এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড এবং সরকারের গোস্সা
কয়েক দিন হলো, ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’ (টিআইবি) জাতীয় সংসদ সম্পর্কে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। ‘সুজন’ নামে আরেকটি সংগঠন সদ্য ‘মনোনীত’ নারী সাংসদদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আরেকটি পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে। মৌচাকে ঢিল পড়লে যে অবস্থা হয়, সরকারি দলের কর্তাব্যক্তিদের কারও কারও উষ্মা প্রকাশ দেখে সে রকমটাই মনে হচ্ছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মনে হয় টিআইবির প্রতিবেদনটি লুফে নিয়েছেন। বলেছেন, ‘এটা ঠিক।’ টিআই যখন তাঁর সরকারের আমলে বাংলাদেশকে চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে, তখন অবশ্য এই সংগঠনটির ওপর তিনি খুবই নাখোশ ছিলেন। আর আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে টিআই ও টিআইবি তখন খুবই আদৃত ছিল। এখন প্রেক্ষিত বদলে গেছে। জনৈক মন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, এসব এনজিও বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, তাদের টাকার উৎস খুঁজে বের করতে হবে, দেখতে হবে, বিদেশ থেকে টাকা এনে তারা জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে কি না, ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। টিআইবি কিংবা সুজন যদি সমালোচিত হয়, জবাব কিংবা কৈফিয়ত দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। আমরা শুধু কয়েকটা কথা আমজনতার জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই। কেননা, তারা এ ধরনের কথা-চালাচালিতে বিভ্রান্ত হতে পারে। যতদূর জানি, বাংলাদেশে এনজিওগুলো কারও কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে কাজ করলে তার জন্য নিবন্ধনের দরকার হয়। একাধিক সরকারি দপ্তর এই নিবন্ধন দিয়ে থাকে।
আর বিদেশ থেকে কোনো অনুদান নিতে হলে তার জন্য ‘এনজিওবিষয়ক ব্যুরো’র নিবন্ধন দরকার হয় এবং প্রতিটি ‘প্রকল্পের’ জন্য আলাদা আলাদা ছাড়পত্র নিতে হয়। এই ছাড়পত্র ছাড়া ব্যাংক কোনো এনজিওকে তহবিল সরবরাহ করবে না। এনজিও ব্যুরো একটি সরকারি দপ্তর এবং এটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া এ দেশে কোনো এনজিও বিদেশ থেকে কিংবা এ দেশে কর্মরত কোনো বিদেশি সংস্থা থেকে অনুদান, এমনকি একটি ফটোকপি মেশিন কিংবা বাইসাইকেলও নিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, বিদেশি অনুদানসংক্রান্ত তথ্য কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। সরকারি দপ্তরগুলোয় ‘একান্ত গোপনীয়’ ছাপ মারা অনেক ফাইল কিংবা চিঠিপত্র চালাচালি হয়। মন্ত্রী সাহেবরাও এগুলো করে থাকেন এবং তা জনগণের কাছে অজানাই থেকে যায়। কিন্তু এনজিও ব্যুরোর তথ্য কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। এই সংস্থার ওয়েবসাইটে গেলেই বিদেশি অনুদানের পরিমাণ সম্পর্কে প্রতিটি এনজিওর বছরওয়ারি হিসাব পাওয়া যায়, এবং যে কেউ এই ওয়েবসাইটে লগ-ইন করে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। এ ছাড়া এনজিওগুলোকে প্রতিবছর তাদের প্রাপ্তি ও খরচের অডিট করতে হয় এবং এই অডিট প্রতিবেদন এনজিও ব্যুরোতে জমা দিতে হয়। যে কেউ চাইলেই তা সংগ্রহ করতে পারেন। বিদেশ থেকে কোন এনজিও কত টাকা পেয়েছে এবং তা কী কী খাতে খরচ হয়েছে, তা গোপন করার সুযোগ নেই। সুতরাং, যারা এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা একটু হোমওয়ার্ক করে নিলেই এসব আবোলতাবোল বলতেন না। বিদেশের কোনো অখ্যাত এনজিও কিংবা দেয়াল পত্রিকায় সরকারের কোনো কাজের প্রশংসা থাকলে তারা তা ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রচার করে।
অথচ তথ্যনির্ভর কোনো পর্যালোচনায় তাদের ঘোর আপত্তি। এ দেশে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে বিদেশি টাকায় সাম্রাজ্যবাদী গন্ধ প্রবল এবং বিদেশি অনুদানপুষ্ট এনজিওগুলোর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদীরা বানের জলের মতো দেশে ঢুকে পড়ছে। এটা সবার জানা থাকা দরকার, বিদেশিরা আমাদের যত টাকা দেয়, তার বেশির ভাগই আসে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য। তাহলে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল। সরকার বিদেশ থেকে টাকা নিলে তা পূতপবিত্র আর এনজিওগুলো নিলে তারা হয়ে যায় ষড়যন্ত্রকারী! সরকার তো আইন করেই এনজিওগুলোকে বিদেশ থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। করছে না কেন? আমাদের জানামতে, এ দেশে কিছু কিছু নাগরিক সংগঠন আছে, যারা বিদেশ থেকে কোনো অনুদান নেয় না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তেল-গ্যাস ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’। অথচ তাদের বিরুদ্ধে সরকারের অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেন। একবার তো পুলিশ দিয়ে তাদের সদস্য ও সমর্থকদের নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিল। কয়েকজনকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। আসলে বিষয়টা বিদেশ থেকে টাকাপয়সা আনা-সংক্রান্ত নয়, ক্ষমতাসীনেরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। তাঁদের ভয়ানক গোস্সা হয়। বিদেশি টাকার দিকে তাঁদের অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি। কয়েক বছর আগে সরকার দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর আর্থিক অনুদানে একটা তহবিল পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে সক্ষমতা তৈরির কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নিলে মন্ত্রী-সাংসদ ও সরকারি দলের অনেকেই ওই তহবিলে ভাগ বসানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ দিয়েছিলেন। ফলে রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক এনজিও গজিয়ে উঠেছিল। টিআইবি কিংবা সুজন ভালো কাজ করছে না মন্দ কাজ করছে, সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তবে তাদেরও জবাবদিহির আওতায় থাকা দরকার। তারা সংসদে কোটিপতি খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু তাদের পরিচালনা পর্ষদগুলোয় যাঁরা আছেন, তাঁরা কি সবাই বিত্তহীন? আর কোটিপতি হওয়া কি দোষের? ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’ এই স্লোগান নিয়ে তো এখন সমাজ চলবে না। যাঁর ঢাকায় এক কাঠা জমি আছে, কিংবা একটি অ্যাপার্টমেন্ট, সে-ই তো কোটিপতি। তাঁরা সবাই কি মন্দ লোক? সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ‘নির্বাচিত’দের মধ্যে ২৪ শতাংশ ‘কোটিপতি’, এটা কোনো তথ্য নয়। তথ্য হতে পারে, তাঁরা কীভাবে কোটিপতি হলেন। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া প্রার্থীদের তথ্য নাড়াচাড়া করে এ ধরনের পর্যালোচনা বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। উচিত হবে, আরও গভীরে যাওয়া। তবে নিজের ঘর থেকেই সেটা শুরু করা যায় না?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments