সন্তানদের তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ
শিক্ষাব্যবস্থায় নানামুখী নৈরাজ্যের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা, এমনকি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএস পরীক্ষাও প্রশ্ন ফাঁসের আওতামুক্ত নয়৷ সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়। গত ২৩ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষার পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন ফাঁসের সুস্পষ্ট প্রমাণ সারা দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমসমূহে পাওয়া গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পরের দিন শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ তুললে তা প্রমাণ করা কঠিন। তার পরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’ তাঁর সামগ্রিক বক্তব্য এখন পর্যন্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এই তদন্ত কমিটি জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলার সময় সাজেশন আকারে, মুঠোফোনে খুদে বার্তা, হাতে লেখা ও টাইপ করা কোনো কাগজ বা তথ্য কারও কাছে পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ ব্যবস্থা তো সেই প্রবাদের মতো, ‘চোর তুই চুরি কর আর গৃহস্থ ঘর সামলা’। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দেখা যায় যে সঠিক তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, সরকারিভাবে প্রায়ই স্বীকার করাও হয় না যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য, একটি জাতির জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? পরীক্ষার আগের সন্ধ্যায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে যখন পরীক্ষা স্থগিত করা হয়, তখন পরীক্ষার্থী কিংবা তাদের অভিভাবকদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। আর যেসব ছাত্রছাত্রী বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে তাদের মনে যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে তারা সব দিক থেকে যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার দায়ভার কে নেবে? কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীর এমন মানসিক পীড়ন ও হয়রানির দায়ভার রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। একটি খুনের শাস্তি যদি ফাঁসি হয়, তাহলে যারা লাখ লাখ কোমলমতি ছাত্রছাত্রীর মেধা খুন করছে, তাদের কী শাস্তি হওয়া উচিত? আর রাষ্ট্র যাদের ওপর শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের ব্যর্থতার জন্যই বা তাদের কী শাস্তি হওয়া উচিত? এভাবে একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হতে পারে না। কোনো প্রতিকারই যদি না হয়, তাহলে প্রতিটি ঘটনায় একটি লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করে লাভ কী? সৃজনশীল পদ্ধতি কিংবা প্রতিবছর জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বৃদ্ধি করে শিক্ষার মান বাড়ানো যায় না। পাসের হার আর শিক্ষার মান এক জিনিস নয়। সব পরীক্ষার আগে এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে প্রকৃত মেধাবীরা হারিয়ে যাবে, দেশ হবে মেধাশূন্য।
কিছু অসৎ লোকের কর্মকাণ্ডে কোনো সমাজ ধ্বংস হয় না, ধ্বংস হয় বিবেকবান আর ভালো মানুষের নিষ্ক্রিয়তায়। তাই সমাজের বিবেকবান মানুষসহ জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে না দঁাড়ালে জাতীয় জীবনে অচিরেই মহাবিপর্যয় নেমে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই। সরকারকেই এ বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে, কারা এভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পঁায়তারা করছে। সরকার প্রায়ই বলে থাকে, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনার কারণে আকাশছেঁায়া সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশের সব পাবলিক পরীক্ষায় তথাকথিত ‘সাজেশনের’ নামে প্রশ্ন ফাঁসসহ যে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা চলছে, তাতে সাধারণ মানুষ কি সরকারের এ দািব মেনে নেবে? প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, ‘জনগণের ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না।’ কিন্তু সাম্প্রতিক সময় গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মহল বা ব্যক্তি দেশের পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রী তথা পুরো জাতির সঙ্গে কানামাছি ভেঁা ভেঁা খেলছে। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী এদিকে নজর দেবেন, এটিকে জাতীয় দুর্যোগ বিবেচনা করে প্রশ্ন ফাঁসের মহোৎসব বন্ধে তিনি বাস্তবমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবেন। প্রকাশিত সত্যের খুব বেিশ তদন্ত দরকার পড়ে না। অবিলম্বে তদন্তকাজ শেষ করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে আমাদের সন্তানদের বঁাচান। হারুনর রশীদ খান: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়৷
No comments