সাগরের মাঝে স্বপ্নিল এক দ্বীপ by এহতেশাম ফেরদউস
হোবার্টের একটি দৃশ্য |
প্রথম আলো, ০৩ জুলাই ২০১৯: বেশ
কয়েক বছর থেকে ভাবছিলাম তাসমানিয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু নানা ব্যস্ততা আর
কাজের মাঝে সময়টা ঠিক বের করা হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
উপস্থিত হয়ে গেল। উদ্দেশ্য কিছু ঘোরাঘুরি করা আর এত দিন ধরে শুনে আসা
তাসমানিয়া নামের দীপটার সৌন্দর্য উপভোগ করা। কথা প্রচলন আছে, তাসমানিয়ায়
বাতাসেও নাকি সৌন্দর্যের গন্ধ পাওয়া যায়।
যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে টিকিট, airbnb–তে ঘর ভাড়া ও গাড়ির ব্যবস্থা ইত্যাদি করলাম। তাসমানিয়ায় থাকবার জন্য মাত্র তিন দিন সময়। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সময়ও এর মধ্যেই বের করতে হবে। সবকিছু মিলে টাইট শিডিউল।
বিমান ছাড়ার কথা কথা খুব সকালে। ভোর ৬টার দিকে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে আর ৭টার দিকে বিমান ছাড়বে। তাসমানিয়া পৌঁছাবে সাড়ে ৮টার দিকে। আমার বাসা থেকে বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতো। আমাদের সঙ্গে শুধু হাতব্যাগ। বিমানবন্দরের কাছের একটা এলাকায় ছোট ভাই থাকে। তাকে ফোন করে বাসার সামনে অপেক্ষা করতে বললাম। যেন সে আমাদের বিমানবন্দরে নামিয়ে আসতে পারে। ভোরবেলায় বিমানবন্দরে যাওয়ার কিছু পাওয়া যাবে না চিন্তা থেকেই বেচারাকে কষ্ট দেওয়া।
আমাদের দেশের মতো সিডনি শহরেও সারা বছর চলে রাস্তার কাজ। কখনো রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। কখনো বা রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে। এ ছাড়া আছে রাস্তার নিচের পানি, বিদ্যুৎ বা গ্যাসের কোনো কাজ। বেশির ভাগ কাজই এখানে রাতে করে। তখন রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। তারপরও যে রাস্তায় কাজ হচ্ছে তা বন্ধ করে বিকল্প রাস্তা দিয়ে যেতে বলা হয়। সেখানেও বিড়ম্বনা। ছোট রাস্তাগুলোতে একসঙ্গে অনেক গাড়ি চলে। আর সেখানেও গাড়ি চলে বেশ ধীরে।
যা হোক, ছোট ভাইকে তার বাসার সামনে রাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম। তাকে বলতে সাহস হচ্ছিল না, যাও তুমি শুয়ে থাকো। আমরা গিয়ে ডেকে তুলব। তার ঘুম বেশ কড়া। একবার ঘুমালে আর ডেকে তোলা যাবে কিনা সন্দেহ। এমনিতেই রাস্তা বন্ধ। বিকল্প রাস্তা দিয়ে যেতে বেশ অনেকটা সময় চলে গেল। তার বাসার সামনে পৌঁছে আমাদের গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে রওনা দিলাম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের দিকে।
বিমানবন্দরে যখন পৌঁছলাম তখন আর মাত্র এক ঘণ্টা আছে বিমান ছাড়ার। ভোরবেলা আর সপ্তাহের মাঝে হওয়ার জন্য বিমানবন্দর বেশ ফাঁকা। অল্প কিছু মানুষ কফি হাতে ঘোরাঘুরি করছেন। সবার মধ্যে যেন কেমন গা ছাড়া ভাব। এ ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পুরোপুরি আলাদা। যে দেশে যখনই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছি সব সময় ব্যস্ততা। মানুষেরের ব্যস্ততা নিজেকেও বেশ প্রভাবিত করে। না চাইলেও ব্যস্ত ভাব এসে যায়।
আমরা মানে আমি আর আমার বাবা দুজনে দেখলাম বেশ নতুন কিছু নিয়ম যোগ হয়েছে এই বিমানবন্দরে। চেক ইন করার জন্য কোনো লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমরা ছোটবেলাই যে রকম মেশিনে ভিডিও গেম খেলতাম, সে রকম মেশিন বসানো আছে। সেটায় গিয়ে নিজের নাম আর ফ্লাইট নম্বর দিলে নিজে থেকেই বোর্ডিং পাস বেরিয়ে আসে। লাগেজ কিছু থাকলে তা কাউন্টারে দিয়ে দিলেই হয়। আমাদের সঙ্গে যেহেতু শুধু ক্যারি অন ব্যাগ একটা করে, আমাদের কাজ এখানেই মোটামুটি শেষ হয়ে গেল।
এরপর নিরাপত্তা গেট পার হয়ে বিমানে ওঠার পালা। দারুণ উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে-ভেতরে। যেন পারলে এখনই বিমানে উঠে বলি ভাই আমাদের চোখের পলকে তাসমানিয়া নিয়ে চল তো। বিমানের সামনের দিকে যাঁরা বসেন তাঁরা বিমানবন্দরের ভেতর দিয়েই বিমানে প্রবেশ করেন। আর যাঁরা পেছনের দিকে বসেন তাঁদের বাইরে দিয়ে হেঁটে বিমানের পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হয়। আমাদের আসন পেছনের দিকে। ওঠার জন্য টার্মিনাল থেকে বের হতেই বসন্তের ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেল। আহা কী শান্তি, মনে মনে বলে উঠলাম। সবকিছুই যেন মন ভালো করার জন্য তৈরি।
বিমান যখন তাসমান সাগর পেরিয়ে তাসমানিয়া দ্বীপে পৌঁছাল জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। কী সুন্দর, অপূর্ব! যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ পাহাড়ের সারি আর মাঝ দিয়ে বয়ে চলা লেক। সরু সুতার মতো আঁকাবাঁকা লেক আর পাহাড়ের সারি। মেঘলা দিন দেখে মনে পড়ে গেল কানাডার ভ্যানকুভারে যখন গিয়েছিলাম ঠিক এ রকম দৃশ্য দেখেছিলাম। শুধু পার্থক্য একটা, কানাডাতে পাহাড়গুলো ছিল শুভ্র বরফে ঢাকা। সেটাও অপার্থিব সুন্দর এক দৃশ্য। পরে কোনো এক সময় সেই কাহিনি লেখা যাবে।
তাসমানিয়ায় বিমানবন্দরে নেমে বেশ অবাক হলাম। কোথাও কোনো ব্যস্ততা নেই। কিছু কাস্টম কর্মকর্তা তাদের কুকুর নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। কুকুরগুলো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা দূর থেকে গন্ধ শুঁকে কারও কাছে সন্দেহজনক কিছু থাকলে তা বের করে ফেলে। অস্ট্রেলিয়ার সব বিমানবন্দরেই এই কড়াকড়ি। তাসমানিয়াতে দেখলাম তা একটু বেশি মাত্রাই। তারা বেশ সচেতন কোনো বীজ (সেই বীজ কোনো বিশেষ রোগ ছড়াতে পারে গাছপালার মধ্যে) বা কোনো কাঠের জিনিস নেওয়া যাবে না (কাঠে উইপোকা থাকতে পারে)। যেকোনো কারণে অস্ট্রেলিয়াতে এগুলো একবার আসতে পারলে খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে। তাসমানিয়ায় কোনো উইপোকা নেই।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বেশ অবাক হলাম। সিডনির তুলনায় বেশ ঠান্ডা। ঠিক যেন সিডনির শীতকাল। সাটল বাসে করে আমাদের গাড়ি ভাড়া করবার জায়গায় গিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে নিলাম। আগে থেকে গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম। তাই খুব দ্রুত কাজগুলো শেষ হলো। বের হয়ে ছোট রাস্তা ধরে একটা শপিং মল খুঁজে নিলাম।
গাড়ি পার্ক করে দ্রুত কিছু খাবার কিনে বের হয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তা সারা জীবন চোখে লেগে থাকবে। পার্কিংয়ের পাশে রাস্তা। তারপর হারবারের মতো একটা অংশ। সেখানে বেশ অনেকগুলো নৌকা রাখা। তার পাশে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে ছোট একটা শহর। ঠিক ভাষাতে বর্ণনা করা যাবে না। কোনো এক অপার্থিব সৌন্দর্য। আর সেই প্রথম মনে হলো আমি আসলেই বাতাসে সৌন্দর্যের গন্ধ পাচ্ছি।
সকাল ১০টায় একজনের সঙ্গে দেখা করবার কথা। জিপিএস ব্যবহার করছিলাম। গন্তব্যে যাওয়ার সময় যা দেখা যায় তাই ভালো লাগে। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যামের বালাই নেই। যার সঙ্গে দেখা করার কথা তিনি থাকবেন বাসার সামনে। বাসায় পৌঁছে অবাক হওয়ার পালা। এখানে কী সব বাসায় এত সুন্দর! সব বাসা থেকেই কী এ রকম দৃশ্য দেখা যায়। বাসার পেছনে apricot ফলের গাছ। বাসায় ঢোকার মুখে অসম্ভব সুন্দর গোলাপ গাছে রং বেরঙের গোলাপ ফুটে আছে। বাসার সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে সবুজ পাহাড়ের সারির মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা লেক। দূরে কোথাও পাহাড়ের গায়ে মেঘ আটকে। আহা কী অপরূপ দৃশ্য!
দুপুরে ঘুরতে গেলাম নিউ নরফল্ক নামের একটা জায়গাতে। যাওয়ার পথে একপাশে লেক। লেক ভরা পানকৌড়ি আর এক পাশে পাহাড়। কোথাও ওয়াইনারি আর কোথাও ছবির মতো সুন্দর কোনো বাসা পাহাড়ের গায়ে। নিউ নরফল্ক পৌঁছে এক অদ্ভুত জায়গায় ঘুরতে গেলাম। জায়গাটাকে বলে গাড়ির কবরস্থান! নষ্ট বাদ পড়া সব গাড়ি। শুনলাম এখানে কিছু গাড়ির বয়স ১০০ বছরের ওপরে। বাবার কাছে জানতে পারলাম তিনি যখন খুব ছোট ছিলেন ১৯৫০-৬০ সালের দিকে তখন এই গাড়িগুলো বাংলাদেশে দেখা যেত। ব্রিটিশ আমলের সেই গাড়িগুলো দেখে মজা লাগছিল। কেমন যেন টাইম মেশিনে চেপে ৬০-৭০ বছর আগের রাস্তা চোখে ভাসছিল।
চারপাশে বিভিন্ন রঙের গাছ, পাতা ফুল, একেকটা একেক রকম। আমি কবি হলে এ রকম দৃশ্য দেখে হয়তো মাথা খারাপ হয়ে যেত। সৃষ্টিকর্তা কত আদর আর যত্ন করে এগুলো সাজিয়েছেন! চারপাশে শুধু রং আর রং। মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো। একটা কফির দোকানে কফি নিয়ে দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসলাম। বাবার অবাক দৃষ্টি, আমারও অবাক দৃষ্টি। যেন সৌন্দর্যগুলো চোখ, মন আর ক্যামেরা দিয়ে গিলে নিচ্ছি।
আমাদের থাকার জায়গায় ২টার দিকে যাওয়ার কথা। শহর পেরিয়ে যখন আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছলাম আরেকবার অবাক হওয়ার পালা। প্রায় ২-৩ একর জায়গার ওপর দুটি বাংলো। একটায় মালিক থাকেন আর অন্যটা আমরা ভাড়া করেছি। মালিকের আতিথেয়তাও অসাধারণ। তাঁর নিজের মুরগির খামার থেকে আমাদের ডিম দিতে চাইলেন আর কোনো কিছু লাগলে যেন তাঁকে জানাই তা–ও বিশেষভাবে বলে গেলেন।
ব্যাগ রেখে আমরা বের হলাম কিছু বাজার করার জন্য। অসাধারণ একটা সময়। পিকনিক পিকনিক ব্যাপার। আমি আর বাবা মিলে কিছু খাবার কিনে আনলাম। তার মধ্যে ডিম–রুটি, চাল–ডাল, মসলা ইত্যাদি। বাসায় এসে বাবা বানালেন ডিম ভাজা দিয়ে রুটি। এতই ক্ষুধার্ত ছিলাম মনে হলো এত মজার খাবার অনেক দিন খাইনি।
বাইরে বেশ হিম পড়তে শুরু করেছে। বিক্ষিপ্তভাবে অনেক খরগোশ আর তিতির পাখির মতো বন্য পাখিরা চারপাশে। বাবা বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তিনি ঘরের হিটার ছেড়ে একটা ঘুম দিলেন। আমি বারান্দায় এসে বসলাম। বুক ভরে বাতাস থেকে সৌন্দর্যের গন্ধ নিতে থাকলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখানে সন্ধ্যাটাও অদ্ভুত সুন্দর। দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্য ডুবে গেল। আর এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। পাহাড়ের পেছন থেকে বেরিয়ে এল অদ্ভুত সুন্দর এক চাঁদ। তাসমানিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চাঁদটা অনেক বড় দেখাচ্ছিল। বাবাকে ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু এই সুন্দর দৃশ্য দেখাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ডেকে তুললাম বাবাকে। দুজন নির্বাক। এ রকম সৌন্দর্যের প্রতিটা মুহূর্ত শুধু চোখ দিয়ে গিলে যেতে হয় আর মনে শক্ত করে গেঁথে নিতে হয়। কথা বলা বারণ।
পরদিন আমরা গেলাম Launcheston (হোবার্টের পর তাসমানিয়ার আর একটি বড় শহর)। ড্রাইভ করে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। শুরুতে যাওয়ার পথে ঢুকলাম হোবার্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রে। দুটি মাত্র উঁচু দালান চোখে পড়ল। একটি ফোন কোম্পানির আরেকটি ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার। রাস্তার পাশের গাছগুলোতে রঙের বন্যা। ফুটপাত আর রাস্তার মাঝের আইল্যান্ডের চারপাশে অনেক রংবেরঙের ফুলের বাহার। চোখ সরানো যায় না। মনে হয় কেউ যেন অতি যত্নে হাতে এঁকে রেখেছেন। একদম শহরের প্রাণকেন্দ্রে কোথাও কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। তাসমানিয়া শহরে শুনেছিলাম ট্রাফিক জ্যাম কি তাঁরা জানেন না।
শহর থেকে বের হওয়ার পথে রাস্তার কাজ হচ্ছিল। সুতরাং শুরুর দিকের দেখার তেমন কিছু ছিল না। শুধু কিছু পুরোনো বাড়ি আর তার সামনে রংবেরঙের ফুলের আর গাছের বাহার।
তুলনাবিহীন সৌন্দর্য শুরু হলো একটু পরে। দুপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি। কোথাও ভেড়া চড়ছে, কোথাও যত দূর চোখ যায় ভুট্টাখেত। গাড়ি চালাব না এই সৌন্দর্য উপভোগ করব? বাবার অবাক দৃষ্টি চারপাশে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কোথাও ছবি তুলছেন, কোথাও আমাকে বলছেন কোনটা কিসের খামার। দুপুরে Launcheston পৌঁছলাম। পাহাড়ের ওপর একটা শহর আর চারপাশে পাহাড়ের সারি, মাঝে মাঝে বয়ে চলা লেক। সব শহর মনে হলো একই দেখতে এখানে। বেশ কিছু নেপালি দেখলাম এই শহরে। বুঝলাম তাদের পাহাড়ে ঘেরা সৌন্দর্যের দেশ ছেড়ে ভালো জীবনের জন্য এখানে পাড়ি জমিয়েছে তারা। শহর থেকে বের হওয়ার পথে প্রথম ট্রাফিক জ্যামে পড়লাম। যদিও তা খুব কম সময়ের জন্য।
দিনে দিনেই হোবার্ট ফিরে এলাম। প্রথমে গেলাম একটা লুক আউট পয়েন্টে। হোবার্ট শহরের অনেকটাই এখান থেকে দেখা যায়। শেষ সূর্যের আলোতে আরও এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সাক্ষী হলাম। পুরো শহরটা যেন পাহাড়ের গায়ে, দেয়ালে রাখা কোনো এক ছবির মতো।
আমাদের থাকার জায়গার পাশেই সুন্দর একটা সমুদ্রসৈকত। নামটাও সুন্দর। বাংলা করলে দাঁড়ায় সাত মাইল সৈকত। সন্ধ্যাটা সেখানে কাটিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে গেলাম স্থানীয় এক বাজারে। নাম সালামাঙ্কা মার্কেট। গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হলো বৃষ্টি। সঙ্গে কোনো ছাতা ছিল না। তাই খুব দ্রুত গাড়িতে এসে বসলাম। মার্কেটটা একটা রাস্তার ওপর বসে। দুপাশ থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয় আর রাস্তার দুপাশে পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। বেশির ভাগ পুরোনো দিনের স্যুভেনির সেট, বাঁধানো ছবি আর খাবারের দোকান। সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম মনা জাদুঘরে। জাদুঘরটা মূলত একটা আর্ট মিউজিয়াম। কিছু ফারাও আমলের প্রতিকৃতি, ইউরোপিয়ান কিছু আবিষ্কারের নমুনা আছে। আমার বা বাবার কাছে আহামরি কিছু মনে হলো না। হয়তো আমরা আর্টের মর্ম বুঝতে পারলাম না। যদিও সবাই এই দুই জায়গাতে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছিল। বাজার আর এই মিউজিয়াম, অল্প সময় থেকেই বেরিয়ে এলাম।
ফিরে গেলাম আমাদের থাকবার জায়গার কাছের সেই সৈকতে। বৃষ্টির কারণে চারপাশ এত ঠান্ডা যে, গাড়ি থেকে বের হওয়া হলো না তেমন। পাশে একটা পেট্রল স্টেশনে গিয়ে প্রথম কোনো বাঙালি ভাইয়ের দেখা পেলাম। তাঁর কাছে জানতে পারলাম তাসমানিয়ায় প্রায় দুই শ বা তার কিছু বেশি বাঙালি থাকেন। তিনি জানালেন আরও বেশ কিছু তথ্য। বেরিয়ে রেন্টের গাড়ি ফেরত দিয়ে বিমানবন্দরে ফিরে চললাম। বিমানবন্দরে পৌঁছে চেক ইন শেষ করলাম। বিমান ছাড়ার তখনো বেশ কিছু দেরি। আমরা বিমানবন্দরের দোকানগুলোতে ক্লান্ত সময় কাটাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বিমানে উঠে বসলাম। বিমান যখন ওপরে উঠে যেতে শুরু করল আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ঠিক বিদাই জানাতে পারলাম না। মনে হলো এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে আমাকে আবার ফিরে আসতে হবে।
সিডনি নামলাম যখন, তখন চারপাশ অন্ধকার। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে কোলাহল আর ব্যস্ত জীবন আবার। গাড়ি ভাড়া করে আমাদের গাড়ির কাছে যাওয়ার পথে চালক গল্প করছিলেন, সিডনিতে তাঁর কয়টা বাড়ি, কীভাবে তিনি ইনভেস্টমেন্ট করেছেন। শুধু ভাড়ার গাড়ি চালিয়ে তাঁর কয়েক মিলিয়নের বাসা ইত্যাদি। কিন্তু আমার মাথাতে তখন ফেলে আসা শেষ বিকেলের আলোতে দূর সাগরের মাঝে এক স্বপ্নলোকের স্বপ্ন।
যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে টিকিট, airbnb–তে ঘর ভাড়া ও গাড়ির ব্যবস্থা ইত্যাদি করলাম। তাসমানিয়ায় থাকবার জন্য মাত্র তিন দিন সময়। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সময়ও এর মধ্যেই বের করতে হবে। সবকিছু মিলে টাইট শিডিউল।
বিমান ছাড়ার কথা কথা খুব সকালে। ভোর ৬টার দিকে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে আর ৭টার দিকে বিমান ছাড়বে। তাসমানিয়া পৌঁছাবে সাড়ে ৮টার দিকে। আমার বাসা থেকে বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতো। আমাদের সঙ্গে শুধু হাতব্যাগ। বিমানবন্দরের কাছের একটা এলাকায় ছোট ভাই থাকে। তাকে ফোন করে বাসার সামনে অপেক্ষা করতে বললাম। যেন সে আমাদের বিমানবন্দরে নামিয়ে আসতে পারে। ভোরবেলায় বিমানবন্দরে যাওয়ার কিছু পাওয়া যাবে না চিন্তা থেকেই বেচারাকে কষ্ট দেওয়া।
আমাদের দেশের মতো সিডনি শহরেও সারা বছর চলে রাস্তার কাজ। কখনো রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। কখনো বা রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে। এ ছাড়া আছে রাস্তার নিচের পানি, বিদ্যুৎ বা গ্যাসের কোনো কাজ। বেশির ভাগ কাজই এখানে রাতে করে। তখন রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। তারপরও যে রাস্তায় কাজ হচ্ছে তা বন্ধ করে বিকল্প রাস্তা দিয়ে যেতে বলা হয়। সেখানেও বিড়ম্বনা। ছোট রাস্তাগুলোতে একসঙ্গে অনেক গাড়ি চলে। আর সেখানেও গাড়ি চলে বেশ ধীরে।
যা হোক, ছোট ভাইকে তার বাসার সামনে রাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম। তাকে বলতে সাহস হচ্ছিল না, যাও তুমি শুয়ে থাকো। আমরা গিয়ে ডেকে তুলব। তার ঘুম বেশ কড়া। একবার ঘুমালে আর ডেকে তোলা যাবে কিনা সন্দেহ। এমনিতেই রাস্তা বন্ধ। বিকল্প রাস্তা দিয়ে যেতে বেশ অনেকটা সময় চলে গেল। তার বাসার সামনে পৌঁছে আমাদের গাড়ি রাস্তার পাশে রেখে রওনা দিলাম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের দিকে।
বিমানবন্দরে যখন পৌঁছলাম তখন আর মাত্র এক ঘণ্টা আছে বিমান ছাড়ার। ভোরবেলা আর সপ্তাহের মাঝে হওয়ার জন্য বিমানবন্দর বেশ ফাঁকা। অল্প কিছু মানুষ কফি হাতে ঘোরাঘুরি করছেন। সবার মধ্যে যেন কেমন গা ছাড়া ভাব। এ ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পুরোপুরি আলাদা। যে দেশে যখনই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছি সব সময় ব্যস্ততা। মানুষেরের ব্যস্ততা নিজেকেও বেশ প্রভাবিত করে। না চাইলেও ব্যস্ত ভাব এসে যায়।
আমরা মানে আমি আর আমার বাবা দুজনে দেখলাম বেশ নতুন কিছু নিয়ম যোগ হয়েছে এই বিমানবন্দরে। চেক ইন করার জন্য কোনো লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমরা ছোটবেলাই যে রকম মেশিনে ভিডিও গেম খেলতাম, সে রকম মেশিন বসানো আছে। সেটায় গিয়ে নিজের নাম আর ফ্লাইট নম্বর দিলে নিজে থেকেই বোর্ডিং পাস বেরিয়ে আসে। লাগেজ কিছু থাকলে তা কাউন্টারে দিয়ে দিলেই হয়। আমাদের সঙ্গে যেহেতু শুধু ক্যারি অন ব্যাগ একটা করে, আমাদের কাজ এখানেই মোটামুটি শেষ হয়ে গেল।
এরপর নিরাপত্তা গেট পার হয়ে বিমানে ওঠার পালা। দারুণ উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে-ভেতরে। যেন পারলে এখনই বিমানে উঠে বলি ভাই আমাদের চোখের পলকে তাসমানিয়া নিয়ে চল তো। বিমানের সামনের দিকে যাঁরা বসেন তাঁরা বিমানবন্দরের ভেতর দিয়েই বিমানে প্রবেশ করেন। আর যাঁরা পেছনের দিকে বসেন তাঁদের বাইরে দিয়ে হেঁটে বিমানের পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হয়। আমাদের আসন পেছনের দিকে। ওঠার জন্য টার্মিনাল থেকে বের হতেই বসন্তের ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেল। আহা কী শান্তি, মনে মনে বলে উঠলাম। সবকিছুই যেন মন ভালো করার জন্য তৈরি।
বিমান যখন তাসমান সাগর পেরিয়ে তাসমানিয়া দ্বীপে পৌঁছাল জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। কী সুন্দর, অপূর্ব! যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ পাহাড়ের সারি আর মাঝ দিয়ে বয়ে চলা লেক। সরু সুতার মতো আঁকাবাঁকা লেক আর পাহাড়ের সারি। মেঘলা দিন দেখে মনে পড়ে গেল কানাডার ভ্যানকুভারে যখন গিয়েছিলাম ঠিক এ রকম দৃশ্য দেখেছিলাম। শুধু পার্থক্য একটা, কানাডাতে পাহাড়গুলো ছিল শুভ্র বরফে ঢাকা। সেটাও অপার্থিব সুন্দর এক দৃশ্য। পরে কোনো এক সময় সেই কাহিনি লেখা যাবে।
তাসমানিয়ায় বিমানবন্দরে নেমে বেশ অবাক হলাম। কোথাও কোনো ব্যস্ততা নেই। কিছু কাস্টম কর্মকর্তা তাদের কুকুর নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। কুকুরগুলো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা দূর থেকে গন্ধ শুঁকে কারও কাছে সন্দেহজনক কিছু থাকলে তা বের করে ফেলে। অস্ট্রেলিয়ার সব বিমানবন্দরেই এই কড়াকড়ি। তাসমানিয়াতে দেখলাম তা একটু বেশি মাত্রাই। তারা বেশ সচেতন কোনো বীজ (সেই বীজ কোনো বিশেষ রোগ ছড়াতে পারে গাছপালার মধ্যে) বা কোনো কাঠের জিনিস নেওয়া যাবে না (কাঠে উইপোকা থাকতে পারে)। যেকোনো কারণে অস্ট্রেলিয়াতে এগুলো একবার আসতে পারলে খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে। তাসমানিয়ায় কোনো উইপোকা নেই।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বেশ অবাক হলাম। সিডনির তুলনায় বেশ ঠান্ডা। ঠিক যেন সিডনির শীতকাল। সাটল বাসে করে আমাদের গাড়ি ভাড়া করবার জায়গায় গিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে নিলাম। আগে থেকে গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম। তাই খুব দ্রুত কাজগুলো শেষ হলো। বের হয়ে ছোট রাস্তা ধরে একটা শপিং মল খুঁজে নিলাম।
গাড়ি পার্ক করে দ্রুত কিছু খাবার কিনে বের হয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তা সারা জীবন চোখে লেগে থাকবে। পার্কিংয়ের পাশে রাস্তা। তারপর হারবারের মতো একটা অংশ। সেখানে বেশ অনেকগুলো নৌকা রাখা। তার পাশে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে ছোট একটা শহর। ঠিক ভাষাতে বর্ণনা করা যাবে না। কোনো এক অপার্থিব সৌন্দর্য। আর সেই প্রথম মনে হলো আমি আসলেই বাতাসে সৌন্দর্যের গন্ধ পাচ্ছি।
সকাল ১০টায় একজনের সঙ্গে দেখা করবার কথা। জিপিএস ব্যবহার করছিলাম। গন্তব্যে যাওয়ার সময় যা দেখা যায় তাই ভালো লাগে। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যামের বালাই নেই। যার সঙ্গে দেখা করার কথা তিনি থাকবেন বাসার সামনে। বাসায় পৌঁছে অবাক হওয়ার পালা। এখানে কী সব বাসায় এত সুন্দর! সব বাসা থেকেই কী এ রকম দৃশ্য দেখা যায়। বাসার পেছনে apricot ফলের গাছ। বাসায় ঢোকার মুখে অসম্ভব সুন্দর গোলাপ গাছে রং বেরঙের গোলাপ ফুটে আছে। বাসার সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে সবুজ পাহাড়ের সারির মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা লেক। দূরে কোথাও পাহাড়ের গায়ে মেঘ আটকে। আহা কী অপরূপ দৃশ্য!
দুপুরে ঘুরতে গেলাম নিউ নরফল্ক নামের একটা জায়গাতে। যাওয়ার পথে একপাশে লেক। লেক ভরা পানকৌড়ি আর এক পাশে পাহাড়। কোথাও ওয়াইনারি আর কোথাও ছবির মতো সুন্দর কোনো বাসা পাহাড়ের গায়ে। নিউ নরফল্ক পৌঁছে এক অদ্ভুত জায়গায় ঘুরতে গেলাম। জায়গাটাকে বলে গাড়ির কবরস্থান! নষ্ট বাদ পড়া সব গাড়ি। শুনলাম এখানে কিছু গাড়ির বয়স ১০০ বছরের ওপরে। বাবার কাছে জানতে পারলাম তিনি যখন খুব ছোট ছিলেন ১৯৫০-৬০ সালের দিকে তখন এই গাড়িগুলো বাংলাদেশে দেখা যেত। ব্রিটিশ আমলের সেই গাড়িগুলো দেখে মজা লাগছিল। কেমন যেন টাইম মেশিনে চেপে ৬০-৭০ বছর আগের রাস্তা চোখে ভাসছিল।
চারপাশে বিভিন্ন রঙের গাছ, পাতা ফুল, একেকটা একেক রকম। আমি কবি হলে এ রকম দৃশ্য দেখে হয়তো মাথা খারাপ হয়ে যেত। সৃষ্টিকর্তা কত আদর আর যত্ন করে এগুলো সাজিয়েছেন! চারপাশে শুধু রং আর রং। মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো। একটা কফির দোকানে কফি নিয়ে দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসলাম। বাবার অবাক দৃষ্টি, আমারও অবাক দৃষ্টি। যেন সৌন্দর্যগুলো চোখ, মন আর ক্যামেরা দিয়ে গিলে নিচ্ছি।
আমাদের থাকার জায়গায় ২টার দিকে যাওয়ার কথা। শহর পেরিয়ে যখন আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছলাম আরেকবার অবাক হওয়ার পালা। প্রায় ২-৩ একর জায়গার ওপর দুটি বাংলো। একটায় মালিক থাকেন আর অন্যটা আমরা ভাড়া করেছি। মালিকের আতিথেয়তাও অসাধারণ। তাঁর নিজের মুরগির খামার থেকে আমাদের ডিম দিতে চাইলেন আর কোনো কিছু লাগলে যেন তাঁকে জানাই তা–ও বিশেষভাবে বলে গেলেন।
ব্যাগ রেখে আমরা বের হলাম কিছু বাজার করার জন্য। অসাধারণ একটা সময়। পিকনিক পিকনিক ব্যাপার। আমি আর বাবা মিলে কিছু খাবার কিনে আনলাম। তার মধ্যে ডিম–রুটি, চাল–ডাল, মসলা ইত্যাদি। বাসায় এসে বাবা বানালেন ডিম ভাজা দিয়ে রুটি। এতই ক্ষুধার্ত ছিলাম মনে হলো এত মজার খাবার অনেক দিন খাইনি।
বাইরে বেশ হিম পড়তে শুরু করেছে। বিক্ষিপ্তভাবে অনেক খরগোশ আর তিতির পাখির মতো বন্য পাখিরা চারপাশে। বাবা বেশ ক্লান্ত ছিলেন। তিনি ঘরের হিটার ছেড়ে একটা ঘুম দিলেন। আমি বারান্দায় এসে বসলাম। বুক ভরে বাতাস থেকে সৌন্দর্যের গন্ধ নিতে থাকলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখানে সন্ধ্যাটাও অদ্ভুত সুন্দর। দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্য ডুবে গেল। আর এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। পাহাড়ের পেছন থেকে বেরিয়ে এল অদ্ভুত সুন্দর এক চাঁদ। তাসমানিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চাঁদটা অনেক বড় দেখাচ্ছিল। বাবাকে ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু এই সুন্দর দৃশ্য দেখাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। ডেকে তুললাম বাবাকে। দুজন নির্বাক। এ রকম সৌন্দর্যের প্রতিটা মুহূর্ত শুধু চোখ দিয়ে গিলে যেতে হয় আর মনে শক্ত করে গেঁথে নিতে হয়। কথা বলা বারণ।
পরদিন আমরা গেলাম Launcheston (হোবার্টের পর তাসমানিয়ার আর একটি বড় শহর)। ড্রাইভ করে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। শুরুতে যাওয়ার পথে ঢুকলাম হোবার্ট শহরের প্রাণকেন্দ্রে। দুটি মাত্র উঁচু দালান চোখে পড়ল। একটি ফোন কোম্পানির আরেকটি ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার। রাস্তার পাশের গাছগুলোতে রঙের বন্যা। ফুটপাত আর রাস্তার মাঝের আইল্যান্ডের চারপাশে অনেক রংবেরঙের ফুলের বাহার। চোখ সরানো যায় না। মনে হয় কেউ যেন অতি যত্নে হাতে এঁকে রেখেছেন। একদম শহরের প্রাণকেন্দ্রে কোথাও কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। তাসমানিয়া শহরে শুনেছিলাম ট্রাফিক জ্যাম কি তাঁরা জানেন না।
শহর থেকে বের হওয়ার পথে রাস্তার কাজ হচ্ছিল। সুতরাং শুরুর দিকের দেখার তেমন কিছু ছিল না। শুধু কিছু পুরোনো বাড়ি আর তার সামনে রংবেরঙের ফুলের আর গাছের বাহার।
তুলনাবিহীন সৌন্দর্য শুরু হলো একটু পরে। দুপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি। কোথাও ভেড়া চড়ছে, কোথাও যত দূর চোখ যায় ভুট্টাখেত। গাড়ি চালাব না এই সৌন্দর্য উপভোগ করব? বাবার অবাক দৃষ্টি চারপাশে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কোথাও ছবি তুলছেন, কোথাও আমাকে বলছেন কোনটা কিসের খামার। দুপুরে Launcheston পৌঁছলাম। পাহাড়ের ওপর একটা শহর আর চারপাশে পাহাড়ের সারি, মাঝে মাঝে বয়ে চলা লেক। সব শহর মনে হলো একই দেখতে এখানে। বেশ কিছু নেপালি দেখলাম এই শহরে। বুঝলাম তাদের পাহাড়ে ঘেরা সৌন্দর্যের দেশ ছেড়ে ভালো জীবনের জন্য এখানে পাড়ি জমিয়েছে তারা। শহর থেকে বের হওয়ার পথে প্রথম ট্রাফিক জ্যামে পড়লাম। যদিও তা খুব কম সময়ের জন্য।
দিনে দিনেই হোবার্ট ফিরে এলাম। প্রথমে গেলাম একটা লুক আউট পয়েন্টে। হোবার্ট শহরের অনেকটাই এখান থেকে দেখা যায়। শেষ সূর্যের আলোতে আরও এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সাক্ষী হলাম। পুরো শহরটা যেন পাহাড়ের গায়ে, দেয়ালে রাখা কোনো এক ছবির মতো।
আমাদের থাকার জায়গার পাশেই সুন্দর একটা সমুদ্রসৈকত। নামটাও সুন্দর। বাংলা করলে দাঁড়ায় সাত মাইল সৈকত। সন্ধ্যাটা সেখানে কাটিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে গেলাম স্থানীয় এক বাজারে। নাম সালামাঙ্কা মার্কেট। গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হলো বৃষ্টি। সঙ্গে কোনো ছাতা ছিল না। তাই খুব দ্রুত গাড়িতে এসে বসলাম। মার্কেটটা একটা রাস্তার ওপর বসে। দুপাশ থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয় আর রাস্তার দুপাশে পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। বেশির ভাগ পুরোনো দিনের স্যুভেনির সেট, বাঁধানো ছবি আর খাবারের দোকান। সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম মনা জাদুঘরে। জাদুঘরটা মূলত একটা আর্ট মিউজিয়াম। কিছু ফারাও আমলের প্রতিকৃতি, ইউরোপিয়ান কিছু আবিষ্কারের নমুনা আছে। আমার বা বাবার কাছে আহামরি কিছু মনে হলো না। হয়তো আমরা আর্টের মর্ম বুঝতে পারলাম না। যদিও সবাই এই দুই জায়গাতে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছিল। বাজার আর এই মিউজিয়াম, অল্প সময় থেকেই বেরিয়ে এলাম।
ফিরে গেলাম আমাদের থাকবার জায়গার কাছের সেই সৈকতে। বৃষ্টির কারণে চারপাশ এত ঠান্ডা যে, গাড়ি থেকে বের হওয়া হলো না তেমন। পাশে একটা পেট্রল স্টেশনে গিয়ে প্রথম কোনো বাঙালি ভাইয়ের দেখা পেলাম। তাঁর কাছে জানতে পারলাম তাসমানিয়ায় প্রায় দুই শ বা তার কিছু বেশি বাঙালি থাকেন। তিনি জানালেন আরও বেশ কিছু তথ্য। বেরিয়ে রেন্টের গাড়ি ফেরত দিয়ে বিমানবন্দরে ফিরে চললাম। বিমানবন্দরে পৌঁছে চেক ইন শেষ করলাম। বিমান ছাড়ার তখনো বেশ কিছু দেরি। আমরা বিমানবন্দরের দোকানগুলোতে ক্লান্ত সময় কাটাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বিমানে উঠে বসলাম। বিমান যখন ওপরে উঠে যেতে শুরু করল আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ঠিক বিদাই জানাতে পারলাম না। মনে হলো এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে আমাকে আবার ফিরে আসতে হবে।
সিডনি নামলাম যখন, তখন চারপাশ অন্ধকার। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে কোলাহল আর ব্যস্ত জীবন আবার। গাড়ি ভাড়া করে আমাদের গাড়ির কাছে যাওয়ার পথে চালক গল্প করছিলেন, সিডনিতে তাঁর কয়টা বাড়ি, কীভাবে তিনি ইনভেস্টমেন্ট করেছেন। শুধু ভাড়ার গাড়ি চালিয়ে তাঁর কয়েক মিলিয়নের বাসা ইত্যাদি। কিন্তু আমার মাথাতে তখন ফেলে আসা শেষ বিকেলের আলোতে দূর সাগরের মাঝে এক স্বপ্নলোকের স্বপ্ন।
হোবার্টের একটি দৃশ্য |
No comments