আমার পিতা হারানোর তিথি by শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাঁড়ে
দেখতে দেখতে পাঁচ-পাঁচটা বছর চলে গেল। ঘাতকের নৃশংস বোমায় মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে গিয়েছিল আমাদের ছোট্ট সোনার সংসার। আমার বাবা ঝালকাঠির সিনিয়র সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে তাঁর সহকর্মী আরেক সহকারী জজ সোহেল আহমেদের সঙ্গে নিহত হন জেএমবি নামের জঙ্গিদের হামলায়।
আমার বাবা, সোহেল চাচ্চুকে মেরে ওদের কী লাভ হয়েছে জানি না, আমার জীবনটা একেবারে পাল্টে গেছে। চিরদিনের জন্য ওরা আমাকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করেছে। নিজের বাড়ির বদলে আমার ঠাঁই হয়েছে মামার বাড়িতে। আমার জীবনের ঠিকানাই ওরা বদলে দিয়েছে।
আমি যে খুব খারাপ আছি, তা নয়। আমার দাদু, দিদা তাঁদের সমস্ত আদর ঢেলে আমাকে মানুষ করছেন। আমার মা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করছেন আমার ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। তিনি নিজের সব সুখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন আমার মুখের পানে চেয়ে। দিব্যি রোজ খাই-দাই, স্কুলে যাই, খেলাধুলা করি। যা দরকার, চাওয়ার আগে পাই। আমার কোনো কিছুর অভাব নেই।
কিন্তু এত সব পেয়েও সারাক্ষণ আমার মন কী এক না-পাওয়ায় ভরে থাকে। যখন কেউ বাবার কথা বলে তখন আমার বুকটা হু-হু করে ওঠে। বাবাকে খুব মনে পড়ে। সবার বাবা আছে, সবার বাবা তাদের ছেলেকে খুব আদর করে, আর আমার বাবা আসে না। ঘাতকদের ফাঁসি হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার কথা মনে হলেই ওদের প্রতি আমার ঘৃণা তীব্র হয়ে ওঠে। আমি কী দোষ করেছিলাম যে ওরা আমার নির্দোষ বাবাকে মেরে ফেলল!
বাবার মৃত্যুর পর প্রথম দুই বছর বহু মানুষ আমাদের খবর নিত। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে কত মানুষ সমবেদনা জানাত। সাংবাদিকদের কত না ছোটাছুটি ছিল আমাদের বাড়িতে। কিন্তু ক্রমশ সবাই বাবাকে ভুলতে বসেছে। সোহেল চাচ্চুকে ভুলতে বসেছে। ওদের ফাঁসির পর আর কিছু শয়তান-বদমাশকে ধরার পর সবাই কি ভেবেছে, সব চুকেবুকে গেছে? আমার বাবার হত্যাকাণ্ড কি এত সামান্য ঘটনা? আমার দাদু বলেন, যারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তাদের উচিত এই দিনটাকে জঙ্গিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা। এতে অন্তত আমার বাবার স্মৃতিটা বেঁচে থাকবে। এই দিন প্রতিবছর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানুষ শপথ নিতে পারবে। স্কুলে আমাকে বাবা সম্পর্কে রচনা লিখতে দিলে আমি কিছু লিখতে পারি না। বাবার আদরের স্মৃতি প্রতিদিনই ফিকে হয়ে আসছে। তবু মনে পড়ে বাবার হাসিমুখ, আমাকে পাপ্পি খাওয়ার স্মৃতি। কালো কোট পরে কোর্টে যাওয়ার আগে আমাকে আর মাকে আদর করার দৃশ্য এখনো মনে পড়ে। কিন্তু বাবা কি শুধু এতটুকু স্মৃতি, নাকি আরও বেশি কিছু অনুভূতি, ঠিক বুঝতে পারি না। তবে এ মুহূর্তে আমার মা-ই আমার মা, বাবা—সব। মা রচনা লিখতে গেলে কষ্টে আমার চোখে জল এসে যায়। এই জল কেন ওরা আমার মায়ের চোখে চিরদিনের জন্য দিয়ে গেল? কেন চিরদিনের জন্য আমার মায়ের সিঁদুর ওরা মুছে দিল—এ প্রশ্নের মীমাংসা আমি কিছুতেই করতে পারি না। আমি কাঁদতেও পারি না। তাই চুপ করে বসে থাকি আর ভাবি। হঠাৎ দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি চলে গেলে কিংবা কোনো হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে গেলে আমার মনে হয় বাবা আমার চারপাশে আছে। তার সেই অস্তিত্ব নিয়েই আমি বড় হচ্ছি। আপনারা সবাই আমাকে আশীর্বাদ করবেন যেন বাবার মতো কিংবা আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্নের মতো আমি হতে পারি।
শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাঁড়ে: জঙ্গি হামলায় নিহত বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ের কন্যা।
আমার বাবা, সোহেল চাচ্চুকে মেরে ওদের কী লাভ হয়েছে জানি না, আমার জীবনটা একেবারে পাল্টে গেছে। চিরদিনের জন্য ওরা আমাকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করেছে। নিজের বাড়ির বদলে আমার ঠাঁই হয়েছে মামার বাড়িতে। আমার জীবনের ঠিকানাই ওরা বদলে দিয়েছে।
আমি যে খুব খারাপ আছি, তা নয়। আমার দাদু, দিদা তাঁদের সমস্ত আদর ঢেলে আমাকে মানুষ করছেন। আমার মা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করছেন আমার ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। তিনি নিজের সব সুখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন আমার মুখের পানে চেয়ে। দিব্যি রোজ খাই-দাই, স্কুলে যাই, খেলাধুলা করি। যা দরকার, চাওয়ার আগে পাই। আমার কোনো কিছুর অভাব নেই।
কিন্তু এত সব পেয়েও সারাক্ষণ আমার মন কী এক না-পাওয়ায় ভরে থাকে। যখন কেউ বাবার কথা বলে তখন আমার বুকটা হু-হু করে ওঠে। বাবাকে খুব মনে পড়ে। সবার বাবা আছে, সবার বাবা তাদের ছেলেকে খুব আদর করে, আর আমার বাবা আসে না। ঘাতকদের ফাঁসি হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার কথা মনে হলেই ওদের প্রতি আমার ঘৃণা তীব্র হয়ে ওঠে। আমি কী দোষ করেছিলাম যে ওরা আমার নির্দোষ বাবাকে মেরে ফেলল!
বাবার মৃত্যুর পর প্রথম দুই বছর বহু মানুষ আমাদের খবর নিত। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে কত মানুষ সমবেদনা জানাত। সাংবাদিকদের কত না ছোটাছুটি ছিল আমাদের বাড়িতে। কিন্তু ক্রমশ সবাই বাবাকে ভুলতে বসেছে। সোহেল চাচ্চুকে ভুলতে বসেছে। ওদের ফাঁসির পর আর কিছু শয়তান-বদমাশকে ধরার পর সবাই কি ভেবেছে, সব চুকেবুকে গেছে? আমার বাবার হত্যাকাণ্ড কি এত সামান্য ঘটনা? আমার দাদু বলেন, যারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তাদের উচিত এই দিনটাকে জঙ্গিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা। এতে অন্তত আমার বাবার স্মৃতিটা বেঁচে থাকবে। এই দিন প্রতিবছর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানুষ শপথ নিতে পারবে। স্কুলে আমাকে বাবা সম্পর্কে রচনা লিখতে দিলে আমি কিছু লিখতে পারি না। বাবার আদরের স্মৃতি প্রতিদিনই ফিকে হয়ে আসছে। তবু মনে পড়ে বাবার হাসিমুখ, আমাকে পাপ্পি খাওয়ার স্মৃতি। কালো কোট পরে কোর্টে যাওয়ার আগে আমাকে আর মাকে আদর করার দৃশ্য এখনো মনে পড়ে। কিন্তু বাবা কি শুধু এতটুকু স্মৃতি, নাকি আরও বেশি কিছু অনুভূতি, ঠিক বুঝতে পারি না। তবে এ মুহূর্তে আমার মা-ই আমার মা, বাবা—সব। মা রচনা লিখতে গেলে কষ্টে আমার চোখে জল এসে যায়। এই জল কেন ওরা আমার মায়ের চোখে চিরদিনের জন্য দিয়ে গেল? কেন চিরদিনের জন্য আমার মায়ের সিঁদুর ওরা মুছে দিল—এ প্রশ্নের মীমাংসা আমি কিছুতেই করতে পারি না। আমি কাঁদতেও পারি না। তাই চুপ করে বসে থাকি আর ভাবি। হঠাৎ দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি চলে গেলে কিংবা কোনো হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে গেলে আমার মনে হয় বাবা আমার চারপাশে আছে। তার সেই অস্তিত্ব নিয়েই আমি বড় হচ্ছি। আপনারা সবাই আমাকে আশীর্বাদ করবেন যেন বাবার মতো কিংবা আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্নের মতো আমি হতে পারি।
শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাঁড়ে: জঙ্গি হামলায় নিহত বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ের কন্যা।
No comments