ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল স্থল ও বিমানবাহিনীর ১০০ জন সেপাই by হাজিমে ইশিই
একটি
বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছিল ঢাকা। আতঙ্ক ছড়িয়েছিল জাপানেও। ঘটনা
ঘটিয়েছিল জাপানি লাল ফৌজ। যাকে বলা হয় রেড আর্মি। জাপানের উগ্রপন্থি একটি
গোষ্ঠী। ১৯৭৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। ১৩৭ জন যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু নিয়ে
জাপান এয়ারলাইনসের একটি বিমান জঙ্গিরা ছিনতাই করে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করে।
চারদিকে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।
ঘটনার নেপথ্যে ছিল রেড আর্মির ৯ সদস্যের মুক্তি ও ৬০ লাখ মার্কিন ডলার আদায়।
ঘটনা সুরাহায় ঢাকায় এসেছিলেন সে সময়ের জাপান সরকারের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই। তাঁর নেতৃত্বে সমঝোতা বৈঠকের সময়ই বাংলাদেশের বিমানবহিনীতে ঘটে নাটকীয় এক অভূত্থান।
হাজিমে ইশিই খুব কাছ থেকে সেই অভূত্থানের নানা ঘটনা অবলোকন করেছেন। মানবজমিন অনলাইন থেকে পাঠকদের জন্য সামরিক অভূত্থানের অজানা কাহিনী তুলে ধরা হলো হাজিমে ইশিই’র বয়ানে-
স্থলবাহিনীসহ নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে সকাল আটটা নাগাদ। ৮টা বেজে ১০ মিনিটে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা মূল ভবনে ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে যায়। ভারি মেশিনগানের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বিমানবন্দরজুড়ে। মাঝেমধ্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট উড়ে এসে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের পাশে কংক্রিটের দেয়ালে বিকট আওয়াজ করে বিদ্ধ হয়ে যায়।
‘মি. ইশিই, নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে পালিয়ে যান! এখানে থাকা একেবারে নিরাপদ নয়!’ কেউ চিৎকার করে আমাকে সাবধান করে দিল। হ্যাঁ, তাই তো। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার অন্যান্য ভবনের চেয়ে উঁচু বলে এটা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সুতরাং দুই পক্ষই মরিয়া হয়ে এটা দখল করার চেষ্টা করবে। তা সত্ত্বেও আমি মনে মনে ভাবছিলাম, যদি বিমান ছিনতাইকারীরা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তখন আমি এখানে উপস্থিত না থাকলে কী হবে? সামরিক অভ্যুত্থানের চেয়ে বিমানে থাকা সব জিম্মিকে উদ্ধার করাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুলির আওয়াজের প্রচন্ডতা আরও বেড়ে গেল। টাওয়ারের ভেতরে থাকলে উড়ে আসা গুলিতে ভেঙে যাওয়া কাচের টুকরোর আঘাতে আহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ছাড়া জিম্মিদের উদ্ধার না করে মারা যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমরা ঠিক করলাম, নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের বাইরের বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নেব। গুলি এড়ানোর জন্য ভবনের পেছনে গা লুকিয়ে বারান্দার মেঝেতে পুরোনো খবরের কাগজ বিছিয়ে তার ওপর বসে পড়লাম। মাথা রক্ষা করার জন্য হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলাম। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট উড়ে যাচ্ছিল।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিয়মিত বাহিনী বিদ্রোহীদের কোণঠাসা করে ফেলতে শুরু করে। বিমানবন্দরে নিয়মিত বাহিনীর আগমনের পর থেকে মূল ভবনের একতলা থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ করছিলেন পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মি. তেশিগাওয়ারা। তখনকার ঘটনাবলি তাঁর পরিষ্কার মনে আছে: ‘বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারের পাশে লোহার হেলমেট পরা সামরিক বাহিনীর সেনারা পজিশন নিয়েছে। যেসব বিদ্রোহী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে মূল থেকে বেরিয়ে আসছে, সামরিক বাহিনীর সেনারা তাদের অস্ত্রমুক্ত করছে।
‘তবে লড়াই তখনো অব্যাহত ছিল। মূল ভবনকে মাঝখানে রেখে বিমানবন্দরের এক পাশে চলা লড়াই এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। তবে এরপর উলটো দিক থেকে গুলির আওয়াজ আবারও শোনা গিয়েছিল। সামরিক বাহিনী ধীরে ধীরে বিদ্রোহীদের পরাভূত করতে শুরু করে। একসময় মূল ভবনে তারা ঢুকে পড়ে। চাকাওয়ালা ভারি মেশিনগান আমাদের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে তারা ছুটে গিয়েছিল। বিদ্রোহী সেনারা ক্যানভাসের জুতা পরলেও নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যদের পায়ে ছিল সামরিক জুতা। ভবনের ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় তাদের জুতা কংক্রিটের মেঝেতে পড়লে খটখট আওয়াজ বেজে ওঠে।
‘মূল ভবনের ভেতর থেকে আবার কানফাটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় পুণরায় শুরু হয়ে গেছে। আমরা সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর কত ঘণ্টা সময় চলে গেছে বুঝতে পারছিলাম না। মনে হয় যেন বেশ কয়েক দিন ধরে এমনটা চলছে। তারা কথা দিয়েছিল বিদেশিদের ক্ষতি করবে না, কিন্তু যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট চলে আসে, তখন কী হবে? গুলি বিনিময় দ্রুত শেষ হোক, প্রাণপণে সেই কামনা করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
‘জাইকা ও জাপান এয়ারলাইনসের কর্মীরা এরপর একসময় সুখবর নিয়ে হাজির হলেন। সামরিক বাহিনীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের ইতি টানা হয়েছে। বিমানবন্দরের ভবনে থাকা জাপানিরা সবাই অক্ষত অবস্থায় আছেন। একতলায় আমরা যারা ছিলাম, সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মি. উয়েদা সেদিনের কথা স্মরণ করে বললেন: ‘সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে দেখলাম, টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের উত্তরের দিক দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা থেকে পথচারীরা হঠাৎ সরে যাচ্ছে। ক্যামোফ্ল্যাজ নকশার সামরিক পোশাক পরা স্থলবাহিনীর সৈন্যরা রাস্তায় জড়ো হয়ে সেখান থেকে বিমানবন্দরের দিকে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরা সবাই প্রাণ বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে শুরু পড়লাম। আমি তিনতলায় ছিলাম। সেখান থেকে দেখলাম আমাদের ঘরের ঠিক নিচে ভবনের দেয়ালে কয়েকজন বিদ্রোহী সৈন্যকে দাঁড় করিয়ে নিয়মিত বাহিনীর সেনারা একযোগে গুলি চালাল। আমি শিউরে উঠলাম। দৃশ্যটা ছিল সত্যিই ভয়াবহ।
‘সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘরে এসে আমাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিল। আমরা সবাই বিদেশি জেনে তারা কোনো হিংসাত্মক আচরণ না করে সেখান থেকে চলে যায়।
‘৮টা ৪০ মিনিটের দিকে লক্ষ করলাম, নিয়মিত বাহিনী গোটা বিমানবন্দর এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এদিক-সেদিকে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে আছে। বিশেষ প্রতিনিধিলের নেতা মি. ইশিইর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমাকে তিনতলা ও নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের মধ্যে আসা-যাওয়া করতে হয়েছিল। সেই আসা-যাওয়ার মধ্যে কয়েকটি মৃতদেহ দেখতে হয়েছিল। সবার মুখে সুন্দর গোঁফ, বাঙালিসুলভ সুদর্শন চেহারা। এই সামরিক অফিসারদের কেন এখানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, তা নিয়ে ভাবার মতো মানসিকতা তখন আমার ছিল না।
‘আমরা জাপানি প্রতিনিধিরা ছিনতাই করা বিমানে থেকে যাওয়া সব জিম্মিকে অক্ষত অবস্থায় করার জন্য ধৈর্যের সঙ্গে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে নির্মম হত্যাযজ্ঞের বলি হয়ে এ দেশের সামরিক ব্যক্তিরা কারও নজরে না পড়ে এভাবে মাটিতে পড়ে রয়েছে! মানুষের জীবনের মূল্য কি কখনো এক হয় না? আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল। কোনো কিছু ঠিকমতো বিবেচনা করতে পারছিলাম না। মৃতদের মধ্যে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের সহযোগী গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার চৌধুরীও ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে জিম্মি উদ্ধারের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তাঁকে কেন এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, আদৌ বুঝতে পারলাম না।’
‘আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমরা আপনাদের রক্ষা করতে এসেছি’, কথাটা বললেন সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার, যিনি কমবেশি ১০ জন সৈন্যের সমন্বয়ে একটি ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অল্পবয়সী ও নিম্নপদস্থ অফিসার হলেও তাঁর মনোভাব দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি এই ইউনিটের প্রধান। তিনি এগিয়ে এসে আমাকে স্যালুট করেন। তারপর আমার সঙ্গে করমর্দন করেন। বিদ্রোহীদের দমন করে নিয়মিত বাহিনী শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। অফিসার ও সেনা সবাই ক্যামোফ্লেজ নকশার সামরিক পোশাক পরিধান করছিল। সেনাদের হাতে ছিল বেশ বড় মেশিনগান। তারা মূল ভবনের ছাদের চার কোণায় ভারি মেশিনগান বসিয়েছে। মেশিনগানগুলোকে বিমানবন্দর ও ঢাকা শহরের দিকে মুখ করে রাখা হয়েছে। ছাদে প্রায় ১৫ জন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের চারপাশে স্থলবাহিনীর সশস্ত্র সৈন্যরা পজিশন নিয়েছে।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল স্থল ও বিমানবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সেপাই। এতে বিমানবাহিনীর একজন অফিসারসহ ২১ জন অফিসার ও সেনা নিহত হন। বিদ্রোহী সেনা মিলে মোট ২০০ জনের বেশি এই ঘটনায় প্রাণ হারান বলে জানা গেছে।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ঠেকাতে না পারার অভিযোগে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি প্রায় পদচ্যুত হতে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সহায়তায় তিনি তাঁর পদে বহাল থাকতে পারলেও সামরিক বাহিনীর মধ্যে তাঁর প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের ভাগ্য নিয়ে এই অনিশ্চয়তার কারণে বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার অবসানের পর বাংলাদেশকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য বিশেষ দূত প্রেরণের ব্যাপারে জাপান সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
৬ই অক্টোবর রাতে জাপানের অন্যত প্রধান দৈনিক মাইনিচি শিম্বুন পত্রিকা টেলিফোনে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।
মাহমুদ: আমি ভালোই আছি। জাপানের জনগণ আমার ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন জেনে খুশি হলাম। তাঁদের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল।
মাইনিচি শিম্বুন: সামরিক অভ্যুত্থানের কথা আপনি কখন জানতে পারলেন?
মাহমুদ: আমি প্রায় না ঘুমিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে দর-কষাকষি চালাচ্ছিলাম। ছিনতাই করা বিমানের যাত্রীসহ আমরা সবাই, এমনকি জঙ্গিরাও, চরম ক্লান্তির মধ্যে ছিলাম। আমার হাতে আর সময় ছিল না। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার সমাধান করার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জঙ্গিদের কাছে সর্বশেষ দাবি জানিয়ে বললাম, ঢাকাতেই সব জিম্মিকে ছেড়ে দিতে হবে।
মাইনিচি শিম্বুন: তার মানে বিদ্রোহীরা যখন নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারে ঢুকে পড়েছিল, আপনি তখন সেখানেই ছিলেন?
মাহমুদ: না। আমি ছিনতাইকারীদের বললাম, আমার প্রস্তাব ভেবে দেখুন। এ জন্য আপনাদের ৩০ মিনিট সময় দেওয়া হবে। এ কথা বলে আমি নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের নিচে আমার অফিসে গেলাম। সেখানে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। কয়েক দিন ঘুমানোর সুযোগ হয়নি বলে ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমের ঘোর আমাকে কাবু করতে যাচ্ছিল। এমন সময় আমাকে বিদ্রোহীদের হামলার মুখোমুখি হতে হলো। আমি সেখানে থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সঠিকভাবে বললে আমার অধীনরাই আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। আমি তাড়াহুড়ো করে বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম। তার পরের ঘটনা...তার পরের ঘটনা সম্বন্ধে বলতে গেলে বেশি লম্বা সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই এখন না-ই বা বললাম। তার চেয়ে বরং ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলোচনার কথাই বলি।
আলোচনা ছিল অত্যন্ত জটিল। আমি সবকিছুর আগে চেষ্টা করেছি আমার ওপর তারা যেন আস্থা না থাকলে আলোচনা কখনো এগোয় না। তারা কোনোক্রমেই আপসরফায় আসতে রাজি ছিল না। অন্যদিকে ঢাকায় সব জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য মি. ইশিইর কাছ থেকে প্রচন্ড চাপ আসছিল। জঙ্গি এবং জাপান সরকার উভয় পক্ষের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে ভালোভাবে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলাম। সে জন্য আমার সহিষ্ণুতার দরকার ছিল। আমি নাজুক অবস্থান ছিলাম। সুতরাং, সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা আমার প্রয়োজন ছিল। এক পর্যায়ে আমি জঙ্গিদের প্রস্তাব করলাম, আমি ছিনতাই করা বিমানে গিয়ে তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। তবে তারা এতে রাজি হয়নি।
ঘটনার নেপথ্যে ছিল রেড আর্মির ৯ সদস্যের মুক্তি ও ৬০ লাখ মার্কিন ডলার আদায়।
ঘটনা সুরাহায় ঢাকায় এসেছিলেন সে সময়ের জাপান সরকারের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই। তাঁর নেতৃত্বে সমঝোতা বৈঠকের সময়ই বাংলাদেশের বিমানবহিনীতে ঘটে নাটকীয় এক অভূত্থান।
হাজিমে ইশিই খুব কাছ থেকে সেই অভূত্থানের নানা ঘটনা অবলোকন করেছেন। মানবজমিন অনলাইন থেকে পাঠকদের জন্য সামরিক অভূত্থানের অজানা কাহিনী তুলে ধরা হলো হাজিমে ইশিই’র বয়ানে-
স্থলবাহিনীসহ নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে সকাল আটটা নাগাদ। ৮টা বেজে ১০ মিনিটে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা মূল ভবনে ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে যায়। ভারি মেশিনগানের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বিমানবন্দরজুড়ে। মাঝেমধ্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট উড়ে এসে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের পাশে কংক্রিটের দেয়ালে বিকট আওয়াজ করে বিদ্ধ হয়ে যায়।
‘মি. ইশিই, নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে পালিয়ে যান! এখানে থাকা একেবারে নিরাপদ নয়!’ কেউ চিৎকার করে আমাকে সাবধান করে দিল। হ্যাঁ, তাই তো। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার অন্যান্য ভবনের চেয়ে উঁচু বলে এটা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সুতরাং দুই পক্ষই মরিয়া হয়ে এটা দখল করার চেষ্টা করবে। তা সত্ত্বেও আমি মনে মনে ভাবছিলাম, যদি বিমান ছিনতাইকারীরা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তখন আমি এখানে উপস্থিত না থাকলে কী হবে? সামরিক অভ্যুত্থানের চেয়ে বিমানে থাকা সব জিম্মিকে উদ্ধার করাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুলির আওয়াজের প্রচন্ডতা আরও বেড়ে গেল। টাওয়ারের ভেতরে থাকলে উড়ে আসা গুলিতে ভেঙে যাওয়া কাচের টুকরোর আঘাতে আহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ছাড়া জিম্মিদের উদ্ধার না করে মারা যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমরা ঠিক করলাম, নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের বাইরের বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নেব। গুলি এড়ানোর জন্য ভবনের পেছনে গা লুকিয়ে বারান্দার মেঝেতে পুরোনো খবরের কাগজ বিছিয়ে তার ওপর বসে পড়লাম। মাথা রক্ষা করার জন্য হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলাম। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে মাঝেমধ্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট উড়ে যাচ্ছিল।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিয়মিত বাহিনী বিদ্রোহীদের কোণঠাসা করে ফেলতে শুরু করে। বিমানবন্দরে নিয়মিত বাহিনীর আগমনের পর থেকে মূল ভবনের একতলা থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ করছিলেন পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মি. তেশিগাওয়ারা। তখনকার ঘটনাবলি তাঁর পরিষ্কার মনে আছে: ‘বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারের পাশে লোহার হেলমেট পরা সামরিক বাহিনীর সেনারা পজিশন নিয়েছে। যেসব বিদ্রোহী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে মূল থেকে বেরিয়ে আসছে, সামরিক বাহিনীর সেনারা তাদের অস্ত্রমুক্ত করছে।
‘তবে লড়াই তখনো অব্যাহত ছিল। মূল ভবনকে মাঝখানে রেখে বিমানবন্দরের এক পাশে চলা লড়াই এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। তবে এরপর উলটো দিক থেকে গুলির আওয়াজ আবারও শোনা গিয়েছিল। সামরিক বাহিনী ধীরে ধীরে বিদ্রোহীদের পরাভূত করতে শুরু করে। একসময় মূল ভবনে তারা ঢুকে পড়ে। চাকাওয়ালা ভারি মেশিনগান আমাদের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে তারা ছুটে গিয়েছিল। বিদ্রোহী সেনারা ক্যানভাসের জুতা পরলেও নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যদের পায়ে ছিল সামরিক জুতা। ভবনের ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় তাদের জুতা কংক্রিটের মেঝেতে পড়লে খটখট আওয়াজ বেজে ওঠে।
‘মূল ভবনের ভেতর থেকে আবার কানফাটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় পুণরায় শুরু হয়ে গেছে। আমরা সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর কত ঘণ্টা সময় চলে গেছে বুঝতে পারছিলাম না। মনে হয় যেন বেশ কয়েক দিন ধরে এমনটা চলছে। তারা কথা দিয়েছিল বিদেশিদের ক্ষতি করবে না, কিন্তু যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট চলে আসে, তখন কী হবে? গুলি বিনিময় দ্রুত শেষ হোক, প্রাণপণে সেই কামনা করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
‘জাইকা ও জাপান এয়ারলাইনসের কর্মীরা এরপর একসময় সুখবর নিয়ে হাজির হলেন। সামরিক বাহিনীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের ইতি টানা হয়েছে। বিমানবন্দরের ভবনে থাকা জাপানিরা সবাই অক্ষত অবস্থায় আছেন। একতলায় আমরা যারা ছিলাম, সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মি. উয়েদা সেদিনের কথা স্মরণ করে বললেন: ‘সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে দেখলাম, টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের উত্তরের দিক দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা থেকে পথচারীরা হঠাৎ সরে যাচ্ছে। ক্যামোফ্ল্যাজ নকশার সামরিক পোশাক পরা স্থলবাহিনীর সৈন্যরা রাস্তায় জড়ো হয়ে সেখান থেকে বিমানবন্দরের দিকে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরা সবাই প্রাণ বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে শুরু পড়লাম। আমি তিনতলায় ছিলাম। সেখান থেকে দেখলাম আমাদের ঘরের ঠিক নিচে ভবনের দেয়ালে কয়েকজন বিদ্রোহী সৈন্যকে দাঁড় করিয়ে নিয়মিত বাহিনীর সেনারা একযোগে গুলি চালাল। আমি শিউরে উঠলাম। দৃশ্যটা ছিল সত্যিই ভয়াবহ।
‘সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ঘরে এসে আমাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিল। আমরা সবাই বিদেশি জেনে তারা কোনো হিংসাত্মক আচরণ না করে সেখান থেকে চলে যায়।
‘৮টা ৪০ মিনিটের দিকে লক্ষ করলাম, নিয়মিত বাহিনী গোটা বিমানবন্দর এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এদিক-সেদিকে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে আছে। বিশেষ প্রতিনিধিলের নেতা মি. ইশিইর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমাকে তিনতলা ও নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের মধ্যে আসা-যাওয়া করতে হয়েছিল। সেই আসা-যাওয়ার মধ্যে কয়েকটি মৃতদেহ দেখতে হয়েছিল। সবার মুখে সুন্দর গোঁফ, বাঙালিসুলভ সুদর্শন চেহারা। এই সামরিক অফিসারদের কেন এখানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, তা নিয়ে ভাবার মতো মানসিকতা তখন আমার ছিল না।
‘আমরা জাপানি প্রতিনিধিরা ছিনতাই করা বিমানে থেকে যাওয়া সব জিম্মিকে অক্ষত অবস্থায় করার জন্য ধৈর্যের সঙ্গে জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে নির্মম হত্যাযজ্ঞের বলি হয়ে এ দেশের সামরিক ব্যক্তিরা কারও নজরে না পড়ে এভাবে মাটিতে পড়ে রয়েছে! মানুষের জীবনের মূল্য কি কখনো এক হয় না? আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল। কোনো কিছু ঠিকমতো বিবেচনা করতে পারছিলাম না। মৃতদের মধ্যে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের সহযোগী গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার চৌধুরীও ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে জিম্মি উদ্ধারের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তাঁকে কেন এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, আদৌ বুঝতে পারলাম না।’
‘আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমরা আপনাদের রক্ষা করতে এসেছি’, কথাটা বললেন সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার, যিনি কমবেশি ১০ জন সৈন্যের সমন্বয়ে একটি ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অল্পবয়সী ও নিম্নপদস্থ অফিসার হলেও তাঁর মনোভাব দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি এই ইউনিটের প্রধান। তিনি এগিয়ে এসে আমাকে স্যালুট করেন। তারপর আমার সঙ্গে করমর্দন করেন। বিদ্রোহীদের দমন করে নিয়মিত বাহিনী শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। অফিসার ও সেনা সবাই ক্যামোফ্লেজ নকশার সামরিক পোশাক পরিধান করছিল। সেনাদের হাতে ছিল বেশ বড় মেশিনগান। তারা মূল ভবনের ছাদের চার কোণায় ভারি মেশিনগান বসিয়েছে। মেশিনগানগুলোকে বিমানবন্দর ও ঢাকা শহরের দিকে মুখ করে রাখা হয়েছে। ছাদে প্রায় ১৫ জন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের চারপাশে স্থলবাহিনীর সশস্ত্র সৈন্যরা পজিশন নিয়েছে।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল স্থল ও বিমানবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সেপাই। এতে বিমানবাহিনীর একজন অফিসারসহ ২১ জন অফিসার ও সেনা নিহত হন। বিদ্রোহী সেনা মিলে মোট ২০০ জনের বেশি এই ঘটনায় প্রাণ হারান বলে জানা গেছে।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ঠেকাতে না পারার অভিযোগে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি প্রায় পদচ্যুত হতে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সহায়তায় তিনি তাঁর পদে বহাল থাকতে পারলেও সামরিক বাহিনীর মধ্যে তাঁর প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের ভাগ্য নিয়ে এই অনিশ্চয়তার কারণে বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার অবসানের পর বাংলাদেশকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য বিশেষ দূত প্রেরণের ব্যাপারে জাপান সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
৬ই অক্টোবর রাতে জাপানের অন্যত প্রধান দৈনিক মাইনিচি শিম্বুন পত্রিকা টেলিফোনে এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।
মাহমুদ: আমি ভালোই আছি। জাপানের জনগণ আমার ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন জেনে খুশি হলাম। তাঁদের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল।
মাইনিচি শিম্বুন: সামরিক অভ্যুত্থানের কথা আপনি কখন জানতে পারলেন?
মাহমুদ: আমি প্রায় না ঘুমিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে দর-কষাকষি চালাচ্ছিলাম। ছিনতাই করা বিমানের যাত্রীসহ আমরা সবাই, এমনকি জঙ্গিরাও, চরম ক্লান্তির মধ্যে ছিলাম। আমার হাতে আর সময় ছিল না। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার সমাধান করার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জঙ্গিদের কাছে সর্বশেষ দাবি জানিয়ে বললাম, ঢাকাতেই সব জিম্মিকে ছেড়ে দিতে হবে।
মাইনিচি শিম্বুন: তার মানে বিদ্রোহীরা যখন নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারে ঢুকে পড়েছিল, আপনি তখন সেখানেই ছিলেন?
মাহমুদ: না। আমি ছিনতাইকারীদের বললাম, আমার প্রস্তাব ভেবে দেখুন। এ জন্য আপনাদের ৩০ মিনিট সময় দেওয়া হবে। এ কথা বলে আমি নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের নিচে আমার অফিসে গেলাম। সেখানে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। কয়েক দিন ঘুমানোর সুযোগ হয়নি বলে ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমের ঘোর আমাকে কাবু করতে যাচ্ছিল। এমন সময় আমাকে বিদ্রোহীদের হামলার মুখোমুখি হতে হলো। আমি সেখানে থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সঠিকভাবে বললে আমার অধীনরাই আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। আমি তাড়াহুড়ো করে বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম। তার পরের ঘটনা...তার পরের ঘটনা সম্বন্ধে বলতে গেলে বেশি লম্বা সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই এখন না-ই বা বললাম। তার চেয়ে বরং ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলোচনার কথাই বলি।
আলোচনা ছিল অত্যন্ত জটিল। আমি সবকিছুর আগে চেষ্টা করেছি আমার ওপর তারা যেন আস্থা না থাকলে আলোচনা কখনো এগোয় না। তারা কোনোক্রমেই আপসরফায় আসতে রাজি ছিল না। অন্যদিকে ঢাকায় সব জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য মি. ইশিইর কাছ থেকে প্রচন্ড চাপ আসছিল। জঙ্গি এবং জাপান সরকার উভয় পক্ষের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে ভালোভাবে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলাম। সে জন্য আমার সহিষ্ণুতার দরকার ছিল। আমি নাজুক অবস্থান ছিলাম। সুতরাং, সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা আমার প্রয়োজন ছিল। এক পর্যায়ে আমি জঙ্গিদের প্রস্তাব করলাম, আমি ছিনতাই করা বিমানে গিয়ে তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। তবে তারা এতে রাজি হয়নি।
No comments