আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা' by ড. সাখাওয়াত আলী খান
বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা এমন একটি লোকও সম্ভবত পাওয়া যাবে না যে বাংলা ভাষা জানে না। এ দেশের ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠির লোকদের মাতৃভাষা বাংলা না হলেও তারা বাংলাভাষা বুঝতে পারে এবং মোটামুটি বলতেও পারে।
তাদের মধ্যে অনেকে বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছে। তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও তারা মূলত বাংলাভাষাই ব্যবহার করে থাকে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই একটি মাত্র ভাষা দেশের সব মানুষের মধ্যে এমন সর্বত্রগামী হয় না। আমাদের জন্য এটি অবশ্যই একটি আশির্বাদ স্বরূপ। একটি জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষেত্রে এই পরিবেশ যেমন অনুকূল, তেমনি জাতিকে অগ্রগতি, উন্নয়ন ও আধুনিকতার পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সকলের বোধগম্য ও ব্যবহার্য এমন একটি ভাষা থাকলে কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যায়।
যে কোন ইতিবাচক কাজের জন্য সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির এটি একটি কার্যকর হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় ইংরেজি এখন বিশ্বের সাধারণ ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। সে কারণে ইংরেজি এখন সব মানুষের জন্যই শিক্ষণীয়, আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। ইংরেজি আমাদের শিখতেই হবে। এছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর নেই। যে সমস্ত জাতি তাদের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষভাবে গর্ব বোধ করে, যেমন ফরাসি, জার্মান, চীনা, জাপানী কিংবা রুশরা,- তারাও কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগের প্রয়োজনে ইংরেজি শেখার উপর জোর দিচ্ছে এবং দ্রুত ইংরেজি শেখার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইংরেজি এখন আর কেবল একটি ভাষাই নয় বরং মাতৃভাষা ইংরেজি নয় এমন মানুষের কাছে এটি হয়ে গেছে একটি অত্যাবশ্যকীয় টেকনলজি, - এই টেকনলজি বা প্রযুক্তি ব্যতীত আধুনিক জীবন অনেকটাই অচল। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এমনকি নিজেদের স্বার্থে দেশের বাইরে কারো সঙ্গে দর কষাকষি করতে গেলে বা আন্তর্জাতিক আলোচনা বা চুক্তি সম্পাদনে ভাল ইংরেজি জানা এখন অপরিহার্য। অন্যথায় সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। যাদের ইংরেজি জানা নেই তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা অনুবাদক বা ইন্টারপ্রেটার সঙ্গে রাখা। কিন্তু অনুবাদকের সাহায্যে কোন আন্তর্জাতিক আলোচনা চালানো যেমন সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল, তেমনি অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তার চাইতে বরং ইংরেজি শিখে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এই বাস্তবতার ফলে আমরা যেন এই বিভ্রান্তিতে না ভুগি যে মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে আমাদের ইংরেজি শিখতে হবে।
যে কোন ইতিবাচক কাজের জন্য সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির এটি একটি কার্যকর হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় ইংরেজি এখন বিশ্বের সাধারণ ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। সে কারণে ইংরেজি এখন সব মানুষের জন্যই শিক্ষণীয়, আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। ইংরেজি আমাদের শিখতেই হবে। এছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর নেই। যে সমস্ত জাতি তাদের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষভাবে গর্ব বোধ করে, যেমন ফরাসি, জার্মান, চীনা, জাপানী কিংবা রুশরা,- তারাও কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগের প্রয়োজনে ইংরেজি শেখার উপর জোর দিচ্ছে এবং দ্রুত ইংরেজি শেখার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইংরেজি এখন আর কেবল একটি ভাষাই নয় বরং মাতৃভাষা ইংরেজি নয় এমন মানুষের কাছে এটি হয়ে গেছে একটি অত্যাবশ্যকীয় টেকনলজি, - এই টেকনলজি বা প্রযুক্তি ব্যতীত আধুনিক জীবন অনেকটাই অচল। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এমনকি নিজেদের স্বার্থে দেশের বাইরে কারো সঙ্গে দর কষাকষি করতে গেলে বা আন্তর্জাতিক আলোচনা বা চুক্তি সম্পাদনে ভাল ইংরেজি জানা এখন অপরিহার্য। অন্যথায় সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। যাদের ইংরেজি জানা নেই তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা অনুবাদক বা ইন্টারপ্রেটার সঙ্গে রাখা। কিন্তু অনুবাদকের সাহায্যে কোন আন্তর্জাতিক আলোচনা চালানো যেমন সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল, তেমনি অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তার চাইতে বরং ইংরেজি শিখে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এই বাস্তবতার ফলে আমরা যেন এই বিভ্রান্তিতে না ভুগি যে মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে আমাদের ইংরেজি শিখতে হবে।
কেন? কারণ এই যে, মাতৃভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যমই নয়। মাতৃভাষাই আমাদের পরিচয়, মাতৃভাষাই আমাদের সংস্কৃতির শেকড়। এসব আমাদের জানা কথা। এ দেশের মানুষ মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। বলা যায় যে, ভাষা আন্দোলন বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসারই এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। কাজেই বাঙালির কাছে মাতৃভাষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। কিন্তু সেই মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক শিথিলতা এখন অনেককেই পীড়া দেয়। দেশে ইংরেজি শেখার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বেড়েছে, এটা অত্যন্ত আশাপ্রদ। কিন্তু দেশের তরুণদের ব্যাপকভাবে ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে অব্যবস্থা, শিক্ষকের অভাব ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই ভালভাবে ইংরেজি শিখতে পারছে না। কিন্তু তাই বলে যে বাংলাভাষাও তারা ভালভাবে শিখছে এ কথাও বলা যাবে না। বরং শুদ্ধভাবে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে অবহেলা বা সচেতনতার অভাব যেন দিন দিনই বাড়ছে। বাংলা বানান ভুল করলে যে লজ্জাবোধ জন্মানোর কথা- তা-ও এখন যেন তেমন দেখা যাচ্ছে না। বাংলা সংবাদপত্র থেকে শুরু করে জনজীবনের নানা কাজে ভুল বানানে বাংলা শব্দ অবলীলায় লেখা হচ্ছে। কেউ তা শুধরে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন বলেও মনে হয় না। অন্যথায় একই ভুল কেন বারবার হচ্ছে? আজকাল নানা স্থানে নানা উপলক্ষে ছোট-বড় সংগঠন বা একক মানুষের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার শুভ প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু যখন দেখা যায় যে, বড় বা ছোট সংগঠন বা একক কোন মানুষ পুষ্পস্তবকে ভুল বানানে বেশ বড় করে শ্রদ্ধাঞ্জলি কথাটি দীর্ঘ ই-কার দিয়ে লেখেন এবং তা বারবার টেলিভিশনে দেখানো হয় বা সংবাদপত্রের পাতায় তা ছাপা হয়, তখন যিনি সঠিক বানানটি জানেন তারই লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছা করে। তেমনি প্রকাশ্যে নানাস্থানে যখন কোন দায়িত্বশীল মানুষ বা সংস্থার প্রচারিত তথ্যে শব্দের বানানে একই ভুল বারবার ঘটতে দেখা যায়, তখন বোঝা যায় সেখানে ব্যাপারটি দেখার কেউ নেই। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এই ভুলগুলো যে অহরহই নানা স্থানে দেখা যায়, সম্ভবত এ ব্যাপারে অনেকেই একমত হবেন। মনে হয়, যারা এই ভুল বানানগুলো লেখেন তারা নিশ্চিত যে তারা শুদ্ধ বানানেই লিখছেন।
অন্যথায় সংবাদপত্রসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দলিলে বা প্রকাশ্য স্থানে কখনো কখনো খুব বড় অক্ষরে ভুল বানানে লেখা দেখা যাওয়ার কথা নয়। যেমন, সার্থক শব্দটি বোঝাতে লেখা হচ্ছে 'স্বার্থক', সাক্ষী শব্দটির বদলে লেখা হচ্ছে 'স্বাক্ষী', নিরক্ষর-এর উল্টো শব্দ সাক্ষর বোঝাতে লেখা হচ্ছে 'স্বাক্ষর', সরণী (রাস্তা) শব্দের বানান লেখা হচ্ছে 'স্মরণী', দুর্ঘটনা লেখা হচ্ছে 'দূর্ঘটনা', সহযোগিতা বা প্রতিযোগিতা শব্দের বানান ভুল করে লেখা হচ্ছে 'সহযোগীতা' বা 'প্রতিযোগীতা', অভু্যত্থান শব্দটি লেখা হচ্ছে 'অভূ্যত্থান'। উল্টো কমার ভিতর লেখা দ্বিতীয় শব্দগুলোর বানান যে ভুল তা অনেকে মানতেই চান না। এছাড়া বাক্য বিন্যাসেও নানা ধরনের ভুল প্রায়শই দেখা যায়।
এর কারণ কী হতে পারে? একটা কারণ তো নিশ্চিত যে, যারা ভুল লিখছেন তারা ভুল শিখেছেন। শিক্ষকই হয়ত ভুল বানানটি শিখিয়েছেন অথবা তারা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভুল বানানটি দেখেছেন যে তারা ভুলটাকেই শুদ্ধ বলে ধরে নিয়েছেন। আর একটা কারণ এই হতে পারে যে, শিক্ষা পরবতর্ী সময়ে তারা বাংলা ভাষার চর্চা তেমন করেন না, করলে নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারতেন যে, তার মূল শিক্ষায় ভুল রয়েছে। ভুল শব্দটির বানান নিয়েও অনেকের ভুল ধারণা। আমাকে বিস্মিত করেছে। তাদের ধারণা ভুল শব্দটি দীর্ঘ-উ-কার দিয়ে লিখতে হবে। যা হোক, ভাষা,-তা বাংলা বা ইংরেজি যে ভাষাই হোক না কেন, চর্চা না করলে যেমন নিজের ভুল শুধরানো সম্ভব নয়, তেমনি কেবল চর্চার মাধ্যমেই ভাষার উপর আরো দক্ষতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সমাজে বোধকরি ভাষা চর্চার অভ্যাসটাই কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে লিখিত ভাষার চর্চা। অধিকাংশ মানুষ যতটা টেলিভিশন দেখে ততটা বই পড়ে না। সংবাদপত্রও অনেকেই তেমন মনযোগ দিয়ে পড়েন না। তদুপরি যখন গণমাধ্যমই ভুল করে, তখন তো ভুলের ক্ষেত্রে হয় সোনায় সোহাগা। গণমাধ্যম ভুল লিখলে তা-ই শুদ্ধ বলে মানুষের মনে গেঁথে যায়। তখন আমরা সহজেই ভুল বলি বা ভুল লিখি।
তাইতো সঙ্গত কারণেই মনে হয় যে, ভাষার ক্ষেত্রে মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে গণমাধ্যমেরও অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত। গণমাধ্যম যদি প্রতিদিন যে ভুলগুলো প্রতিনিয়ত হচ্ছে সে সম্পর্কে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের সচেতন করার চেষ্টা করে, তবে এক্ষেত্রে ভুলমোচনে তা সহায়ক হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, গণমাধ্যম যদি তাদের মূল্যবান পৃষ্ঠা বা সময় থেকে প্রতিদিন ভাষার ভুল সংশোধনে কিছুটা জায়গা বা সময় ব্যয় করে, তবে জনগণ তাদের ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ভাষা বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে হবে। সমাজে কোন্ ভুলগুলো বেশি হচ্ছে, কেন হচ্ছে ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণার জন্য যদি ভাষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয় তবে সংশোধনের উপায় বের হতে পারে। সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই এ দেশের গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে বলে আমরা আশা করি। এছাড়া স্কুল-কলেজে বাংলা ও ইংরেজি শেখানোর মত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করতে যা কিছু করা প্রয়োজন, তা কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতেই করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া দরকার। এদেশে নানা বিষয়ে প্রায়ই সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। ভাষার ভুল ব্যবহার রোধ করার উপায় নির্ধারণে সুশীল সমাজ বা কোন সংস্থার পক্ষ থেকে সভা-সেমিনার ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা খুব একটা শোনা যায় না। অনবরত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আলোচিত হলে এর সমাধান হওয়ার পন্থাও হয়ত বেরিয়ে আসবে - এমন আশা করা বোধকরি ভুল হবে না।
এখানে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় উলেস্নখ করতে চাই। বাংলাদেশের পনের কোটি লোক তো বাংলা ভাষায় কথা বলেই, তদুপরি বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা এবং পৃথিবীতে নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাঙালিরা বাংলা ভাষায়ই তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি বিপুল। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি সব বাঙালিই কামনা করে এ কথা বলা যায় সহজেই। কিন্তু তারপরও বাংলা ভাষাকে অবক্ষয় থেকে মুক্ত রেখে এটিকে আরো সমৃদ্ধ, আরো গতিশীল, আরো কার্যোপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্ব অনেক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পরিণামে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাঙালিদের উপর প্রধানত বর্তেছে। কথাটি আর একটু পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় যে, বাংলাভাষার পরিচর্যা ও বিকাশ ঘটানোর যে সুযোগ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে হয়ত একদিন বাংলাভাষাকে রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্ব বাংলাদেশের বাঙালিদেরই নিতে হবে। বাংলা বাংলাদেশেরই রাষ্ট্রভাষা। অন্য কোন দেশে বাংলার সেই মর্যাদা নেই। পশ্চিমবঙ্গেই একসময় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটেছিল। বাংলাদেশে অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক থাকলেও বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখনও শ্রদ্ধেয় ও উচ্চারিত অনেক নামই পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার। এখনও বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু বড় প্রতিভা এবং নিবেদিতপ্রাণ মানুষ কলকাতায় তথা পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এই প্রবণতায় যেন অনেকটা ভাটা পড়ছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি সামাজিক কারণেও কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা হিন্দী ভাষা শিখতে বেশি আগ্রহী। হিন্দী ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষাও বটে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ গান-বাজনার আসরে যতটা না গাওয়া হয় বাংলা গান, তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় গাইতে শোনা যায় হিন্দী গান। কলকাতার নাম করা গায়ক-গায়িকারা প্রায় সকলেই কম-বেশি হিন্দী গান করেন। কেউ কেউ হিন্দী গান গেয়েই বেশি নাম করেছেন। অবশ্য বাংলা গানের নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীরাও এখনো সেখানে আছেন, কিন্তু বাস্তব কারণেই হিন্দী গানের শিল্পীদের প্রভাব বিপুল।
অন্যদিকে এ কথাও সত্যি যে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত বাঙালি তথা ভারতীয়দের তুলনায় ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু অফিস-আদালতসহ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশী বাঙালিরা যে পরিমাণে বাংলা ব্যবহার করতে পারছে, পশ্চিমবঙ্গে তা নানা কারণে সম্ভব হচ্ছে না। তবে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এখনও পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতার সাহিত্যিকদের অবদান অসামান্য, বাংলাদেশের পাঠকদের কাছেও তারা বিপুলভাবে সমাদৃত। এতদসত্ত্বেও স্বীকার না করে উপায় নেই যে, হিন্দির দাপটে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কিছুটা অপাংতেয় হয়ে পড়ছে।
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হলেও সেখানে বাঙালি ছাড়াও নানা ভাষাভাষী মানুষ বাস করে। বিশাল নগরী কলকাতায় অবাঙালিদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে বলে শোনা যায়। কলকাতার কিছু কিছু অংশে মূলত উর্দু অথবা হিন্দী কিংবা ভারতীয় অন্য কোন ভাষাভাষী অঞ্চলের লোকেরই বসবাস। ভারতীয় অর্থনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণামেই এমনটা ঘটছে। ভবিষ্যতে কলকাতায় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার অনিবার্য পরিণতিতে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে এখানে বাংলা শেখার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। তবে এখানে প্রয়োজন মাফিক ইংরেজি শিক্ষার সুযোগের অভাব নিয়ে কথা উঠলেও এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরো ভালভাবে ইংরেজি শেখানোর মত শিক্ষক নিয়োগের যুক্তিসঙ্গত দাবি থাকলেও জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু করাই রাষ্ট্রীয় নীতি। সর্বক্ষেত্রে তা কার্যকর না হলেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলা যায়। সেইসঙ্গে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা শেখা অত্যাবশ্যক বলেই অধিকাংশ চিন্তাশীল নাগরিক মতামত দিচ্ছেন।
বাংলা ভাষার চর্চা সম্পর্কে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অনন্য ভূমিকা অটুট থাকুক বা না থাকুন, এ কথা সত্যি যে, বাংলা ভাষার অর্থাৎ এ দেশে মানুষের মাতৃভাষা ও একই সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার উন্নতি, সমৃদ্ধি, বিকাশ, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এই দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবেই তাদের উপর ন্যস্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা ভালভাবে আয়ত্ত করার পাশাপাশি নিজের মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করাই এখন বাংলাদেশী বাঙালিদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য।
কিন্তু নিজের ভাষা শেখার ক্ষেত্রে আমাদের যে গাফিলতি দেখা যাচ্ছে, তার ফলে এই ঐতিহাসিক কাজ সম্পাদনে আমাদের সাফল্য পাওয়া কঠিন হবে। এই লেখার প্রথম দিকে নিজের ভাষা নিয়ে গঠিত যে জাতিসমূহের কথা উলেস্নখ করা হয়েছে অর্থাৎ ফরাসি, জার্মান, চীনা, জাপানী কিংবা রাশিয়ানরা এখন ইংরেজি শিক্ষায় আগের চেয়ে মনযোগী হলেও তাদের নিজের ভাষা চর্চায় কিন্তু বিন্দুমাত্র গাফিলতি নেই। এই দেশগুলোসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন তাদের নিজেদের ভাষায় অতুলনীয় সব সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হচ্ছে। তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে যায়নি। তেমনি আধুনিক বিশ্বকেও আত্মস্থ করে নিজ ভাষায় সাহিত্য রচনা করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘটনাক্রমে ইংরেজি এত ভাল শিখেছে যে, ইংরেজিতেও গ্রহণযোগ্য সাহিত্য রচনা করছে।
তবে তারা ব্যতিক্রম মাত্র। সব ভাষায় অধিকাংশ সাহিত্যিকের অনুভূতি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো, 'মাতৃভাষায় রতনের রাজি'। নানা ভাষায় রচিত মহামূল্যবান এই সমস্ত উচ্চমানের সাহিত্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে সাহিত্য পিপাসু বিশ্ববাসীর চাহিদা মেটাচ্ছে। এই সমস্ত ভাষার প্রকাশভঙ্গি ও ধারণ ক্ষমতা ইংরেজি ভাষার চাইতে কম তো নয়ই, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রায় অতুলনীয়। এই ভাষাগুলো তাদের দেশের লেখকদের পরিচর্যায়ই এত উন্নত, সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
বাংলা ভাষার লেখক বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙালি লেখকদেরও এখন উপরি উক্ত ভূমিকাই গ্রহণ করতে হবে। এ দেশের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গান রচয়িতা, গায়ক, অভিনেতা এক কথায় সকল সাংস্কৃতিক কমর্ীর্র উপর নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার যে দায়িত্ব বর্তেছে, তেমনি আমাদের মত সাধারণ মানুষকেও যার যার অবস্থান থেকে ভাষা সমৃদ্ধকরণে ভূমিকা রাখতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপারটি কেবল একটি শেস্নাগানে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের দায়িত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মানুষকে যথাসম্ভব প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান যে গণমাধ্যমের দায়িত্ব তাদের তা দিতে হবে শুদ্ধ পরিশীলিত ভাষায়। গণমাধ্যমের ভাষা কিন্তু জনজীবনে বিশাল প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। আজকাল অফিস-আদালতে যে বাংলা গদ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তা অধিকাংশই সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূলতঃ বাংলা সংবাদপত্রের ভাষা অনুসরণ করেই সৃষ্টি করেছেন। এমনকি রাজনীতিকরা যে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন তার সৃষ্টিতেও সংবাদপত্রের ভাষার বিপুল প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিক্ষেত্রে বা অন্য অনুষ্ঠানে বেশ কিছুসংখ্যক বক্তা যে চমৎকার বাংলা বক্তৃতা করেন তার প্রশংসা আমি পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট জনের কাছ থেকে শুনেছি। জাতিসঙ্ঘেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলায় বক্তৃতা করে এসেছেন। বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট। ভালভাবে বাংলা শেখা এখন দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব।
আসুন আমরা সকলে ইংরেজি শেখার কর্তব্য পালনের পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে অপাংক্তেয় করে রাখার মারাত্মক ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হই। একই সঙ্গে আমাদের পরের প্রজন্ম যেন কোনভাবেই এই ভুল ধারণার বশবতর্ী হয়ে নিজেদের পরিচয় হারিয়ে না ফেলে সে ক্ষেত্রেও আমরা সচেষ্ট থাকি। অন্যথায় ভবিষ্যৎ কালের প্রবাহ আমাদের ক্ষমা করবে না।
=========================
আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ' আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ ড. সাখাওয়াত আলী খান
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ' আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ ড. সাখাওয়াত আলী খান
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments