গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়
স্বপ্নের ভেতর পাওয়া গেল এক অদ্ভুত ইশারা। বোবা ইশারা, সালমা সকালে উঠে বিছানায় শুয়ে সেই ইশারার ব্যাখা করতে লাগল মনে মনে।
কালো একটা মুখ, ভেংচি কেটে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল। কখনো মনে হচ্ছিল জহিরের চাপা অসুখটার কথা বলছে। কখনো মনে হচ্ছে- তা নয়, সালমার নতুন বসের স্বভাব নিয়ে আগাম সতর্ক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সালমা অভিনেত্রী নয়। হলে হয়তো ইশারা-ইঙ্গিতের একটা অর্থ বের করে ফেলত। সে ছাপোষা এক নারী, মতিঝিলের একটি বীমা কোম্পানীতে নটা-পাঁচট অফিস করে ক্লান্ত, প্রতিটি সপ্তাহ শুরু হয় শুককুরবারের আশায়।
ভাবে সারাদিন কেবল ঘুমাবে, অধরা স্বপ্নের মতো দিনটির হাতছানি ওকে মাতিয়ে রাখে সপ্তাহভর। আবার শুককুরবার এলে ঘুম ভাঙে সকাল সকাল। তখন সবকিছু অর্থহীন লাগে। নানা রকমের প্রাত্যহিক হুজ্জুতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একসময় নিজের মন থেকে ছুটির দিনের আবেশ ঝরে পড়ে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে ওঠে, ধ্যাৎ।
ভাবে সারাদিন কেবল ঘুমাবে, অধরা স্বপ্নের মতো দিনটির হাতছানি ওকে মাতিয়ে রাখে সপ্তাহভর। আবার শুককুরবার এলে ঘুম ভাঙে সকাল সকাল। তখন সবকিছু অর্থহীন লাগে। নানা রকমের প্রাত্যহিক হুজ্জুতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একসময় নিজের মন থেকে ছুটির দিনের আবেশ ঝরে পড়ে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে ওঠে, ধ্যাৎ।
স্বামী জহির ওকে বুঝতে চায় না। ব্যবসায়ী মানুষ, সুপার মার্কেটে কসমেটিকসের দোকান তার, দুবার আগুনে পুড়ে ব্যবসা এখন লসের খাতায়, দিন দিন লোকটি অপরিচিত মানুষ হয়ে উঠছে সালমার কাছে। কাজ-কর্ম ফেলে যখন তখন ওর অফিসে গিয়ে বসে থাকে, ঘন্টার পর ঘন্টা ওর কলিগদের সাথে আড্ডা দেয়। স্ত্রীর পয়সায় দুপুরে লাঞ্চ খায়। নিজের সম্পর্কে লম্বা চওড়া কথা বলে, সে যে বড় মাপের কেউ সুযোগ পেলেই সে তা প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত থাকে। স্ত্রীর চাকুরিটিও যে স্রেফ বিলাসিতা তা-ও সে সুযোগ পেলে বলে আলগা সুখ কেনে।
সালমার এসব ভাল লাগে না। সে নিজের জগৎটিকে সযতনে লুকিয়ে রাখতে চায় জহিরের কাছ থেকে। যখন তখন মিথ্যা বলতে পারে না সে। সীমিত পরিসরে সুখ কেনে সালমা। ঈদের বন্ধে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে মন চায়। গ্রামের বাড়ির অকিঞ্চিৎকর হাঁদাপচা ডোবাটার দিকে একদল হাঁস ছুটে গেলেও সে আনন্দ পায়। গভীর রাতে চালের উপর কোন রাত জাগা বেড়ালের মিঁউ মিঁউ শুনলেও ওর ঘুম ভেঙে যায়। উদ্বাস্তু নাগরিক জীবনের কষ্টের কথা ভেবে নিজের উপর অকারণ রাগ হয়। এসব নানারকমের ছোট ছোট ভাল লাগা মন্দ লাগা নিয়ে সালমার মনোজগৎ। অন্যদিকে , জহির পছন্দ করে সারাদিন হৈ চৈ করে সময় বরবাদ করতে, থাইল্যান্ড ব্যাংকক গিয়ে মউজ-মাস্তির ভেতর সারাক্ষণ নাক ডুবিয়ে রাখতে। রাস্তায় কোন সুন্দরী নারী দেখেলে আগ্রাসী চোখে তাকাতে ভালবাসে। ভাল খাবার, দামি পারফিউম, বিশাল লনওলা বাড়ি, ঈর্ষা জাগানো পোশাক আশাক- সব ওর পছন্দ।
সালমা আর জহিরের বিয়ের বয়স চার বছর। প্রথম প্রথম সন্তান নেবার আকাঙ্ক্ষা দু'জনার কেউ বোধ করে নি। এখন প্রচন্ড ইচ্ছে থাকলেও ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে ঘন ঘন। নিবিড় চিকিৎসা প্রয়োজন, কিন্তু জহির এ ব্যাপারেও যথেষ্ট উদাসীন। ভারতে যাওয়ার কথা বেশ কজন স্বজন পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু জহির শুধুমাত্র চিকিৎসার কারণে বিদেশ যেতে রাজী হচ্ছে না। সে আকারে-ইঙ্গিতে যা বলতে চেয়েছে তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- কেবলমাত্র যমুনার পাড়ে মর্মর পাথরে গড়া তাজমহল আর দুধের সরের মতো পূর্ণিমা দেখার আমন্ত্রণ পেলে তার পক্ষে ভারতে যাওয়া সম্ভব। তাতেও রাজী ছিল সালমা। তারপরও ওদের কেন যাওয়া হল না তা এদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদেরও কেউ ঠিক ধরতে পারেননি।
সালমা এখন নিজেকে সবকিছু থেকে বিযুক্ত মনে করে। স্বামীকে দেখে পাশের বাড়ির পড়শীর মতো, কোন আক্ষেপ নেই, আবার কোন আনন্দ বোধও হঠাৎ করে বুকের তলায় জেগে উঠে সবকিছু ভাসিয়ে নিতে চায় না। জহির এসে মাঝে মাঝে নানারকমের কথা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চায় ওকে। কোন ফলাফল নেই তাতে, সে ওর সামনে থেকে অন্য কোথাও চলে যায় অথবা এমন কর্কশ কথা জবাব হয়ে মুখ থেকে বেরোয় যে, জহির হতচকিত বোধ করে। আবার সে-ও এই হঠাৎ গজানো ঝগড়ায় যোগ দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু যেই মাত্র স্বামীর গলার শব্দ চড়তে শুরু করে তখনি সালমা কোন অজ্ঞাত কারণে একেবারে মিইয়ে যায়। তখন জহিরের মনে হয় সালমা আসলে ওর কোন কথাই শুনতে চাইছে না বা ওর কোন শব্দ ওর আবেগে সুড়সুড়ি দিতে পারছে না। অগত্যা, সে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে, যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে খামোকা উদাসীন দেখলে কার আর ভাল লাগে দড়ি প্যাঁচাতে। সে ঘুরতে থাকে, পুরোন বন্ধুদের সংগ্রহ করে আড্ডা পেটায়। হঠাৎ কোন বড়লোক বন্ধুর দেখা পেলে তাকে নিয়ে কদিন মেতে থাকে। রাতের বেলায় বাসায় ফেরার পথে কোন মেয়েকে একলা বাসে বসে থাকতে দেখলে সে নিজের রিক্সা ছেড়ে সেই বাসে উঠে পড়ে। মেয়েটি যদি মিরপুর গোল চক্করে নামে তো সে-ও সেখানে চলে যায়। সারাদিনের কাজের শেষে মেয়েটি ঘরে ফিরছে আর দূর থেকে জহির সেই মেয়েটির অন্য রকম রূপ কল্পনা করে অদ্ভুত সুখ নেয় অন্তরে। কোন কথা নয়, কোন বিরক্ত করা নয়, শুধু দূর থেকে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে পথচলা। মেয়েটির অঙ্গভঙ্গি, পৃষ্ঠদেশ, মুখাবয়ব সব সে কল্পনার রঙে এঁকে নেয়। নেশার মতো সে তা উপভোগ করে। এরকম করতে গিয়ে দুবার বিপদে পড়তে হয় তাকে। একবার মেয়েটি বেশ্যা হওয়ায় পুলিশের হাতে পড়ে সে প্রায় জেলে যেতে বসেছিল আর অন্যবার ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাত থেকে কোন রকমে জান ফিরে পেয়েছিল ছোটবেলায় ভাল দৌড়বিদ হিসাবে বেশ কটি মেডেল পাওয়ার কারণে।
সে আসলে রাজার মতো থাকতে চায়। রাজার মতো বাঁচতে চায়। খাওয়া দাওয়া পোশাক আশাক সবকিছু সে রাজার মতো করে পেতে চায়। একটা ধারণা ছোটবেলা থেকে কেমন করে যেন গেঁথে রয়েছে ওর বুকের ভেতর। সে সাধারণ কেউ নয়, যেন ছদ্মবেশে সে ঘুঁটে কুঁড়েনির ঘরে আশ্রিত হয়ে সময় অতিক্রম করছে। কেউ তাকে চিনতে পারছে না। তার সাথে যে সম্মান আর সহবতের কথা বলার কথা অন্যের, তা কেউ করছে না। নিরিবিলি জায়গায় গেলে সে বুঝতে পারে নিজের ভেতর থেকে কেউ একজন কথা বলার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইছে। সে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করে, যাকে সবাই কুর্নিশ করে পথ ছেড়ে দেয়ার কথা। সে তখন নিজেকে বড় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসাবে হিসাবে ভাবতে শুরু করে। এই দ্বৈত সত্তার উপস্থিতি সে বড় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে নিজের ভেতর। একদিন গুলিস্তানের মোড়ে এক উদ্ভ্রান্ত ভিক্ষুক এসে ওকে কায়দা করে কুর্নিশ করে। সে নিমিষে থমকে দাঁড়ায়। পকেট থেকে দশটি টাকা পাগলটিকে দিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে ওঠে, 'আমারে চিনলি ক্যামতে?'
পাগলটি ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে। সে জহীরের কাছ থেকে টাকার নোটটি নিয়ে কানের খাঁজে গুঁজে রাখে।
একই ভাবে, সালমার কাছে সে সুযোগ পেলেও নিজেকে এক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসাবে তুলে ধরতে চায়। মুচকী হাসে আর বলে, 'চিনলা না। সময় থাকতে চিনলা না।'
সালমা তেরছা করে তাকায় ওর দিকে। চোখে-মুখে শেস্নষ, জহির বেশীক্ষণ তাকাতে পারে না সেদিকে। অপরাধবোধ চেপে বসে মনে। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তবু মুখে একই কথা, যেদিন চিনবা সেদিন আরঃ'
সালমা বিরক্ত হয়। সে ওর এসব টালবাহানা দীর্ঘ সময় থেকে দেখে আসছে, একসময় এসব কথা হলে চেপে ধরত মুখ, যেন এসব বাজে কথা তাকে ফের শুনতে না হয়। আর এখন জীবন সম্পর্কে অনেক বেশী অভিজ্ঞতা বেড়েছে। এখন ওর কাছে এগুলো স্রেফ নাটুকেপনা ছাড়া অন্য কোন মূল্য বহন করে না। চাকুরি করতে গিয়ে প্রথম কোন পুরুষ ওর দিকে তাকালে সে শিউরে উঠত। কিছু না হলেও অস্বস্তিবোধ চেপে বসত। পুরুষ মানুষের ন্যাংটো দৃষ্টির ভাষা সে বুঝতে পেরে কত যে ইতস্তবোধ করত, কখনো রাগ হত, কখনো শিহরণ, কখনো বিরক্তির চূড়ায় পৌঁছে যেত অকারণ। আর এখন একজন পুরুষকে কেবল পুরষ বলেই মনে হয়। প্রথমে দেখে বয়স, তারপর শিক্ষা ও রুচি । বয়স্ক পুরুষদের এমন লেলিহান দৃষ্টির সামনে সে এখন কেবলি কাতুকুতু বোধ করে। শুধুমাত্র কোন ছোকরা বা যুবকের চোখে আগুন দেখলে সে বড় অস্থির হয়ে ওঠে। মনে হয় সালমা এখনো ফুরিয়ে যায় নি। সে জহিরের মতো ভান করে না, নাটুকেপনা দিয়ে করুণা কিনতে চায় না। সালমা জহিরের চেয়ে অনেক বেশী বোল্ড, সে নিজের চাওয়া পাওয়ার সীমা পরিসীমা বোঝে । জহির তা বুঝতে পারে না। সে কেবল নিজেকে ধুলোর মতো উড়াতে পারে, ফের নিজের ঠিকানায় ফিরতে জানে না।
ওদের বিয়েটা ভালবাসার নয়, জহির বিদেশ-টিদেশ ঘুরে টুরে এসে সিদ্ধান্ত নিল- সে এবার বিয়ে করবে। হাতে কাঁচা টাকা বিদেশের, কিছু ডলার, কিছু টাকা, কোনটা রেখে কোনগুলো খরচ করবে তা-ই নিয়ে সে রাত কাটায় দুশ্চিন্তায়। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনের ভেতর এক সংক্রামক কাতুকুতু-ছেলে বিদেশ থেকে ফিরেছে, ব্যাগ ভরা ডলার, তাকে যত ম্যানেজ করা যায় তত লাভ, তত সুখ। বাবা-মা গায়ে পড়ে এসে ছেলেকে বিয়ে করাতে চাইল। বারবার করে অনুরোধ, একসময় বিরক্ত হয়ে সালাম বলে উঠল, আমি রাজি। বিয়ের পর বেশ কটা দিন রেন্ডি কড়-ইর ফাঁকে কোন অদৃশ্য কোকিলের কুহু ডাকের মতো, রাস্তা চলতে হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসা কোন গানের কলির মতো, সারাদিনের কড়া রোদে পোড়ার পর ঘুমানোর আগে তুমুল বৃষ্টির মতো কিংবা সারাদিনের বৃষ্টির পর বিকেলের ভেজা নরোম রোদের মতো ওকে মাতিয়ে রাখল। বন্ধুদের আড্ডায় প্রকাশ্যে স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করতে শুরু করল। কেউ কিছু বলতে চাইলেই ওর বাধা উত্তর, 'ও অন্যরকম।' বলে সে গভীর দিবানিদ্রার মতো এক আবেশের ভেতর সেঁধিয়ে থাকতে চাইত। সালমাকে নিয়ে বড় বোনের সাথে সে ঝগড়া বাধাল। মাকে ভুল বুঝল এবং একসময় পরিবারের সবার সাথে মন কষাকষি করে স্ত্রীকে একান্তে পাওয়ার বাসনায় ফ্ল্যাট নিল অন্যখানে। মাত্র ছয় মাস, এরই মাঝে সে ত্যাগ করল আত্মীয় পরিজন। সবাইকে স্বার্থপর মনে হতে লাগল। সবাই কেবল ওর কাছে পেতে চায়, ওর নিজের সুখ সুবিধা আহ্লাদ ভাল ভালবাসা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। যে ওকে একটুখানি বোঝার চেষ্টা করছে নীরবে, তাকেও কাছে রাখতে দেয় না। কেড়ে নিতে চায় এই বনলতা সেনকে। সে ক্ষিপ্ত হল এবং একশ' আটটা অভিযোগ অনুযোগের পুঁটলি তৈরি করে সরাসরি বলে দিল, আমি নাই তোমাদের সাথে। এদ্দিন চোখ খোলে নি। এবার বুঝতে পেরেছি।
মা-বাবা দুজন ওকে বোঝাতে চাইল। সে কান পর্যন্ত দিল না ওদের কথায়। বরং হম্বি-তম্বি করে সে এমন ভাব দেখাতে লাগল যে তার কিনার ঘেঁষে কারো দাঁড়ানোই কঠিন হয়ে পড়ল।
আলাদা বাসায় আলাদা থাকার বৈচিত্রময়তা ওরা উপভোগ করতে লাগল। সারাদিন ধরে কথা, ঘোরাঘুরি, যা খুশি তা খাওয়া, যা খুশি তা পরে একজন আরেকজনকে বলা, কেমন লাগে বলতো?' অদ্ভুত একাকী সুখের মাঝে ওরা ডুবে রইল মাসের পর মাস। রাস্তায় বেরোলে নিজেদের সবচেয়ে সুখী বলে ভাবত ওরা, সুখের যত সংজ্ঞা এ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে সব এসে যেন ওদের কাছে থমকে দাঁড়াচ্ছে। দাম্পত্য সুখ কিভাবে রচনা করতে হয় তা এবার তোরা দেখে যা আমাদের দুই রুমের বাসায় এসে। কবিতার মতো স্বপি্নল নয়, গানের মতো অচিন পাখী নয়, আমরা আমাদের মতো এক অমলিন সুখ খুঁজে পেয়েছি, যা আগে কেউ কখনো আবিষ্কার করতে পারে নি। এই অভিজ্ঞতা কেবল আমাদেরই, এর অস্তিত্ব আগেও ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতে হবে বলেও আশা করি না। এমনি অহং আর বিশ্বাস দিয়ে তৈরি যে সম্পর্ক তাদের জীবনের জলছবিটা কখনো অস্পষ্ট মলিন হবার কথা নয়, তবু কী কারণে যে দুজন দুজন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তা এখন আর কেউ বলতে পারে না।
জীবন একঘেয়ে- এই কঠিন সত্যটুকু শেষ পর্যর্ন্ত ওদের গ্রাস করল। যে যুবক একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল আমি মৃতু্যকে জয় করব, সেই যুবক এখন পথের ধারে গাছের তলায় বসে করুণস্বরে ক্রমাগত আবৃত্তি করে চলেছে, জীবন এ্যাতো ছোটো ক্যানে !
জহির মনে মনে বলে, 'মাগী কিসু বোঝে না। চাকরি করে আর বেডাগো লগে ফস্টি নস্টি করে। তাইর কি অহন জামাইর দরকার আছে? তাইর লাঙ তো অহন একশটা।' অফিসের পুরুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর এরকমই মনে হয়।
সালমা ওর দিকে তাকালেই কোথ্বেকে যেন দলা দলা বিরক্তি এসে ভর করে। মনে হয় শরীর আর চলছে না, মন-মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছে, অন্তর্গত এক খিঁচুনি ধারা বইতে থাকে শরীর মন জুড়ে, 'নিষ্কর্মাডা আছে খালি বউর রোজগার খাইতে। বইয়া বইয়া খাইয়া শরিলডা যে বানাইছে, পেটটা য্যান একটা মিষ্টি কুমড়া, ওইডা নিয়া আবার মাইয়া গো লগে টাংকি মারে। ফালতু।' সে ফিচ করে মুখের একদলা থুথু ফেলে রাস্তার কিনারে। একটি লোক অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবে এমন মিষ্টি মহিলাটি এমন বিটকেলে রকমে কেন থুথু ফেলছে, তাও রাস্তা ধরে চলতে গিয়ে সবার সামনে?
সালমার বস হারুণ বিশ্বাস স্বামীর কথা জানতে চান। মাঝে মাঝে অফিসে এলে বলে ফেলেন, 'নিয়ে তো আসতে পারেন আমার রুমে। পরিচিত হতাম।'
মুচকী হাসে সালমা। সামান্য লজ্জার ভান করে, এমন ভাবে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করে যেন আরেকটু বস দ্বারা উজ্জীবিত হলে বলে উঠবে, 'কে বলেছে আমার স্বামী, আমার তো বিয়েই হয় নি স্যার।' কিন্তু এই বসটি তার সব জানে। কিভাবে যেন জেনে নিয়েছে। তাই হাসি উপহার দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।
সালমা লোকটিকে স্বামীর তুলনায় অনেক বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করে। বিবাহিত পুরুষ এবং পুত্রসন্তানের বাবা হওয়া সত্ত্বেও নিজের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন নি। কিন্তু লোকটি কেবল কথা বলতে চায়, এর বেশি কিছু নয়। প্রথম এই বিভাগে আসার পর এবং দু'চারবার কথা বলার পর যেমনটি লেগেছিল এখন আর তা মনে হয় না। লোকটি ভীরু প্রকৃতির, সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা আর স্বপ্নের জগতের নিরাপদ মরীচিকা দেখানো ছাড়া আর কিছু জানে না।
'জানেন, পদ্মার পাড়ে গিছলাম গত শুককুরবার। কী যে অসাধারণ, নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে পদ্মা দেখলাম। দুপুরে তাজা ইলিশের ভাজা দিয়ে ভাত খেলাম। কী যে সুস্বাদু , ভাবা যায় না। যাবেন?'
'হঁ্যা।' লজ্জা জড়ানো গলায় সে বসের প্রস্তাব মেনে নিল। কিন্তু তারপর দেখা গেল আর কোনদিন সে এই প্রসঙ্গে আসছে না। এভাবে অনেকদিন চলার পর সালমা ভাবল-পুরুষগুলোর স্বভাবটাই এমনতরো, নারী পেলেই কেবল স্বপ্ন বেচতে ইচ্ছে করে, চুল থেকে নখ পর্যন্ত বেনিয়া। নাফা ছাড়া কিসু্য বোঝে না। সব পুরুষের ভেতর সে কোন না কোনভাবে জহিরকেই খুঁজে পায়। সে বিরক্ত হয়ে থুূথু ফেলে কিংবা অাঁচল দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরে রাস্তা চলে ।
সালমা আজকাল বড় সন্দেহের চোখে দেখে জহিরকে. বিশেষ করে যখন সে সালমার কাছে গভীর করে করুণা কাড়ার আশায় বলে , 'আমি চলে গেলে বুঝবাঃ' সালমা একা হলে প্রায়ই এই কথাটার অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে। অনেক ভাবাভাবির পর সালমার মনে হয়েছে-জহির কোন দুষ্ট ব্যাধির শিকার, সে এ কথা গোপন রাখছে স্ত্রীর কাছে। এই চলে যাওয়ার অর্থ আর কিছু নয়, মৃতু্য। এ কথাটা ভাবতে গিয়ে বড় আরাম আর স্বস্থি খুঁজে পেল সে। এই বেঢপ লোকটি ওর জীবন থেকে বিদায় নিলে সে ফের কুমারী জীবনের ফেলে আসা স্বাধীনতা ফিরে পাবে, নিজের দায় নিজের বহন করার যে আনন্দ তা সে খুঁজে পাবে। কারো কাছে কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না, ইচ্ছেমত সংসার চালাতে পারবে, খরচ করতে পারবে যখন যা খুশি তা, নিত্য শংকা ওকে আর গ্রাস করবে না, অকারণ দুশ্চিন্তা ওকে ভাবাবে না। সমাজও তাকে মায়াময় চোখে বিচার করবে, সংগ্রামী নারী হিসাবে সম্মানও জানাতে পারে। সালমা স্বপ্নের ভেতর পাওয়া বোবা ইশারার একটা অর্থ দাঁড় করাতে চায়। সে স্পষ্ট করে জানতে চায়, লোকটি ওর জীবনে আর কদ্দিন।
জহিরের দোকানে প্রায়ই একটি মেয়ে এসে কসমেটিক্স নাড়াচাড়া করে। জহিরের ধারণা মেয়েটির একাধিক বিয়ে হয়েছে, কিন্তু ওর কাছে চেপে যাচ্ছে। নানারকম অসংলগ্ন কথা বলে। হাতের মুঠোয় ডলার ধরে লোভ দেখায়। জমির কাগজপত্র এনে মুখের সামনে নাড়াচাড়া করে। জহির প্রথমদিকে সামান্য নেতিয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে ওর ভেতর বদ্ধমূল ধারণা হয়- এই মেয়েটি সালমা থেকে আলাদা নয়। কদিন গেলে সে-ও পাল্টে যাবে, চাহিদার পাহাড় ওর সামনে তুলে ধরে বলে বসবে, তুই একটা অপদার্থ। এই জমি, এই অর্থ, এই দেহ দেবার পরও কেন তুই কিছুই করতে পারস না। কেন?
জহির মুখ ফিরিয়ে নেয়। বাসায় গিয়ে সালমাকে বলে, আমিও পারি। সালমা উত্তর দেয় , পারলে দেখাও। কিন্তু জহির কিছুই দেখাতে পারে না। সে কেবল রাস্তার ধারের পাগল কিসিমের ভিক্ষুককে পকেট থেকে এক টাকা দিতে জানে আর নিরিবিলি পেলে পাগলের কানে কানে বলতে পারে, আমারে চিনছ?
পাগল না বুঝে হাসে, উত্তর দেয় না। সে তৃপ্তি পায় হাসি পেয়ে, ভাবে- পাগলই কেবল ওকে চিনতে পারছে।
সালমা আর জহিরের জীবনে কোন টানাপোড়েন নেই। একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন নিস্পন্দ নিস্তরঙ্গ এক জীবন।
ওরা দুজনই এই ভুল জীবনের খোলস থেকে বের হয়ে আসতে চায় তুমুলভাবে। এক অন্যরকম জীবনের জন্য আকুল ব্যাকুল হওয়া সত্ত্বেও ওরা কেউ তা ধরতে পারছে না। তাই, ঘৃণা তীব্র হলে সালমা পথের ধারে থুূথু ছিটায় আর জহির পাগলকে এক টাকা ঘুষ দিয়ে কিনতে চায় অব্যাহত সুনাম।
ওরা দুজনই এক ভাঙা ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, নীচে অথৈ নদী, ঢেউ'র পর ঢেউ ভাঙছে, ওরা জানে না শেষ পর্যন্ত ওদের ঝাঁপ দিতে হবে কি হবে না।
=========================
গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা' আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ' আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ মণীশ রায়
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা' আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ' আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ মণীশ রায়
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
No comments