ক্ষমতার রাজনীতি ও তার পরিণতি by বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি সিপিডি আয়োজিত ‘রাজনৈতিক দল ও
বাংলাদেশের গণতন্ত্র’ শীর্ষক একটি সেমিনারে আমার অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়৷ এতে
স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান একই শিরোনামে একটি
প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন৷ প্রবন্ধের উপসংহার হলো: বাংলাদেশের রাজনৈতিক
দলগুলো ক্ষমতা দখলের জন্য পাগল৷ দলগুলোর অভ্যন্তরে কোনো গণতন্ত্র নেই৷
তারা ব্যক্তি ও পরিবারতন্ত্রে আকণ্ঠ নিমজ্জিত৷ তারা নীতি-আদর্শের ধার ধারে
না৷ তারা সন্ত্রাস ও পেশিশক্তি ব্যবহারে এবং দলীয়করণে সিদ্ধহস্ত৷
বাংলাদেশের রাজনীতির যেকোনো নিবিড় পর্যবেক্ষকই দ্বিমত করবেন না যে আমাদের রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার রাজনীতিতে বিভোর৷ তাঁরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে বদ্ধপরিকর৷ দলে গণতন্ত্রচর্চার মতো যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য, সেগুলো থেকে তাঁরা বহু দূরে৷ কিন্তু কেন? তার পরিণতিই বা কী? রাজনীতির যেসব গুরুতর সমস্যার কথা অধ্যাপক রওনক জাহান হাজির করেছেন, তার অধিকাংশই রোগের উপসর্গমাত্র৷ তবে রোগের চিকিৎসার জন্য রোগের কারণ চিহ্নিত করা জরুরি৷ আমাদের ধারণা, দুর্নীতিই আমাদের বিরাজমান ক্ষমতার রাজনীতির প্রধান কারণ৷ জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কল্যাণই ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ৷ তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় সর্বস্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মূলোৎপাটন করা আমাদের অন্যতম জাতীয় অগ্রাধিকার৷
ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাট করা যায় এবং সেই লুটপাটের ফসল প্রায় নির্বিঘ্নে ভোগ করা যায়৷ আনুগত্য ‘ক্রয়’ বা অব্যাহত রাখার জন্য ফায়দা হিসেবে তা ব্যবহারও করা যায়৷ এ কারণেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং ক্ষমতার আশপাশে থাকা ব্যক্তিরা, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই অঢেল অর্থবিত্তের মালিক৷ নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনদের উৎপত্তি এ প্রক্রিয়াতেই ঘটেছে৷ ফায়দা বিতরণের মাধ্যমে আনুগত্য ক্রয়ের কারণে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি হয়৷ এ কারণেই আমাদের দেশে আজ শিক্ষকেরা বিভক্ত, সাংবাদিকেরা বিভক্ত, আইনজীবীরা বিভক্ত, সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিভক্ত—এককথায়, পুরো সমাজ বিভক্ত৷ একাত্তরের ঐক্যবদ্ধ জাতি আজ পরস্পরের সঙ্গে প্রায় ‘যুদ্ধে লিপ্ত’ দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এই প্রক্রিয়াতেই৷ লুটপাট করার ও অন্যায় ফায়দা বিতরণের জন্য শাসক শ্রেণির কাউকে সাধারণত জেলে যেতে হয় না৷ অর্থ ও তদবিরের বিনিময়ে তাঁরা পার পেয়ে যান৷ কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধের মামলা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ প্রত্যাহার করা হয়৷ রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এসব দুর্বৃত্তের তেমন কোনো মাশুল গুনতে হয় না৷ তাই লুটপাটতন্ত্র কায়েম এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগই ক্ষমতায় যাওয়ার উম্মত্ত প্রতিযোগিতার প্রধান কারণ বলে আমাদের বিশ্বাস৷
৪৩ বছরের ইতিহাসে একমাত্র সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেই দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটতে হয়নি৷ তবে দুর্নীতির অভিযোগে জেল খাটলেও এরশাদ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নির্বাসিত হননি; বরং তিনি আমাদের রাজনীতিতে ‘কিং-মেকারে’ পরিণত হয়েছেন৷ আমাদের প্রধান দুটি দলই—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরশাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য এখনো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত৷ প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের প্রাক্কালে প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্য প্রধান দলগুলো এরশাদের দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের সমঝোতা না করার অঙ্গীকার করেছিল৷
দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কাঠামোতে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতা ‘দখল’ করলেই হয় না, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়৷ আর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়োজন পড়ে৷ সে কারণেই দল ও সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আমাদের দেশে দুই ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার বা একান্ত অনুগতদের হাতে কুক্ষিগত৷ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোয় ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের অনপুস্থিতি এ ব্যবস্থারই প্রতিফলন৷
ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমাদের দেশে বিভিন্ন সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়৷ এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোয় সময় সময় ‘প্রলয়’ ঘটে এবং এগুলো ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে৷ এর মাধ্যমে শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন হয়৷ এ প্রক্রিয়ায় আইনের শাসন পদদলিত হয়৷ এ ক্ষেত্রে অবশ্য অর্থের প্রভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এভাবে বর্তমানে আমাদের দেশে এক চরম বিচারহীনতার তথা অবিচারের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে৷ সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের খঁুটিস্বরূপ৷ আর খঁুটি দুর্বল হলে রাষ্ট্রের ভিত কেঁপে উঠতে বাধ্য৷
ক্ষমতার উৎস প্রধানত দুটি৷ একটি হলো বল প্রয়োগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, যা বৈধ ক্ষমতা৷ অন্যটি হলো সরকারবিরোধীদের রাজপথে সহিংসতা সৃষ্টির শক্তি৷ এ দুই ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে ভারসাম্য থাকলে অর্থাৎ তাদের ক্ষমতা ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ হলে, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সাধারণত রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টির পথ সুগম হয়৷ তারা কিছু কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ ধরে৷ ফলে ন্যূনতম, অর্থাৎ ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, যা বাস্তবে ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে৷
রাষ্ট্রীয় বৈধ ক্ষমতা অবৈধভাবে ব্যবহার করা গেলে দুই ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়৷ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণের মাধ্যমে এ ভারসাম্য নষ্ট ও ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ আর ভারসাম্য নষ্ট হলে সমঝোতা ভেঙে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পাঁয়তারা করেন, যা ঘটেছিল ২০০৬ সালে৷
রাষ্ট্রীয় বৈধ ক্ষমতা অবৈধভাবে ব্যবহার করা গেলে সে ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়, এমনকি নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টাও চালানো যায়৷ র্যাবকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার এর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷ ২০০৪ সালে র্যাব সৃষ্টি করা হয় মূলত ফায়দা প্রদান ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে৷ কিন্তু দলীয়করণের কারণে র্যাব ক্রমাগতভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে, যার নগ্নতম প্রতিফলন ঘটে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ে৷ অন্যায়ভাবে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের মাধ্যমে র্যাবের শৃঙ্খলা বহুলাংশে ভেঙে পড়ে এবং এ বাহিনীর কিছু সদস্যের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টি হয়৷ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এ প্রবণতারই প্রতিফলন বলে আমাদের ধারণা৷
রাজপথে সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মাস্তান পোষে, সরকারি দলের পক্ষে যা করা অপেক্ষাকৃত সহজ৷ অনেক দিন থেকেই আমাদের রাজনীতিতে তা চলে আসছে৷ ফায়দাতন্ত্রের সম্প্রসারণের ফলে মাস্তানের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ আর এ মাস্তানদের অনেকেই বর্তমানে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন এবং নির্বাচনী অঙ্গনে প্রবেশ করছেন৷ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলদারত্ব ইত্যাদি অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া এসব মাস্তানের অনেকেই এখন তাঁদের পুরোনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করছেন৷ এসব মাস্তানের কেউ কেউ টাকা ও পেশিশক্তি খাটিয়ে এখন মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা বা পৌরসভার চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ইত্যাদি পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন৷ ফলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে রাষ্ট্র আজ, প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায়, ক্রমাগতভাবে ‘বাজিকরদের’ হাতে চলে যাচ্ছে, যা এক ভয়াবহ অশনিসংকেত৷
রাজনৈতিক দলে ব্যক্তি ও পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসার ফলে এমনিতেই রাজনীতিতে মেধাবী ব্যক্তিদের প্রবেশের পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে৷ রাজনীতিতে ক্রমাগতভাবে মাস্তানতন্ত্রের বিস্তারের কারণে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা এ অঙ্গন থেকে ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হবেন৷ এর ফলে দেশে ক্রমবর্ধমানহারে অযোগ্য ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, যা জাতির জন্য কোনোভাবেই কল্যাণ বয়ে আনবে না৷ এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য ভবিষ্যতে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে৷ এ ছাড়া চাঁদা-টেন্ডার তথা ফায়দা প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে এবং সরকারি দলের অভ্যন্তরে খুনখারাবি আরও বাড়বে৷
আর দেশে অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এর মাশুল পুরো জাতিকেই দিতে হবে৷ কারণ, অপরাধীদের শাসন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে উগ্রবাদী শক্তির উত্থানের পথকে সুগম করবে৷ ধর্মাশ্রিত শক্তি এরই মধ্যে এই উপমহাদেশে তাদের কুৎসিত চেহারা প্রদর্শন করা শুরু করেছে৷ বিরাজমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে উগ্রবাদের বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলেই আমাদের আশঙ্কা৷
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)৷
No comments