিন বদলালেও স্বৈরতন্ত্রের মূলোৎপাটন সম্ভব নয়।
মানিক আনিসুজ্জামান: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
manik780@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.