মানিক মিয়ার সাংবাদিকতা এবং বর্তমান বাংলাদেশ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
গতকাল (১ জুন রবিবার) ছিল পঞ্চাশের দশকের
অপরাজেয় সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যু দিবস। আজ থেকে চার
দশকেরও বেশি সময় আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তবু বছর বছর আমরা তাকে স্মরণ করি।
কারণ, একজন সম্পাদক থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জাতির বিবেক। এই বিবেকটি তিনি
কোনো কারণেই কোনো প্রলোভন ও কোনো ভয়ের কাছে বিক্রি করেননি। তার মতো
বিবেকবান সাংবাদিক ও সম্পাদক দেশে জšে§ছিলেন বলেই দেশটি আজ স্বাধীন। এই
স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই, তাতে তিনি ছিলেন সাহসী লড়াকু। এই স্বাধীনতা তিনি
দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু এই স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পর আজ যদি তিনি
সহসা সমাধি থেকে জেগে উঠতেন, স্বাধীন বাংলার চেহারা দেখতেন, তাহলে কী
ভাবতেন, কী দেখতেন, কী লিখতেন সে কথা আজ সবিস্ময়ে ভাবি।
সেই পঞ্চাশের যুগে, পাকিস্তান আমলে তিনটি নাম ছিল আমাদের সাংবাদিকতার আকাশে ধ্র“বতারা। মানিক মিয়া, জহুর চৌধুরী ও আবদুস সালাম। ইত্তেফাক, সংবাদ ও পাকিস্তান অবজারভার (পরে বাংলাদেশ অবজারভার) এই দুটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে তারা যুক্ত ছিলেন। ইংরেজি দৈনিকটি এখন নেই। বাকি দুটি বাংলা দৈনিকই টিকে আছে। ব্যবসায়ে, প্রচারে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ও শোভন অঙ্গসজ্জায় তাদের সমৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু সাহস ও বিবেকের সেই প্রাণস্পন্দন নেই আমাদের সাংবাদিকতায়। তিনটি নক্ষত্র অস্তমিত হওয়ার পর সাংবাদিকতার আকাশে অনেক নক্ষত্র ফুটেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি নক্ষত্র। কিন্তু আগের সেই আলোর দ্যুতি নেই।
মানিক মিয়া যখন তার দৈনিকটি প্রকাশ করেন, তখন তার নিজস্ব প্রেস ছিল না; পত্রিকাটি ছিল মাত্র চার পৃষ্ঠা। ওই চার পৃষ্ঠার কাগজ কেনার জন্য রাস্তায় হকারদের কাছে ক্রেতারা ভিড় জমাত। খবর তাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ ছিল না। প্রধান আকর্ষণ ছিল ওই কাগজে মানিক মিয়ার প্রতিদিনের নিজস্ব কলাম। মোসাফির এই ছদ্মনামে রাজনৈতিক মঞ্চ শীর্ষক কলামটি তিনি লিখতেন। শোনা যায়, ঢাকায় তখনকার প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের চিফ সেক্রেটারি থেকে তার চাপরাশি পর্যন্ত ছিলেন তার কলামের পাঠক। কী জাদুস্পর্শ ছিল তার লেখনীতে, যা তার মতের বিরোধী পাঠককেও এমন মোহমুগ্ধ করে রাখত?
সবাই স্বীকার করেছেন, এমনকি তার সমালোচকরাও। তার লেখা শুধু গতানুগতিক সাংবাদিকতা ছিল না, ছিল একটি স্বপ্ন নির্মাণের জন্য সংগ্রামের দিকদর্শন ও আবাহন। এ স্বপ্নটি ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার। দেশের মানুষকে অভাব, দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত করার। এই সংগ্রামে পঞ্চাশের দশকের তিন পথিকৃৎ সম্পাদকই ছিলেন আপসহীন। তারা বারবার কারাগারে গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের কাগজের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা নতজানু হননি। সাহস ও বিবেকের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন দেশবাসীর সামনে। সাংবাদিকতাকে অতি মুনাফার ব্যবসা করে তোলেননি; তাকে করেছিলেন তাদের সংগ্রাম ও সাধনার হাতিয়ার।
মানিক মিয়াদের বাংলাদেশ ও আজকের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক তফাৎ। তখন বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্বাঞ্চল। আসলে পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত একটি উপনিবেশ। শিল্প, বাণিজ্য, ব্যবসা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে ছিল এই উপনিবেশটি পিছিয়ে। তার সম্পদ ও অর্থ নিত্য পাচার হতো দেশটির পশ্চিম অংশে। ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও উপনিবেশের মানুষের গলাটিপে ধরে তাকে আঠারো ও উনিশ শতকের আফ্রিকার দাস কলোনিতে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছিল। আজকের উগ্র মৌলবাদ, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের তখনই অংকুরোদগম। কিন্তু তা এমন ব্যাপকতা লাভ করেনি। কারণ, সমাজ দেহে তার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ছিল। দেশের সাংবাদিকতা মানুষের বিবেক জাগ্রত রাখার প্রেরণা জোগাত। সত্যবাবু তখনও এমনভাবে রোগগ্রস্ত হননি। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি হয়নি আগ্রাসী লোভ ও পুঁজির দাস।
আর এই পুঁজির দাস একটি বিক্রীত-বিবেক সুশীল সমাজ তখন দেশে গড়ে ওঠেনি। যারা সমাজে সুশীল নামে পরিচিত ছিলেন তারা ছিলেন সত্যই সুশীল। তারা বিদেশের টাকায় বিদেশীদের স্বার্থে নিত্য সভা, সমাবেশ ও গোলটেবিল বৈঠক করে নিজের দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতেন না। তারা নিত্য থাকতেন জনতার মিছিলের অগ্রভাগে। তারা পাঁচতারা হোটেলের তথাকথিত মতবিনিময় সভায় বা টেলিভিশনের টকশোতে নিত্য নকল সংগ্রামী সাজতেন না। তারা প্রকৃতই থাকতেন সংগ্রামের মাঠে। তাই বাঙালির ভাষা সংগ্রাম সফল হয়েছে। বাংলা হরফ, রবীন্দ্র ও নজরুলসঙ্গীতের বিরুদ্ধে অবাঙালি শাসকদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটি গাড়ার চক্রান্ত প্রতিহত করা গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উচ্ছেদ ঘটানো গেছে। মধ্যযুগীয় মৌলবাদের অভ্যুত্থান রোখা গেছে। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম সফল করা গেছে। বাঙালির এই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন শ্রেষ্ঠ অগ্রপথিক ছিলেন মানিক মিয়াও। তাই আমরা বছর বছর তাকে স্মরণ করি।
তার প্রয়াণের চার দশকেরও বেশি সময় পর আজ আমরা নিজেদেরই নিজেরা প্রশ্ন করতে পারি, এই বাংলাদেশ কি পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের মানিক মিয়ারা চেয়েছিলেন? আজ যদি তিনি হঠাৎ আজিমপুরে সমাধিতে জেগে ওঠেন এবং সমাধি থেকে বেরিয়ে এসে গোটা বাংলাদেশ নয়, শুধু ঢাকা শহরটা একবার ঘুরে দেখতেন, তাহলে কী ভাবতেন, কী লিখতেন? দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের এত ব্যাপকতা, রাজনীতিতে এই পচন, সন্ত্রাসী মৌলবাদের ভয়াবহ প্রতাপ, শিল্প সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় এই অবক্ষয়, লোভের রাজত্বের প্রতিষ্ঠা, মিথ্যার বেসাতি তার মনে কি পরাধীন আমলের চেয়েও বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করত? তিনি আবার রাজনৈতিক মঞ্চ লেখার জন্য কলম ধরতেন?
আমি মনে মনে ভাবি, ভাগ্যিস মানিক ভাই আজ বেঁচে নেই! বেঁচে থাকলে আজকের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেও তাকে কলম ধরতে হতো। তিনি তার প্রিয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছিলেন। আমার মনে আছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি তিনি রোধ করবেন এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনবেন। এই প্রতিশ্র“তি সোহরাওয়ার্দী সরকার রক্ষা করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে ধান চালের দাম তেমন না বেড়ে শাকসবজি, কাঁচামরিচ, মাছ-মাংসের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। তখন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি নতুন থিওরি দিয়েছিলেন। থিওরিটি হল, তার সরকার দেশের এত উন্নয়ন ঘটাচ্ছে যে, কিছুটা মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে, তবে তাতে লাভ হচ্ছে উৎপাদনকারী কৃষকদেরও। কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, রসুনের দাম বাড়ার ফলে তারা এখন হাতে ভালো টাকা পাচ্ছে।
নিজের নেতার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মানিক মিয়া তার কলাম রাজনৈতিক মঞ্চে। তার মন্তব্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক নয়। কৃষক আগে যেখানে এক সের চাল বা দুই সের ধান বিক্রি করে মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো কিনতে পারত; এখন সেখানে দশ সের ধান ও পাঁচ সের চাল বিক্রি করেও তা কিনতে পারছে না। কারণ ধান-চালের দাম ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ার মধ্যে কোনো সমতা নেই। এই সমতা না আনতে পারলে কাঁচামরিচের দাম বাড়ার ফলে কৃষক লাভবান হওয়ার বদলে তার চালের গোলা শেষ হচ্ছে, তার দারিদ্র্য বাড়ছে সে কথাটা সরকারকে বুঝতে হবে। নইলে আমার উন্নয়নের তত্ত্ব দেশের মানুষকে শুনিয়ে লাভ নেই। আমি এখানে মানিক মিয়ার ভাষায় হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারছি না; কিন্তু নিজের স্মরণ থেকে তার মন্তব্য মোটামুটি তুলে ধরছি।
দুর্নীতি সম্পর্কে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের (প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয়) সমালোচনায় মানিক মিয়া ছিলেন সরব। তিনি লিখেছিলেন, (ভাষা আমার) মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ক্ষমতায় আসার আগে দুর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন ক্ষমতায় বসে তার সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হওয়া দূরের কথা, তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের ছোট-বড় অনেক নেতা এখন পশ্চিম পাকিস্তানে পান রফতানির লাইসেন্সবাজিতে রত। নেতাদের যুক্তি, এতকাল আওয়ামী লীগের কর্মীরা কিছুই পায়নি, এখন একটু পাক। এ পাওয়ার জন্য কি গোটা পান রফতানির ব্যবসাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করতে হবে? সরকার এখনই সতর্ক হোন। নইলে এই ছোট দুর্নীতির বীজ থেকেই দুর্নীতির বিরাট মহীরুহ গজিয়ে উঠবে। সেই মহীরুহ শুধু আওয়ামী লীগকে নয়, গোটা দেশকে ধ্বংস করবে। তখন আমাদের কারও কিছু করার থাকবে না।
মানিক মিয়ার এ সতর্কবাণী যে কত সঠিক ছিল, চার দশকেরও বেশি সময় পর আজ দেশের অবস্থা, আওয়ামী লীগও আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থা দেখে আমরা তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রাক্কালে বরিশালে মালেক নামে এক বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মীর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি তখনকার সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে এই বলে আওয়ামী লীগকে সতর্ক করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ যেন একজন সন্ত্রাসীকেও দলে আশ্রয় না দেয়। এমনকি নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা না থাকলেও সন্ত্রাসীদের যেন দলে প্রশ্রয় দেয়া না হয়। সন্ত্রাস একবার দেশের রাজনীতিতে ঠাঁই পেলে শুধু গণতন্ত্রই বিপন্ন হবে না; সন্ত্রাস সমাজব্যবস্থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে দেশের অস্তিত্বই বিপন্ন করে ফেলবে। সেই তখনই আওয়ামী লীগ দলে যেসব কর্মী ও নেতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে, তাদের নামের তালিকা তৈরি করে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছিলেন মানিক মিয়া। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে সন্ত্রাসীদের চরমভাবে মাথা তোলা দেখতে পেতেন, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানার পর তিনি রাজনৈতিক মঞ্চে কী লেখা লিখতেন তা মাঝে মাঝে আমি ভাবতে চেষ্টা করি।
মানিক মিয়া একবার তার রাজনৈতিক মঞ্চে হয়দিশ কথাটি পথের ঠিকানা অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। জামায়াতিরা তখন দেশে এতটা শক্তিশালী নয়। কিন্তু অসাধুভাবে ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করছে। তারা প্রচার চালালো, মানিক মিয়া হয়দিশ নয় হাদিস কথাটি তার লেখায় ব্যবহার করেছেন এবং পবিত্র হাদিসের অবমাননা করেছেন। তাকে ধর্মের অবমাননাকারী আখ্যা দিয়ে জামায়াতের তখনকার মুখপত্র জাহানে নওতে অবিলম্বে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করা হল। নইলে তার জীবননাশেরও প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়া হয়েছিল। মানিক মিয়া তাদের হুমকির জবাবে লিখেছিলেন, আমি একজন মুসলমান। ধর্ম আমার কাছে বিশ্বাস। ব্যবসা নয়। জামায়াত ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। তাদের হুমকিতে আমি ভীত নই। গণতন্ত্রে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের উচিত এ ধর্ম ব্যবসায়ীদের দেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করা। নইলে তারা ধর্মান্ধতার বিষ ছড়িয়ে দেশের অস্তিত্বই একদিন বিপন্ন করে তুলবে। পাঠকদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। মানিক মিয়ার লেখাগুলো আমার হাতের কাছে না থাকায় আমি তার লেখার হুবহু উদ্ধৃতি দিতে পারছি না। যা হোক সে যুগে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে মানিক মিয়া নতজানু হননি, ক্ষমা চাননি। বরং কড়া জবাব দিয়েছেন। আর এ যুগে মৌলবাদীদের সামান্য চোখ রাঙানিতেই প্রতিষ্ঠিত দৈনিকের সম্পাদক ছুটে গিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের কাছে তওবা পড়েন। এখানেই মানিক মিয়ার যুগের সাংবাদিকতার সাহসিকতার বৈশিষ্ট্য।
সন্দেহ নেই মানিক মিয়া আজ যদি বেঁচে থাকতেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা, আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান অবস্থা দেখে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হতেন। নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ড, ফেনীর বর্বরতা, দেশময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে তিনি কঠোর হতে কলম ধরতেন। আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই দেশের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ঘটিয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের সব ফসল যে খেয়ে ফেলছে দলের ভেতরে একশ্রেণীর মন্ত্রী, নেতা ও এমপিদের সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এবং দৃঢ় হাতে এই সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের এখনই দমন করা না গেলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যে হবে ভারতের কংগ্রেসের চেয়েও শোচনীয়ভাবে এ সত্যটা তিনি বিনা দ্বিধায় তুলে ধরতেন। তিনি টিভির টকশোতে যেতেন না; ট্রান্সপারেন্সি বা পলিসি ডায়ালগের সেমিনারে গিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গলাবাজিও করতেন না। তিনি তার রাজনৈতিক মঞ্চে সঠিক তথ্য ও বক্তব্য তুলে ধরতেন, যা হতো আওয়ামী লীগের জন্য কঠোর সতর্কবাণী এবং দেশবাসীর জন্য পথের নির্দেশ।
দেশবাসীকে উন্নয়নের ছবি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার খুশি করতে পারবেন না। সর্বাগ্রে তাদের জীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্বৃত্ত দমনে প্রশাসনকে শক্তি ও ক্ষমতা জোগাতে হবে। পুলিশ যেন দুর্বৃত্তকে গ্রেফতার করতে গিয়ে স্থানীয় এমপি অথবা মন্ত্রীর নির্দেশে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। দলের ভেতর থেকে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ বলে চিহ্নিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিনা দ্বিধায় বহিষ্কার করতে হবে। দেশে গণতন্ত্র স্থায়ী হবে কি করে যদি আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত না হয়! আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে, জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি না ফিরলে জাপান থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এনে দেশে উন্নয়নের বন্যা বহালেও আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থনের খুঁটি শক্ত করতে পারবে না। মানিক মিয়া আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আওয়ামী লীগকে শক্তভাবে একথাটা বোঝাতেন এবং দেশবাসীকেও নতুন সংগ্রামের পথের দিশা দিতেন।
লন্ডন ১ জুন ॥ রবিবার,
No comments